চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৩৬

0
3088

চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৩৬
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

“স্পর্শী আমার বিয়ে করা স্ত্রী। সি ইজ দ্যা ওয়াইফ অফ নির্বাণ সাইয়্যেদ।”

কথাটি যেন সকলের কর্ণকুহরে বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় তরঙ্গিত হলো। আশ্চর্যান্বিত ভাব ভর্তি হলো দৃষ্টির কানায় কানায়। ওষ্ঠ্যদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব বিদ্যমান। স্পর্শীর অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। সে দৃষ্টি তুলে নির্বাণের পানে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন কিছুর প্রত্যাশা সে কোন কালেই করেনি। আর করবেই বা কি করে? নির্বাণের ব্যক্তিত্ব তো কহে বলে বেড়ানোর মত নয়। সে তার জীবন অত্যন্ত একান্ত রাখতে পছন্দ করে। নির্বাণের নাম আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ব্যতীত কেউই তার ব্যাপারে সামান্যটুকু তথ্য জানে না। এমনকি, তার কলিগরা পর্যন্ত না। ক্লাসে বা স্টাফরুমে কেউ যদি কখনো তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেও থাকে তাহলে নির্বাণ সে-টা সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলে। সেখানে আজ সে নিজ থেকে সকলের সামনে স্পর্শীকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, বিষয়টা এলাহি কান্ডের ন্যায় ঠেকলো সকলের নিকট৷ তবে, অবিশ্বাসের এক ছাপ তখনও বিদ্যমান সকলের মাঝে। অকস্মাৎ কেউ একজন চিত্তে সাহস জুগিয়ে বলে উঠলো, “আপনি যে সত্য বলছেন সেটা কিভাবে বিশ্বাস করি আমরা? নিজের অবৈধ সম্পর্ক লুকাতে মিথ্যাও তো বলতে পারেন আপনি।”

যুবকটির সাহসিকতা দেখে সকলেই হতবাক, ভাবলো এবার নির্বাণ নিশ্চয়ই রাগে ফেটে পড়বে। তিক্ত মুখের বাণীতেই বিষিয়ে দিবে টগবগে যুবকটির চঞ্চলতা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে নির্বাণ আজ রাগলো না। শীতল নয়নে তাকালো সে। নির্মল কন্ঠে সকলের দিকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন আমাদের ছবি সেই জঘন্য শিরোনাম সহকারে ভাইরাল হলো তখন সবাই নিমিষেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলেছিল। কেউ তো একবারও প্রশ্ন বা যাচাই করতে আসেনি সেই পোস্টটার সত্যতা কতখানি তাহলে এখন এই প্রশ্ন আসছে কেন?”

কিয়ৎকালের ব্যবধানেই সকলের মুখশ্রী বিবর্ণ আকার ধারণ করলো৷ কণ্ঠনালিতে বাঁধলো হরতাল। নির্বাণ স্মিত হাসলো, পুনরায় প্রশ্ন করলো, “এখন কেন প্রমাণ চাচ্ছে সবাই? যেখানে আমি আগেই বলেছি ছবিগুলো সত্য আর আমরা দুইজন বিবাহিত সেখানে দ্বিধায় থাকছে কেন? তার মানে কি বুঝব আমি, সোশ্যাল মিডিয়ায় র‍্যান্ডমি যে কেউ এসে যা ইচ্ছা তাই লিখে পোস্ট করুক না কেন সেটা শতভাগ গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু যাকে আপনারা দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসছেন তার বলা কথা নয়? প্রমাণ দিয়ে নিজের কথা বিশ্বাসযোগ্য করাতে হবে? এমন পার্থক্য কেন? এখন গিয়ে প্রশ্ন কেন উঠে, মানুষটার বলা কথাগুলো কতখানি সত্য? আদৌ সত্য তো?”

