টরেটক্কা – ২
Afsana Asha
সকালে ঘুম থেকে উঠে একমগ পানি নিয়ে ছাদে উঠেছি। খাওয়ার পানি না, হাতের মগটাতে গরম পানি। এক চিমটি লবণ দিয়েছি পানিতে। এখন গড়গড়া করব। আমার ঠান্ডার ধাত আছে। কাল রাতে ফ্যান বন্ধ করা হয়নি। ঘুমাতে গিয়েছি, তখন গরম লাগছিল। ফুলস্পিডে ফ্যান চালিয়েছিলাম। ভোরের দিকে ঠান্ডায় নাকমুখ বুজে গেলেও ফ্যান বন্ধ করতে উঠে সাধের ঘুমটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছিল না। কাঁথা টেনে নেবো, তাও যে কোথায়, মাথার কাছে না কি পায়ের কাছে রেখেছি মনে পড়ছিল না। কাঁথা খোঁজার হ্যাপা নেওয়ার চেয়ে হাঁটু বুকের ভেতরে নিয়ে গোল হয়ে শোওয়াটা বেটার অপশন মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে,
একটা বউ থাকলে খুব একটা খারাপ হতো না। খুব ভালো এবং আনন্দদায়ক ব্যাপার হতো। শেষরাতে ঠান্ডা লাগলে কাঁথাটা বুকের উপর টেনে দিতো নইলে নিজেই জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা দিতো আমাকে। বউয়ের খোলা চুল আমার বুকে, ভাবতেই ভালো লাগল। রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপারস্যাপার। রোমান্টিক। প্রেমপূর্ণ জীবন। প্রেমময় জীবন। বাহ, জীবনটাই সুন্দর। সকালটাই সুন্দর হয়ে গেল আমার। পাখি ডাকছে, হালকা রোদ, টুকরো বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। বাহ! কী সুন্দর সকাল। শুভ সকাল রাফিন, শুভ সকাল!
‘এই রাফিন, তুই কী করলি এইটা?’ দীঘির কাঠচেরাই করা গলা খরখর করে উঠল। আমার সুন্দর সকালটা নষ্ট করে দিতে এসেছে। ওর দিকে তাকিয়ে, ওর কথা শুনে সকালটা আরও নষ্ট করে একেবারে পচিয়ে দেওয়ার কোনো মানে নেই। আমি আমার কাজ করতে থাকলাম৷
‘এই উল্লুক! এটা পুদিনা গাছ। তুই এখানে কুলির পানি কেন ফেলছিস?’
‘কেন গাছের গায়ে বোর্ড লাগানো আছে? এখানে কুলি করিবেন না। করিলে জরিমানা!’ আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম।
‘শোন রাফিন। সারাদিন তোর মত ঝগড়া করার জন্য টপগিয়ারে স্পিড নিয়ে ঘুরি না আমি। প্রথম কথা হচ্ছে, এতজায়গা থাকতে তুই গাছের গোড়াতে কেন কুলি করবি? আর শেষকথা হচ্ছে পুদিনা খাওয়া হয়। আংকেল প্রায়ই মিন্ট লেমোনেড, মোহিতো বানায়। এগুলোর মেইন ইনগ্রিডেন্ট হলো পুদিনা। মজা করে হোমমেড বোরহানি খাস যে সেটাও পুদিনাপাতা দিয়ে বানানো হয়। আর এই যে ড্রিংকগুলোর নাম বললাম সবগুলোতেই পাতাটা কাঁচা ব্যবহার করা হয়। এখন চিন্তা কর, তুই একগ্লাস লেমোনেড খাচ্ছিস, সেখানে আমি এককুলি পানি দিয়েছি, কেমন লাগবে তোর?’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী গিদর আর খচ্চর এই মেয়ে! সারাজীবনে আমি আর কোনোদিন বোরহানি খেতে পারব না! আপনারা পারবেন?
