হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ১৭,১৮
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৭
পরেরদিন মাহমুদের বাসা থেকে ফেরার পর টানা তিনদিন অফিসে যায় নি মেহরিন। গতকালও শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে কামাই করেছে। সোহাগ ফোন করতেই জানালো অসুস্থ। জ্বর,মাথাব্যথা। অথচ কন্ঠ শুনে মনে হলো দিব্যি সুস্থ সে! খটকা লাগলো মাহমুদের। সোহাগকে দিয়ে আজকে আবারো ফোন করালো। কিন্তু রিসিভ করলো মেহরিন।
-‘কি বুঝলে সোহাগ?’, সোহাগ ফোন রাখতেই তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ। তাঁর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
-‘কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি গতকাল রাতেও ফোন দিয়েছিলাম,বললো ব্যস্ত। তাড়াহুড়ো করেই ফোন কেটে দিলো।’
বিচলিত চেহারা নিয়ে, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালো মাহমুদ। গতকাল রাত থেকেই হঠাৎ করে এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে তাঁর। কোন কারণ ছাড়াই মনটা খচখচ করছে। কেন এমন হচ্ছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।
সময় নষ্ট না করে টেবিলের ওপর রাখা গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পেছন থেকে সোহাগ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু জবাব দেওয়ার অবকাশ হলো না তাঁর।
★
তিনচারবার বেল বাজানোর পরেও ভেতর থেকে কোন সাড়া নেই। আবার বাজালো মাহমুদ। বিনা কারণেই বুক ধড়ফড় করছে তাঁর। কপালের কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে নিয়ে ফের বেল বাজালো সে। কিন্তু এবারেও কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। অতঃপর দরজায় দাঁড়িয়ে মেহরিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। সুইচড অফ!
টেনশনে, অস্বস্তিতে কপাল কুঁচকে গেলো মাহমুদের। অগত্যা পাশের ফ্ল্যাটে বেল বাজালো। মাঝবয়েসী এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে হাসিমুখে অভিবাদন জানালো তাঁকে। যদিও আগে কখনো মাহমুদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় নি। তথাপি মেহরিনের কলিগদের মোটামুটি সবাইকেই চেনেন ভদ্রমহিলা।
মাহমুদ সময় নষ্ট না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, মেহরিন কোথায় গেছে তিনি জানেন কিনা।
-‘আসলে আমি অনেকক্ষণ যাবত বেল বাজাচ্ছি কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছি না।’, বিনীত কন্ঠস্বর মাহমুদের।
-‘তাই নাকি?’
-‘জি।’
-‘কোথাও গেছে কিনা সেটা তো বলতে পারবো না। তবে গতকাল রাতে ওর ফ্ল্যাটে একবার গিয়েছিলাম। দেখলাম জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো অফিসের কাজে নাকি বাইরে যেতে হবে। সকালে আবার যখন আমার উনি অফিস যাচ্ছিলো তখনও দেখা হয়েছে। বাইরে থেকে দরজা লক করছিলো।’
একটু থেমে মিষ্টি করে হাসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর খানিকটা লজ্জিত কন্ঠেই বললেন,’ঐ সময় আসলে আমার ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হয়। সকালের ঐ সময়টাতে আমার খুব তাড়া থাকে। বেশিকিছু জিজ্ঞেস করার সময় পাই নি।’
মাহমুদ মনে মনে ভদ্রমহিলার কথাগুলো আউড়ে নিলো। গতকাল রাতে মেহরিন গোছগাছ করছিলো। মানে কি? অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে? কিন্তু মিথ্যে বলে গেছে কোথায়? অফিসেও তো যায় নি!
-‘আচ্ছা। ও কখন বেরিয়েছে সময় টা কি একটু মনে করে বলতে পারবেন?’
-‘ঘন্টাখানেক হবে!’
চট করে সেদিন রাতের ভিসা সংক্রান্ত মেসেজটার কথা মনে পড়ে গেলো মাহমুদের। আচমকাই পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। অশনি সংকেত বেজে উঠলো বুকের ভেতর। মেহরিন কি তবে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে? ভয়ে আতংকে আর বেশিকিছু ভাবতে পারলো না।
মেহরিনের বাসা থেকে এয়ারপোর্ট ঘন্টাখানেকের রাস্তা। তারমানে হাতে বেশি সময় নেই! দ্রুত গাড়ির কাছে এসে সোহাগের নাম্বারে ফোন করলো।সোহাগ ফোন রিসিভ করতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,’এইমুহূর্তে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করো সোহাগ। আজকে সকালে ওদের যত ফ্লাইট আছে সব একঘন্টার জন্য ডিলে করতে বলো। কুইক!’