এবার নীরবতার পরিমাণ যেন দৃঢ় হলো। উত্তর দেওয়ার মত বর্ণ,শব্দ,বাক্য জমা নেই ভান্ডারে। নির্বাণ এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “সবটা সত্য নাকি মিথ্যা এই প্রশ্নটা এখন কেন আসে? আগে কেন পোস্টটা দেখামাত্র এই প্রশ্নটা মাথায় আসেনি? কেউ কেন কোন যাচাই করোনি? আমার জানা মতে, ছবিতে তো অশ্লীল কিছু ছিল না, তাহলে তখন এই প্রশ্ন মাথায় না আসার কারণ কি?”

এবারও নিরুত্তর রইলো সবাই

কি উত্তর নেই কারো কাছে? এর কারণ জানো কেন? কারণ হচ্ছে আমরা বাঙালি জাতি, আমরা খেটে খেতে নয় বরং আমাদের সামনে একটা জিনিস সুন্দর করে সাজিয়ে-টাজিয়ে পরিবেশন করে দিলেই সে-টা আমরা আহার করতে পছন্দ করি। হোক সে-টা ভালো বা মন্দ। এখানেও বিষয়টা একই। তোমাদের সকলের সামনে সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা জিনিস পরিবেশন করা হয়েছে আর তোমরাও সেটা অনাহারে আহার করেই চলেছ। সমালোচনা করে, চারদিকে শেয়ার করতে তো একদমই ভুল-নি। আর মূল জিনিসটাকে চার ডিগ্রি বাড়িয়ে বলা তো আমাদের বাঙালি জাতির জন্মগত অভ্যাস। সেটা নাই বা বলি। কিছু সময়ের ব্যবধানে কোন বিচার-আচার না করেই চরিত্রহীন আর চরিত্রহীনা ট্যাগটা লাগিয়ে দিয়েছ। অশ্রাব্য ভাষায় যা নয় তাই বলে গিয়েছ। তোমাদের আচরণ দেখে যা বুঝেছি, এইটাই হচ্ছে বর্তমানে মর্ডান জাতির নমুনা।”

এতটুকু বলে নির্বাণ স্থির হলো৷ সকলের মাথা তখন নত। তবে লজ্জায় নাকি সংশয়ে তা বুঝা গেল না। নির্বাণ সেদিক তাকিয়ে বলল, ” তোমাদের মন-মানসিকতা ঠিক কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছে সে-টা ফেসবুকে ঢুকে কমেন্ট বক্সে গেলেই দেখা যায়। না বুঝো তোমরা কোন সম্পর্কের শুদ্ধতা, না চিনো কোন সম্পর্কের মাধুর্যতা। বুঝো শুধু ফেসবুক। কোন একটা পোস্ট দেখেছ তার ভিত্তিতেই মানুষের চরিত্র কেমন সে-টা নির্ণয় করে ফেলছ, অথচ জানার চেষ্টা-ই করছো আসল ঘটনাটা কি? দোষ অবশ্য তোমাদেরও না, এই জেনারেশনের-ই। যেখানে আজ কাল ভাই-বোন একসাথে বের হতে পারে না, একসাথে বের হলেই তাদের নোংরা চোখে দেখা হয় সেখানে আমাদের তোমরা রেহাই দিবে ভাবাই বিলাসিতা।”

নির্বাণ এবার স্পর্শীর ধরে রাখা হাতটা টেনে তাকে তার পাশে এনে দাঁড়ালো। অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলল, “যাই হোক, অনেক বলে ফেলেছি আর কিছু বলার ইচ্ছা বা শক্তি কোনটাই আমার নেই। তবে, সময় মত সব প্রমাণ হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন আপনারা, সে সাথে আমাদের কাবিননামার ছবিও। স্পর্শী আমার বউ এটা নিয়ে কারো মনে সন্দেহ থাকুক তা আমি চাই না। আর হ্যাঁ, পরবর্তীতে যেকোনো ঘটনায় নিজের বিচার-বুদ্ধি পাশে না রেখে প্রয়োগ করতে শিখো। নিজের মনুষ্যত্ব বিলীন হয়ে যেতে দিও না। দ্যাটস অল!”