আমার বোরহানির গ্লাস ভেঙে খানখান করে দিয়ে ও বার্মিজ জুতো পায়ে মচমচ করে চলে গেল। এই জুতোয় পানি ঢুকলে মচমচ, কচকচ করে শব্দ হয়। আমার ইচ্ছে হয় কেটে কুচোকুচো করে জুতোগুলো ছাদ থেকে ফেলে দিই। কিন্তু পারি না, কেননা এটা আমিই কিনে দিয়েছিলাম ওকে। তাই আমাকে শাস্তি দিতে এটাকে মচমচ করে চলে ও, আমি বেশ জানি। বেশ তো, দীঘি, মিষ্টি ইনফিনিটি, আর নিস কোনোদিন। আমার কাছ থেকে কোনো গিফট আর কোনোদিন নিয়ে দেখাস!
রাগে কটমট করতে করতে আমি নিচে নেমে এলাম। আম্মু ডাকল ‘ও রাফিন এদিকে আয়।’
একগাদা কাপড়ের ভেতর বসে আছে আম্মু, বিপাশা আর দীঘি। একটা একটা করে জামা এলোমেলো করছে, এলোমেলো জামা নিজেদের গায়ে লাগিয়ে দেখছে, তারপরে আবার ভাজ করে রেখে দিচ্ছে। আমি খাটের উপর আয়েশ করে বসতে বসতে বললাম ‘কী রে, এগুলো কি রিসাইকল বিনে দিচ্ছিস? দে, বেচে দে। ভালো টাকা পাবি। আমাকে জিনজিয়ানে ট্রিট দিস,!’
রেগে গেলে সব মেয়েদের চোখ থেকেই কি সূচ্যদৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়? বিপাশা বেশ রেগে গিয়ে বলল ‘একটা প্যান্ট চার পাঁচমাস একটানা পরিস। পরতেই থাকিস, পরতেই থাকিস। তারপর সেটা ছেড়ে আরেকটা ধরিস। তখন আগেরটার কথা আর তোর মনে থাকে না। সবজায়গাতে যাওয়ার জন্য তোর প্যান্ট একটাই কিন্তু তোর কাবার্ড টাল হয়ে আছে। দে না ওটা খালি করি? ফেরিওয়ালাকে দশ টাকা পিস বেচলেও হাজারখানেক টাকা হয়ে যাবে।’
‘খবরদার বিপাশা, আমার প্যান্টে হাত দিবি না।’
‘খুব লাগে না? তাহলে আমাদের জামা বেচে দিতে কেন বললি?’
‘এত জামা তাহলে নামিয়েছিস কেন?’
‘এগুলো আমার না। দীঘির। ও বুঝতে পারছে না কোনটা পরবে আজকে, তাই মিলিয়ে দিচ্ছি।’
‘তুই কি ওর ওয়্যারড্রব কনসালট্যান্ট?’
‘ভাইয়া? যা তো এখান থেকে। যতসব আজেবাজে কথা।’
‘ঠিক আছে যাচ্ছি। আমাকে আম্মু ডেকেছে। নইলে কে আসত তোদের শাকচুন্নি, পেত্নিদের আড্ডায়?’ উঠতে উঠতে বললাম আমি।
‘উঠিস না খোকা। এই তোদের ঝগড়া থামা। খোকা, আজকে একটু যাবি দীঘির সাথে।’
আম্মুর কথায় আমি চুপ করে বসলাম।
‘দীঘির সাথে? কোথায়?’
‘চাংপাইতে। ভালো একটা প্রস্তাব আছে। ছেলেপক্ষ ভার্সিটিতে এসে ওকে দেখে গেছে আগেই। খুব আগ্রহ ওদের। এখন ছেলেটা একটু আলাদা করে কথা বলতে চাইছে ওর সাথে। একা একা মেয়ে পাঠিয়ে দেওয়াটা কেমন লাগে না? তুই একটু যাবি সাথে। পরিচয় হলো। ওদের একটু সহজ করে দিলি।’
‘কীসের ছেলেপক্ষ?’
