বিবর্ণ জলধর,পর্ব: ০১

0
2282

বিবর্ণ জলধর,পর্ব: ০১
লেখা: ইফরাত মিলি

“ছি ছি ছি! তোমার ছেলে এমন একটা কাণ্ড করবে আমি তা কল্পনাও করতে পারিনি লায়লা। বিয়ে খেতে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছে তোমার ছেলে! মান সম্মান সব ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিলো আমার। কী করে…কী করে পারলো বিয়ের মজলিসে অতগুলো লোকের সামনে ওই খারাপ, লোভী মেয়েটাকে ভালোবাসে বলতে? আহ! আমার মান সম্মান সব শেষ…সব শেষ লায়লা!”

লায়লা খানম স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টার্থে বললেন,
“আপনি একটু শান্ত হন। মাথা ঠান্ডা রাখুন। এরকম মাথা গরম করবেন না।”

“ঠান্ডা মাথা? তোমার ছেলে কি মাথা ঠান্ডা রাখার মতো অবস্থা রেখেছে? তিন তিনটা অন্যায় করে বসে আছে তোমার ছেলে। একে তো বিয়ে খেতে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, ওই মেয়েটাকে ভালোবাসে বলেছে! তৃতীয়ত, আমার মান সম্মান নষ্ট করেছে। আচ্ছা, তোমার ছেলে কি জানে না মেয়েটার চরিত্র সম্পর্কে? যে মেয়ে অন্য ছেলেদের সাথে রাতও কাটিয়েছে বলে শোনা যায়, সেই মেয়েকে কোন মুখে ভালোবাসে বলতে পারে? তাও বলেছে এমন সময়…সময়টা দেখো। আজ মেয়েটার বিয়ে। বর পক্ষ সব উপস্থিত। সেই বিয়ের আসরে ও হঠাৎ করে বলে উঠলো, ও রুমকিকে ভালোবাসে! ছি! ভাবতে পারো? বর পক্ষ বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গেছে তোমার ছেলের কীর্তি কলাপে! নাহ, এই মুখ লোক সমাজে দেখানোর পরিস্থিতি রাখলো না তোমার ছেলে!”

কবির সাহেব এবং লায়লা খানমের থেকে কিছুটা দূরত্বে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কবির সাহেবের মেয়ে জুন, দূর সম্পর্কের ভাগ্নে কারিব এবং বাড়ির কাজের বুয়া রুপালি।
হঠাৎ করে রুপালি বললো,
“শুধু কি ভালোবাসে সেটাই কইছে স্যার? রুমকির সাথে যে তার তিন বছরের প্রেম, সেটাও তো কইছে। আমি তো ভেবেই কূল পাচ্ছি না শ্রাবণ এত ডাহা মিথ্যা কথাটা কীভাবে বললো! ওই খবিশ ছেমড়ির সাথে কহন, কীরকম প্রেম ছিল তার?”

কবির সাহেব রুপালির কথার খেই ধরে বললেন,
“সেটাই তো, ও এই ডাহা মিথ্যা কথাটা কেন বললো? ওর কি রুমকির সাথে প্রেম ছিল? তিন বছরের প্রেম ছিল ওদের?”

কারিব বললো,
“প্রেম তো দূরের থাক মামা, আমি তো শ্রাবণ ভাইকে বেশি কথাই বলতে দেখিনি ওই মেয়ের সাথে। টুকটাক এক দুইদিন কথা বলতে দেখেছি। যদি প্রেমই থাকতো, তাহলে ওই মেয়ের সাথে ঘোরাঘুরি করতো না? কথা বলতো না ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? কিন্তু এরকম কোনো হিস্ট্রিই তো আমার জানা নেই। রুমকির সাথে শ্রাবণ ভাইয়ের কোনো প্রেম থাকতে পারে না। প্রেম থাকলে রুমকি কি একবারের জন্যও স্বীকার করতো না? রুমকি তো একবারের জন্যও বললো না শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে তার প্রেম ছিল। রুমকি তো অস্বীকার করে গেল সবটা।”