নির্বাণের ঠান্ডা মাথায় বলা প্রত্যেকটা কথা সৈন্যের ধাঁরালো ন্যায় আঘাত করলো সকলের মস্তিষ্কে। প্রভাব ফেললো মনোবৃত্তিতে৷ অনুশোচনায়, দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকলো বক্ষঃস্থলটি। যার সবটাই নির্বাণ বেশ বিচক্ষণতার সাথে করেছে। স্পর্শীকে নিয়ে উপহাস এবং গালমন্দ করা মানুষদের মধ্যে তার-ই ক্লাসমেটদের সংখ্যা ছিল বেশ৷ যা নির্বাণের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই এর শোধ নিয়েছে এভাবে। প্রত্যক্ষভাবে নির্বাণ তাদেরকে নিজেদের কর্মের শাস্তি না দিলেও পরোক্ষভাবে মানসিক অশান্তিতে এবং তীব্র অনুশোচনায় ফেলে দিয়েছে ঠিকই।নির্বাণের কথা বলার ভঙ্গিমা এমনই যে তার কথা উপেক্ষা করার জোড় কারোই নেই। যদিও সকলের ক্ষেত্রে একই মনোভাব কাজ করে না, তবে তার কথাগুলো কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠেকেছে ঠিকই৷ যেটা কি-নাই ছিল নির্বাণের মূল লক্ষ্য।

এদিকে, নিজের বক্তব্য শেষ করেই নির্বাণ যেভাবে স্পর্শীর হাত ধরে এসেছিল সেভাবে বেরিয়ে গেল। স্পর্শী তখনও কোন ঘোরের মাঝেই ছিল, সবকিছুই স্বপ্নের মত লাগছে তার। নির্বাণ যে তার জন্য নিজের কনফর্টজোন থেকে বেরিয়ে এসে স্ট্যান্ড নিয়েছে, কথা বলেছে তা অবিশ্বাস্য ব্যতীত কিছুই মনে হচ্ছে না। কেন না, নির্বাণ কখনো কারো নিজেকে এভাবে তুলে ধরে না। আজ সে এমনটা করেছে শুধুমাত্র তার জন্যই। এ থেকেই বুঝা যায় নির্বাণের জীবনে তার গুরুত্ব ঠিক কোথায় অবস্থিত। স্পর্শীর দৃষ্টি এবার প্রফুল্লচিত্তে আবৃত হলো। অধরদ্বয়ের কোণে জায়গা পেল এক ফালি মিষ্টতা। সকল মান-অভিমান, অভিযোগ গলে পড়তে থাকলো নিজ দায়িত্বেই।

_______________

ওয়েটিং রুমের কাউচের উপরে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে রুদ্র। পাশের চেয়ারে তার বন্ধুরা, সকলের চোখে-মুখেই নিঃস্পৃহ ভাব। সকলের কাছ থেকেই মোবাইলফোন নিয়ে বন্ধক রাখা হয়েছে, যার দরুন বাহিরে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা মোটেও অবগত নয়। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করার ফলে তিক্ততা এসে পড়ে সকলের মাঝে। নিজের মনের ঝাল মিটাতে অতি নিম্ন ভাষায় যে যাই পারছে তা বলে চলেছে নির্বাণ এবং স্পর্শীকে নিয়ে। রুদ্রও তাল মিলাচ্ছে তাদের সহিতে। তাদের মুখের ভাষা এতটাই নিম্ন যে সাধারণ কেউ শুনলে কর্ণকুহর হতে রক্তের বন্যা বইতে সময় লাগবে না। এতটাই অশোচনীয় কথাবার্তা চলছিল তাদের মাঝে। কিয়দংশ সময় এভাবেই অতিক্রম হয়ে যেতে ওয়েটিং রুমের দরজা খুললো। দরজা খোলার শব্দে সকলের নেত্র গিয়ে আটকালো সেদিক। ধূসর-কালো রঙের স্ন্যাকারসে মৃদু শব্দ তুলে এগিয়ে এলো নির্বাণ। নির্বাণকে দেখেই রুদ্র অবজ্ঞাসূচক হাসি হাসলো। নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে উঠে সম্মুখে দাঁড়ালো নির্বাণের। বলল, “কি ব্যাপার স্যার? হঠাৎ এখানে আসলেন যে? কোন বিশেষ ব্যাপার-স্যাপার আছে নাকি?”