‘আরে দীঘিকে পছন্দ করেছে। ঠিকঠাক হলে এইখানেই বিয়ে হয়ে যাবে।’
আমি আড়চোখে তাকালাম দীঘির দিকে। আকর্ণ লাল হয়ে আছে ও। খুব লজ্জা পাচ্ছে। ওর শ্যামলা গালও লাল হয়ে আছে। ও সরে গেল সামনে থেকে। আমার রাগ হলো তিড়িং করে ‘গতসপ্তাহে না কথা হলো? তখন তো কারো কথা শুনিনি। এর ভেতর ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? এত দ্রুত কীভাবে?’
‘আরেহ বিয়ে ঠিক হবে কেন? কথাবার্তা শুরু হয়েছে। খুব ভালো ছেলেটা। ইঞ্জিনিয়ার।’
‘আরে ইঞ্জিনিয়ার তাতে কী? আমার বন্ধু দেখোনি ইমতিয়াজ? ও ও তো ইঞ্জিনিয়ার। একটা নষ্ট রিচার্জেবল ফ্যান দিলাম, সেটাই ঠিক করে দিতে পারল না। ওসব ইঞ্জিনিয়ার ফিঞ্জিনিয়ারে কোনো কাজ হবে না।’
‘খোকা?’ আম্মু আমার কথার রাশ টানল। ‘আজ বিকেলে দীঘির সাথে তুই যাবি।’
‘আমি যাব না আম্মু। আমার সময় নেই। বিপাশা যাক?’
‘বিপাশাই যেত। কিন্তু দীঘির মা চাইছেন না।’
‘কেন? বিপাশা গেলে কী সমস্যা?’
‘সমস্যা নেই। আবার সমস্যা। বিপাশা ফর্সা আর দীঘি কালো।’
‘তাতে কী?’
‘তাতে কিছু না। ওর মা ভয় পাচ্ছে, যদি বিপাশা পাশে থাকলে দীঘিকে পছন্দ না করে বিপাশাকে করে ফেলে?’ আমার সাথে কথা বলতে বলতে মা গলা চড়ালো ‘এই বিপাশা? খোকার খাবারটা এখানে দিয়ে যা।’
‘কী বলো? এমন হয় না কি?’ এমন উদ্ভট ঘটনা আমি আসলেই শুনিনি। কালো বলে দীঘিকে রিজেক্ট করা যায়? স্বভাবে খান্ডারনি বলে রিজেক্ট করা যায়, কালো বলে কখনোই নয়।
‘হয়ই তো। সবাই কি রতনের মূল্য বোঝে? চকচক করতে দেখলেই সোনা ভেবে বসে। আমিই তো মেয়েটাকে নিজের করে রেখে দিতাম। এত মিষ্টি মেয়েটা।’
আমিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। মেয়েটা আসলেই মিষ্টি। মিষ্টি ইনফিনিটি। আরও বেশি আবগে ভেসে হয়তো মাকে বলেই ফেলতাম ‘বেশ মা, ওই মিষ্টি ইনফিনিটিকে আমিই বিয়ে করব।’ তার আগেই আমার নাকে পুদিনার তীব্র সুঘ্রাণ এসে ঢুকল। শুক্রবার সকালের স্পেশাল খাবার আলুপরোটা আর পুদিনার চাটনি। আলুপরোটার ভেতর থেকেও পুদিনা পাতা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করছে, যেমন করে প্রিয় মানুষ হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে তেমন করে।
আমার পেটের ভেতর ঢিসুম ঢিসুম শুরু হয়ে গেছে। আমি বিড়বিড় করলাম ‘ও মাই গড! ওহ মাই গড!’
আচ্ছা আপনারাই বলেন, ছুটির দিনের সকাল, সামনে আলুপরোটা আর ভাজামাংস, পুদিনার চাটনি। গরম ধোঁয়া উঠছে। কিন্তু এখন এই জিনিস আমার গলা দিয়ে নামবে? কেমনটা লাগে বলেন?
চলবে…