“আমি জানি না, আমি জানি না কারিব। আমার ছেলে কোত্থেকে কী করছে কিছু বুঝতে পারছি না আমি। ওর মাথায় কোনো গন্ডগোল দেখা দিয়েছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে আমার। তাও তো ভালো যে ঘটনাটা সব টাকার উপর দিয়ে গেছে। যদি ওই খারাপ মেয়েটাকে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চাইতো, তখন কী করতাম? মান সম্মান যাও টিকে আছে তাও তো থাকতো না। ওই মেয়েকে কি আর আমার বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে মানায়? ওই মেয়ে কি পোষ মানতো আমাদের বাড়িতে? ওই মেয়ে কি পোষ মানার মতো? একটাবার ভেবে দেখো, কত বড়ো সর্বনাশ ডেকে এনেছিল শ্রাবণ! ভাগ্য ভালো হামিদ নিজের মেয়েকে শ্রাবণের গলায় ঝুলিয়ে দিতে না চেয়ে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা চেয়েছে। ঝামেলাটা দ্রুত মিটে গেছে। নয়তো এই ঝামেলা যে কোত্থেকে কোথায় গিয়ে গড়াতো, সে আর আমি ভাবতে পারছি না। আর টাকার পরিমাণটাও কি কম? তিন লাখ টাকা পুরো জলে গেছে আমার।”

জুন চুপচাপ সব কথা শুনছিল। যদিও তার মনোযোগ এখনও আটকে আছে বিয়ের মজলিসে। বাবা কতগুলো লোকের সামনে তার ভাইয়ের গালে থাপ্পড় মারলো! দৃশ্যটা বার বার চোখের পর্দায় ফুঁটে উঠছে। চৌদ্দ বছর বয়সি জুনের ধারণা, বাবা যা করেছে তা ঠিক করেনি। জুন সেই নিয়ে মুখ খুললো,
“যত যা-ই বলো না কেন আব্বু, তোমার মোটেই উচিত হয়নি অতগুলো মানুষের সামনে ভাইয়ার গালে ওভাবে থাপ্পড় মারা।”

কবির সাহেব মেয়ের কথায় হুংকার দিয়ে উঠলেন,
“তুই চুপ কর! ও যা করেছে তাতে কি শুধু থাপ্পড়? ওকে তো উচিত এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া। লাট সাহেব কোথায় এখন? এত বড়ো কাণ্ড ঘটিয়ে কোথায় পড়ে আছে সে?”

কারিব জবাব দিলো,
“সম্ভবত ছাদে থাকবেন।”

________________

ছাদের মুক্ত বাতাসের মাঝে শ্রাবণ সিগারেট টেনে যাচ্ছে আনমনে। সিগারেট খাওয়া তার অভ্যাস নয়। ঊনত্রিশ বছরের জীবনে বলতে গেলে সর্বোচ্চ পাঁচ কি ছয় বার সিগারেট ছুঁয়েছে সে। শেষ সিগারেট ধরেছিল ষোলো বছর বয়সে। যখন ক্লাস টেনে পড়তো। বাবা সে বার সিগারেট খেতে দেখে নিয়েছিল। সেই নিয়ে কী রাগারাগি! এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিল বাবা। ষোলো বছর বয়সে সেই যে সিগারেট খাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এতগুলো বছরে আর একবারও সিগারেট ছুঁয়ে দেখেনি। আজ হঠাৎ করে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলো আবার। রুমকির বিয়ের আসর থেকে বাসায় ফেরার পথে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছে তাই।

