ঘুনপোকা,পর্ব_২,৩

0
726

ঘুনপোকা,পর্ব_২,৩
মিম
পর্ব_২

– চারদিন পর বাবা আমাকে বললো, আজ বিকেলে মেয়ে দেখতে যাবো। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,

– মেয়ের বাড়ির লোকজন জানে আমি ডিভোর্সি?

বাবা বললো,

– হ্যাঁ জানে। জেনেই রাজি হয়েছে। ওদের মেয়েরও সমস্যা আছে৷
– কি সমস্যা?
– ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় মেয়েটা বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো ওর প্রেমিকের সাথে। আগেরদিন বিকেলে পালিয়ে গেলো পরদিন রাতে একাই ফিরে আসলো। পুরো এলাকা জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো মেয়ে বাসা থেকে পালিয়েছে৷ লোকে অনেক আজেবাজে কথা বলতো ওকে নিয়ে। কয়েকদিন বাদেই ওর বাবা স্ট্রোক করলো৷ অসুস্থ ছিলো অনেক দিন। মুখটা বেঁকে গিয়েছিলো। একটা হাত প্যারালাইজড ছিলো প্রায় দেড় বছরের মত। হাত এরপর ঠিক হয়ে গেলেও মুখটা এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি৷ কথায় সামান্য জড়তা আছে৷
– মেয়ের বাবা কি তোমার পরিচিত?
– হ্যাঁ। আমার অফিসের কলিগ ছিলো। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো উনার সঙ্গে। এখনো আছে। মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করি।
– আচ্ছা বাবা, মেয়েটা ফিরে এলো কেন?
– কেন ফিরে এসেছে সেটা স্পষ্ট কেউই জানে না। মেয়েটা কখনো বলেনি।
– এখন কি করে সে?
– মাস্টার্স করছে।
– নাম কি ওর?
– রুপন্তি। মেয়েটা খুব ভালো। আমার খুব পছন্দের। তোর মায়েরও ভীষণ পছন্দ৷ খুব সাংসারিক আর সরল মনের। কখনো কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করে না। যে যা বলে হাসিমুখে চুপচাপ শুনে চলে আসে। এমন মেয়ের সাথে যেকোনো ছেলে আজনম সংসার করতে পারবে নির্দ্বিধায়।

বাবার এই কথাগুলো আমার মাথায় গেঁথে গেলো। এমন মেয়েই আমার দরকার। নবনীকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য এই মেয়েটাই প্রয়োজন। আমার দোষ ত্রুটি যাই থাকুক চুপচাপ সংসার করে যাবে। সেদিন বিকেলে আমি আর আমার ফ্যামিলি গেলাম ওদের বাসায়। দোতলা পুরাতন একটা বাড়ি। রুপন্তীর দাদার আমলের তৈরী করা বাড়ি৷ বাড়ির সামনে ছোট্ট এক টুকরো উঠান। নিচতলায় থাকতো রুপন্তির ফুফুরা আর উপরতলায় রুপন্তিরা। ঘরভরা মানুষ ছিলো সেদিন। রুপন্তির ফুফুর ফ্যামিলি, ওর মামা খালারা সবাই ছিলো। বাসায় যাওয়ার পর একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো আমাকে। এত লোকজন দেখে সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিলো আমি মেয়ে দেখতে আসিনি, বিয়ে করতে এসেছি। রুপন্তির নিজের ফ্যামিলি খুব বড় না। আমাদের মতই ছোটখাটো। রুপন্তির মা নেই। ও জন্ম নেয়ার সময়ই মারা গিয়েছিলেন৷ ওর একটা বড় ভাই আছে যে বয়সে রুপন্তির চেয়ে অনেক বড়। কমপক্ষে ১৬-১৭ বছর তো হবেই। ওর সংসারে আরো দুজন মেম্বার হলো ভাইয়ের বউ আর ভাইয়ের একটা ছেলে রাহাত। রুপন্তির মা মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পরেই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেন আমার শ্বশুর। ওর বড় ভাই আর ভাবী ওকে নিজের সন্তানের মতই আগলে রাখতো। রাহাত আর রুপন্তির বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। চার বছরের ছোটবড়। কি যে সখ্যতা ওদের দুজনের! একদম বন্ধু……

মোবাইলে কল এসেছে সৈকতের। গল্প থামিয়ে কল রিসিভ করলো সে৷ কয়েক সেকেন্ড পর কল কেটে ইমরানকে বললো,

– নিচে ডেলিভারি ম্যান দাঁড়িয়ে আছে৷ এই টাকাটা নাও। পার্সেল নিয়ে টাকাটা দিয়ে আসো ওর হাতে।

হাত বাড়িয়ে সৈকতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রুম ছেড়ে ইমরান বেড়িয়ে গেলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সৈকত৷ রুমের একপাশে থাকা পারটেক্স বোর্ডের মাঝারি আলমারির শেষ তাক থেকে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গেঞ্জি আর ছোট্ট তয়লা বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। গায়ের শার্টটা খুলে বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়ালো সৈকত৷ নিজেকে খুব মনোযোগে একবার দেখে নিচ্ছে। চেহারায় একরাশ ক্লান্তি লেপ্টে আছে। চোখের নিচের কালচে দাগগুলো আগের চেয়ে আরো একটু গাড় হয়েছে৷ ট্যাপ ছেড়ে হাত ভিজিয়ে চুলগুলোতে রাখতেই চোখে পড়লো হাতের নখগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। হঠাৎই থমকে গেলো সৈকত৷ রুপন্তি এসে স্মৃতির দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। সে এই হালে দেখলে হয়তো নেইলকাটার এনে নখগুলো সযত্নে কেটে দিতো। চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতে আলুর রস লাগিয়ে দিতো। ক্লান্ত চেহারা দেখা মাত্রই বড় একমগ ভর্তি ঠান্ডা লেবুর শরবত হাতে ধরিয়ে বলতো,

– তোমাকে কি ক্লান্ত দেখাচ্ছে! শরবতটা খাও। লেবু চিনির সাথে আমার এত্তগুলা ভালোবাসাও মিশিয়েছি শরবতে৷ মুহূর্তেই এসব ক্লান্তি-টান্তি ভ্যানিশ হয়ে যাবে।

বুকচিরে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সৈকতের। অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি৷ সেই অনুভূতির খবর রুপন্তি জানে না৷ সেই যন্ত্রণায় তাকে কতটা ছটফট করতে হচ্ছে তাও রুপন্তির অজানা৷ রুপন্তি জানতে চায় না সেসব৷ কেন জানতে চায় না রুপন্তি? এসব ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সৈকতের। রাগ হচ্ছে তার। ভীষণ রাগ৷ চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে নোনাজলে। ট্যাপ থেকে পানি পড়ছে। দু হাত আঁজলা করে পানি নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে সে।

