ইতি মাধবীলতা,পর্ব_১
আভা_ইসলাম_রাত্রি
(১)
মাধবীর গগণবিদারক চিৎকারে সম্পূর্ণ কালি মন্দির যেনো নিস্তব্ধ গুহার ন্যায় নীরব হয়ে গেছে। মাধবীর সিথি ভর্তি লাল টকটকে সিঁদুর, নাকে ঠোঁটে সিঁদুরের লাল রঙের ছিটে! এই মুহূর্তে মাধবীকে দেখতে নিলাংসুর কাছে সাক্ষাৎ দেবী দুর্গার মত প্রাণনাশিনী মনে হচ্ছে। মাধবী এক রক্ষণশীল বেদ পরিবারের মেয়ে। কিন্তু আজকের দিনটা মাধবীর জন্যে এমনরূপে ধ্বংস ডেকে আনবে, সেটা মাধবী ঘুর্নাক্ষরে জানতে পারেনি। কিছুক্ষণ আগেই জমিদার বাড়ির বড় ছেলে নিলাংসু মাধবীকে একপ্রকার ধরেবেধে এই মন্দিরে নিয়ে এসে, মাধবীর সম্মতিবিহীন জোরপূর্বক মাধবীকে মন্দিরে সিঁদুর দান করেছে।
মাধবীর মরে যেয়ে ইচ্ছে করছে, তার মাথায় লেপ্টে থাকা সিঁদুরকে পা দিয়ে পিষে ফেলতে মন চাইছে তার। মাধবী ধপ করে মাটিতে বসে গেল। হাত উঠিয়ে মাথার সিঁদুর এবড়োথেবড়ো করে মুছে ফেললো ও। অতি রাগে নিজের হাত নিজেই কামড়ে ধরলো। খামচে ধরলো নিজের চুল, গলার নরম মাংসপিন্ড। গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো ও। চিৎকার করে বলতে লাগলো,
— ও ভগবান, এ কি সর্বনাশ হয়ে গেলো আমার।
মাধবীর পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নিলাংসু। তার হাত ভর্তি সিঁদুর। সে স্থির চোখে ক্রন্দনরত মাধবীর দিকে চেয়ে আছে। তার চোখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে মাধবীর ক্রন্দনরত মুখ পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্য্য। নিলাংসু ধীরেধীরে মাধবীর পাশে হাঁটু গেরে বসলো। মাধবী অনুভব করতে পারলো তাকে। মাধবীর কান্না এখন হিংস্রতায় পরিণত হলো। সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো নিলাংসুর পানে। অথচ, নিলাংশসু বেপরোয়া। সে ঠোঁটে অদ্ভুত এক বক্র হাসি টেনে আবারও এক বেপরোয়া কাজ করে বসলো। হাতের অবশিষ্ট সিঁদুর দ্বারা পুনরায় রাঙিয়ে দিলো মাধবীর সিথিখানা। মাধবী হতবাক হয়ে গেলো। নিজের প্রতি ঘৃণায় চোখ বুজে এলো তার। নিলাংসু সরে এলো। মাধবীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো আলতো করে। মাধবী থমকালো। এক ধাক্কায় সরিয়ে দিতে চাইলো নিলাংসুকে। কিন্তু, নিজের এহেন জীর্ণশীর্ণ দেহ দ্বারা নিলাংসুর মত পালোয়ান শরীরকে একবিন্দুও সরাতে পারলো না ও। মাধবী হার মানলো। বাঘ যেমন শিকারের কাছে বশীভূত হয়, এমন করে সে নিলাংসুর শক্তির কাছে বশীভূত হলো। নিলাংসু মৃদু হাসলো। মাধবীর কানের কাছে ঠোঁট এনে পুরুষালি মধুর কণ্ঠে বললো,
— তুমি যতবার আমার নামের সিঁদুর মুছবে, আমি ততবার আমার নামে তোমার সিথি রাঙিয়ে দেবো, মাধবীলতা!
মাধবী এবার গর্জে উঠলো। হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় তেড়ে গেলো নিলাংশুর দিকে। নিলাংশুর পাঞ্জাবির কলার নিজের আঙ্গুলের ভাঁজে মুচড়ে ধরলো ও। চোখে রাগ রীতিমত টগবগ করছে। অথচ, নিলাংসু হাসছে। মন খুলে হাসছে সে। মাধবী গর্জন করে বললো,
— তোকে আমি খুন করে ফেলবো, পাপী!আমার এত বড় সর্বনাশ করতে তোর বিবেকে একবারও বাঁধলো না। বল!