সোহাগ তাঁর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,’কেন স্যার?’
-‘মেহরিন পালাচ্ছে!’
-‘পালাচ্ছে মানে?’
-‘তোমাকে আমি পরে সব বুঝিয়ে বলবো। আগে প্লিজ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করো।’
-‘ঠিক আছে। কিন্তু এয়ারলাইন্স থেকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?’
-‘বলবে আমরা খবর পেয়েছি একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল এনএসআই এর সমস্ত ইনফরমেশন চুরি করে পালানোর চেষ্টা করছে। যেভাবেই হোক তাঁকে আটকাতে হবে। প্রয়োজনে মেহরিনের ছবি সহ ওদের কাছে পাঠিয়ে দাও।’
-‘ঠিক আছে।’
-‘আরেকটা কথা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি এবং এনা দুজনেই এয়ারপোর্টে পোঁছে যাবে। সঙ্গে আমাদের ফোর্স নিয়ে আসবে।’
-‘আচ্ছা।’
ফোন রেখে মেহরিনের বাসার সামনে থেকে সোজা এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরলো মাহমুদ। বুকের ভেতরটা অনবরত ধড়ফড় করছে তাঁর। হাতপা কাঁপছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো আর যাইহোক না কেন মেহরিন যেন এয়ারপোর্টেই থাকে!
★
মেহরিনের পাসপোর্ট চেক করছে অল্পবয়সী সুন্দরী এক তরুনী। পাসপোর্টের ছবি দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেলো তাঁর। কোনরকম কথাবার্তা ছাড়াই ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো। রিসিভ হতেই মিষ্টি হেসে বললো,’উই গট হার!’
সোহাগকে নিয়ে একে একে সবগুলো ইমিগ্রেশন চেক করছিলো মাহমুদ। এরমধ্যেই সোহাগ জানালো মেহরিনকে পাওয়া গেছে। সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলো দুজনে।
মেহরিন কিছুই বুঝতে পারছে না। বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড মিলে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও কোন কথা বলছে না। অবশেষে মিনিট দুয়েক বাদে ঘর্মাক্ত, বিধ্বস্ত মাহমুদকে দেখতে পেয়ে বিষয়টা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে তাঁর কাছে।
গায়ের ফুলহাতা শার্ট ঘামে ভিজে চুবচুবে মাহমুদের। চোখমুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। আতংকে, ভয়ে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো মেহরিনের। তাঁর চোখে চোখ পড়তেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। এতক্ষণে প্রাণ ফিরে এসেছে। চোখের কোনে জমা হলো কয়েক বিন্দু জল। কিন্তু পরোক্ষণেই আবার জ্বলে উঠলো চেহারা। এমন পাষণ্ড নারীকে এত সহজে ক্ষমা করা যাবে না। কঠিন রাগের দৃষ্টি নিয়ে সরাসরি চাইলো অপরাধিনীর দিকে।
ভয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো মেহরিন। সোহাগ তাঁর কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,’কি করতে যাচ্ছিলে তুমি? মাহমুদ ভাই কিন্তু ভয়ংকর খেপে আছেন! আজকে তোমাকে ছাড়বে না!’
★
অতঃপর এয়ারপোর্ট থেকে যাবতীয় ফর্মালিটিজ সেরে মেহরিনকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো সবাই। এনা ড্রাইভ করছে। মেহরিন পেছনের সীটে সোহাগের সঙ্গে বসেছে। মাহমুদ বসেছে এনার পাশে। চারজনের একজনও কোন টু শব্দ করলো না। গাড়ি থামলো গিয়ে একেবারে কাজি অফিসের সামনে।
গাড়ি থেকে নেমে মেহরিনকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলো মাহমুদ। সোহাগ এবং এনা তাঁকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। প্রাথমিক অবস্থায় কিছুই বুঝতে পারলো না মেহরিন। চুপচাপ ওদের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই কাজি সাহেবকে দেখে অবাক হয়ে গেলো সে। গোলগোল চোখ করে সোহাগ এবং এনার দিকে চাইলো। ওরা দুজন হাসছে।
কাজি অফিসে আসার খবরটা ইরফান আহমেদকে ফোন করে জানালো মাহমুদ। খবর শুনে আধঘন্টার মাঝেই লায়লা শারাফত কে নিয়ে রওনা হলেন তিনি।
★
মাহমুদ ভেতরে ঢুকতেই মেহরিন দৌঁড়ে গেলো তাঁর দিকে। বিস্মিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’এসব কি হচ্ছে মাহমুদ? আমরা কাজি অফিসে কেন এসেছি? কি বলছে ওরা? কিসের বিয়ে হবে? কার বিয়ে? আমি কিন্তু কোন বিয়ে টিয়ে করবো না বলে দিলাম!’