পুরো অফিসজুড়ে দুজন পিয়ন ছাড়া আর কেউই নেই৷ পিয়ন দুজন এখানেই থাকে সবসময়৷খাবার টেবিলের উপর রেখে ইমরান অপেক্ষা করছে সৈকতের জন্য৷ এই প্রথম সে অফিসে রাত কাটাবে। তাও আবার বিনাকাজে। গল্প শোনার লোভে হুট করেই রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। সারাদিন এই কাপড় পড়ে কাটিয়েছে। রাতটাও এটা গায়ে দিয়েই কাটাতে হবে। রাতে একবার গোসল করার অভ্যাস। আজ আর রাতে গোসলটাও করা হবে না। এসব ভাবতেই অস্বস্তি হচ্ছে খুব।

– ভ্রু কুঁচকে কি ভাবছো ইমরান?
– আপনি এই কাপড় পেলেন কোথায়?
– এখানে আমার দুই তিন সেট কাপড় রেখে দেই৷ হুটহাট অফিসে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কাপড় চোপড় সাথে থাকলে একদিকে খুব সুবিধা৷ ফ্রেশ হয়ে নরমাল কাপড় পড়ে রাত কাটানো যায়।
– আমার বাসা কাছেই। ১০ মিনিটের পথ৷ আমি তো ভাবছি বাসা থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে আসবো কি না৷
– তাহলে এক কাজ করো, খাবারটুকু খেয়ে বাসায় চলে যাও৷ আজ আর আসার প্রয়োজন নেই। আরেকদিন নাহয় গল্প শোনাবে৷
– না, না৷ আমি আজই শুনবো৷
– তাহলে বাসায় যেতে হবে না৷ আমার গেঞ্জি পরে নাও। ফ্রেশ হয়ে আসো। ডিনারটা করে নেই৷ এরপর নাহয় আস্তে ধীরে গল্প শোনাবো৷

সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে সৈকত। টেবিলের কাছ থেকে চেয়ার টেনে এনে ইমরান সোফার কাছাকাছি এসে বসেছে। খাবার শেষ করেছে মাত্রই। খাবার শেষে সিগারেট খাওয়া সৈকতের বহু পুরোনো অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। খাওয়া শেষ করে সোফায় বসেই সিগারেটটা ধরিয়েছে সে। এ্যাশ ট্রে তে সিগারেটের ছাঁই ফেলতে ফেলতে বললো,

– সেদিন ছিলো জুনের ১৩ তারিখ৷ রুপুর সাথে আমার প্রথম দেখা। লাইট পিংক কালারের সালোয়ার কামিজ পড়ে এসেছিলো আমার সামনে৷ সাদা জর্জেট ওড়নায় মাথা ঢেকে রেখেছিলো। আমার মুখোমুখি ওকে যখন বসানো হয় সেই সময়টা ছিলো পশ্চিমে সূর্য হেলে যাওয়ার মুহূর্ত৷ আমার মুখোমুখি সোফাটাতে ও এসে বসলো৷ পশ্চিমের জানালার গ্রিল গলে বিকেলের রোদ ওর চেহারার একপাশে এসে লেপ্টে ছিলো।ওর সেদিনের মুখটা আমার নজরে ভাসে জানো! খুব শুভ্র আর সাদামাটা একটা মুখ। মেকআপের কোনো চাকচিক্য নেই। চিকন করে কাজল জড়ানো একজোড়া চোখ আর নাকের বামপাশে চিকচিক করতে থাকা সাদা পাথরের নাকফুল৷ লম্বা চুলগুলো বেণী করা ছিলো৷ জর্জেট ওড়নার আড়ালে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ওর বেণীটা। ওর গাল পর্যন্ত সামনের কিছু চুল কাঁটা ছিলো৷ মুখের দুপাশ দখল করে নিয়েছিলো চুলগুলো৷ ফ্যানের বাতাসে হাল্কা উড়ছিলো। মুখের সামনে বারবার আসছিলো আর ও চুলগুলো বারবার কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছিলো। প্রায় আধাঘন্টা ওকে আমাদের সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো। আমি ওকে একবারের জন্যও আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতে দেখিনি৷ বাবা মা আর সাবিহা যা জিজ্ঞেস করেছে ও শুধু মাথা নিচু করে উত্তর দিয়ে গেছে।
– আপনি কিছু জিজ্ঞেস করেননি?
– না। আমি চাচ্ছিলাম আলাদা বসে কথা বলতে। কেন যেনো মনে হচ্ছিলো ও এই বিয়েতে রাজি না। আমি চাচ্ছিলাম আলাদা বসে ওর সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু খোলাখুলি কথা বলে নেই।
– এমন মনে হলো কেন?
– ও আমার দিকে একবারের জন্যও তাকায়নি৷ কেন তাকাবে না? যার সাথে বিয়ের কথা চলছে তাকে তো সবাই দেখতে চাইবে তাই না?
– হুম, তা চাইবে। তারপর? কথা কি বলতে পেরেছিলেন?
– না। মা আমার পাশে বসা ছিলো। আমাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি রে মেয়ে পছন্দ হয়েছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ হয়েছে৷
মা আবার জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে করা যায়?
আমার তখন কি হলো আমি জানি না৷ আমার কাছে মনে হচ্ছিলো রুপু অসম্ভব শান্ত একটা মেয়ে৷ হাজবেন্ড কিংবা সংসার নিয়ে আহামরি চাহিদা আছে বলে মনে হয় না। যেভাবে রাখবো সেভাবেই থাকবে৷ আর বাবা তো বলেছিলোই এমন মেয়ের সাথে জনম জনম সংসার করা যায়৷ আমি হুট করেই মা কে হ্যাঁ বলে দিলাম। সাথে এটাও বললাম, এমন মেয়েই আমি খুঁজছিলাম৷

ব্যস….. অতটুকুতেই কাজ হয়ে গেলো৷ আমার মা ভরা মজলিসে বলে দিলো মেয়েপক্ষের আপত্তি না থাকলে তিনি আজই আংটি পড়াতে চান। রুপুর ভাই আর বাবা সাথে সাথেই সায় দিয়ে দিলো৷ আমার মা তো খুশিতে আটখানা হয়ে পার্স থেকে আংটি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো,

– কি সুন্দর মেয়েটা! একদম বাচ্চা বাচ্চা মুখ। কত্ত আদর লাগে দেখতে! তোর বাবা বললো খুব লক্ষ্মী। চেহারা দেখেই তো বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা কি লক্ষ্মী। ওকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আজই আংটি পড়িয়ে যাবো৷

আমিও মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে আংটি হাতে নিয়ে বসে রইলাম রুপুকে আমার পাশে এনে বসানোর অপেক্ষায়। রুপুকে ধরে ওর ভাবী আমার আর মায়ের মাঝে এনে বসিয়ে দিলো। আমার মা রুপুর হাত ধরে আমার সামনে এগিয়ে দিলো আংটি পড়ানোর জন্য৷ রুপু তখনও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আংটি পড়ানোর ঠিক আগ মুহূর্তে ফিসফিস করে ওকে বললাম,

– আপনি কি বিয়েতে রাজি না?

রুপু খুব আস্তে শব্দ করলো,

– হুম।

আংটি পড়াতে যাবো ঠিক সে সময় রুপুর ফুফু বলে উঠলো আজই বিয়ে করতে৷ এই কথা শুনে আমার মা সাথে সাথেই আমার বাবাকে বললো,

– সৈকতের বাবা, বিয়েটা করিয়ে ফেললেই বোধ হয় ভালো হয়। তাই না বলো?

