#শেষ_থেকে_শুরু_২,পর্ব_১৭[রহস্যভেদ]
#নন্দিনী_চৌধুরী
৩২.
দেখতে দেখতে প্রায় ১মাস চলে গেছে। এই ১মাসে আরিশ চেয়েও পারেনি মুগ্ধের সাথে দেখা করতে। এর কারণ এটাই আরিশ জানেনা মুগ্ধ কোথায় আছে। সায়মাদের বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখেছে ওখানে নেই। সায়মার মাকে জিজ্ঞেশ করলে সে সাফ জানায় সে জানেনা মুগ্ধ কই। আরিশের শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সেদিনের পর থেকে আরিশ সায়মা একদম আলাদা হয়েগেছে। আরিশ নিজের মতো করে থাকে আর সায়মা নিজের মতো। ইদানিং সায়মার শরীরও অনেক খারাপ করছে। চাইলেও সায়মা আগের মতো লাইফ লিড করতে পারছেনা।
আরিশের বিজনেসের অবস্থা অনেক খারাপ হয়েগেছে। একদিকে রোগের চিকিৎসা করানো তারপর সংসার চালানো সব একদম নাজেহাল অবস্থা। অফিস আরিশের প্রায় ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে।
আরিশ আর সায়মা রেডি হচ্ছে আজকে সায়মাদের বাসায় যেতে বলেছে মাহফুজ। তাদের সাথে তার দরকার আছে জানিয়েছে মাহফুজ। আরিশ সায়মা রেডি হয়ে চলে আসে সায়মাদের বাসায়। সায়মাদের বাসায় এসে দেখে সামিয়া,সামিয়ার স্বামী,সালমা,মাহফুজ সবাই বসে আছে। সামিয়া ওদের দেখে ওদেরকেও বসতে বলে। ওরা বুঝতে পারছেনা ওদের ডেকে এভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে কেনো। কিছু সময় বাদে বাসায় আসলো মেহের, মুগ্ধ, মেহেরের অফিসের মেনেজার। এতো গুলা মাস পর আজ আরিশ মুগ্ধ মুখামুখি। মুগ্ধ যেমন আরিশকে দেখে অবাক হয়েছে তেমনি আরিশ মুগ্ধকে দেখে অবাক হয়েছে। আরিশ মুগ্ধকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। মেহেরের আরিশকে দেখে রাগ উঠে গেছে কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে মেহের। মুগ্ধের হাত শক্ত করে ধরলো মেহের। তারপর গিয়ে ওরা ৩জনেও সোফায় বসলো। আজকে এখানে সবাই একত্রিত করেছে মেহের। তার সবার সাথে কথা আছে সেই জন্য।
মাহফুজ মেহেরেকে উদ্দেশ্য করে বলে,
মাহফুজঃকি ব্যাপার মেহের তুই সবাইকে এখানে আসতে বললি যে?
মেহেরঃহ্যাঁ সবাইকে আসতে বলেছি কারণ আমার তোমাদের সবাইকে কিছু জানানোর আছে।
মাহফুজঃকি?
মেহেরঃ তোমাদের সবাইকে আমি এখানে আসতে বলেছি, কারণ আজ আমি তোমাদের অনেক এমন অজানা কথা জানাবো। যেটা তোমরা জানোনা। যা তোমাদের থেকে অজানা।
সালমাঃ কি বলতে চাও তা ক্লিয়ার করে না বললে কেউ কিভাবে বুঝবে।
মেজেরঃজ্বি আজ অনেক কিছু ক্লিয়ার করবো। তো প্রথমে আসি আমার মা বাবার মৃত্যুর ঘটনায়।
আমরা সবাই জানি আমার মা বাবা মারা গেছে একটা এক্সসিডেন্টে। সবাই এটাকে এক্সসিডেন্ট মানতে চাইছিলোনা। অনেকেই বলেছিলো এটা মাডার। তো আমি সেই জন্য সেই বহু বছর আগের ঘটনাটাকে খোঁজ লাগাই আর জানতে পারি যে আসলেই আমার মা বাবার এক্সসিডেন্ট আসলে কোনো দূর্ঘটনা নয় বরং এটা একটা পরিকল্পনা করা মাডার।
মেহের কথা শুনে সবাই চমকে গেলো। সালমা মেহেরের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। মাহফুজ মেহেরকে বলে,
মাহফুজ:কি বলছিস মেহের!