জবাবে মাহমুদ ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো কেবল! তারপর পাশ কাটিয়ে সোহাগে পাশে চেয়ার টেনে বসলো।
ভয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলো না মেহরিন। আজকে মাহমুদকে একেবারে অন্যরকম লাগছে! বোঝাই যাচ্ছে, বাড়াবাড়ি করে বিশেষ লাভ হবে না। তাঁর কোন কথা শুনবে না মাহমুদ।
অতএব মুখ গোমড়া করে চুপচাপ এনার পাশে গিয়ে বসলো। এনা ফিসফিস করে বললো,’এমনিতেই মাহমুদ ভয়ানক রেগে আছে মেহরিন আপু। তারওপর আপনি ওকে আরো রাগিয়ে দিচ্ছেন। আমি নিশ্চিত আজকে আপনার খবর আছে।’
মেহরিন ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,’ভয় দেখিয়ো না তো এনা। আমি কি ওকে ভয় পাই?’, চোখেমুখে কৃত্রিম বিরক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো সে।
কিন্তু এনার ধারণা মনে মনে মহাখুশি মেহরিন! মুখে না বললেও এনা জানে মাহমুদকে ঠিক কতটা ভালোবাসে সে। মাহমুদের খুশির জন্যই তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মাহমুদের সত্যিকার খুশি যে তাঁর সঙ্গে। এইকথা বোধহয় আজকে বুঝতে পেরেছে।
বাস্তবিকই এতদিন বাদে বোধোদয় হয়েছে মেহরিনের। ভালোবাসার এমন বহিঃপ্রকাশে সত্যিই তাঁর ভেতরটা অনেকদিন বাদে প্রাণ খুলে হাসছে। মনে মনে মাহমুদকে দেখে বারবার শিহরিত হচ্ছে। বুকের ভেতর আনন্দের বাজনা বাজছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলো না।
#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৮
ইরফান সাহেব এবং লায়লা শারাফাত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো সবাইকে। তাঁরা এলে নির্বিঘ্নে বিয়ের কার্য সমাধা হয়ে গেলো। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার জন্য একবারের বেশি দুইবার আর বলা লাগলো না মেহরিনকে। বাধ্য মেয়ের মত চুপচাপ সাইন করে দিলো।
বিয়ে পড়ানোর শেষে মাহমুদ গম্ভীর মুখে তাঁর পাশে বসে রইলো।
ইরফান সাহেব এবং লায়লা শারাফাতের নিজেদের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছেন। সোহাগ এবং এনা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এইসুযোগে মেহরিন আলতো করে একটা হাত রাখলো মাহমুদের হাতের ওপর। বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের আনন্দ হচ্ছে। এইমুহূর্তে মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে একশো একটা চুমু খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে হাত রাখতেই মাহমুদ ঝট করে উঠে গিয়ে সোহাগের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিলো। পাত্তাই দিলো না মেহরিনকে। এনা সেটা দেখতে পেয়ে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হাসলো।
কথাবার্তা শেষে মেহরিনেরকে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন ইরফান আহমেদ।মাহমুদও সম্মতি জানিয়ে অফিসের দিকে রওনা হলো। সোহাগ এবং এনাও তাঁর পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো। মেহরিন হতবাক! নতুন বউকে এভাবে ফেলে রেখে কি করে যেতে পারে মাহমুদ? যাওয়ার সময় একটাবার মুখের দিকে তাকায় নি পর্যন্ত! লজ্জায় নিজেও মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারলো না।
অগত্যা ইরফান সাহেবের সঙ্গে বাসায় ফিরে যেতে হলো। এরপর সারাদিন আর মাহমুদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ হলো না। বাসায় এসে জানতে পারলো বড় করে বিয়ের অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত এই বাসাতেই থাকতে হবে। নিমিষেই মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাহমুদের নাম্বারে ডায়াল করলো দুবার। রাগ করে দুবারই ফোন কেটে দিলো মাহমুদ। মেহরিন মুখ ভার করে বসে রইলো।
★
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাত দশটায় দিকে মাহমুদ যখন বাসায় ফিরলো তখন ফ্ল্যাটে কারেন্ট জেনারেটর কিছুই নেই। পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকার। মোবাইলের টর্চ অন করতে যাবে এমন সময় রিংটোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে সোহাগের নম্বর ভেসে উঠেছে। রিসিভ করতেই সোহাগের উদ্বিগ্ন স্বর শোনা গেলো,’হ্যাঁ মাহমুদ ভাই আপনি কি বাসায় ফিরেছেন?’