বাবা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করলো,

– ভাই আপনার কি মতামত?

আমার শ্বশুর উপস্থিত সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালো। সবার চেহারা দেখার পর বললো, উনিও একমত।

– বিয়ে হয়ে গেলো?
– হুম। সেদিনই সাড়ে নয়টায় বিয়ে হয়ে গেলো।
– এত জলদি? কোনো চেনা জানা ছাড়াই? কোনো কথাই তো বললেন না ভাবীর সাথে।
– আমি কেন যেনো সেদিন চুপ ছিলাম! বাবা মা যা বলছিলো আমি সব মেনে যাচ্ছিলাম৷ কেন মেনে নিচ্ছিলাম তা জানি না। আমি কিন্তু চুপচাপ বাবা মায়ের কথা মেনে নেয়ার মত ছেলে না। কিংবা চেনা জানাহীন কোনো মেয়েকে বিয়ে করবো এমন মানুষও না৷ কিন্তু সেদিন সবকিছুই বিপরীত ঘটছিলো৷ সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো। ঝড়ের গতিতে একটা অচেনা অজানা মেয়ে আমার বিয়ে করা বউ হয়ে গেলো। তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না রুপন্তি আসলে কি? যাকে আমি শান্ত শীতল চাঁদ ভেবেছিলাম সে আসলে একটা টর্নেডো৷ রুপন্তি নামক এই টর্নেডো আমার জীবনে এলো আর এই আমিকে একদম এলোমেলো করে দিলো।

হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো সৈকত। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মাথার চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে একদফা ঠিক করে নিলো। ইমরান কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। লোকটা টর্নেডোকে বিয়ে করেছে বলে থেমে গেলো৷ কেন টর্নেডো বললো, সেই টর্নেডো তার জীবনে কি কি আঘাত হেনেছে এসব তো জানার বাকি৷ এমন টানটান মূহুর্তে কেও গল্প বলা থামিয়ে দেয়! কৌতূহলের পীড়াপীড়িতে ইমরান বলেই ফেললো,

– চুল পরেও ঠিক করা যাবে। আগে কাহিনি বলেন।

সৈকত মুচকি হাসলো৷ বললো,

– আছেই তো সারারাত বাকি। ধীরে ধীরেই নাহয় শুনো।
– না, না৷ আমি বিরতি দিয়ে গল্প শুনতে পারি না৷ অস্থির হয়ে যাই একদম।
– রুপুও খুব অস্থির স্বভাবের ছিলো। মাথায় যখন যা আসতো তাই ই করে বসতো৷ তবে সবসময় সবার সাথে করতো না৷ বেশিরভাগ পাগলামি করতো আমার সাথেই৷ কত যে অত্যাচার করতো!
– করতো মানে? এখন করে না?
– এখনও করে। তবে অত্যাচারের ধরণ বদলে গেছে।
– কেমন?
– বলবো৷ পুরোটাই বলবো। পুরো গল্পটা শোনানোর জন্যই তো তোমাকে সারারাতের জন্য রেখে দিয়েছি।
– বিয়ের পর কি হলো?
– কোনোরকমে আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো। ওদের বাসা থেকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমার বাসায় ফিরতে রাত একটা বেজে গেলো।
– বউসহ ফিরেছিলেন?
– হুম। রুপুকে সাথেই নিয়ে এসেছিলাম। নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে পা রাখে একগাদা মানুষকে সামনে রেখে। বরণ করা হয় মিষ্টি মুখ করিয়ে৷ রুপুর বেলায় তেমন কিছুই হলো না। ওরকম কোনো প্রিপারেশন আমাদের ছিলোই না৷ আমার বিয়েতে আমার দুই মামার ফ্যামিলি, এক ফুফুর ফ্যামিলি আর আমার চার পাঁচটা বন্ধু উপস্থিত ছিলো। ওরা সবাই যার যার মত বিয়ের দাওয়াত খেয়ে ওখান থেকেই বাসায় ফিরে গেলো। আর আমরা চারজন বাসায় ফিরলাম নতুন বউ নিয়ে৷ গেস্ট বলতে শুধু রুপন্তির ভাইয়ের ছেলেটা এসেছিলো আমাদের সাথে। দুইদিনের জন্য পাঠানো হয়েছিলো ওকে এই বাসায়৷ খালিমুখেই রুপুকে বাসায় আনা হলো। কারণ আমাদের বাসায় তখন মিষ্টি ছিলো না৷
– এত তারাহুড়ো করে বিয়ে না করলেও তো পারতেন। সপ্তাহখানেক সময় কিন্তু নেয়া যেতো। কিংবা বিয়ে করেছেন ভালো কথা, বউ না আনলেও তো চলতো৷ পরেও তো তাকে আনা যেতো। তাই না?
– হ্যাঁ, তা যেতো৷ কিন্তু তখন আমাদের সবার মাথায় কি পোকা ঢুকেছিলো কে জানে! বিশেষ করে আমার মা আর রুপুর ফুফু এই দুজনের মাথায়ই পোকা একটু বেশিই নড়াচড়া করছিলো।
– তারপর?
– দেড়টা নাগাদ যার যার ঘরে চলে আসলাম। রুপুর সাথে তখন পর্যন্ত আমার কোনো কথা হয়নি৷ সেই যে বিকেলে একটা কথা হয়েছিলো? ব্যস, অতটুকুই।
– কথা হলো না কেন?
– কি কথা বলতাম? সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন সে৷ তারউপর ওর সঙ্গে একবারের জন্যও আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ পাইনি। রুপুও কথা বলার চেষ্টা করেনি। এসব কারণেই আর কথা বলা হয়নি।
– নিজের ঘরে এসে কথা বলতে পেরেছিলেন তো? নাকি সেদিন আর কথাই হয়নি?
– হয়েছে। রুপুই কথা বলেছিলো প্রথম। ঘরের দরজা আটকে আমি ভাবছিলাম কি কথা বলা যায়! ভাবতে ভাবতে রুপুই শুরু করলো৷ লাল রঙের শাড়ীটার আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকেছিলো৷ আমি দরজা আটকে দিতেই মাথার ঘোমটা ফেলে ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা ওর লাগেজটার পাশে বসে পড়লো। লাগেজ থেকে একটা কাঠের বক্স বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– এটা আপনার গিফট৷

আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম৷ হঠাৎ গিফট পেলে তো চমকে যাওয়ারই কথা! আমি বক্সটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– কিসের গিফট?

ও বললো,
– আজ আমাদের বাসর না? বাসর রাতে গিফট দিতে হয় তো। জানেন না আপনি?