মেহের:হুম চাচ্চু। আমি ঠিক বলছি।
আমার মা বাবার যেই গাড়িতে এক্সসিডেন্ট হয় সেই গাড়িটার ব্রেক কেউ ইচ্ছা করে নষ্ট করে দিয়েছিলো। তাই সেই গাড়িটা ব্রেকফেল করে আর পাহাড় থেকে পরে যায়।
মাহফুজ:কে করেছে এসব জানতে পেরেছিস?
মেহের:হুম।
মাহফুজ:কে সে?
মেহের এবার কিছুসময় চুপ করে থেকে সালমার দিকে তাকিয়ে বলে,
মেহের:প্রিয় চাচি আমিই কি সব বলবো নাকি এবার আপনি আপনার মুখটা খুলবেন।
মেহেরের কথা শুনে সালমা ভিতু চোখে তাকায় ওর দিকে। মেহেরের কথায় সবাই যেনো আকাশ থেকে পরছে। সালমা ভিতু গলায় বলে,
সালমা:আ.আমি কি ব.বলবো।
মেহের:সেইতো আপনি কি বলবেন। আপনি বলবেন কেনো আপনি আমার মা বাবাকে মারলেন। আপনি বলবেন কি শত্রুতা ছিলো আপনার তাদের সাথে।
মেহেরের কথায় সালমা এবার ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। মাহফুজ সালমাকে বললো,
মাহফুজ: সালমা মেহের কি বলছে। এসব কি সত্যি। কি হলো বলো এসব সত্যি।
সালমা এবার আর থেমে থাকতে পারলোনা চিৎকার দিয়ে বললো,
সালমা:হ্যাঁ সত্যি। এটা সত্যি আমি মেহেজাবিন আর মেহেরাবকে মেরেছি। কিন্ত আমি শুধু মেহেজাবিনকে মারতে চেয়েছিলাম মেহেরাবকে না।
মেহের:কেনো! কেনো আপনি আমার মাকে মারতে চেয়েছিলেন বলুন।
সালমা: আমি আর মেহেজাবিন একই কলেজে পড়তাম। আমাদের সিনিওর ছিলো মেহেরাব। মেবেরাবকে আমার শুরু থেকে ভালো লাগতো ভালোবাসতাম আমি মেহেরাবকে। একদিন আমি ঠিক করি আমি মেহেরাবকে আমার মনের কথা জানাবো। যেদিন আমি মেহেরাবকে নিজের মনের কথা জানাতে যাই সেদিন জানতে পারি মেহেরাব মেহেজাবিনকে ভালোবাসে। সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। তারপর অনেক চেষ্টা করেছিলাম মেহেরাবকে ভুলতে কিন্ত পারিনি। তারপর একদিন মেহেজাবিন ওর জন্মদিনের পার্টিতে আমাকে ইনভাইট করে। আমি সেখানে যাই সেখানে যাওয়ার পর মেহেজাবিনের ভাই আমার দিকে কুনজরে তাকিয়ে ছিলো আমি সেটা বুঝতে পেরে তাকে এরিয়ে চলছিলাম। কিন্ত সে আমাকে একটা ওয়েটারকে দিয়ে নেশা মিশানো জুস খাওয়ায়। তারপর আমার নেশার সুযোগ নেয় যে। পরেরদিন যখন নিজেকে বিছানায় নিজের সব থেকে দামি জিনিশ হারানো অবস্থায় দেখি সেদিন ও অনেক কেঁদেছিলাম। মেহেজাবিনের ভাই আমাকে ভয় দেখায় আমি যেনো কাউকে কিছু না বলি। সেদিনের মতো বাসায় এসে নিজেকে ঘর বন্ধি করে দিলাম। এর কয়েকমাস পর বুঝতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলামনা। মেহেজাবিনের ভাইকে জানালে সে বলে বাচ্চা ফেলে