-‘এই তো মাত্র ফিরলাম। কেন কোন সমস্যা? তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?’
-‘না মানে, একটা গোপন খবর আছে!’
-‘গোপন খবর? কি সেটা?’
-‘আসলে বস এইমাত্র আমাকে ফোন করে জানালেন সায়েদের বাবা নাকি উনাকে হুমকি দিয়েছেন তাঁর ছেলের অপমানের প্রতিশোধ সে নেবে। এর পরিণাম ভালো হবে না। তাই আপনাকে সাবধান করার জন্য ফোন করেছি।সবাই ভীষণ চিন্তায় আছে। বোঝেনই তো বেশ পাওয়ার লোক এরা।’
মাহমুদ পাত্তা দিলো না। মুচকি হেসে বললো,’ঠিক আছে। এবার তুমি ফোন রাখো। আমি ফ্রেশ হবো।’
-‘এতটা হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। আপনি প্লিজ সাবধানে থাকবেন। আপনার ওপরেই ওদের বাপ ছেলের ক্ষোভ বেশি।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে থাকবো। তুমিও সাবধানে থেকো।’
-‘ঠিক আছে। রাখছি আমি। কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবেন।’
সোহাগ ফোন কেটে দিলে টর্চ অন করলো মাহমুদ। রান্নাঘর থেকে হাতড়ে হাতড়ে মোম বের করলো। কিন্তু হঠাৎ করে ড্রয়িংরুম থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো।
শব্দটা পরপর দুবার শোনা গেলো। সতর্ক হয়ে গেলো মাহমুদ। মোমটা নিভিয়ে, টর্চ অফ করে দিলো। কোমরের ভাঁজ থেকে রিভলবার টা বের করে পা টিপেটিপে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলো। মোবাইলের হালকা আলোতে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটির দিকে রিভলভার তাক করতেই চাপা হাসিতে ফেটে পড়লো কেউ একজন। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে কুটিকুটি ছায়ামূর্তিটি।
-‘মেহরিন!’, রিভলভার নামিয়ে নিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। তাঁর অবস্থা দেখে মেহরিনের হাসি যেন থামেই না।
রিভলবারটা আলতো করে সোফার ওপর থ্রো করলো মাহমুদ। বামহাতে টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে বললো,’এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি? যদি গুলিটুলি লেগে যেতো?’
-‘বেশ হতো। তুমি তো সাজা দিতেই চেয়েছিলে!’
-‘এটা মোটেও মজা করার মত কোন বিষয় নয়।’
এগিয়ে গিয়ে মাহমুদের পায়ের পাতার ভর করে দাঁড়ালো মেহরিন। দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে আলতো করে চুমু খেলো। নেশাতুর কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,’আমি একদমই মজা করছি না। তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলে, কি চাও নি বলো?’
মাহমুদ অসাড়! সকালের সমস্ত রাগ নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো! মন্ত্রমুগ্ধের মতন স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাঁর ডান হাতটা সন্তর্পণে নিজের কোমরে স্থাপন করলো মেহরিন। মিষ্টি হেসে বললো,’অপরাধিনী হাজির। সকল শাস্তি মঞ্জুর!’
দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো মাহমুদ। সস্নেহে চুমু খেলো প্রেয়সীর দুইগালে।
চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আদুরে কন্ঠে বললো,’তুমি সত্যিই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’
মেহরিন আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। অভিযোগের সুরে বললো,’সকালে আমাকে রেখে কেন চলে গিয়েছিলে?’
-‘তুমি যে আমাকে ছেড়ে পালাচ্ছিলে?’
-‘সে তো তোমার কথা ভেবেই পালাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম আমি না থাকলে এনাকে নিয়ে সুখে সংসার করবে!’
মাহমুদ হাসলো। বললো,’তুমি ভাবলে কি করে সবকিছু জানার পরেও আমি তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো?’
-‘ভাবতে দোষ কি?’
-‘অবশ্যই দোষ আছে। আজ পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া অন্যকাউকে নিয়ে একটা চুমু খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভাবিনি আমি।আই নেভার থট অফ হেভিং আ কিস উইথ সামওয়ান এলস্। এক্সেপ্ট ইউ। সেখানে বিয়ে তো অনেক দূরের কথা।
-‘ইশশ! তবে যে সকালে ফেলে রেখে এলে?’
-‘সে তো তোমাকে শাস্তি দেবো ভেবেছিলাম।’
-‘এখন ভাবছো না?’, ফোঁড়ন কাটলো মেহরিন।
-‘ভাবছি কিন্তু তাঁর আগে একটা কথা বলো ফ্ল্যাটের চাবি পেলে কোথায়?’
-‘মাস্টার কী। বাবা দিয়েছিলেন।’
মাহমুদ হাসলো। সবাই মিলে যুক্তি করেই মেহরিনকে তাঁর বাসায় পাঠিয়েছে। ইরফান সাহেবও এতে যুক্ত আছেন ভেবে ভালো লাগলো। বুদ্ধিটা মন্দ নয়। বিয়ের রাতে বউ ছাড়া থাকা সত্যিই কষ্টকর হতো।
-‘এইজন্যই বুঝি সোহাগ আমাকে ফোন করে ভয় দেখিয়েছে?’
জবাবে তাঁকে ছেড়ে দিয়ে শব্দ করে হাসলো মেহরিন। তাঁর বুদ্ধিতেই কাজটা করেছে সোহাগ। নতুবা মাহমুদের রাগ ভাঙ্গানো এত সহজ হতো না।
মাহমুদ অতি আদুরে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তাঁর রাগী, অভিমানী প্রিয়তমার মুখের দিকে। বহুকাল বাদে এমন হাসিমুখ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। খামোখা রাগ দেখিয়ে এই সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করতে চাইলো না। দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’দেখি কাছে এসো। তোমাকে একটু ভালোবাসি।’
হাসি থামিয়ে লাজুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইলো মেহরিন। হঠাৎ করেই একরাশ লজ্জা এসে ভীড় করলো তাঁর সমস্ত শরীরে।
তার পরণে লাল জামদানি শাড়ি। হালকা সাজ, তারসাথে খোঁপায় বেলি ফুলের মালা। উদ্দেশ্য ছিলো যেভাবেই হোক মাহমুদের রাগ ভাঙ্গাবে।
কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে। শাড়ির কোনা চেপে ধরে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহমুদ সামান্য ঝুঁকে কাছে টেনে নিলো। কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বললো,’কি ব্যাপার বলতো? আজকে দেখছি লজ্জার লহর বইছে একেবারে।’
মেহরিন লাজুক মুখে মাথা নিচু করে ফেললো। লজ্জায় মাহমুদের চোখের দিকে সরাসরি চাইতে পারলো না সে।
মাহমুদ মুচকি হেসে বললো,’আজকে আমি খুব খুশি। তুমি যা চাইবে তাই দেবো। বলো কি চাও?’
প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মেহরিন। কিন্তু মাহমুদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে মুখ খুললো। অনুচ্চস্বরে ফিসফিস করে বললো,’এই বাসাতে থাকতে চাই।’
শব্দ করে হেসে ফেললো মাহমুদ। তাঁর নাকটা টেনে দিয়ে বললো,’সকালে তো খুব পালিয়ে যাচ্ছিলে। এখন এই বাসায় থাকতে চাই?’