আমি রুপুর দিকে ভালো করে তাকালাম। ও ফ্লোরে আসন ধরে বসে আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো৷ এতক্ষণ যেই শান্ত চুপচাপ আর লাজুক রুপুকে দেখছিলাম এটা সেই রুপু না৷ ওর চোখে মুখে শান্ত আর চুপচাপ স্বভাবের ছিঁটা ফোঁটাও ছিলো না৷ চেহারা আর হাসি দেখে তখন মনে হচ্ছিল এই মেয়ে খুব দুষ্ট৷ এই যে আমি অপরিচিত একজন যার সাথে ও আজ থেকে রুম শেয়ার করবে সেসব নিয়ে ওর কোনো ভাবনাই নেই। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো সব কিছু স্বাভাবিক আর আমি ওর পূর্ব পরিচিত৷ বক্সটা আমি হাতে নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ওকে দেখছিলাম, ওকে বুঝার চেষ্টা করছিলাম৷ বক্সটা খুলছিনা বলে রুপু আমাকে বলে উঠলো,

– এখনই এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকলে চলবে? সারারাত পড়ে আছে। আমি কি কোথাও চলে যাচ্ছি? থাকবো তো আপনার সামনেই৷ দেখতে পারবেন তো আমাকে। এখন গিফটটা একটু খুলে দেখুন।
– কি গিফট করেছিলো উনি?
– বক্সে একটা আফটার শেইভ, এক প্যাকেট সিগারেট, একটা লাইটার আর একটা পারফিউম ছিলো৷ আমি অবাক হওয়ার আরেক ধাপে পৌঁছালাম। আমি জানতাম স্ত্রী সম্প্রদায় কখনোই হাজবেন্ডের সিগারেটের অভ্যাস সহ্য করতে পারে না৷ অথচ রুপু আমাকে লাইটারসহ সিগারেট গিফট করেছে!

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আমার সিগারেটের অভ্যাস আছে সেটা আপনি কিভাবে জানেন?
– আপনার ঠোঁট দেখে বুঝেছি।
– আমার দিকে তো একবারও তাকাতে দেখিনি!
– আরেহ্ দেখেছি দেখেছি। কারো চেহারা দেখার জন্য কি ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে হয় নাকি? এক মুহূর্তই যথেষ্ট।
– তাই বলে সিগারেট গিফট করবেন?
– কেন? কি সমস্যা?
– ওয়াইফরা তো কখনোই সিগারেটের অভ্যাস মেনে নিতে পারে না।
– ওহ্! তাই নাকি! আমার তো ভালোই লাগে। সেক্সি স্মেল। যে কয়টা গিফট করেছি সবগুলোর স্মেল আমার কাছে ভীষণ সেক্সি লাগে। বিশেষ করে ঐ আফটার শেইভটা। আমার ভাইয়ের ছেলেটা আছে না? রাহাত? ওকে দিয়ে সব কিনে আনিয়েছি। রাহাত আমার হাতে বক্সটা দিতেই কি এক দুষ্ট খেয়াল মাথায় এসেছিলো জানেন?
– কি?
– শুনলে তো বলবেন মেয়েটা বড্ড নষ্ট খেয়ালের। তবুও বলি….. সম্পর্কে তো আপনি আমার হাজবেন্ড। আপনি নষ্ট ভাবেন আর মিষ্টি ভাবেন আজীবন তো আপনার হয়েই থাকবো৷ আপনার কাছে আর লজ্জা করে লাভ কি? তো যা বলছিলাম, বক্সটা হাতে নিতেই খেয়াল এলো আপনি পারফিউম আর আফটার শেইভ মেখে সিগারেট মুখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। একদম আমার কাছে এসে আমার মুখ বরাবর সব ধোঁয়া ফুঁ মেরে ছেড়ে দিলেন। পারফিউম, আফটার শেইভ আর সিগারেটের ধোঁয়া সবগুলোর ঘ্রান মিলেমিশে একাকার। ফ্যানের বাতাসে সেই ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের সবখানে। আমার পুরো ঘর জুড়ে শুধু সেক্সি স্মেল। মনভরে সেই ঘ্রান নাক দিয়ে টানতেই মাতাল হবো হবো এমন সময় আপনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু দিয়ে দিলেন।

ও এতটুকু বলেই মুখ চেপে হাসতে শুরু করলো। আর আমি! ও খোদা বলে মনে মনে দিলাম এক চিৎকার। কেও শুনলো না আমার সেই চিৎকার। কেও দেখলো না আমার সেই ভয়ে ছোট হয়ে যাওয়া আত্মা। ওর কথা শুনে আমি পুরোপুরি জমে গিয়েছিলাম ইমরান। ভাবতে লাগলাম, এটা আমি কাকে বিয়ে করেছি!

#পর্ব_৩

উল্টোহাতে মুখ চেপে হাসছে ইমরান। মাথা নিচু করে হাসছে সৈকতও। খানিক সময় বাদে হাসি থামিয়ে ইমরান বললো,

– এতটুকু শুনে মনে হচ্ছে উনার সাথে কাটানো সময়গুলো খুব মজার ছিলো। তাই না?
– উহুম। এত জলদি গল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী দেয়া ঠিক না। গল্পের মাঝামাঝি তো আসতে দাও৷

চুপ করে রইলো ইমরান। পরবর্তী অংশটুকু শোনার জন্য তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। দু’হাত মাথার পিছনে রেখে হেলান দিয়ে বসলো সৈকত। এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে আয়েশ করে বসলো। নিজের অতীতে আবারো ডুব দিলো সে৷
-আমি বসেই রইলাম। রুপুকে নিয়ে এটা সেটা ভাবতে থাকলাম। এরমাঝে রুপু ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসলো৷ আয়নায় রুপুকে দেখা যাচ্ছিলো। আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে রুপুকে দেখছিলাম। ও খুব যত্ন করে চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিলো আর গুনগুন করে গান গাচ্ছিলো। সে এই বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছে তাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো এটা ওরই ঘর। আর আমি এমন চুপচাপ বসে ছিলাম যে কেউ দেখলে হয়তো ভাবতো এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি এই বাড়ির নতুন জামাই৷ তাই লজ্জায় চুপ করে বসে আছি।
– আপনি চুপ হয়ে ছিলেন কেন? ভাবীর কথা শুনে?
– হ্যাঁ। ও অস্বাভাবিক রকমে স্বাভাবিক আচরন করছিলো৷ তারউপর তখন কি সব বলে ফেললো না? আমি আসলে একদম বোকা বনে গিয়েছিলাম ওর কথায় আর আচরণে। কি করবো বা কি বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না।
– সারারাত কি ওভাবেই পার করেছেন নাকি কথা বলার মত কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন?
– রুপন্তি তোমার পাশে বসে থাকবে আর তুমি চুপচাপ থাকবে এটা অসম্ভব। কথা তোমাকে বলতে হবেই৷ আমি আয়নায় তাকিয়ে ওকে দেখছি এটা ও খেয়াল করলো। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কি দেখছেন? হুম? আমার চুল দেখছেন?

