ইতি মাধবীলতা – ৪

0
771

ইতি মাধবীলতা – ৪
আভা ইসলাম রাত্রি

নিচের নোট পড়ার অনুরোধ রইলো।

সম্পূর্ণ জমিদার বাড়ি এই মুহূর্তে নীরব হয়ে আছে। প্রতিজনের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ অব্দি গা’টাকে শিরশির করে তুলছে। এমতাবস্থায় জমিদার সমরেশ ভট্ট গলা ছাড়লেন। কণ্ঠনালি অবাধ গাম্ভীর্যে পূর্ণ করে বললেন,
— হিন্দু ঘরের পুত্র হয়েও তোমার এহেন কাজ আমাদের জমিদার বাড়ির মাথা হেঁট করে দিয়েছে, নিলাংসু। তোমার কাছে এই পাপের আশা আমি কস্মিককালেও করি নে।

নিলাংসু মুখ বুজে শুনলো বাবার অভিযোগ। একে একে বাড়ীর সকল পুরুষ অভিযোগ জানাতে লাগলো। নিলাংসুর মেঝো ভাই সত্যনারায়ণ যথাসম্ভব নম্র কণ্ঠে বললো,
— আসলেই দাদা, কি করে করলে বলো তো এ কাজ? একবারও কি আমাদের জাতের কথা চিন্তায় আসলো না?

নিলাংসু তখনো নিরুত্তর। মাধবী কক্ষের একপাশে কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের তীক্ষতা জ্বলসে দিচ্ছে এ কক্ষের সকল ব্যক্তিকে। কাকামশাই বললেন,
— তা বিয়ে করেছো, ভালো কথা। কিন্তু, এ ছোট জাতের মেয়ের হাতের অন্ন মুখে রুচবে?

মাধবী বলতে চাইল, ‘ তোদের কে বলেছে আমার হাতের অন্ন খাওয়ার জন্যে। আমায় মুক্তি দে। জনমের অন্ন খাওয়া শিখিয়ে দেবো একদম।’ তবে, সে বলতে পারলো না। তার আগেই তার ভাষা আটকে দিলেন জমিদার গিন্নি। হাত খামচে ধরলেন মাধবীর। মাধবী আটকালো, তবে রুখে গেলো না। ব্যগ্র হাতে জমিদার গিন্নির হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। জমিদার গিন্নি এতে বেশ অপমানিত বোধ করলেন, তবে ঘরভর্তি মানুষের সামনে নিজের অপমানকে আর প্রশ্রয় দেওয়ার সাহস জুটলো না তার।

— চুপ কেন? হয়তো নিজের অন্যায় স্বীকার করো নতুবা এ পাপী মেয়েকে এ ঘর থেকে বিদায় করো। মেয়ে বিদায় হওয়ার পর গঙ্গা জলে নিজেও স্নান করবে, আর ঘরেও শিব নাম জপ করে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দেবে। এতে যদি পাপ মোচন হয়!

সমরেশ ভট্ট কথাটা বলে ধুতি সামলে উঠে দাঁড়ালেন। তার কথা তিনি বলে দিয়েছেন। এখন শুধু তার আদেশ পালন করার অপেক্ষা। তিনি এও জানেন, এ বাড়িতে তার আদেশ অমান্য করার দুঃসাহস কারোর ইহজন্মেও হবে না। সমরেশ ভট্ট পা বাড়ালেন শোবার ঘরের পানে। এতক্ষণ পর হঠাৎই নিলাংসুর কথায় সমরেশ ভট্টর চলন্ত পা মমির ন্যায় নির্জীব হয়ে গেলো।

— আমি মাধবীলতাকে বিয়ে করে যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, তবে মাধবীলতা নয় বরং আমি নিজে এই জমিদার বাড়ি ত্যাগ করবো।
সমরেশ ভট্ট পেছনে ফিরলেন। তার চোখ ভয়ানক আগুল ছলকে উঠছে। নিজ পুত্রের এহেন দুঃসাহসিক কাজ তার মাথার শিরা উপশিরা অব্দি নড়ে উঠেছে। নিলাংসু কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখোমুখি হলো নিজের অহংকারী বাবার সাথে। চোখে চোখ রেখে বললো,
— আমি মাধবীলতাকে ভালোবাসি। আমি ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি যে, ভালোবাসা কোনো ধর্ম, জাত পাত মানে না। মাধবী বেদের মেয়ে তা জেনেই আমি ওকে সিঁদুর দান করেছি। নর্দমা তুল্য সমাজের কাছে আমি আমার ভালোবাসার বলিদান করতে পারবো না। এতে যদি আমার গৃহত্যাগ করতে হয়, তবে তাই সই!

