হিমির_বিয়ে(৬ষ্ট পর্ব)

0
1189

হিমির_বিয়ে(৬ষ্ট পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বললো..

-কিডনি ট্রান্সফার কমপ্লিট। তবে যিনি কিডনি ডোনেট করেছেন তার শরীরটা অনেক দুর্বল। তার দিকে কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে।

– স্যার আমি কি এই মূহুর্তে আমার মায়ের কাছে যেতে পারব?

– না কারো কাছেই যেতে পারবেন না। আমাদের ডাক্তাররাই পেশেন্ট দুজনের দেখভাল করছে।

– জি ঠিক আছে।

– ও হ্যাঁ। কিছু মেডিসিন আনতে হবে।

– আচ্ছা আমায় প্রেসক্রিপশনটা দিবেন।

– আপনি চাইলে গ্লাসের বাইরে থেকে তাদের দেখতে পারেন। তাও সব সময়ের জন্য পারবেন না।

– আচ্ছা আমি একটা পলক দেখতে চাই।

গ্লাসের বাহির থেকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি। আমার মা ঘুমিয়ে আছে। অপজিটে তাকিয়ে আমার চোখ বড় হয়ে গেলো। হিমি শুয়ে আছে আমার মায়ের পাশে। তাহলে আমার মাকে হিমিই কিডনি দিয়েছে। কিন্তু কেনো? হিমি আমার মাকে কিডনি দিতে যাবে কেনো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু যেনো গোলমাল পাকিয়ে ফেলছি।

উফফ আর পারছি না। কি হচ্ছে এসব?

অফিস থেকে ফোন এসেছে। কি যেনো জরুরি দরকারে আমার অফিসে যেতে হবে। কিছুদিন আগেইতো আমার জবটা ছেড়ে দিয়ে আসলাম। তাহলে হঠাৎ করে আমায় অফিসে যেতে বলছে কেনো?

এই পরিস্থিতিতে মাকে এবং হিমিকে এখানে ফেলে যাবো কি করে? বাবা একা তো সামলিয়ে উঠতে পারবে না। আর তাছাড়া কখন কি লাগে বাবা তো সব পারবে না। বাবা এমনিতেই সিক হয়ে গেছেন। বাবার ঠিক মত খাওয়া দাওয়া নেই। তার মাঝে যে কি কাজ করছে তা নিজেই জানেন। কারো সাথে ঠিক মত কথাও বলছে না।

দুইদিন পরে তাদের কাছে আমাদের যেতে দিলো। কিন্তু কারো সাথেই তেমন কথা বলতে দিচ্ছেনা ডাক্তার। শুধু চোখ দিয়েই তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে। মা কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন এখানে এভাবে দেখে। তার কি হয়েছে সে নিজেও জানে না। কিছুক্ষন পরে ডাক্তার আমাদের এখান থেকে বের করে দিলেন। মা আর হিমির পাশে শুধু কথাকেই রেখে আসলাম। আমি আর বাবা বাহিরে চলে আসলাম। এই কদিন ধরে বাবা ঠিক মত খাচ্ছে না। তাকে সাথে করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলাম। কিন্তু তাকে কোনো কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। বাবা কেমন যেনো মেন্টালি প্রেশারের মধ্যে আছে। তার চলা ফেরাও ঠিক মত নেই।

মা এবং হিমির কিছুটা উন্নতি দেখে আমি আমার অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অনেক দূরের পথ। যেতে আসতে একদিন কেটে যাবে। কিন্তু কি এমন জরুরী কাজ আছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না।

অফিসের দিকে যাচ্ছি। আর চেনা শহরটাকে দেখছি। যে শহরে ছিলো আমার ভালোবাসা। যাকে জুড়েই ছিলো যেনো এই ইট-পাথরের রঙ্গিন শহরটা। এখন আর এই শহর টা ভালো লাগে না। স্মৃতি গুলো ভেসে উঠলেই চোখ ফেটে কান্না চলে আসে। নিজের কাছে নিজেকেই মৃত মনে হয়।

“যেখানে ছিলো তোমার আনাগোনা আর স্পর্শের ছোঁয়া,
সেখানে আজ কুঁকড়ে যাওয়া পুড়ছে হৃদয় উড়ছে কালো ধোয়া!
এই শহরে বিষের তিক্ত, নীল বর্ণের আলো,
একাকীত্বের দলে যে কেউ,কে বা খবর নিলো!