নির্বাণ স্মিত হাসলো, “তা অবশ্য আছে বটেই। নাহলে আমার ক্লাস এখনো এত লো হয়নি যে তোমার সাথে আমার দেখা করতে আসতে হবে।”

কথাটা শুনেই রুদ্রের অভিব্যক্তিতে ক্রোধাগ্নি দেখা দিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সেটা দেখতেই পাচ্ছি। তবে, একটা বিষয় কি জানেন তো? আপনার আর আপনার প্রিয়তম ছাত্রীর কুকর্মের বনাম শহর। যেটা এখন চাইলেও আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। বলি কি, আর কাউকে পেলেন না ভালো? শেষে কি-না একটা নষ্ট-আ….”

নির্বাণ মুহূর্তে কন্ঠস্বর দ্বিগুণ করে বলল, “মুখের ভাষা ঠিক রেখে কথা বলো, নাহলে পরিমাণ যা হবে তা তোমার সহ্যসীমার বাহিরে চলে যাবে।”

“বাব্বাহ! এত ভালোবাসা? আ’ম ইম্প্রেসড। তবে নিজের ভালোবাসা একটা সস্তা মেয়ের উপর অপচয় করছেন না? যে নাকি আপনাকে ইউস ছাড়া কিছুই করছে না। জানেন তো, মেয়েটি বিবাহিত? নিজের কার্য হাসিল করতেই আছে আপনার সাথে। খামাখা ওর জন্য নিজের সম্মানটা হারালেন আপনি।”

কথাটা বলে রুদ্রে আফসোসের সুরে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করতে থাকলো। নির্বাণ তা দেখে বলল, “আসলেই তোমাকে দেখে মুখের ভাষা সভ্য রাখা দায়। অকথ্য ভাষা মুখ দিয়ে বেরিয়েই আসে।”

“সেম টু ইউ! আপনাকে তো স্যার হিসাবে কল্পনা করতেও ঘৃণা করে এখন আমার। না জানি এত সম্মান এখনো কেন দিচ্ছি আপনাকে।”

রুদ্রের গা ছাড়া ভাব। নির্বাণ তা দেখে রুদ্রের নিকটে এসে তার কানের সামনে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, “বলার আর কিছু সময় বাকি আছে তোমার হাতে, বলে নাও। বাট আফটার এ হোয়াইল দ্যা রিয়্যাল কাউন্টডাউন উইল বি স্টার্টেড।”

কথাটা শুনে রুদ্রের ভ্রু কুঁচকে এলো, “মানে কি?”

“আগুনে হাত দিয়েছ তুমি, সুতরাং হাত পোড়া এখন অনিবার্য। অপেক্ষা কর, নিজের সকলের কর্মের ফল পাবে তুমি।”

কথাটা বলেই নির্বাণ সরে এলো এবং দরজার দিকে অগ্রসর হলো। যেতে যেতে আনমনে বলে উঠলো, “আমার স্পর্শীকে নিয়ে বলা প্রত্যেক কথার শোধ আমি নিবই। এন্ড আই উইল মেক সিউর ইউ মাস্ট বি ট্রাবল ইন দ্যা লং রান।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here