সমরেশ ভট্ট দুচোখ শীতল হয়ে এলো। পুত্রের কণ্ঠের ভয়ানক তেজে তার বুকের ভেতর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেতে লাগলো। বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হলো, এ তারই ঔরসজাত সন্তান। সমরেশ ভট্ট এবার খানিক কঠোর হলেন। গা কাপিয়ে গর্জন করলেন,
— তুমি ভুলে গেছো, আমাদের জাত, আমাদের সম্মান, আমাদের বংশ জ্ঞান? দু পয়সার ভালোবাসার জন্য তুমি গৃহত্যাগ করার জ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবার আমাদের কথা চিন্তা করলে না?

নিলাংসু নম্র কণ্ঠে জবাব দিল,
— আপনারাও তো আমার কথা চিন্তা করেন নি। তবে, আমার বেলায় কেনো এতো অবিচার?

সমরেশ ভট্ট যেনো মূর্ছা যাবেন। তার মাথা ভনভন করছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। দেহের আকস্মিক অসুস্থতার দরুন তার কন্ঠ শীতল হয়ে এলো। তিনি বললেন,
— তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি তাই করো। তবে ভুলে যেও না, এ বাড়ির কর্তা এখনি জীবিত আছেন। আর তোমরা সবাই তার ক্ষমতাভুক্ত।

সমরেশ ভট্ট গজগজ করতে করতে সে জায়গা প্রস্থান করলেন। নিলাংসু ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে মাধবীর দিকে তাকালো। মাধবীর চোখ তখন অবাকতায় ছেয়ে আছে। এ বাড়ির সদস্যের বংশ, জাত-পাত নিয়ে অহংকার তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে দিয়েছে। এরা কি আদৌ মানুষ? মাধবী ভাবতে পারলো না।
___________________________
নিলাংসু নিজ কক্ষে আরাম করছে। মাধবী উনুনের কাছে বসে আছে। কি করবে, কোথা যাবে কিছু ঠাওর করতে পারছে না সে। এ বাড়ি থেকে পালানো এক প্রকার অসম্ভব। বাড়ির সদর দরজায় পাহারা দিচ্ছে তিনজন পালোয়ান লোক। তাদের হাতে বল্লম, পিঠে সূক্ষ ধনুক। মাধবীর মত চুনোপুটি তাদের কাছে অতিকায় নগন্য এক নারী। এ নরক থেকে কিভাবে পালাবে আপাতত তার মাথায় এই চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

— বড় কত্তি, বড় কত্তা আপনাকে ডে’কচেন।

মাধবীর ধ্যান কাটলো। সে তাকালো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নত মুখের দাসীর পানে। মাধবী রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
— বলে দাও, আসতে পারবো না। আমার এত ঠ্যাকা পড়েনি তার কাছে যাওয়ার।

দাসি অবাক হলো ভীষণ। হঠাৎ করে মাধবীর এমন রেগে যাওয়া তার মস্তিষ্কে বেধ করতে পারলো না। দাসি পুনরায় ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
— বড় কত্তা বেজায় রাগি, কত্তি! তেনাকে এ কথা বললে তেনি আমায় পায়ের তলায় পিষে ফেলবে নে।

মাধবী ভ্রু কুঁচকালো। এ বাড়িতে এসে একটা বিষয় সে অবগত হতে পেরেছে, এ বাড়ির প্রত্যেক সদস্য নিলাংসুকে ভীষণ ভয় পায়। আর পাবেই না কেনো? মানুষটা তো আস্ত এক খিটখিটে স্বভাবের। এর মাথায় আদৌ কোনো আক্কেল জ্ঞান আছে?

মাধবী উঠে দাঁড়ালো। মাথায় কাপড় তুলে দাসিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। তবে, পেছন থেকে বাঁধ সাধলো দাসি। বললো,
— কত্তি, গেলাসে করে দুধ দেবো আপনাদের?

মাধবী থমকে গেলো। হুট করে মাথায় খেলা করলো ভয়ানক এক ভাবনা। সে কুটিল হাসলো। পেছন ফিরে বললো,
— না, তুমি যাও। আমি নিজে বানিয়ে নিচ্ছি।

দাসি কথা বাড়ালো না। নতমুখে রান্নাঘর প্রস্থান করলো সে। মাধবী হাসলো আবার। ঠোঁটে বক্র হাসি টেনে বিড়বিড় করে বললো, ‘এবার জমবে খেলা! মরবে সৈন্য, মুক্তি পাবে ঘোড়া!’

#চলবে

জরুরী নোটিশ, গল্পে ধর্ম নিয়ে অনেক মাতামাতি হচ্ছিল। তাই সবার কথা ভেবে, আমি একদম শুরু থেকে মাধবীকে এক বেদের হিন্দু মেয়ে হিসেবে এডিট করেছি। আপাতত ভুলে যান, মাধবী এই গল্পে কোনো মুসলিম মেয়ে ছিল। আমি মাধবীকে ধর্মান্তরিত করিনি। বরং শুরু থেকেই তাকে হিন্দু বানিয়েছি। এখন থেকে তাকে হিন্দু মেয়ে হিসেবেই পাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here