রুমকি! তার প্রথম প্রেম! প্রথম ভালোবাসা! রুমকিকে প্রথম দেখেছিল এখন থেকে প্রায় দশ বছর আগে। রুমকিরা যশোর জেলা ছেড়ে সবে ঢাকা এসেছিল। একদিন রুমকি এলাকার রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছিল, তখনই প্রথম দেখেছিল রুমকিকে। রুমকির বয়স তখন পনেরো ছিল। আর তার আঠারো। প্রথম দেখাতেই যে রুমকিকে ভালো লেগেছিল, সেটা টের পেয়েছিল সে। মূলত রুমকির সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছিল তাকে। আজব ভাবে তিন দিন পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে আবার দেখা হয়েছিল রুমকির সাথে। শুধু দেখাই হয়েছিল, কথা আদান-প্রদান হয়নি কোনো। রুমকি নতুন ভর্তি হয়েছিল। নবম শ্রেণিতে। প্রায়শই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা এলাকার ভিতরে দেখা হয়ে যেত রুমকির সাথে। তবে কখনও কথা বলা হয়ে ওঠেনি দুজনের। কথা হয়েছিল অনেক দেরিতে। তখন রুমকি ক্লাস টেনে পড়ে। রুমকির সাথে প্রথম কথা বলার দৃশ্যপটটি মনে ভেসে উঠছে শ্রাবণের।
দিনটি ছিল বৈশাখের কোনো এক শুক্রবার। শ্রাবণ যাচ্ছিল তার বন্ধু হাসিবের বাসার উদ্দেশ্যে। রুমকিদের বাড়ির সামনে দিয়েই আসা যাওয়া করতে হয় সব সময়। রুমকিদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসা যাওয়ার সময় একবার হলেও রুমকিদের বাড়ির দিকে তাকাতো সে। সেদিনও তাকিয়ে ছিল। দূরে থাকতেই দেখতে পেয়েছিল বাড়ির সামনে কালো স্কার্ট, টি-শার্ট পরিহিত রুমকি দাঁড়িয়ে আছে। রুমকিকে দেখা মাত্রই চোখ সরিয়ে নিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে শ্রাবণ। রুমকিদের বাড়ি অতিক্রম করে আসার সময় দূর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি একটা মেয়ে কণ্ঠ চলন থামিয়ে দেয় তার।

“এই যে শুনুন…”

শ্রাবণ দাঁড়িয়ে পড়ে। ডাক অনুসরণ করে তাকায় বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রুমকির দিকে। রুমকি শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বললো,
“এদিকে আসেন।”

শ্রাবণ একটু বিচলিত হলো, কিন্তু ভদ্র ছেলের মতো রুমকির কথা অনুযায়ী এগিয়ে গেল ওর দিকে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রুমকি বললো,
“আপনি সাইকেল চালাতে পারেন?”

রুমকির কথায় শ্রাবণ লজ্জায় পড়লো। হয়তো তার মতো সব ছেলেরাই সাইকেল চালাতে পারদর্শী। কিন্তু সে সাইকেল চালাতে পারে না। বাবা কোনোদিন সাইকেল কিনে দেয়নি। আসলে নিজেরই কোনোদিন সাইকেলের শখ ছিল না। বন্ধুদের সাইকেলও ধরেনি কখনও। শ্রাবণ সলজ্জ বলে ফেললো,
“জি না, আমি সাইকেল চালাতে পারি না।”

“পারেন না?” রুমকির চেহারায় বিদ্রূপ ভাব ফুঁটে উঠলো।

যা দেখে শ্রাবণের আরও লজ্জা লাগলো। সে কিছু না বলে নীরব রইল।
রুমকি বললো,
“আপনি যেহেতু সাইকেল চালাতে পারেন না, সেহেতু আমার সাইকেলে চড়বেন আপনি?”

