হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ৩,৪

0
730

হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ৩,৪
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩

পরেরদিন বিকেল বেলা ঘুম ভাঙলো মাহমুদের নকের আওয়াজে। হাই তুলে দরজা খুললো মেহরিন। মাহমুদ তাঁর আপাদমস্তক একঝলক লক্ষ্য করে ব্যস্তভঙ্গিতে বললো,’আমাদের বেরোতে হবে। আধঘন্টা সময় আছে হাতে।’

ফের হাই তুললো মেহরিন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,’আসছি।’

দরজা থেকেই চলে গেলো মাহমুদ। ফ্রেশ হতে দশমিনিটের বেশি সময় নিলো না মেহরিন। এমনিতেও গতকাল তাঁর ফ্রেশ হওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনেছে শয়তানটা। আজকে আর খামোখা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করতে চাইলো না। হালকা নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লো।

সোহাগ এবং মাহমুদ ম্যাপ দেখছে। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরিন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ম্যাপটার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,’হোটেলের লোকজন আগে থেকেই সরিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় ওরা টের পেয়ে যাবে।’
সমর্থণ করলো সোহাগ। মাহমুদ চুলের গোড়ায় আঙ্গুল চালাতে চালাতে বললো,’আমি সিগন্যাল পাঠানোর আগ পর্যন্ত ভেতরে ঢুকবে না কেউ। যত দ্রুত সম্ভব সিগন্যাল পাঠানোর চেষ্টা করবো আমি।’

-‘তুমি সিগন্যাল পাঠাবে মানে? ভেতরে তো আমার ঢোকার কথা ছিলো?’

কালকে সারারাত একফোঁটাও ঘুমায় নি মাহমুদ। বসে বসে প্ল্যানটা নিয়ে ভেবেছে। কিভাবে প্ল্যানটাকে আরো বেশি সেইফ করা, রিস্কের সম্ভাবনা কমানো, সহজ থেকে সহজ করা যায় এসবই ভেবেছে। ইরফান সাহেবকেও শান্তিতে থাকতে দেয় নি। ফোন করে বারবার বিরক্ত করেছে।

ইরফান সাহেব অবশ্য বিরক্ত হন নি। ঠান্ডা মাথায় সব শুনেছেন। সবশেষে গম্ভীর কন্ঠে বলেছেন,’তোর ওপর আমি ভরসা করি মাহমুদ। তুই চাইলে তোর সুবিধামত প্ল্যান গুছিয়ে নিতে পারিস কিন্তু একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখবি, প্ল্যান কিন্তু সাকসেসফুল হওয়া চাই। অ্যাট এ্যানি কস্ট!’

-‘হবে।’, আত্মবিশ্বাসী কন্ঠস্বর মাহমুদের।

-‘ঠিক আছে রাখছি আমি।’


আজকে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ মাফিয়া দলটির বিদেশী কিছু ক্রিমিনালের সঙ্গে একটা মিটিং আছে। স্থানীয় একটা হোটেলে খুব সিক্রেটভাবে মিটিংটার আয়োজন করেছে তাঁরা। খুব সম্ভবত তাদের দলনেতাও মিটিংটাতে থাকবে। তাই মাহমুদদের মধ্য থেকে কোন একজনকে ভেতরে ঢুকে ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে জানাতে হবে। সেই অনুযায়ী পজিশন নেবে পুরো টিম।

ভেতরে ঢোকার কাজটা মেহরিনের! কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না মাহমুদের। একই পরীক্ষা বারবার দিতে চায় না সে। ভেতরে ঢোকা মানে নিশ্চিত ভাবে ধরা পড়ে যাওয়া। শত্রুপক্ষের রেস্ট্রিকশন এরিয়ার ভেতরে বিপক্ষদলের এজেন্ট ঢুকবে অথচ তাঁরা টের পাবে না এত অল্প সিকিউরিটি নিয়ে নিশ্চয়ই মিটিং এরেঞ্জ করে নি তাঁরা? কিন্তু তাহলে ঢুকবে কে? এনাকে অবশ্য দেওয়া যায়। স্বাচ্ছন্দ্যেই রাজি হয়ে যাবে সে! কিন্তু যেখানে মেহরিনকে পাঠাতে মন সায় দিচ্ছে না সেখানে এনাকে পাঠাতে বিবেকে বাঁধছে। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলো সে-ই ভেতরে ঢুকবে। এর চাইতে ভালো উপায় আর হতেই পারে না। সকালেই সোহাগের সাথে এই ব্যপারে আলোচনায় বসলো। সোহাগ আপত্তি করলো না। কাজের দিক থেকে ইইরফান আহমেদের মতন সে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে মাহমুদকে। আর যাই হোক দলের ক্ষতি করে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না মাহমুদ।