দিতে। আমি তার পায়ে ধরি বাচ্চা না ফেলার জন্য কিন্ত সে আমাকে অনেক অপমান করে। সমাজের মানুষের কথার ভয়ে বাবা মায়ের সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে নষ্ট করে দেই আমার বাচ্চাটাকে। এর কিছু সপ্তাহ পর বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে মাহফুজের সাথে। বিয়ের আগেও আমি জানতাম না যে মাহফুজ মেহেরাবের বড় ভাই। যেদিন আমার বিয়ে হয় সেদিন মেহেরাবকে দেখার পর জানতে পারি এটা। কি কপাল আমার যাকে ভালোবাসলাম তার বড় ভাইয়ের ঘরের বউ হলাম আমি। বিয়ের পর মাহফুজকে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। কারণ চোখের সামনে মেহেরাবকে দেখতাম। এরপর দেখতে দেখতে মেহেরাব মেহেজাবিনের বিয়ে হয়ে গেলো। মেহেজাবিনকে আমি সয্য করতে পারতামনা একদম। ওকে দেখলে নিজের সাথে হওয়া সব অন্যায় এর কথা মনে পরে আর মেহেরাবের সাথে দেখলে আরো রাগ লাগে। মেহেজাবিনের বিয়ের কারণে ওর ভাই বাসায় আসতো সেখানে এসে আমাকে দেখে সেও অবাক হয়। এভাবেই যাচ্ছিলো দিন। বছর ঘুরতেই শুনি মেহেজাবিন প্রেগন্যান্ট। এই খবর শুনে সবাই খুশি হতে পারলেও আমি পারিনি খুশি হতে। মেহেজাবিনের ছেলে হবার পর আমি জানতে পারলাম আমি আবার প্রেগন্যান্ট। দেখতে দেখতে আমার মেয়ে হলো। কিন্ত মেহেজাবিনের প্রতি রাগ আমার কমছিলোনা। ওকে ওর ভাইকে দেখলেই আমার প্রতিশোধের নেশা জেগে ওঠে। এভাবে যাওয়ার পর মুগ্ধ আসলো ওদের ঘরে। একদিন আমি আমার হাতে আমার শশুড়ের করে যাওয়া দলিল পাই। সেখানে দেখি তিনি তার ছোট ছেলের বউয়ের নামে সম্পত্তির হাফ দিয়েছেন। বাকিটা ভাগ করেছেন তার ছেলেদের মাঝে। এটা দেখার পর মেজাজ আরো খারাপ হলো। তাই ভেবে নিলাম আর বাঁচিয়ে রাখবোনা মেহেজাবিনকে। পরিকল্পনা করলাম বাসায় থেকে ওকে মারা যাবেনা বাহিরে এটা করতে হবে। তাই সবাইকে নিয়ে চলে গেলাম পাহাড়ে বেড়াতে। সেখানে গিয়ে আমি ফিরে আসার দিন মেহেজাবিনের গাড়ির ব্রেক নষ্ট করিয়ে দেই। কারন কথা ছিলো মেহেজাবিন একা আসবে মেহেরাব কাজের জন্য যেতে পারবেনা। কিন্তু আমি জানতাম না যে মেহেরাব ওই গাড়িতে বসবে। এক্সসিডেন্টের জানতে পারলাম গাড়িতে মেহেজাবিন আর মেহেরাব দুজনেই ছিলো। ভয় হচ্ছিলো যদি ধরা পরে যাই। এরপর সব মিটে গেলো। পুলিশ কোনো তেমন প্রমান পায়নি যে এটা মাডার।
সালমা একটু চুপ করে শ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগলো,,,