রুমকির এই কথায় শ্রাবণ সেদিন ভীষণ রকম ভড়কে গিয়েছিল। কতটা ভড়কে গিয়েছিল সেটা এখনও টের পায়। চেহারাটা তখন তার দেখার মতো ছিল। কিছুক্ষণ বোকার মতোই তাকিয়ে ছিল সেদিন রুমকির দিকে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলেছিল,
“না, আমি চড়বো না আপনার সাইকেলে।”

“চড়বেন না?” রুমকি স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো।

শ্রাবণ না বোধক মাথা নাড়লো।

“ঠিক আছে, না চড়লে যান।”

শ্রাবণ আর কথা বাড়ায় না। যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। রুমকি আবার ডাকে,
“শুনুন।”

শ্রাবণ দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে তাকালে রুমকি জিজ্ঞেস করলো,
“নাম কী আপনার?”

“আনান ইসলাম।”

“আনান?” রুমকি গলায় কেমন একটা তুচ্ছ সুর ধরে বললো।

শ্রাবণ একটু হোঁচট খেলো রুমকিকে এমন করে বলতে শুনে।

“আর কোনো নাম নেই আপনার?”

“আছে।”

“তাহলে সেটা বলেন।”

“শ্রাবণ!”

“হুম, ভালো নাম। ঠিক আছে। আপনি এখন যান।”

শ্রাবণ যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে রুমকি আবারও ডাকলো,
“শুনুন…”

শ্রাবণ দাঁড়ায়। পিছন ফিরে তাকায় রুমকির উজ্জ্বল অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা মুখখানিতে।

রুমকি বললো,
“আমি রুমকি ইমরোজ। আমাকে রুমকি বলে ডাকবেন।”

ওখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল সেদিন রুমকির সাথে বাক্যলাপের। রুমকি আর কিছু না বলে একটু হেসে বাড়ির ভিতর ঢুকে যায়। এরপরও মাঝে মাঝে দেখা হলে কথা হয়েছে দুজনের। তবে বেশি নয়, খুব অল্প পরিমাণ। কেমন আছে, কোথায় যাচ্ছে এসব আরকি। কথাবার্তা বেশি না হলেও মনে অনুভূতি ছিল রুমকির জন্য। রুমকির প্রতি যে তার অনুভূতি গাঢ় ছিল সেটা নয়। ভাসা ভাসা একটা অনুভূতি ছিল। কিন্তু যবে থেকে রুমকির বিয়ের গুঞ্জন শুরু হলো, সেই থেকে এই ভাসা ভাসা অনুভূতি ক্রমে ক্রমে কেমন যেন বাড়তে লাগলো। নিজের ভালোবাসার কথা রুমকিকে কখনও মুখ ফুঁটে বলতে পারেনি। তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি কখনও। মনের চার দেয়ালের মাঝেই আটকা পড়েছিল এই ভালোবাসার প্রতিলিপি। রুমকির বিয়ের কথা শুনে ভিতরে যে তোলপাড় শুরু হয়েছিল, খুব কষ্টে দমিয়ে রেখেছিল তা। তোলপাড়ের এই ঝাপটা ঘুণাক্ষরেও বাইরে প্রকাশ করতে চায়নি। রুমকিকে ভালোবাসার কথা শুধু নিজের মাঝেই আটকে রাখতে চেয়েছিল চিরকাল। কিন্তু কোত্থেকে কী যেন হয়ে গেল!
রুমকির বিয়েতে প্রথমে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না শ্রাবণের। কিন্তু আচমকা আবার রুমকিকে বধূবেশে দেখার তৃষ্ণা জাগলো মনে। রুমকিকে বধূবেশে কতটা সুন্দর লাগে সেটা দেখার তীব্র আকুলতা সৃষ্টি হলো। শেষমেশ বিয়েতে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিতে হলো। বাবা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। বাবার সাথে সাথে সপরিবারকে বিয়েতে ইনভাইট করেছিল। মা বাদে সবাই গিয়েছিল রুমকির বিয়েতে। বাবা তো বিয়েতে দামি একটা গিফট দিয়েছেই, সাথে সে নিজেও আলাদাভাবে একটা গিফট দিয়েছিল। প্ল্যান ছিল এমন যে, যাবে রুমকির বিয়েতে। চুপচাপ বিয়েটা দেখে চলে আসবে। চুপচাপই তো ছিল। কিন্তু শেষ দিকে কী যেন একটা হলো! ভিতরের ঝড়টা লাগামহীনভাবে বেসামাল হয়ে পড়লো। মনে হতে লাগলো, যদি এখন রুমকির বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে মরে যাবে সে। একদম মরে যাবে! তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, জায়গাতেই লুটিয়ে পড়বে সে। নিজের এমন দমবন্ধকর পরিস্থিতি আর সামাল দিতে পারেনি শ্রাবণ। বিয়ের মজলিসে নানান মানুষের মাঝে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, সে ভালোবাসে রুমকিকে। তিন বছরের প্রেম তাদের মাঝে। আরও অনেক কিছু।
কী করে এসব কথা বললো এত মানুষের সামনে, সেটা নিজেও ভাবতে পারছে না। শুধু যেটা স্পষ্ট ভাবে মনে গেঁথে আছে সেটা হলো, বাবার হাতের ভারি থাপ্পড় এসে লেগেছিল তার গালে! থাপ্পড়ের কথা মনে উঠতে শ্রাবণের গাল ব্যথায় টনটন করে উঠলো। গালটা যেন এখনও অবশ বনে আছে। বাবা এত জোরে থাপ্পড় মারলো মানুষের সামনে? মারলে মারুক। কোনো কিছু যায় আসে না তাতে। বিয়েটা তো আটকাতে পেরেছে, সেই ঢের!