এদিকে মেহরিন জবাবের অপেক্ষায় ধারালো দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে। মাহমুদ আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বললো,’ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে।’

-‘নির্দেশ এসেছে না তুমি আনিয়েছো? কি প্রমাণ করতে চাও তুমি? আমি অযোগ্য?’

জবাব দিলো না মাহমুদ। নিজের মত করে রেডি হতে শুরু করলো। রাগে কেঁদে ফেলার উপক্রম মেহরিনের! তবে এই প্রথমবার মাহমুদের পক্ষ নিলো সোহাগ। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বললো,’তুমি ভুল বুঝছো মেহরিন। এই ব্যপারে মাহমুদ ভাইয়ের সত্যিই কোন হাত নেই।’

মেহরিন শুনলো না। মাহমুদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে বললো,’কেন করছো এসব?’

-‘আমি কিছু করি নি!’

-‘তাহলে এসব কেন হচ্ছে?’

-‘বললাম তো বসের অর্ডার এসেছে।’

বেশকিছুক্ষণ নিরবে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো মেহরিন। তারপর পথ ছেড়ে দিলো। মাহমুদ ওয়াটকিটা দেখে নিতে নিতে সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,’এনাকে একটু ডেকে পাঠাও তো সোহাগ। আমার গানটা ওর ব্যাগে আছে বোধহয়।’

সোহাগ বেরিয়ে গেলে শান্তভাবে নিজের কাজ গোছানোয় মনোযোগ দিলো মাহমুদ। ভেতরে ভেতরে মেহরিনের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিলো। মেহরিন গেলো না।

-‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো যে? রেডি হবে না?’

-‘আমি তোমাদের সঙ্গে মিশনে যাচ্ছি না।’ শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো মেহরিন।

ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকাতেই গানটা পেয়ে পেলো মাহমুদ। এনা তাঁর ব্যাগেই ঢুকিয়েছে। সেটা কোমরে গুঁজে নিতে নিতে বললো,’তুমি খামোখা আমার ওপর রাগ করছো মেহরিন। আমি হচ্ছি হুকুমের গোলাম! তোমাকে যেমন উপরমহলের নির্দেশ মেনে চলতে হয় তেমনি আমাকেও চলতে হয়। আমরা কেউ-ই বসের নির্দেশের উর্ধে নই!’

-‘কেবল তুমি আমার সঙ্গে থাকলেই কেন বসের নির্দেশ গুলো পাল্টে যায়? অন্যসময় তো ঠিকই থাকে!’

-‘কারণ বেছে বেছে রিস্কি মিশনগুলোতেই আমাদের দুজনকে একসঙ্গে পাঠানো হয়। আর তুমি তো ভালো করেই জানো এসব মিশন নির্দিষ্ট কোন স্কিম অনুযায়ী হয় না। সিচ্যুয়েশন অনুযায়ী স্কিম চেইঞ্জ করে নিতে হয়!’

-‘এখনকার সিচ্যুয়েশনটা কি শুনি?’

-‘ওদের রেস্ট্রিকশন এরিয়ার ভেতরে অচেনা মেয়ে দেখলে ওরা নির্ঘাত বুঝে ফেলবে শত্রুপক্ষের এজেন্ট তাই আমাকে ওয়েটার হিসেবে ভেতরে ঢুকতে হবে। এইব্যপারে এখানকার পুলিশ আমাদের সহযোগীতা করবে।’

-‘তুমি সিউর ওয়েটার সেজে ঢুকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই?’

