মন_হারানোর_বিজ্ঞাপন,পর্ব ৪ শেষ
নুজহাত_আদিবা
অন্বয় অফিস থেকে আসার পর আমরা দুজনে একসাথে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। প্রথমে আমি আর অন্বয় শপিংমলে গিয়ে একটা গিফট কিনলাম। তারপর চলে গেলাম অন্বয়ের কলিগদের বাসায়। ওখানে গিয়ে অন্বয়ের অন্যান্য কলিগের বউদের সাথেও দেখা হলো৷ সবাই মিলে খুব গল্প করলাম আমরা। ওনাদের সাথে আমাদের বিয়ের দিন দেখা হয়েছিল শুধু। এরপরে এবার-ই প্রথম দেখা হলো। ওনাদের বাসাটা খুব সুন্দর। ড্রয়িংরুমে বড় করে ভাইয়া আর ভাবীর একটা ছবি লাগানো। ভাইয়া আর ভাবী দুজনেই হেসে দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার ছবিটা দেখা মাত্রই অন্বয়ের কথা মনে হলো। অন্বয়ের সাথে আমার ছবি আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা। অন্বয় বেশ সিরিয়াস টাইপের মানুষ। তাই, আমার সাথে এত হেসে ছবি তোলার মতো সময় ওনার নেই। হেসে কী ছবি তুলবে? এমনিই ছবি তোলে না আবার হেসে!
আমি ভেবেছিলাম অন্বয় হয়তো আমি ব্যাতীত সবার সাথেই কথা বলে। বাট ব্যাপারটা আসলে এমন না। অন্বয় স্বভাবতই চুপচাপ ধরনের। ওখানে গিয়েও কারো সাথে তেমন কথা বলেনি। হুহ, হু, না এবং আচ্ছা এই চারটা শব্দেই অন্বয়ের কথাবার্তার সমাপ্তি। কিন্তু,এভাবে আর কতদিন? আমার তো আজকাল মনে হয়। আমি কোনো মানুষ না বরং, একটা রোবটের সাথে সংসার করছি। গুনে গুনে আমার সাথে কথা বলে অন্বয়। আর কতদিন এভাবে সহ্য করে যাবো আমি?
অন্বয়ের সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি চাতক পাখির মতো বসে থাকি। কিন্তু, অন্বয়? সারাদিনে ঠিকঠাক ভাবে আমার সাথে কথাও বলে না অন্বয়। ওইদিন রাতে আর ঘুমালাম না। সারারাত চিন্তা ভাবনা করে এই সমস্যার একটাই সমাধান বের করলাম। অন্বয়ের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে সরাসরি কথা বলতে হবে। নাহলে,এর সমাধান আর সম্ভব না। বিয়ে হয়েছে কতগুলো মাস কেটে গেছে। আর কত সহ্য করবে আমি? মেয়ে হয়েছি বলেই এসব সহ্য করতে হবে? সব স্যাক্রিফাইস আমি একা-ই করবো? সংসার কী আমার একার না কি? যে, আমাকেই এত কিছু হজম করে; মুখ বুঝে থাকতে হবে। বেশি কিছু তো চাইনি অন্বয়ের কাছে। শুধু চেয়েছিলাম একটু ভালোবাসা আর একটু সময়। তাও যদি না পাই তবে আমার আর কী করার আছে? কম তো ভালোবাসি না অন্বয়কে। এত ভালোবাসার পরেও এত অবহেলা পেতে কার ভালো লাগে? যদি ভালো নাই বাসে তাহলে ছেড়ে দিক আমাকে। চলে যাই আমি, তাও ছাড়বে না। আবার আমাকে ভালোও বাসবে না।
সকালে ভোর ছয়টা বাজে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না শেষ করলাম। অন্বয়কেও ভোর বেলা ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললাম, একটু কাজ আছে। আমার সঙ্গে ছাঁদে চলুন একটু। অন্বয় হয়তো ওনাকে এভাবে ঘুম থেকে তুলে ওঠানোর জন্য বিরক্ত হলেন। কিন্তু, আমি আজকে ওনার বিরক্তির ধার ধারলাম না। আজকে এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো।
~~~~~~~~~~
ছাঁদে গিয়ে অন্বয়কে আমি বললাম, আপনি কী কাউকে ভালোবাসেন অন্বয়? কোনো পছন্দ আছে আপনার? অন্বয় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মানে? আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন না। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কাউকে ভালোবাসেন কি না। অন্বয় জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন, তুমি আমার বউ; তুমি ব্যাতীত অন্য কাউকে ভালোবাসবো কীভাবে?