মেহরিন জবাব দিলো না। আচমকাই চোখে পানি চলে এলো তাঁর। সে যে মাহমুদের ভালোর জন্যই মাহমুদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছিলো একথা বোধহয় কোনদিন বুঝবে না মাহমুদ। এই খোঁটা তাঁকে সারাজীবন শুনতে হবে।
মাহমুদ তাঁর কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে ফের হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। কান্নাকাটি থামাও! এই বাসাতে থাকতে চাও তো? থাকবে। একশোবার থাকবে। হাজার বার থাকবে। কিন্তু অনুষ্ঠানের পর। নইলে তোমার বাপ আমার মাথা ফাটিয়ে দেবে।’
-‘বাবার সঙ্গে যা বোঝার আমি বুঝবো।’
-‘এত তাড়া?’, সুযোগ পেয়ে মাহমুদও ফোঁড়ন কাটলো।
ফের লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মেহরিন।
-‘বলো। বলো। তাড়াতাড়ি বলো। আর? আর কি চাও?’
-‘আর তোমার ভালোবাসা!’, লজ্জাসত্ত্বেও মুখ ফস্কে কথাটা বলে ফেললো মেহরিন।
হাসি থেমে গেলো মাহমুদের। গাঢ় অনুরাগ, স্নেহের দৃষ্টিতে বেশকিছুক্ষণ চেয়ে রইলো প্রিয়তমার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে মুচকি হেসে বললো,’সেটা তোমাকে কখনো চেয়ে নিতে হবে না। তুমি অনেক আগেই আমার সমস্ত ভালোবাসা পেয়ে গেছো। আমার হৃদয়টা যে তোমার কাছেই জমা পড়ে ছিলো। অন্যকাউকে দেওয়ার সুযোগই হয় নি।’
-‘সে আমি জানি। আমি অন্য ভালোবাসার কথা বলছি।’
-‘আচ্ছা?’ অবাক হওয়ার ভান করলো মাহমুদ। বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,’তারমানে তুমি আমার চরিত্র হনন করতে চাইছো? কি তাইতো?’
অত্যাধিক লজ্জায় মেহরিনের মরণদশা। ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলো সে। চট করে তাঁর হাত ধরে ফেললো মাহমুদ। হাসি থামিয়ে বললো,’পালাচ্ছো কোথায়? চরিত্র হনন করবে না? আমি তো ভাবছি আগামী একমাস ছুটি নিয়ে নেবো। এই একমাস মাহমুদ সিদ্দিকি কোন কাজ করবে না। এই একমাস শুধু চরিত্র হনন চলবে।’
কান লাল হয়ে গেলো মেহিরিনের। লজ্জায় অস্বস্তিতে মাথা তুলতে পারলো না সে। মাহমুদের ধরে রাখা হাতটা মোচড়ামুচড়ি করলো ছাড়া পাওয়ার জন্য।
-‘কি হলো ডাকুরানী হঠাৎ এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? সে কি আমার প্রস্তাবে রাজি?’
-‘জানি না ছাড়ো।’
মাহমুদ ছাড়লো না। কোমরে চাপ দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,’পালালে তো হবে না। চরিত্র হননের দায়িত্বটা যে তোমার ওপরেই দিয়েছি।’
মেহরিন কাতর দৃষ্টি মাহমুদের মুখের দিকে চাইলো। লজ্জায় দিয়ে দিয়ে আজকে তাঁকে মেরে ফেলবে অসভ্যটা। অনুনয় করে বললো,’দোহাই তোমার। ছাড়ো। হাতে অনেক কাজ আছে আমার।’
‘কাজ?’, সম্মতিতে মাথা ঝাঁকালো মাহমুদ। চোখেমুখে হাসি! মেহরিনের দ্রুত ছাড়া পাওয়ার জন্য কোমরে আঁচল গুঁজে নিয়ে বললো,’ফ্রেশ হয়ে এসো। খাবে।’
-‘তারপর?’, মাহমুদের চোখেমুখে তখনো হাসি।
-‘জানি না।’
-‘না জানলে আমি বলছি। তারপর তোমার আমার চরিত্র হন..’
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না সে তার আগেই মেহরিন মুখ চেপে ধরলো। মাহমুদ তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বললো,’তারপর কেন? চলো এখনই শুরু করি!’
সে কথা শেষ করার আগেই মেহরিন ছুটে রান্নাঘরের দিকে পালিয়ে গেলো। মাহমুদ অট্টহাসি ঠেকিয়ে মৃদু হেসে বললো,’সাবধানে। পড়ে ব্যথা পাবে!’