আমি উত্তর দিবো ঠিক তখনই ও আমাকে থামিয়ে নিজেই বললো,

– দূর থেকে বসে কি দেখছেন? কাছে আসুন। আমার হাত থেকে চিরুনিটা নিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে দিন। এক কাজে তিন কাজ হবে। এক, আমার চুলগুলো আঁচড়ানো হবে। দুই, এই বাহানায় আমার চুলগুলো একটু ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। তিন, কাছাকাছি বসে আমাদের একটু সময়ও কাটানো হবে।
– চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন?
– উহুম।
– কেন? সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটাতে পারতেন। আমি তো বলবো আপনার ওয়াইফ খুবই রোমান্টিক।
– আমার তখন মনে হচ্ছিলো আমি একটা পাগল ঘরে তুলে এনেছি৷ সদ্য বিয়ে করা বউকে যখন তুমি পাগল হিসেবে আবিষ্কার করবে তখন আর এই জগত সংসার তোমার ভালো লাগবে না৷ রসে টইটম্বুর কথাবার্তাও মনে হবে তেঁতো বিষ। তারপর শোনো কি হলো, আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রুপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? আমার কাছে কিসের লজ্জা বলুন তো? আমি তো আপনার বউ। বিয়ে করা আপন বউ৷ লজ্জা টজ্জা ঝেড়ে ফেলুন তো।
– ঠিকই তো বলেছে। লজ্জা পেয়ে লাভ কি?
– আমি কি লজ্জা পাচ্ছিলাম? না তো। আমি রুপুকে নিয়ে খুব দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমি যেমন ভেবেছিলাম রুপু যে তেমন না সেটা বুঝতেই পারছিলাম৷ এমনটা তো আমি আশা করিনি৷ আমার প্রয়োজন ছিলো একদম চুপচাপ শান্ত নিরীহ একটা মানুষ যে কখনোই কোনোকিছুতে অভিযোগ করবে না। রুপু মনে যা আসে তাই বলে দেয়। এই ধরনের মানুষ কখনোই চুপচাপ সহ্য করার মত না। পান থেকে চুন খসলেই আমার সাথে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলবে। নিজেকে বিশাল অপরাধী মনে হচ্ছিলো। বাবা মায়ের কথা চুপচাপ মেনে নিয়ে নিজের জীবন ধ্বংস করা অপরাধী৷ মনে মনে বারবার একই প্রশ্ন করতে থাকলাম, আমি তো বাবা মায়ের অবাধ্য ছেলে। তাহলে আজ কেন বাধ্য হতে গেলাম?
– তারপর?
– রুপু চুলগুলো পাঞ্চক্লিপে আটকে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। খাটের মাঝে কোলবালিশ দিয়ে বললো,

– আপনি তো লজ্জা পাচ্ছেন তাই মাঝে বালিশ দিয়ে দিলাম। কাপড় পাল্টে ঘুমিয়ে পড়ুন। গুড নাইট।

মুখের উপর ওড়না দিয়ে ঢেকে রুপু শুয়ে রইলো। আর আমি ওড়নায় ঢাকা রুপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ ওকে ডেকে আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,

– তুমি তো মোটেও শান্ত না। চুপচাপও না৷ তাহলে বিকেলে ওরকম ঢঙ করলে কেন? এতবড় ভাওতাবাজি কেন করলে রুপন্তি?

– দোষ কিন্তু একতরফা দিয়ে দিলেন।

ভ্রু কুঁচকে ইমরানকে সৈকত জিজ্ঞেস করলো,

– একতরফা? বুঝলাম না ঠিক।
– হুম, একতরফাই তো। উনি নাহয় ঢঙ করেছে, আপনিও তো মেয়েকে না জেনে বুঝেই বিয়ে করে ফেললেন।
– হ্যাঁ সে হিসেবে বলতে পারো দোষটা আমি একতরফাই দিয়েছিলাম।
– সে রাতে ঘুম হয়েছিলো?
– শেষরাতের দিকে ঘুম এসেছিলো৷
– ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কি এসবই ভাবছিলেন?
– উহুম, শুধু রুপুর অদ্ভুত আচরন নিয়ে না৷ আরো কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ও আমাকে গিফট করেছে অথচ আমি ওকে কিছুই গিফট করিনি। ওকে কিছু গিফট করতে হবে বা করা উচিত এই ব্যাপারটা আমার মাথায় একদমই আসেনি। ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ লজ্জাজনক ছিলো৷ ক্ষণে ক্ষণে মাথায় খোঁচাচ্ছিলো। তাছাড়া হুট করে বিয়ে শাদী হয়েছে অফিসের কাউকেই জানানো হয়নি৷ পরদিন সকালেই অফিস ছিলো। ছুটিও নেয়া হয়নি৷ ভাবলাম পরদিন মিষ্টি নিয়ে যাবো অফিসে। সবাইকে খবরটা জানাবো৷ শনি আর রবিবার দুদিন অফিসে যাবো। ইম্পরট্যান্ট কিছু কাজ ছিলো সেগুলো সেড়ে বাসায় থাকবো সপ্তাহখানেক। বাসায় বসে রুপন্তি নামক এই অদ্ভুত মেয়েটাকে জানবো, বুঝবো। আর সবচেয়ে বড় ভাবনা হলো কাল সকালেই সাবিহার কাছ থেকে আমাদের বিয়ের ছবি নিয়ে প্রোফাইল পিকচার চেইঞ্জ করবো এবং সেই ছবি কোনো না কোনোভাবে নবনীর ইনবক্সে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।
– বিয়েটা তো তাহলে একরকম জেদের বশেই করেছিলেন।
– একরকম না, পুরোটাই ছিলো জেদের বশে। নবনীকে আমি দেখিয়ে ছাড়বো এটা একদম মনে গেঁথে গিয়েছিলো৷ আমার কাঁধে দোষ চাপিয়ে ও অন্য কারো সাথে হাসিখুশি জীবন পার করবে এটা আমার সহ্য হচ্ছিল না৷ আমি ওকে দেখাতে চাচ্ছিলাম তোমাকে ছাড়া আমিও ভালো থাকতে পারি৷ বিবাহিত জীবন আমিও সুন্দর করতে জানি। আমার বউ আমাকে পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে সংসার করছে৷
– জেদের বশে আর যাই হোক সংসার সুখের হওয়ার কথা না সৈকত ভাইয়া।
– সুখী হতে পেরেছি কি পারিনি সে প্রসঙ্গে পরে আসবো৷ আগে গল্প শোনো, তারপর নাহয় পরিণতি নিয়ে ভেবো৷
– হুম, হুম। আপনি বলুন না!
– পরদিন সকালে আমার ঘুম কিভাবে ভেঙেছিলো জানো?
– কিভাবে?
– রুপু আমার চোখের পাতা টেনে ধরে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিলো। ঘড়িতে তখন বাজে ছয়টা পনেরো। ঘুমিয়েছি সাড়ে তিনটার দিকে। ছয়টা বাজেই সে আমাকে এমন অাজব কায়দায় ঘুম থেকে উঠালো। আমার ঘুম ভাঙতেই দেখতে পেলাম সামনের সব কয়টা দাঁত বের করে হাসছে। কি যে বিদঘুটে লাগছিলো ওর হাসিটা!
– কেন? দাঁত সুন্দর না?
– আরেহ্ না। দাঁত সুন্দর ছিলো। অসময়ে আরামের ঘুম কেও ভেঙে দেয়ার পর তখন নিশ্চয়ই সেই মানুষটার হাসি তোমার অসহ্য লাগবে। তাই না?
– হ্যাঁ, তা তো লাগবেই।
– আমারও লেগেছিলো। ঘুম ভাঙিয়ে রুপু আমাকে বললো,

জরুরী দুইটা কথা বলার জন্য আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছি। এক, আমি আপনাকে আজ থেকে তুমি করে বলবো৷ আর দুই, আপনাকে আজ থেকে আমি সিকু বলে ডাকবো। সৈকতরে শর্টফর্ম হচ্ছে সিকু। সিসিমপুর শো হয় না টিভিতে? ঐ শো তে একটা ক্যারেক্টারের নাম হচ্ছে সিকু৷ ওখান থেকেই ইন্সপায়ার হয়ে আপনার এই নামটা ঠিক করেছি। সুন্দর না?