নিলাংসু আবারও হাসলো। জীবন্ত বাঘিনীকে ঠান্ডা করা তার হাতের খেল। তবুও সে নিজের সেই খেল দেখালো না। বরং খুব শান্ত ধীরে বললো,
— আজ থেকে আমিই তোমার সকল সর্বনাশের কারণ হবো, মাধবীলতা। আমার চোখেই, আমার গভীরতম স্পর্শেই আজ থেকে তোমার বিনাশ হবে, আমার মাধবীলতা।
মাধবী ক্ষেপে গেলো। গলা টিপে ধরলো নিলাংসুর। নিলাংসুর দম বন্ধ হলো, শ্বাস রোধ হলো। তবুও সে নির্বিকার। স্থির চিত্তে চেয়ে রয় নিজের প্রাণনাশিনীর পানে। মাধবী বললো,
— আমি তোকে আমার স্বামী হিসেবে মানি না। আমি বিষ খেয়ে মরে যাবো, তাও নিজেকে তোর হাতে সঁপে দেবো না, পাপী।
মাধবীর কণ্ঠে আত্মহত্যার কথা শুনে মুহূর্তেই নিলাংশুর বদন পরিবর্তন হয়ে গেলো। সে এবার নিজের জোর খাটালো। সামান্য শক্তি প্রয়োগ করে নিজের গলা থেকে মাধবীর হাত ছাড়িয়ে নিল। নিজের সাথে চেপে ধরলো মাধবীর তেজপূর্ণ দেহ। চোখে চোখ রেখে বললো,
— মরার কথা আরেকবার বলে দেখ না, শুধু। তোর মরার পর তোর চৌদ্দ গুষ্টিকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো আমি। যম চিনিস, যম? আমি হলাম সেই যম।
নিলাংসু ছেড়ে দিল মাধবীকে। এতক্ষণ নিলাংশুর হাতের মুঠোয় নিজের দেহ আবদ্ধ থাকায় মাধবীর সব শক্তি ফুরিয়ে গেলো। পানির পিপাসায় জিহ্বাটা যেনো ঝুলে পড়বে। তবুও তার গর্জন একরত্তিও কমে নি। মাধবী দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
— একরাতের মধ্যে আমি তোর জান খেয়ে ফেলবো, আমায় ছেড়ে দে। নাহলে নিজের মৃত্যু ডেকে আনবি।
— তো মেরে ফেলো। বাঁধা দিচ্ছে কে?
নিলাংশু নির্বিকার। তার মধ্যে মরার কোনো ভয় নেই। সে অকুতোভয়! মাধবী অতি বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। কথা ফুরিয়ে গেলো তার। যে মরার ভয় পায় না, তাকে আর কিসের ভয় দেখানো যায়, মাধবী জানে না। মাধবীর এহেন পরাজিত মুখ দেখে নিলাংসুর গর্ব হলো খুব। সে বলল,
— আজকের মধ্যে যদি আমায় তুমি খুন করে ফেলতে পারো, তবে তোমার মুক্তি নিশ্চিত। আর হ্যাঁ, আমায় তুমি নিশ্চিন্তে খুন করতে পারো। আমি মরে গেলেও তোমার কোনো জেলার গানি টানতে না হয়, সেই ব্যবস্থাই করে যাবো আমি। চিন্তা নেই, আমার মাধবীলতা।
মাধবী হতবিহ্বল হয়ে গেলো। তার কথা ফুরিয়ে গেলো। সে তীক্ষ্ম চোখে পরখ করতে লাগলো নিলাংসুকে। মনে মনে ছক সাজাতে লাগলো, নিলাংসুর মৃত্যুর! আজ এই মহা পাপীকে মাধবীর হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কেউ না, একমাত্র মা লক্ষ্মী ব্যতীত।
_____________________________
জমিদার বাড়িতে এই মুহূর্তে বেশ হইচই চলছে। সবার মুখে ফিসফিসিয়ে কথা, ‘ জমিদার বড় পুত্র এক বেদের মেয়েকে বিয়ে করেছে? ছেহ, ছেহ, ছেহ! এ কি অমঙ্গল! শনির প্রভাব পড়েছিল নাকি পুত্রের গায়ে? ‘
সবার মুখেতেই এখন কথা ফুটেছে। কিন্তু জমিদার গিন্নি একদম নীরব হয়ে আছে। নিজ ঘরে বসে আছেন মুখে কুলুপ এঁটে। সবাই মুখ বন্ধ করে কথা বললেও, উনার কানে সব কথাই আসছে। তিনি শুধু অপেক্ষা করছেন, তার পুত্র আর পুত্রবধূর বাড়ি ফিরে আসার। আজ এর একটা হ্যস্তন্যস্ত করতেই হবে। নিলাংসু কি জমিদার বাড়ির প্রথা ভুলে গেছে?
একটুও পর, বাড়ীর দাসী হন্তদন্ত হয়ে জমিদার গিন্নির কাছে এলো। জমিদার গিন্নি তখন মুখে পান চিবুচ্ছেন। দাসি নম্র কণ্ঠে খবর দিল,
— গিন্নি মা, বড় কর্তা এইচেন।
জমিদার গিন্নি গম্ভীর মুখে বললেন,
— যাও, আসছি আমি।
দাসি চলে গেলে জমিদার গিন্নি শাড়ীর আঁচল কাঁধে তুললেন। লম্বা চুলে খোঁপা বেধে হেঁটে চললেন সদর দরজার দিকে।
— কনক, বরণ ডালা নিয়ে আয়।
দরজার সামনে দন্ডায়মান নিলাংসুর আর তার স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন হাক ডাকলেন জমিদার গিন্নি। নিলাংসু মায়ের এহেন রাগান্বিত কণ্ঠেও মাধবীর হাত শক্ত করে ধরে আছে। বরন করার কথা শুনে মাধবীর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেলো। সে তেরে যেতে চাইলো জমিদার গিন্নির দিকে। তবে হাত আটকালো নিলাংসু। রক্তলাল চোখে তাকালো মাধবীর দিকে। মাধবী থমকে রইলো। তবে মুখের রাগ এখনো স্পষ্ট
তার।
অতঃপর উলু, শাখ বাজিয়ে ফুল দিয়ে বরণ করা হলো মাধবীকে। তবুও মাধবী সব সহ্য করছে। মনে মনে ভাবছে, শুধু আজকের রাতটাই তো। তারপর নিলাংসুকে মেরে এই নরক থেকে পালিয়ে যাবে মাধবী!
#চলবে