আমি কবিতায় এক্সাপার্ট নই,তবুও তানহা আমার ভুলভাল বলা কবিতা শুনতো প্রায়ই। আমার এই অগোছালো কবিতা যেনো তানহাকে খুব সহজেই ছুঁয়ে দিতে পারতো। ও যখন আমার বলা কবিতা শুনে খিলখিল করে হাসে তখন যেনো আমার মাঝে আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করে। রিক্সায় বসে তানহার মাথাটা আমার কাঁধে গুজে দিয়ে বাহানা ধরতো অগোছালো শব্দের কবিতা শুনার জন্য। আমি কবিতা শুনাতাম আর তানহা এবং রিক্সা ওয়ালা দুজনেই হাসতো। লজ্জা লাগলেও কিছু করার ছিলো না, কবিতা নামের রচনা শুনাইতাম। যখন কবিতা শেষ তখন রিক্সা থেকে নেমে আমরা তিনজনে মিলে চা কিংবা কফি খেতাম। কাঠফাটা রোদ্দুরে বসে চা খাইতাম। তানহার ফুটপাতের চা অথবা কফি পছন্দ। ব্রান্ডের যে চায়ের দোকান আছে সেগুলার চেয়ে আসলেই ফুটপাতে ভালো চায়ের কারিগর।

একদিন আমি তানহাকে জিজ্ঞেস করি….

– আচ্ছা তানহা আমরা যে প্রতিটা দিন ঠাডা পড়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে চা খাই, এটা কি ভালো লাগে? তোমার কষ্ট হয় না? আমার তো মাথা ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা।

– আচ্ছা একটা কথা বলি তোমায়। আমরা যে তিনজনে, তিনজন বলতে তুমি আমি আর এইযে ড্রাইভার মামা একসাথে চা খাই। এই যে একটা আনন্দ এই আনন্দ কি কোনো রেস্টুরেন্টে পাবো? ওয়েটারকে হাজার টাকা বকসিস দেওয়ার চেয়েও এই মামাদের সাথে বসে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা চা খাওয়ানোর মধ্যে আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করে। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো আমাদের সাথে বসে তারা চা বা অন্যান্য কিছু খেলে তাদের কতটা ভালো লাগে?

সেদিনের পরে আমি আর তানহানে কিছুই বলিনি বরং আমারও ভালোলাগা কাজ করেছে। তানহা চা খেয়ে সাথে সাথে একটা আইসক্রিম খাবে,এটা ওর বদ অভ্যাস। প্রায় সময় এই কাজটা করে থাকে। কি আর করার সে তো কথাই শুনে না।

ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম লেগে আসছে। এরই মধ্যে বাসের হেল্পার কিছুটা ধাক্কা দিয়ে বললো,”ভাইজান এখন একটু উঠেন,সেই কখন থেকে ডাকতেছি,আপনি এই স্টেশনে নেমে যাবেন।”

হকচকিয়ে উঠে গেলাম। আসলেই আমি আমার অফিসের সামনে চলে এসেছি।

আজ জুম্মার নামাজের দিন। আজান দিয়ে ফেলছে, ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজের জন্য মসজিদের চলে গেলাম। পরক্ষনেই মনে হলো,আজ তো শুক্রবার। আজ কেনো আসলাম? আজ তো অফিস বন্ধ। তার মানে একটা দিন এখানে থাকতে হবে। যাহ কিছুই মাথায় থাকে না।

নামাজ শেষে আমার অফিসের এক কলিগকে ফোন দিলাম। ফোন দিয়ে জানতে পারলাম ও বাসায় আছে। আমি ওর বাসায় চলে গেলাম।

সন্ধ্যার পরে আমার সেই কলিগকে নিয়ে তানহাদের বাসার সামনে গেলাম। দারোয়ানের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। ফিরে আসেনি তানহা বা তানহার মা। আজ দশদিন যাবত তানহার বাবাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। বাসা লক করে যে কোথায় গেছে তা কেউই জানে না।