নাক কুঁচকে এলো ইমরানের। বললো,

– সিকু! ভাবী আপনাকে সিকু বলে ডাকে?
– হ্যাঁ, সিকু। মাত্র একরাতের ব্যবধানে আমি সৈকত থেকে সিকু হয়ে গেলাম। আমার ৩২ বছরের পুরোনো নামটার করুণ দশা হয়ে গেলো।

শব্দ করে হাসছে ইমরান। ইমরান সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো,

– নিজের এমন অদ্ভুত নাম শুনে আগেরদিনের মত মনে মনে ও খোদা বলে চিৎকার করেননি?

হেসে ফেললো সৈকত৷ সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরো একটা সিগারেট বের করে বললো,

– সিকু নামটা নিয়ে তখন এতটাও ভাবিনি। যে ব্যাপারটা মাথায় হাতুরিপেটা করছিলো সেটা হচ্ছে রুপন্তি খুবই বিশ্রিভাবে আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে বকা দেই৷ কিন্তু দেইনি৷ নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলাম। ও নতুন এসেছে এই বাসায়, ধমক দেয়া ঠিক হবে না৷ আমি শুধু শান্ত কন্ঠে বললাম, আমি আটটা পর্যন্ত ঘুমাবো। আমাকে যেনো ডাকাডাকি না করা হয়।
– ঘুমাতে দিয়েছিলো আপনাকে? মনে তো হয় না!
– বাহ্! এত জলদি রুপুকে বুঝে ফেললে!
– সত্যিই ঘুমাতে দেয়নি?
– না৷ সামান্য আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার সমস্যা আছে। ও একটু পরপরই দরজা খুলে রুমে আসছে আর যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে, শব্দ করে হাসছে। খাটে এসে কিছুক্ষন পরপরই ধুপ করে বসছে। মানে ঘরের ভিতর কিছু না কিছু আওয়াজ সে করেই যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইলাম। জানতাম আমাকে সজাগ দেখলেই কথা বলা শুরু করবে। বেশি মেজাজ খারাপ হলে আমি চুপ হয়ে যাই জানোই তো। কেন হই জানো?
– কেন?
– উল্টাপাল্টা কিছু যেন না বলি সেজন্য। আমি চাচ্ছিলাম না ওকে আজেবাজে কিছু শোনাতে। ও আমার সাথে তখন কথা বলতে আসলেই নির্ঘাৎ কিছু না কিছু শুনিয়ে দিতাম। বিয়ের পরদিন সকালেই আমি রুপন্তিকে নিয়ে ভাবতেই হাঁপিয়ে গেলাম। এত অস্থির একটা মেয়ে! একজায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না৷ অকারণে এখান থেকে সেখানে আসা যাওয়া চলতেই থাকে। আর অদ্ভুত কথাবার্তা তো আছেই। এমন একটা মেয়ের সাথে আমি সংসার কিভাবে করবো সেসব ভাবতেই আমার দম আটকে আসছিলো৷

আঙুলের ভাঁজে থাকা সিগারেটটা ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে আগুন ধরালো সৈকত। প্রথম টান দিয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সৈকত বললো,

– এই লাইটারটা রুপন্তির দেয়া। যত্ন করে রেখে দিয়েছি। সবসময় ব্যবহার করি না। মাঝেমধ্যে করি। বছরে তিন চারবার।
– আর বাকি গিফটগুলো? সেগুলো কি আছে?
– সিগারেটগুলো অনেক আগেই শেষ।পারফিউম আর আফটার শেইভের বোতলগুলো এখনও আছে। রেখে দিয়েছি আমার আলমারিতে। এই জিনিসগুলোর মূল্য আমার কাছে কতখানি তা কাওকে বুঝানো সম্ভব না৷ এই জিনিসগুলো একদিন আমার কাছে এতটা মূল্যবান হয়ে যাবে জানলে আমি সিগারেটের প্যাকেটও ফেলতাম না৷ রেখে দিতাম ঐ বক্সটাতে৷
– তখন কি মূল্যবান ছিলো না?
– উহুম। অন্য দশটা মানুষের দেয়া গিফটের মতই সাধারণ কোনো গিফট মনে হয়েছিলো৷ এটা আমার রুপন্তির দেয়া প্রথম গিফট এই স্পেশাল ফিলিং টা তখন আসেনি৷ আসলে রুপন্তি তখন শুধু রুপন্তি ছিলো আমার কাছে। তাই ওর গিফটগুলোও সাধারণই ছিলো৷ রুপন্তিকে যখন আমার নিজের মনে হলো ঠিক তখন থেকে ওর সবকিছুই আমার কাছে স্পেশাল মনে হতে লাগলো।

বাহিরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার গ্লাসে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। একমনে সিগারেট ফুঁকছে সৈকত৷ জানালার গ্লাসে তাকিয়ে একটু একটু করে জমতে থাকা পানিগুলো দেখছে সে। ইমরান চেয়ার ছেড়ে উঠে সোফার অন্য অংশে বসলো। আসন ধরে বসে সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো,