খুব কাছে কারো পদধ্বনির শব্দে শ্রাবণের সম্বিৎ ফিরলো। কারিবকে দেখে হাতের সিগারেটটা ফ্লোরে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো দ্রুত। কারিব এসে তার পাশে বেঞ্চির উপর বসলো। কারিবের দৃষ্টি প্রথমে গেল ফ্লোরে। ফ্লোরে পাঁচটা সিগারেটের অংশ পড়ে রয়েছে। সিগারেটের অংশগুলোর দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে, শ্রাবণের মুখের দিকে তাকালো সে। শ্রাবণ তার দিকে চেয়ে নেই। শ্রাবণের শূন্য দৃষ্টি সামনে স্থাপিত। ছাদের নিবিড় আলোয় জ্বলতে থাকা লাইটের আলোকিত আভায় শ্রাবণের মুখে চেয়ে থেকে কারিব বললো,
“কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন শ্রাবণ ভাই?”

শ্রাবণ না তাকিয়েই উত্তর দিলো,
“ঠিক-বেঠিক আমি জানি না কারিব। তবে যেটা করেছি, সেটাই ঠিক মনে হচ্ছে।”

“না, ঠিক করেননি আপনি। এমন একটা কাণ্ড করা উচিত হয়নি আপনার। কতটা সম্মানহানি হলো বলুন তো? কবে থেকে ভালোবাসতেন আপনি রুমকিকে? রুমকিকে ভালোবাসার কোনো কারণ তো দেখতে পাচ্ছি না আমি। তার যা আছে, তা তো শুধু রূপ। শুধু কি রূপ থাকলেই হয়? রূপের সাথে সাথে ভালো মনও তো থাকতে হয়। তাকে আপনি চেনেন না? সে তো মেয়ে ভালো না। লোভী! অনেক ছেলের সাথে সম্পর্ক তার। সেই ছেলেদের পটিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। ছেলেদের সাথে রাত কাটিয়েছে বলে শোনা যায়! আপনি কি সেটা জানেন না?”