এরপর মেহেরকে ওর মামারা নিয়ে গেলো আর মুগ্ধকে আনলো মাহফুজ। আমি মেহেরের মামাকে ভয় দেখিয়েছিলাম যদি সে মেহেরকে আমাদের কাছে দেয় তবে আমি ওকে মেরে দেবো যেমন ওর বোনকে মেরেছি আর এটাও সবাইকে বলে দেবো ও আমার সাথে কি করেছিলো। এই ভয়ে ওর মামা মেহেরকে এদিকে তেমন যোগাযোগ করতে দিতোনা। মেহেরের থেকে মুগ্ধকে আলাদা করে দিতে পেরেছিলো পুরোপুরি ওকে দেশের বাহিরে নিয়ে গিয়ে। আমি মেহেরের মামার থেকে তখন টাকা নেওয়া শুরু করি মুগ্ধের নাম করে। সব জায়গায় টাকা আনার সময় নিজেকে মুগ্ধের মা বলেছি আমি। মুগ্ধের আসলে কোনো দোষ ছিলোনা কিন্তু তবুও ও মেহেজাবিনের মেয়ে ছিলো তাই ওকে সয্য হতোনা আমার। আর তাছাড়া সম্পত্তির ভাগ ওকেও দিতে হতো। তাই ভাবতাম ওকে মেরে দেই কিন্তু এটা করলে বিপদ হতো। তাই ওকে অত্যাচার করতাম সবসময়। তারপর যখন ওর বিয়ে হয়ে যায় ভাবলাম আপদ বিদায় হইছে কিন্ত না পরে জানলাম ও স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়েছে এটা জেনে প্রথমে খুশি হলাম। জানতাম না তখন যে আমার মেয়েই এর মূলে আছে। মুগ্ধ বাসায় আসার পর মেহেরকে দেখে আমি ভয় পেয়েযাই। যদি মেহের সব জেনে যায় সেই ভয়ে। তাই আমি রিস্ক নিলাম মুগ্ধকে মারার। লোক দিয়ে হামলা করালার ওর উপড়। কিন্তু মুগ্ধ বেঁচে যায় প্রানে। পরে জানলাম আরিশ যেই মেয়ের জন্য মুগ্ধকে ডিভোর্স দিয়েছে সেই মেয়ে আর কেউনা সায়মা। এটা জানার পর আমি ভয় পাই। যে মেহের জানলে তো সায়মাকে আস্ত রাখবেনা। এমনিতেই মেহের টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ করেছে। তখনি বুঝতে পেরেছি মেহের কিছু জানতে পেরেছে। তাই সায়মাকে বুদ্ধি দেই বাচ্চা নেওয়ার। কিন্ত এতো সব করেও শেষ রক্ষা হলোনা। ঠিক সেই মেহের সব জেনে গেলো। তবে ভালোই হয়েছে আমার প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে মরেছে মেহেজাবিন তার ভাই। আমার আর কোনো আফসোস নেই এখন ধরা পরার। তবে হ্যাঁ আরেকটা কথা বলেই দেই তোমাদের মামাকেও আমিই মেরেছি। তোমার মামার সব থেকে কাছের সেক্রেটারিকে দিয়েই খুন করিয়েছি। আমি সফল আমার প্রতিশোধে।
সালমার কথা শুনে রুমে থাকা সবাই স্তব্ধ হয়েগেছে। মুগ্ধ তো যেনো একদম ঘোরে চলে গেছে। মাহফুজ সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে সামিয়াকে ওর স্বামী চেয়ার টেনে বসালো। সায়মা একদম বোবার মতো চুপ আর আরিশ সেও চুপ! এক মা মেয়ে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা ভাবছে আরিশ।
#চলবে
বানান ভুল হলে সরি। রিচেক করা হয়নি।