-‘আছে কিন্তু সময় পাওয়া যাবে। ওরা টের পাওয়ার আগেই আমি সিগন্যাল পাঠিয়ে দিতে পারবো।’

এবার বোধহয় কিছুটা শান্ত হলো মেহরিন। নরম গলায় বললো,’বস তোমাকে কখন জানিয়েছেন?’

-‘কালরাতে।’

তথাপি সন্দেহ পুরোপুরি গেলো না মেহরিনের। তবে তর্ক করার মতন আর কোন যুক্তিও খুঁজে পেলো না সে। মাহমুদ মুচকি হেসে বললো,’আশাকরি, আর কোন কনফিউশন নেই তোমার?’

ইনডাইরেক্টলি মেহরিনকে বেরিয়ে যেতে বলছে মাহমুদ। প্ল্যানটা সে চেইঞ্জ করেছে বুঝতে পারলে আর কিছুতেই মানানো যাবে না মেহরিনকে। দেখা যাবে, তাঁর আগে ভেতরে ঢুকে বসে আছে মেহরিন। তাই কথাগুলো বলার সময় ভেতরে ভেতরে টেনশন হচ্ছিলো তাঁর। সেটা চাপতেই মেহরিনকে তাড়াতাড়ি বের করে দিতে চাইলো।

এদিকে ‘ঠিক আছে’ বলেও বেরোলো না মেহরিন। মাহমুদ পুনরায় গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’এবার কি আমি আমার কাজগুলো সেরে নিতে পারি? আসলে বেশ কয়েকটা ফোন করার ছিলো।’

বেরিয়ে গেলো মেহরিন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো মাহমুদ।


এনাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছে সোহাগ। ফোনও ফেলে গেছে রুমে। এদিকে অলরেডি সাড়ে চারটা বেজে গেছে। আর বেশী দেরী করা যাবে না। বাধ্য হয়ে মাহমুদ নিজেই খুঁজতে বেরোলো।
স্পা এরিয়াতে উঁকি দিতেই দেখা মিললো তাঁর। মাহমুদকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,’দারুণ মাস্যাজ করে এরা। নেবে নাকি?’

না-সূচক মাথা দোলালো মাহমুদ। তাড়া দিয়ে বললো,’আমাদের কে এক্ষুনি বেরোতে হবে এনা। হাতে সময় খুব কম।’

মুখে আন্তরিক দুঃখভাব ফুটে উঠলো এনার। এভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত স্পা এরিয়াতে বসে থাকা একদমই উচিৎ হয় নি তাঁর। তবে দেরী করলো না সে। ঝটপট উপরে চলে গেলো রেডি হওয়ার জন্য।

নিচে দাঁড়িয়ে এনার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। মজার বিষয় হলো আজকেও স্বামী স্ত্রী সেজে বেরোতে হবে তাঁদের। সন্দেহ ঠেকাতে কাধে একটা ছবি তোলার ক্যামেরা ঝুলিয়েছে সোহাগ। সেটাই নেড়েচেড়ে দেখছিলো। মাহমুদ ফোন স্ক্রল করছে। মেহরিন গম্ভীরমুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই সোহাগ ফিসফিস করে বললো,’মানানো কি গেছে স্যার? নাকি আগের মতনই আছে?’

মাহমুদ হাসলো। ঠাট্টার সুরে বললো,’গেছে। বললাম,তুমি গেলে আমাদের সোহাগের কি হবে ভাই? বেচারা এমনিতেও সারাক্ষণ তাঁর মেহরিন ম্যামকে নিয়ে টেনশনে থাকে। ওকে আর টেনশন দিও না।’ কথা শেষ করে শব্দ করেই হাসলো সে।

-‘ব্যপার উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতন হয়ে গেলো না?’, সোহাগও হাসিমুখেই খোঁচাটা মারলো।

হাসি থেমে গেলো মাহমুদের। স্থির ভাবে সোহাগের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর? তারপর অস্বীকার করতে গিয়ে ফের হেসে ফেললো সে! ততক্ষনে এনাও নেমে এসেছে। সোহাগের ঘাড়ে আলতো করে চাপড় দিয়ে বললো,’চলো বেরোই।’ তারপর একসঙ্গেই বেরোলো চারজন।
.
.
.
চলবে