“ওসব মিথ্যা। আমি বিশ্বাস করি না। রুমকি মোটেই অমন মেয়ে নয়। মানুষজন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে। হয়তো কিছু ছেলেদের সাথে রিলেশন আছে ওর, তাই বলে ও এমন নয়। ওসব মানুষের বানোয়াট কথা।”

“বানোয়াট নয় শ্রাবণ ভাই। রুমকি আসলেই খারাপ। তার সাথে আপনাকে মানায় না। আপনি তার সম্পর্কে সব জেনেও কেন ভালোবাসেন তাকে?”

“মানুষের অনুভূতি কখন কার প্রতি জন্ম নেবে সেটা কে বলতে পারে কারিব? আমি জানি কয়েকটা ছেলের সাথে ওর রিলেশন আছে। এটা তো আজকাল স্বাভাবিক। বিয়ের পর এসব থাকে না।”

“আপনার মাথা ঠিক আছে? রুমকিকে আপনি যতই ভালোবাসেন কোনো লাভ হবে না। তাকে আপনার বউ হিসেবে আপনার মা-বাবা কেউ-ই মেনে নেবে না। রুমকি ভালো না। লোভী! আর তার ফ্যামিলির মানুষগুলোও তো লোভী! তেমন হলে তো তারা আপনার সাথে রুমকির বিয়ে দিতে চাইতো। কিন্তু তারা তো তা করলো না। তারা ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা চাইলো। তিন লাখ টাকার চেক আমি নিজে গিয়ে দিয়ে এসেছি তাদের।”

শ্রাবণ পাশ ফিরে কারিবের দিকে চেয়ে বললো,
“টাকা চেয়েছে আর তোমরা টাকা দিয়ে দিলে? টাকা না দিয়ে আমার সাথে রুমকির বিয়ে দেওয়াটাই তো যুক্তিযুক্ত কাজ ছিল। রুমকির সাথে আমার বিয়েটা ঠিক করতে পারলে না?”
কথাগুলো বলে শ্রাবণ আবার চোখ সরিয়ে নিলো।

কারিব শ্রাবণের কথা শুনে হতবাক। তারও এখন সন্দেহ হচ্ছে, শ্রাবণের মাথায় আসলেই কোনো গন্ডগোল দেখা দিয়েছে কি না! কারিব অবিশ্বাস্য সুরে বললো,
“এটা আপনি কী বললেন? আপনার মাথায় তো দেখছি আসলেই গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে শ্রাবণ ভাই। মামার ধারণা ঠিক। এত কিছু জানার পরও আপনি সেই রুমকিকে বিয়ে করার কথা বলছেন? রুমকি আসলেই ভালো মেয়ে না। ও কিন্তু খারাপ!”

শ্রাবণ গরম চোখে তাকালো কারিবের দিকে।
কারিব একটু ভয় পেয়ে গেল।
শ্রাবণ কটমট করে বললো,
“এখান থেকে চলে যাও কারিব।”

শ্রাবণের কথায় কারিব আর কিছু বলতে পারলো না। ভীত মন নিয়ে দ্রুত কেটে পড়লো শ্রাবণের পাশ থেকে।

________________

কবির সাহেবের বাড়ির পাশে এক তলা ছোট একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে মোট পাঁচজন সদস্য থাকে। ইদ্রিস খান এবং তার স্ত্রী হাফিজা। আর তিন মেয়ে মিহিক, নোয়ানা, তিন্নি। ইদ্রিস খান কবির সাহেবের অফিসে কাজ করেন। কবির সাহেবের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক। কবির সাহেবদের পাশের এই এক তলা বাড়িটায় ভাড়াটিয়া হিসেবে আছে প্রায় দুই বছর হলো। কবির সাহেবই এই বাড়িটার সন্ধান দিয়েছিলেন তাকে। কবির সাহেবের সাথে যেমন তার ভালো সম্পর্ক ছিল, তেমনি এখন কবির সাহেবের পাশের বাড়িতে ভাড়াটিয়া থাকার সুবাদে দুই ফ্যামিলির মাঝেই সম্পর্কটা বেশ সখ্যতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেশ ভাব জমে গেছে দুই ফ্যামিলির মাঝে। কবির সাহেবদের পাশের বাড়িতে থাকার কারণে ভালো সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছেন বলা চলে। কবির সাহেবের বড়ো ছেলে রুমকির বিয়েতে যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা তাদের কানেও এসে পৌঁছেছে। তারা কেউ-ই রুমকির বিয়েতে উপস্থিত ছিল না। তবে এই ঘটনাটা শুনতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।