– উনাকে কি গিফট করেছিলেন?
– গোল্ড ব্রেসলেট।
– সেদিনই তো প্রথম আপনাদের দুজনের একসাথে ঘুরতে বের হওয়া তাই না?
– উহুম, দুজন না। চারজন।
– মানে?
– শুধু আমরা দুজন ঘুরতে বেড়িয়েছি এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। প্রতিবার ও পুরো ফ্যামিলি সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করতো। সাবিহাকে ছাড়া রুপু বেড়াতে যেতেই চাইতো না৷ সাবিহা লজ্জা পেতো আমাদের দুজনের সাথে বেড়াতে যেতে। ও কখনোই আমাদের সাথে যেতে চাইতো না৷ সাবিহা ভাবতো ও আমাদের সঙ্গে গেলে আমাদের বিরক্ত করা হবে৷ ও চাইতো আমরা আলাদা একটু সময় কাটাই। মাঝেমধ্যে রুপু ওকে ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে পারতো আবার কখনো পারতো না। সাবিহা দরজা আটকে নিজের ঘরে বসে থাকতো কিংবা পড়ার বাহানায় বান্ধবীর বাসায় চলে যেতো৷ আমার মা বাবাকেও সাথে করে নিয়ে যেতো কখনো কখনো।
– উনি কি সবাইকে সাথে নিয়ে থাকতে পছন্দ করে?
– হুম, খুব৷ ফ্যামিলিই ওর সব। বিশেষ করে সাবিহা। অজানা কারনবশত সাবিহার প্রতি ওর বিশেষ দুর্বলতা ছিলো একদম প্রথম দিন থেকেই৷ সাবিহাও রুপু বলতে বেহুশ। রুপু যদি বলে সাবিহা ডানে যাও তো যাবে, যদি বলে বামে যাও তো যাবে৷ আঠার মত লেগে থাকতো দুজন দুজনের সাথে৷ বিয়ের পর রুপু যতবার বাবার বাড়ি গিয়েছে একবারও সাবিহাকে রেখে যায়নি। প্রত্যেকবার ওকে সাথে করে নিয়ে যেতো। শুধু ওর বাবার বাড়ি কেন? ও যেখানে বেড়াতে যেতো সেখানে সাবিহাকে ধরে নিয়ে যেতো। এমনকি ফ্রেন্ডদের সাথে হ্যাংআউটে গেলেও সাবিহাকে রেখে যেতো না৷ একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে রুপুর ফ্রেন্ডরা সাবিহার ফ্রেন্ড হয়ে গেলো।
– আপনার বোন আর ওয়াইফ কি সেইম এজ ছিলো?
– নাহ্। সাবিহা তিনবছরের ছোট ছিলো রুপুর চেয়ে।
– বয়সের পার্থক্য তো খুব বেশি না৷ এজন্যই হয়তো এত মিল ছিলো।
– উহুম। বয়সের পার্থক্য বেশি হলেও মিল থাকতো। বয়স বিবেচনা করে মেলামেশা করার মত মেয়ে রুপু না৷ যেকোনো বয়সী মানুষের সাথে দারুন ভাব জমাতে জানে মেয়েটা। আমার বোন থেকে শুরু করে আমার মা বাবা, আত্মীয় স্বজন, পাশের ফ্ল্যাটের আট বছরের নীলাদ্রি, উপরতলার ৭৫ বছরের জামান আংকেল সবার সাথে রুপুর দারুন ভাব ছিলো। আমার ঐ বিল্ডিংয়ের কার সাথে রুপুর ভাব ছিলো না সেটা জিজ্ঞেস করো! রুপুকে বিয়ে করার আগে ঐ বিল্ডিংয়ের কাউকে আমি ঠিকমত চিনতাম না, তারাও আমাকে চিনতো না৷ বিয়ের পর থেকে সবাই আমাকে চিনে। আমিও সবাইকে চিনি। রুপু আমাদের পরিচয় করিয়েছে৷ এরপর থেকে যখনই রুপু বাপের বাড়ি যেতো বেড়াতে তখনই আমি সিড়ি দিয়ে উঠানামার সময় লোকজন জিজ্ঞেস করতো,

রুপন্তি কোথায়? ওকে আজকাল দেখি না যে!

আমার কি মনে হতো জানো?
– কি?
– সেইদিন আর খুব বেশি দূরে না যেদিন পুরো পাড়াসুদ্ধ লোকের সাথে ও ভাব জমিয়ে আমাকে পরিচয় করাবে। এরপর মহল্লার লোকজন আমাকে চিনবে মহল্লার সেরা আড্ডাবাজ মেয়ের হাজবেন্ড হিসেবে।
– আপনার বাবা মায়ের সাথেও সম্পর্ক খুব ভালো তাই না?
– ভালো মানে! বলো যে ভালোর চেয়েও বেশি কিছু । শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে কোনো মেয়ের এমন সম্পর্ক থাকা একটা বিরল ব্যাপার৷ রুপু সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের পাগলা ভক্ত। আমার মা বাবা সাবিহা এই তিনজনকে নিয়ে সে মুভি দেখতো৷ কখনো কখনো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বাবার গায়ে হেলে পড়তো। আবার কখনো কাঁদতে কাঁদতে মায়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছতো। সবচেয়ে শকিং ব্যাপার কি ছিলো জানো? ও ঐসব মুভির গানে সাবিহাকে নিয়ে নাচানাচি করতো আর বাবা মা আরেকঘর থেকে বসে ওদের দেখতো৷ বিয়ের দুইমাসের দিকে এক রাতে আমি দেখতে পেলাম আমার মা ওদের সাথে হেলেদুলে নেচে যাচ্ছে আর বাবা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের তিনজনকে দেখছে।
– ইন্টারেস্টিং!
– আরও গল্প আছে ওদের। বৃষ্টি নামলেই ওরা চারজন ছাদে চলে যেতো ভিজতে৷ প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বাসায় কেউ নেই। ওরা চারজন দলবেঁধে চলে গেছে বাহিরে নাস্তা করতে। ওরা নাস্তা করে ফিরে আসার সময় আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসতো। প্রায় রাতেই ওদের গল্পের আসর বসতো। রাত দুইটা তিনটা পর্যন্ত চলতো ওদের গল্প। কয়দিন পরপরই মা, রুপু, সাবিহা মায়ের শাড়ী গহনা পড়ে অহেতুক সাজগোজ করতো। বাবা আবার খুব আনন্দ নিয়ে ছবি তুলে দিতো। রুপু আসার পর আমার বাসার চেহারা পুরোপুরি বদলে গেলো। যেই বাসায় আগে সারাদিনেও কারো কন্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া যেতো না, সেই বাসায় সারাক্ষণ কথার শব্দে মুখর থাকতো। রুপন্তি খুব কথাপ্রিয় মানুষ৷ যাকেই পাবে তার সাথে ননস্টপ কথা বলতেই থাকবে। কতশত কথা যে বলতে জানে মেয়েটা! ওর ছোটবেলার গল্প, ওর স্কুল কলেজের গল্প, ওর বান্ধবী, বাপ-ভাই, মামা, চাচা চৌদ্দগুষ্ঠির গল্প শোনাতো। আমার ঘরের লোকজন খুব মন দিয়ে ওর গল্পগুলো শুনতোও। কখনো তাদেরকে আমি বিরক্ত হতে দেখিনি। হঠাৎ আমার মনে হচ্ছিল রুপুর মত আমার ঘরের লোকগুলোও কথা বেশি বলা শুরু করেছে। আমার ফ্যামিলির খুব সুন্দর সময় কাটছিলো রুপুকে নিয়ে৷ এক কথায় বলতে পারো মন ভালো করা একটা পুতুল পেয়েছিলো আমার বাসার লোকজন৷ বাসায় গেস্ট আসলেই আমার মা বাবা বসে যেতো রুপুর প্রশংসার ঝুলি নিয়ে। আমার আত্মীয় স্বজনের মাঝে বেশ ভালোই সাড়া পড়লো রুপুকে নিয়ে৷ আমার আত্মীয়দের মধ্যে যে-ই রুপুকে সামনাসামনি দেখতো সে-ই রুপুর বিশাল ভক্ত হয়ে যেতো।
– আর আপনি? আপনার সাথে কেমন সম্পর্ক ছিলো?