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪

ধরা পড়েছে আবার পড়েও নি মাহমুদ। ওয়েটার সেজে বিয়ার পরিবেশন করা কালীন হাঁটার ওপর দিকে ভেতরে একঝলক উঁকি দিয়েছিলো সে। ভেতরে শত্রুপক্ষের নেতা আছে। স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ভেদ করে সাউন্ড যদিও বাইরে আসছে না তবে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সবকিছু। আড়ালে সরে গেলো সে। কোমরের কাছ থেকে ওয়াকিটকি টা বের করে দ্রুত সিগন্যাল পাঠালো। এদিকে ভেতরে থেকে সিসিটিভিতে বাইরের সবকিছু মনিটরিং করছিলো শত্রুরা। মাহমুদকে উঁকি দিতে দেখে আর একমুহূর্তও দেরী করে নি। দ্রুত বেরিয়ে এসেছে দুই তিনটা ষন্ডা টাইপের লোক। কিন্তু লাভ হলো না। ওরা মাহমুদ অব্দি পৌঁছানোর আগেই পুরো ফোর্স নিয়ে ভেতরে ঢুক পড়েছে সোহাগ। সঙ্গে মেহরিন এবং এনাও আছে। তারপর শুরু হলো মুখোমুখি আক্রমণ।
তবে সিক্রেট মিটিং হওয়ায় দরুন আক্রমণের পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে আসে নি শত্রুপক্ষ। তাই বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলো না। আধঘন্টা মধ্যেই ধরাশায়ী হয়ে গেলো।


ক্রিমিনালদের আপাতত তাসখন্দের পুলিশ কাস্টোডিতে রাখা হবে। সেখান থেকেই বাংলাদেশে পাঠাবে উজবেকিস্তান সরকার। হোটেলের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটাও সরকারের পক্ষ থেকে মিটিয়ে দেওয়া হবে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মাহমুদরা সবাই। আনন্দ দৌড়ে গিয়ে মাহমুদকে জড়িয়ে ধরলো এনা। নতুন এজেন্ট হওয়ায় বিদেশী মিশনগুলো খুন এঞ্জয় করে সে। সেই সাথে মিশন সাকসেসফুল হলে তো কথাই নেই। আনন্দ রাখে কে? মাহমুদ আলতো করে তাঁর পিঠে চাপড় দিয়ে বললো,’আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ!’

মেহরিন সোহাগের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এনাকে ছেড়ে সোহাগের সঙ্গে কোলাকুলি করলো মাহমুদ। ভ্রু কুঁচকে ফেললো মেহরিন। মাহমুদ কি তাকেও জড়িয়ে ধরবে? লক্ষণ তো তাই মনে হচ্ছে! না! সেই সুযোগ তাঁকে কোনভাবেই দেওয়া যাবে না। সবকিছু শেষ করার সিদ্ধান্ত যখন মেহরিন নিয়েই নিয়েছে তখন সেটা পুরোপুরি শেষ করা উচিৎ। ইমোশনকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে ফাঁক রেখে দেওয়া। হাতদুটো ভাঁজ করে আড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ব্যপারটা নজরে এড়ালো না মাহমুদের। হ্যান্ডশেইক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো সে।
যদিও মেহরিনের ওপর মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়ে আছে সে। এই নিয়ে যতবার মেহরিন তাঁর সঙ্গে মিশনে এসেছে ততবারই মাহমুদকে বাড়তি টেনশন মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আজকেও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি। আরেকটু হলেই গেছিলো মেহরিন যদি না উল্টো দিক থেকে পরপর দুটো গুলি এসে শত্রুটিকে ঘায়েল না করতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথম গুলিটা মাহমুদই করেছে। আর দ্বিতীয় গুলিটা?