রুমকির বিয়েতে ঘটানো শ্রাবণের ওই কাণ্ড নিয়ে ছোটখাটো একটা আলোচনা বসেছে তিন বোনের মাঝে। মিহিক, নোয়ানা এবং তিন্নি তিনজন এখন ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসে আছে।
এই তিন বোনের ব্যাপারে একটু ধারণা দেওয়া আবশ্যক। মিহিকের অনার্স শেষ হয়েছে। লেখাপড়ায় আর কোনো আগ্রহ নেই তার। এখন ছোটখাটো একটা চাকরির জন্য এপ্লাই করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো আশাচিত ফল পাচ্ছে না।
নোয়ানা পড়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। বেশ মেধাবী। পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনিও করে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ছয়জনকে পড়ায়। খুব বেশি ইনকাম হয় না তাতে। তবে যা হয় তাই তার কাছে অনেক।
তিন্নি হলো সবচেয়ে ছোট। সে পড়ে ক্লাস নাইনে। কবির সাহেবের মেয়ে জুন আর সে একই ক্লাসের শিক্ষার্থী। দুজনকে বেস্ট ফ্রেন্ড বললে মন্দ হবে না।

ব্যালকনিতে কোনো লাইট নেই। রুমে জ্বলতে থাকা লাইট যেটুকু আলোকিত করতে পেরেছে ব্যালকনিটাকে। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ছাপিয়ে ঝাপসা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
বারান্দার ঝাপসা আলোর মতো নোয়ানার চিন্তাদেরও কেমন ঝাপসা ঝাপসা ভাব। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে শ্রাবণ এমন একটা কাজ করেছে। সেই নিয়ে এবার বোনদেরও বললো,
“আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না শ্রাবণ ভাইয়া এমন একটা কাজ করতে পারে। শ্রাবণ ভাইয়াকে তো কতই দেখেছি। কত নম্র, ভদ্র উনি। এমন একটা কাজ করতে পারে এটা আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না।”

মিহিক চেয়ারের সাথে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। পা গ্রিলের উপর একটার উপর আরেকটা রেখে দোলাতে দোলাতে বললো,
“যাকে বাইরে থেকে ভদ্র দেখবি সে যে ভিতর থেকেও ভদ্র হবে, এমন কোনো কথা নেই নোয়ানা। ওনাকে তো আমিও দেখেছি। ভদ্র একটা মানুষ। বেশি কথা বলে না। দেখা হলে সালাম দিয়ে সুন্দর করে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করে। কিন্তু মুখে যতই সৌন্দর্য ফোঁটাক, ভিতরে যে কী আছে সেটা যতক্ষণে না সে প্রকাশ করবে ততক্ষণে বুঝতে পারবি না। উনি বাইরে ভদ্র হলেও ভিতরে আসলে অভদ্র। অভদ্র না হলে কারো বিয়ে ভেঙে দিতে পারে এরকম? এত লোকের সামনে চেঁচিয়ে বলতে পারে তার সাথে রুমকির তিন বছরের প্রেম ছিল? পারে না।”

তিন্নি বললো,
“আসলেই কি ওনার রুমকি আপুর সাথে প্রেম ছিল?”

“সেটা আমি কী করে বলবো? ওনাকেই প্রশ্ন করে জেনে নিস। আর যদি প্রেম না থাকতো, তাহলে কি এভাবে লোকের সামনে চেঁচিয়ে প্রেমের কথা বলতো শুধু শুধু?”