আমার চোখে পানি টলমল করছিল তখন। ঝাপসা চোখ নিয়েই আমি বললাম, কখনো বলেছেন আমাকে ভালোবাসেন? প্রত্যেকটা মানুষই তাঁর প্রিয় মানুষের থেকে এটা শুনতে চায়। আপনি আমাকে বলেছেন কখনো? আপনি আমাকে ভালোই বাসেন না। যা করেন দায়িত্বের খাতিরে করেন। এভাবে আর থাকা যায় না। ভালো না লাগলে বলবেন; আমি চলে যাবো। এভাবে একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। অন্বয় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা আমি তোমাকে আমার কাজকর্মে বোঝাবো। যে, আমি আসলেই তোমাকে ভালোবাসি। হাজার হাজার প্রতারক,ধর্ষকের মুখ দিয়ে যেই ভালোবাসা নাম বানী নিশ্বসিত হয় সেই বানী আমি নিজ মুখে কখনোই দেবো না। ভালোবাসা আমার ও আছে তোমার প্রতি তবে তা আমার কাজকর্মে আচার আচরণে প্রকাশ পাবে। ভালোবাসা থাকলেই যে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে লাফাতে হবে সেরকম কোনো শর্ত কিন্তু এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ”
আমি এবার কান্না চেপে রেখে বললাম, আপনি তো আমার সাথে ঠিকঠাক ভাবে কথাই বলেন না। আমার কী খারাপ লাগে না এতে?
অন্বয় নিচু গলায় বললেন, এটাতে তুমি আমার দোষ দিতেই পারো। আমি খুব চুপচাপ ধরনেরই। তুমি কথা বললে আমি জবাব দিতে দিতে কথা ঠিকই বলতাম। আমিও কথা বলি না তুমিও কথা বলো না। আমি ভেবেছি তুমি হয়তো আমার মতো চুপচাপ ধরনের।
আমি অন্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি মোটেও চুপচাপ ধরনের না। আমি কথা বলতে এবং মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না তাই জানেন না।
অন্বয় এবার আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন, আবারও! এবার অন্বয় বললেন, কী ভাবে বোঝালে তুমি বুঝবে বলো? আমি এমনিই, এখন তুমি আমার দোষ দাও আর নিজের দোষ দাও। আমি তো এমনিই!
আমি অন্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, জানেন? আমার বান্ধবীর বর তাঁর ছবি নিজের ওয়াল পেপারে দিয়ে রেখেছে। আর আপনি? আমার ছবিই তো নেই। উল্টো একটা ফুলের ছবি দিয়ে রেখেছেন ওয়ালপেপারে। সবাই নিজের ভালোবাসার মানুষের ছবি ওয়ালপেপারে দিয়ে রাখে। আর আপনি! ফুল, ফল, লতাপাতা যা পেয়েছেন। সব কিছুর ছবি সামনে ঝুলিয়ে রেখেছেন। শুধু আমার ছবি বাদে। আপনি আমাকে আসলেই একটুও ভালোবাসেন না। ভালোবাসলে এমনটা করতে পারতেন না।
অন্বয় এবার আমার কথা শুনে খুবই বিরক্ত হলো মনে হয়। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি দিনের বেশিরভাগ সময়-ই অফিসে কাটাই। অফিসে বেশিরভাগই পুরুষ মানুষ।কোনো মিটিংয়ে কথা বলছি সবার সাথে। এখন হঠাৎ করে আমার কোনো দরকার হলো ফোনে। ফোন খোলার সাথে সাথেই তো তোমার ছবি আগে ভেসে উঠবে। তো আমার বউকে অন্য একটা পুরুষ মানুষ দেখবে এটা কী আমার ভালো লাগবে বলো?
আমি এবার অন্বয়ের যুক্তির কাছে হেরে গেলাম। কথাটা খারাপ বলেনি অন্বয়। নিজের বউকে একটা পরপুরুষ দেখবে এটা কোনো স্বামীই সহ্য করতে পারে না। কথা ঘোরানোর জন্য অন্বয়কে বললাম,এটা নাহয় বাদ দিলাম। আমি এত রান্না করি আপনার জন্য। আপনি খারাপ হলেও বলেন ভালো। আবার ভালো হলেও বলেন ভালো। এটা কী ঠিক হলো?
অন্বয় অসহায়ের মতো মুখ করে বললো, এত কষ্ট করে আগুনের তাপে রান্না করো আমার জন্য। সেটা আমি খারাপ বলি কীভাবে?
আমি আবার হেরে গেলাম অন্বয়ের কাছে। এবার অন্বয়কে বললাম, তাহলে আপনি গোলাপ ফুলের তোড়া চুড়ি এগুলো কার জন্য আনেন? অন্বয় এবার রেগে গেলেন একটু। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ছাড়া আর কার জন্য আনবো? তুমি জানো? তুমি আসলে একটু বুদ্ধু! তোমার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই। আমি অন্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, সেটা বলে দিলেই তো হয়। আপনি আমার জন্য এনেছেন আর আমাকে বলবেন না?
এটা বলেই পাশে তাকিয়ে দেখি অন্বয় চলে যাচ্ছে ছাঁদ থেকে। আমি অন্বয়কে পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? থাকুন না আমার সাথে আরেকটু!
অন্বয় পেছন ফিরে বললেন, মন হারানোর বিজ্ঞাপন দিতে। আমি কিছু না বুঝতে পেরে বললাম মানে? অন্বয় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার বউ নামক এক নারীতে আমার মন হারিয়েছে। তাই এখন মন হারানোর বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না আমি।
এটা বলেই অন্বয় ছাঁদ থেকে নেমে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম ওখানেই। না বলুক ভালোবাসি, এভাবেই নাহয় অপ্রকাশ্য ভাবে প্রকাশ করুক নিজের ভালোবাসা!
সমাপ্ত।