দ্বিতীয় গুলিটা, এনা করেছে! হ্যাঁ, সোহাগ তখন আশেপাশেও ছিলো না। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এনা এত দ্রুত শুট করেছে যে মাহমুদের গুলিটা মিস হলেও বেঁচে যেত মেহরিন।

মেহরিন বরাবরই জেদী, একরোখা! প্রয়োজনে নিজে শহীদ হয়ে যাবে কিন্তু শত্রুপক্ষকে ছাড়বে না। এছাড়া টিম লিডারের নির্দেশ অমান্য করা তাঁর খুব কমন একটা বদঅভ্যাস। যেটা নিয়ে শুধু মাহমুদ নয়, বিদেশি অনেক এজেন্টও তাঁর বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে ইরফান আহমেদের কাছে। প্রথম প্রথম তিনি প্রায় প্রতিটা মিশন শেষেই পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করতেন মেহরিনের জন্য। কিন্তু লাভ হয় নি। ফলাফল শূন্য! মেহরিন যেমন ছিলো, তেমনই আছে। তাই আস্তে আস্তে সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। যাই করুক না কেন, দলের ক্ষতি তো আর করছে না? উপরন্তু মিশনগুলোও সাকসেসফুল হচ্ছে। কিন্তু মাহমুদ? সর্বদা আতঙ্কে থাকে সে! গম্ভীর মুখে হ্যান্ডশেইক করে বললো,’কংগ্রাচুলেশন! তুমি বেঁচে আছো!’

খোঁচা সহ্য করার পাত্রী মেহরিন নয়। তাঁর ধারণা প্রাণ বাঁচিয়ে তাঁকে খোঁটা দিচ্ছে মাহমুদ। তাই দুকথা শুনিয়ে দিতে সে-ও ছাড়লো না। নিজের বাড়ানো হাতটা চট করে সরিয়ে নিয়ে এনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’থ্যাংক ইউ এনা। ইউ হ্যাভ ডান আ লট টু মি।’ জবাবে এনা বিনয়ী হাসলো। তারপর মাহমুদকে উদ্দেশ্য কটাক্ষ করে বললো,’অলসো থ্যাংকস টু ইউ মি.মাহমুদ। যদিও এটা টিম ওয়ার্ক ছিলো। অ্যাজ ইউ নো দ্যাট, টিমের একজন বিপদে পড়লে আরেকজন এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু তবুও, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আফটার অল, ইউ সেইভড্ মাই লাইফ।’

মেহরিনের এমন আক্রমণে খানিকটা বিব্রত হলো এনা। যদিও মেহরিন তাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে নি তথাপি মাহমুদের সঙ্গে এহেন আচরণ মেনে নিতে পারলো না সে। মেহরিন শুধু শুধু মাহমুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে! জবাবে সে খুব শান্তভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তাঁর আগেই মাহমুদ থামিয়ে দিলো। ইশারায় বেরিয়ে তাঁকে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। বাধ্য হয়ে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসলো এনা। সে বেরিয়ে গেলে মাহমুদ হেসে উঠে বললো,’বাহ! তোমার মুখ থেকে থ্যাংক ইউ? ইট সাউন্ডস লাইক মিউজিক। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’

রাগের বিপরীতে মাহমুদের হাসি আরো বেশি মেজাজ গরম করিয়ে দিলো মেহরিনের। থমথমে মুখে বললো,’দিস ইজ নট ফান অ্যাট অল।’,

-‘আমি কখন বললাম এটা মজা? ডিড আই এভার স্যে দ্যাট?’

-‘আলবৎ বলেছো। তুমি আমাকে ডিমিন করতে চাইছো।’

-‘আমি মোটেও তোমাকে ডিমিন করতে চাইছি না। তুমি অকারণেই আমার ওপর খেপে যাচ্ছো।’

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলো মেহরিন। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’আমি অকারণে তোমার ওপর খেপছি মানে? আমি কি পাগল?’

মেহরিনকে শান্ত করানো যাবে না বুঝতে পেরে সোহাগ তাড়াতাড়ি মাহমুদকে বাধা দিয়ে বললো,ইট’স ওকে স্যার। চলুন আমরা গাড়ির দিকে যাই।’

মাহমুদ তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,’সবসময় তোমার মেহরিন ম্যামকে সাপোর্ট করা বন্ধ করো সোহাগ! এটা জরুরী নয় যে সবসময় কেবল সে-ই ঠিক হবে আর বাদবাকি সবাই ভুল। সেল্ফ-ডিফেন্স বলে যে একটা ব্যপার আছে সেটা তো তোমার ম্যাম মানতেই রাজি নন।’