মিহিকের কথার পর পরিবেশ একটু নীরব হয়ে পড়লো। এক দুই মিনিট নীরবতা চলার পর তিন্নি হঠাৎ বললো,
“তুমি ঠিকই বলছো আপু। বাইরে ভদ্র থাকলেও, সব মানুষের ভিতরটা ভদ্র থাকে না। আমার তো মনে হয় যারা বাইরে বেশি ভদ্র দেখানোর চেষ্টা করে, তাদের ভিতরটা আসলে সবচেয়ে বেশি অভদ্র।”

“এমনটা নয় তিন্নি…” তিন্নির কথার প্রতিবাদ জানালো নোয়ানা।
“শ্রাবণ ভাইয়া আসলেই ভালো এবং ভদ্র মানুষ।”

মিহিক মাথাটা কাত করে কেমন বাঁকা চোখে তাকালো নোয়ানার দিকে। ত্যাড়া কণ্ঠে বললো,
“তুই ওই শ্রাবণের টান টানছিস কেন বলতো? তুই ওর প্রেমে-ট্রেমে পড়ে যাসনি তো?”
কথাটা বলে ফিচেল হাসলো মিহিক।

নোয়ানা বিরক্তির সুরে বললো,
“কী বলো আপু? আমি তার প্রেমে পড়বো কেন? তিনি আমার ভাইয়ের মতো।”

মিহিক আরেকটু বেশি হেসে বললো,
“এমন ভাইয়েরা ভাই থেকে প্রেমিক হতে বেশি সময় নেয় না। খবরদার নোয়ানা! ওই অভদ্র শ্রাবণের প্রেমে পড়বি না তুই। যে ছেলে অন্য একটা মেয়ের বিয়ে এভাবে ভেঙে দিলো, সে ছেলে কোনোদিন ভালো হতে পারে না।”

_______________

জানালা ভেদ করে সকালের সূর্যরশ্মি লিভিং রুমের ফ্লোর স্পর্শ করেছে। ঘড়িতে এখন সকাল ১০:৩৭ ছুঁই ছুঁই। শ্রাবণের ঘুম ভেঙেছে এই কিছুক্ষণ আগে। এত বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস তার নেই। বাবার কড়া হুকুম, ফজরের নামাজ আদায় করতে হবে। ফজরের আযানের সাথে সাথে রোজ এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো। কাল রাতে ঘুমিয়েছে দুটোর দিকে। এর থেকে বেশি রাতও হতে পারে। সঠিক সময় জানা নেই তার। ঘুম থেকে জাগার পরই মাথায় ব্যথার উদ্ভব হলো। এলোথেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে, সোফার উপর বসে দুই হাতে মাথা চেপে রেখে নুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
শুনতে পেল বাড়ির সদর দরজা খুলে যাচ্ছে। শ্রাবণ চোখ তুলে তাকালো। দেখতে পেল জুতোয় গটগট শব্দ করে তার দিকে এগিয়ে আসছে রুমকি। রুমকির মুখে আক্রোশের গাঢ় রং।
শ্রাবণ থ হয়ে তাকিয়ে রইল। দ্বিধায় পড়তে হলো তাকে। তার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? রুমকি কাছাকাছি এলে দাঁড়িয়ে গেল শ্রাবণ। তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,
“রুমকি তুমি?”

প্রশ্নটা করতে না করতেই রুমকি তীব্র রাগের সাথে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো শ্রাবণের গালে।
কালকে বাবার থাপ্পড় মারার জায়গাটাতে আবারও ভারি একটা থাপ্পড় লাগাতে শ্রাবণ খুব ব্যথা অনুভব করলো। সেই সাথে ভাঙলো তার দ্বিধা। এটা হ্যালুসিনেশন নয়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here