কি হচ্ছে এসব? কিছুদিন আগে তানহা এবং ওর মা বাসা থেকে চলে গেছে। আজ এসে শুনি তানহার বাবাও নাকি বাসায় নেই। তাহলে কি এটা কোনো শত্রুতা ভাবে ওদের এমন কাজ করছে? নাকি নিজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে? কিছু বুঝতে পারছিনা। এই বাসার একটা না একটা মানুষের তো জানার কথা। কাউকে না কাউকে তো কিছু একটা বলে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে তাদের গায়েব হওয়ার তো কোনো মাঝে বুঝলাম না। সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে কেন এমন করতেছে এরা? তানহা এবং তানহার মা তারপরে আবার তানহার বাবাও গায়েব হয়ে গেল।

ওদের কাছের যত আত্মীয়-স্বজন ছিল সবার কাছে খোঁজ নিয়েছিলাম কিন্তু কেউ কোনো হদিস দিতে পারল না। জানি কারো সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। এরা আসলে কোথায় গেল? তানহার কাছে তো আমি ছিলাম একটা মানুষ যে মানুষটার কাছে সব কিছুই শেয়ার করতো। আমার কাছেও তানহা কোনো কিছু শেয়ার না করে এভাবে হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেল। আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। একটা মানে তো আছেই। কোন কারন ছাড়া তো এভাবে হুট হাট চলে যেতে পারে না।

আমার মাথায় যেন কোন সূত্র মিলছে না।
কোনো চক্রান্তের ফাঁদে পরেনি তো?

পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পর বসের রুমে গেলাম বস আমাকে বললেন…

– রায়ান কি অবস্থা কেমন আছো?

– এইতো স্যার আছি। হঠাৎ করে অফিসে ডাকলেন যে?

– আমাদের অফিসে ব্যাক করবা কবে? আমরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

_ স্যার আমিতো জবটা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলাম। যেখানে আমি বিপদে পরে পাঁচটা দিনের জন্য ছুটি পেলাম না, সেই অফিসে আমি কেন জব করবো? আর তাছাড়া আমার মা অসুস্থ এখনো মেডিকেলে ভর্তি আছে সুতরাং এখানে জয়েন করা হবে না।

– কেনো কি হয়েছে তোমার মায়ের?

– দুইটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিলো, চারদিন আগে অপারেশন করানো হয়েছে, এখন একটু সুস্থ্য।

– যাক আলহামদুলিল্লাহ। সামান্য একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে তাই চলে গিয়েছো। তারপরও তোমার জায়গাটা এখনো আমরা ফাঁকা রেখেছি। নতুন করে কোনো নিয়োগ দেইনি। আমি তোমার অফিসের বস হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি, তুমি আবার আমাদের অফিসে জয়েন করবে। কারণ তোমার মত দক্ষ কর্মী আমরা হারাতে চাই না। তোমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারব না। আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি ব্যাক করবে।

– এটাই বলার জন্য এতদূর থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন?

– না! তোমার বড় একটা পার্সেল আসছে। তোমাকে খুঁজে না পেয়ে আমাদের এই অফিসে রেখে গিয়েছে। সে কারনেই এখানে নিয়ে আসা। আর হ্যাঁ একটাবারই তো। ভুল হতেই পারে। আমার কথাটা রেখে এখানে চলে এসো,খুশি হব।

একটা পার্সেল কিছুটা ভারী।পার্সেলটা নিয়ে আমি অফিস থেকে বের হয়েছি। মেডিকেলে যেতে হবে মায়ের কাছে। কথা বারবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে কখন ফিরবো। পার্সেলটি নিয়ে আমি রওনা হয়েছি। এটা কিসের পার্সেল? অনেকদিন হলো অনলাইনে অর্ডার করি না। তাহলে পার্সেলটা কে পাঠালো?

তানহা?
না তানহা তো হতেই পারে না। তানহার তো কোনো খোঁজই নাই। এই অফিসে যদি তানহা আসে তাহলে তো আর কলিগরা আমাকে জানাবে?

হুট করেই ফোনে ম্যাসেজ আসলো..

” পার্সেলটা আজ হাতে পেলে। এটাও জানি পার্সেল এখনো খুলে দেখো নি। যখন খুলে দেখবে অনুভুতি কেমন হবে?”

[চলবে……]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here