ধমক খেয়ে সোহাগ তাঁকে আর কিছু বলার সাহস পেলো না। মেহরিনকে কিছু বলার আগেই সে রাগে কটমট করে চাইলো। ভয়ে বেচারা আর দাঁড়ালো না। যা খুশি করুক, ঝগড়া করতে করতে দুজনে শহীদ হয়ে যাক। তাঁর কি? এরা কি তাঁর কথা শুনবে? শুনবে না। অতএব নিরিবিলিতে গাড়িতে গিয়ে বসাই শ্রেয়।

এদিকে মাহমুদের কথা শেষ হওয়ার সাথেই পালটা জবাব দিলো মেহরিন। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’সেটা আমার পার্সনাল ইস্যু। তোমার কি?’

-‘আমার কি মানে? তুমি জানো না, টিমের কোন সদস্যের ক্ষতি হলে বাকিদের মনোবলের ওপরে তাঁর ইফেক্ট পড়ে? আর এজেন্সির একজন সিনিয়র এজেন্ট হিসেবে আমি নিশ্চয়ই চাইবো না আমার টিম মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ুক?’

-‘ও তারমানে তুমি একলাই কেবল প্রফেশনালিজম মেইনটেইন করতে পারো আর কেউ পারে না? সবাই বোকা?’

-‘আমি একবারও সেই কথা বলি নি মেহরিন। আমি শুধু তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।’

-‘সেই সাথে নিজের ঢোল নিজে পিটিয়েছো।’

মাহমুদ এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়লো। কপালের রগ চেপে ধরে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো সে। মেহরিন জীবনেও ভুল স্বীকার করবে না। অতএব হার যদি কাউকে স্বীকার করতে হয় সেটা তাঁকেই করতে হবে। নতুবা আজকে সারারাতেও আর্গুমেন্ট শেষ হবে না। বাম হাতে মাথার তালু চুলকালো সে। শান্ত কন্ঠে বললো,’ঠিক আছে বাদ দাও। আসল কথা হলো প্ল্যান সাকসেসফুল হওয়া নিয়ে। সেটা যখন হয়েছে তখন আর তর্ক করে লাভ নেই। চলো, বাইরে ওরা অপেক্ষা করছে।’
বিজয়ীর ভঙ্গিতে মাথা দোলালো মেহরিন। গম্ভীর মুখে বললো,’চলো।’

যাওয়ার সময় গাড়িতে সোহাগ এবং মেহরিন একসাথে বসলো। এনা পেছনের সীটে একা বসেছে। ভিউ দেখবে বলে ড্রাইভারের পাশে সামনে বসেছে মাহমুদ। রিভার ভিউ মিররে আড়চোখে মেহরিনের দিকে একবার চাইলো সে। মুখ ভার করে বসে আছে। কারণটা তাঁর অজানা নয়। ঝগড়া হলেই মেহরিন এমন করে। প্রথমে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে তারপর নিজে নিজেই কষ্ট পাবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে দিকে চাইলো সে।
তবে আজকে মেহরিনের মন খারাপের কারণ মাহমুদের সঙ্গে ঝগড়া নয়। অন্য একটা কারণে মন খারাপ তাঁর। যেটা সে চাইলেও অস্বীকার করতে পারছে না। তখন মাহমুদ হ্যান্ডশেইক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় মুখের হাসির রেখা সে টেনে নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু খারাপ লেগেছে তাঁর। খুব খারাপ লেগেছে। মাহমুদ তাকে জড়িয়ে ধরলে হয়ত আরো বেশি খারাপ লাগতো, রাগ হতো, অন্যায় মনে হতো। মনে হতো বুঝি সে এনাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু এখন কষ্ট হচ্ছে! খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে সবকিছু ভুলে একবার যদি মাহমুদের বুকে মাথাটা রাখতে পারতো তাহলে সব কষ্ট দূর হয়ে যেত তাঁর! আসলে আবেগ জিনিসটা বরাবরই খুব আনপ্রেডিক্টেবল। কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারে না। চোখ বন্ধ করে সীটে মাথা এলিয়ে দিলো সে। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। শক্ত থাকতে হবে তাঁকে।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here