মুখ বাকিয়ে হাসলো সৈকত। এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে আয়েশ করে বসে বললো,

– রুপুর সাথে একদম শুরুর দিন থেকেই আমার মনের মিল হয়নি। রুপু আর আমি হলাম দুই মেরুর মানুষ। ওর সাথে আমার কিছুই মিলতো না। আমি কথা কম বলা পছন্দ করতাম আর ও কথা বলতে। আমাকে পেলেই হলো! সে তার কথার ঝুলি খুলে বসে যেত। এমন মানুষকে নিয়েও গল্প করতো যাকে আমি চিনি না এবং ভবিষ্যতে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবুও আমি শুনতাম। শুনতাম বললে ভুল হবে। আমাকে সেসব গল্প শুনতে হতো। রুপু জোর করে শোনাতো। ওকে আমি সরাসরি অনেক কথা বলতে পারতাম না যেহেতু নতুন বিয়ে হয়েছে। ওকে বিভিন্নভাবে বুঝাতাম যে আমি ওর এত এত গল্প শুনতে মোটেই ইন্টারেস্টেড না। ও সেসবে পাত্তাই দিতো না৷ নিজের মত গল্প বলতেই থাকতো৷ আমি কি করছি, কোথায় যাচ্ছি, বাসায় কতক্ষন নাগাদ ফিরবো সর্বক্ষন এসব জানতে চাওয়া আমার কাছে খুবই বিরক্ত লাগতো। মনে হতো কেউ বুঝি আমার স্বাধীনতা নিয়ে টানাটানি করছে। কখনোই কেউ আমাকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতো না। নবনী কিংবা আমার বাসার লোকজন কেউই না। সবাই জানতো বারবার আমাকে এসব জিজ্ঞেস করলে আমি খুব রেগে যাই।
– ভাবী কি এই কাজটা করতো?
– হ্যাঁ। বিয়ের পরদিন থেকেই ও আমাকে ঘড়ি ধরে একঘন্টা পর পর কল করতো। কি করছি, কোথায় আছি, বাসায় ফিরবো কখন এই তিনটা প্রশ্নই করতে থাকতো৷ প্রথম কয়েকদিন সহ্য করেছি। সাত আটদিন যাওয়ার পর আর পারছিলাম না৷ তখন বাধ্য হয়েই বললাম, আমাকে বারবার কল করলে আমি বিরক্ত হই। কাজে ডিস্টার্ব হয় আমার৷ বারবার কল না করলে খুশি হবো৷ দিনে এক দু’বার কথা বললেই তো যথেষ্ট তাই না?

ও খুব অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর বললো,
– কেন? বিরক্ত কেন হবা?
– কাজে ডিস্টার্ব হয়। তাছাড়া আমি কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি এসব বারবার জিজ্ঞেস করা আমার খুব অপছন্দ।
– কেন? অপছন্দ কেন হবে?
– অপছন্দ কেন হবে এটার উত্তর তো আমি দিতে পারবো না৷ পছন্দ অপছন্দের তো নির্দিষ্ট কারণ থাকে না৷ ভালো লাগে না, ব্যস লাগে না।
– তোমার ভালো না লাগলে তো আমি কি করবো? আমি কল করবোই। আমি খোঁজ নিবোই। আমি তোমার একমাত্র বউ৷ আমি তোমার খোঁজ না নিলে কে নিবে?
– খুব অধিকার খাটাতো তাই না?
– খুব বেশিই। আমি অফিস থেকে বের হয়ে প্রায়ই বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেতাম। রুপুর সেটা একদম সহ্য হতো না। একমাত্র শুক্রবার ছাড়া বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলে রুপু খুব বিরক্ত করতো। সাড়ে আটটার মধ্যে বাসায় না ফিরলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিতো৷ বলতো, সারাদিন তো বাইরে থাকো৷ রাতে একটু তোমার সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাই সেটাও হতে দাও না। চলে যাও বন্ধুদের সাথে গল্প করতে।
– আপনি উনার বাঁধা মেনেছেন বলে তো মনে হয় না।
– আরে নাহ্। পাগল তুমি! আমাকে আটকানোর ক্ষমতা কারোই ছিলো না৷ রুপুরও না। আমি যেতামই ওদের সাথে দেখা করতে। আর বাসায় ফেরার পর শুরু হতো ওর ঘ্যানঘ্যান।
– অভিযোগ করবে না এমন মেয়ে চেয়েছিলেন। আশা সব মাটিতে মিশে গেলো সেই কষ্টেই তো বোধ হয় শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন।
– শুধু কি এতটুকুই! আরো কত কি সমস্যা! আমি বাহির থেকে ঘরে আসলে সবার আগে গোসল করি। এর আগে বিছানায় বসিও না। নয়তো আমার ভীষন অস্বস্তি হয়। আর রুপু কি করতো! প্রায়ই আমি বাসায় ফিরলেই আমার পিছন পিছন ঘরে আসতো। অফিসের কাপড় পড়া অবস্থাতেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আটকে রাখতো। ফ্রেশ হতে যেতে দিতো না। অফিসের কাজ করছি কিংবা বন্ধুদের সাথে কনফারেন্স কলে কথা বলছি এমন সময় এসে বিড়ালের মত জড়োসড়ো হয়ে কোলে উঠে বসে যেতো। অকারণে তখন এসে ঠোঁটে চুমু দিতো৷ ওর যন্ত্রণায় শান্তিমত ফোনে কথা বলতে পারতাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করেই আমার চোখে মুখে এলোপাতাড়ি চুমু দিতো। কি যে নোংরা মনে হতো ওকে! কখনো কখনো জোর করে আমার সাথে বাথরুমে ঢুকে যেতো। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বলতো,

– এ্যাই সিকু, একটু শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে নেচে দেখাও তো।

হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো ইমরান। বললো,
– নেচে দেখাতেন?
– রুপু একটা পাগল। পাগলের কথায় পাগলামি করবো নাকি! ও দাঁড়িয়েই থাকতো৷ ওকে কোনোমতেই বের করতে পারতাম না৷ ধমকে কাজ হতো না৷ ধমক খেয়েও নির্লজ্জের মত হাসতো আর বলতো,

– আহ্ একটু নাচোই না! মাঝেমধ্যে আমারও তো একটু বিনোদনের দরকার হয়৷ হাজবেন্ড হিসেবে আমাকে বিনোদন দেয়া তোমার দায়িত্ব।

সে এসব হাবিজাবি বলতেই থাকতো আর আমি বাধ্য হয়ে ওর সামনেই গোসল করতাম। রাতে ঘুমাতেও পারতাম না ঠিকমত। লম্বা লম্বা হাত পা এনে গায়ের উপর তুলে দিতো। ওকে সরাতে চাইলে আরো শক্ত করে ধরে রাখতো। বলতো, সিকু একদম বিরক্ত করবা না৷ আমাকে ঘুমাতে দাও। উনি আরাম করে আমার গায়ে হাত পা তুলে ঘুমাতো আর আমি একটু ভালো ঘুমের আশায় এপাশ ওপাশ করতে থাকতাম।
– আপনার ঘুমের কেন ডিস্টার্ব হবে?
– আমি একটু স্পেস নিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করি। ঘুমের সময় গায়ের উপর হাত পা রাখা আমার খুবই অপছন্দ। আমার ঘুম হয় না।
– ভাইয়া, আপনার এত সমস্যা কেন আমাকে একটু বলবেন? ভাবী যা কিছু করতো সেগুলো কিন্তু সব ছেলেরাই তার ওয়াইফের কাছে এক্সপেক্ট করে। আর আপনি বিরক্ত কেন হতেন সেটাই তো বুঝলাম না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here