ইতি মাধবীলতা – ৬ (১ম অংশ)

0
708

ইতি মাধবীলতা – ৬ (১ম অংশ)
আভা ইসলাম রাত্রি

মাধবীকে এরূপ স্থির দেহে লক্ষ্য করতেই নিলাংসুর অধর কোণে চাপা হাসি ছড়ালো। সে ঠোঁট রাখলো মাধবীর কানের লতিতে। কানের লতি নিজ দন্ত দ্বারা কামড়ে ধরতেই সম্ভিত ফিরে পেলো মাধবী। ক্ষেপে উঠলো তার রক্ত, শিরা উপশিরা। সে নিলাংসুর বুকে হাত রেখে এক ধাক্কায় তাকে নিজের থেকে সরিয়ে ফেললো। নিলাংসু সরে গেলো ঠিকই, তবে ঠোঁটে সবজান্তার ন্যায় এক অদ্ভুত বক্র হাসি টেনে চেয়ে রইলো নিজের প্রিয়তমার পানে। রাগে মাধবীর সম্পূর্ণ শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। সে ভীষন রকমের তেজ নিয়ে বললো,
— আমাকে ছোঁয়ার স্পর্ধা হয় কি করে আপনার? একবার বলেছি না, আপনার স্পর্শে আমার ঘৃনা হয়! তাও কেনো বারবার একই কাজ করেন?

নিলাংসু একটুখানি হাসলো। বুকে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে তীক্ষ্ম চাওনি নিক্ষেপ করলো মাধবীর দিকে। বললো,
— কেনো? ভয় হয় আমার স্পর্শে? যদি না নিজের মন হারিয়ে ফেলো?

মাধবী কিছুটা থতমত খেলো। মানুষটা এত ত্যাড়া কেনো? স্বাভাবিক কথার এরূপ অস্বাভাবিক অর্থ বের করাই কি তার সহজাত ধর্ম? মাধবী ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। তথাপি একরত্তিও কথা বাড়ালো না। চুপচাপ নিলাংসুকে পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে বালিশ হাতে নিল। বারান্দার দিকে পা বাড়ালে নিলাংসু পেছন থেকে প্রশ্ন করে বসে,
— কোথায় ঘুমাবে তুমি?

মাধবী যেতে যেতে বলে,
— আপনার পাশে তো অবশ্যই নয়! বারান্দায় ঘুমাবো এখন থেকে।

এবার নিলাংসুর বেশ রাগ হলো। রাগের উত্তাপে নাকের ডগা লাল টকটকে হয়ে গেলো। রক্তিম ঠোঁটজোড়া নিছক কেঁপে উঠলো। সে তেড়ে আসলো মাধবীর পানে। অন্যমনস্ক মাধবীকে হুট করে নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা পাজকোলা করে নিয়ে ছুটলো নিজের বিছানার পানে। মাধবী হতবাক হলো, অতি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকালো নিলাংসুর পানে। অতঃপর, অস্থির হয়ে উঠলো। পা নাড়াতে লাগলো ক্রমাগত, হাত দিয়ে নিলাংসুর বুকে অজস্র আঘাত বসালো। তবে নিলাংসুর তা দেখার বিন্দুমাত্র অবসর নেই। সে তার কাজে মত্ত! মাধবীকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মাধবী চঞ্চল হয়ে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বসে চিৎকার করে বললো,
— এসব কি ধরনের অভদ্রতা? ছাড়ুন, আমি এখানে ঘুমাবো না।

নিলাংসু শুনলো। উত্তরে শুধু এটুকু বললো,
— আমার মর্জি যেখানে, তোমার রাত সেখানেই পোহাবে, মাধবীলতা!

অতঃপর, মাধবী হার মানলো মানুষটার কাছে। নিলাংসুর শক্তপোক্ত দেহের চাপে নিজের এহেন জীর্ণশীর্ণ দেহ কোথায় হারিয়ে গেলো টেরই পেলো না। নিলাংসু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে মাধবীকে। মাধবীর কোমল কাঁধে নিলাংসুর ওষ্ঠ! তার ঠোঁটের স্পর্শ মাধবীর ত্বক বেধ করে শিরা উপশিরা অব্দি পৌঁছে গেছে। মাধবী নিলাংসুর থেকে মুক্তি পেতে চড়ুই পাখির ন্যায় ছটফট করলো খানিক। তবে নিলাংসুর শক্ত হাতের স্পর্শে নিজের শক্তি খুব একটা কাজে দিলো না। মাধবী একসময় হার মানলো। রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
— আমার রাগ লাগছে, কিন্তু! ছাড়ুন আমায়।
— রাগ লাগুক! বাঁধা দিচ্ছে কে?
— আমি কিন্তু সব ছারখার করে দেবো!
— আমি তো সেই কবেই তোমার প্রেমের অনলে ছারখার হয়ে আছি!
— এর জন্যে বহুত পস্তাবেন আপনি!
— তোমাকে ভালোবাসে আমি যেটুকু সহ্য করেছি, তাতে এই পস্তানো নিছক সামান্য বটে!

মাধবী আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। নিলাংসুর ইতিমধ্যে ঘুমের চোটে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যস্ত! তবে মাধবীর চোখে ঘুম কই? তার শরীরে হিম কাঁপন সৃষ্টি হচ্ছে। গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এ কি অসহ্য অত্যাচার!
_____________________________
আজ জমিদার বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতি বছর এই ঘোরোয় উৎসব জমিদার বাড়ীর ঐতিহ্য! উৎসবের খাতিরে সম্পূর্ণ বাড়ি সেজে উঠেছে। নিলাংসু সকাল থেকে এই উৎসবের জন্যে কাজে ব্যস্ত! মাধবী আপন ঘরে বসে আছে। বিশেষ কোনো কাজ নেই তার। আর কাজ থাকবেই বা কি করে? এ বাড়ির সবাই মাধবীকে কিছু ছুঁতে অব্দি দেয়না। পাছে ছোট জাতের স্পর্শে যদি কিছু অপবিত্র হয়ে যায়?

হঠাৎ মাধবীর ঘরে দাসীর আগমন ঘটলো। দাসী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নম্র কণ্ঠে জানালো,
— বড় কত্তি, মেঝো গিন্নিমা আপনায় ডেক’চেন!
মাধবী ছোট্ট করে বললো,
— বলে দাও, আসছি আমি।

দাসী চলে গেলো। মাধবী লম্বা চুলে খোঁপা বেঁধে পা চালালো রান্নাঘরের ওদিকে।

— তোমার বাপ নাকি এসেছে এ বাড়িতে?
নিলাংসুর মেঝো কাকীর কণ্ঠে কথাটা শুনে মাধবী একপ্রকার স্তব্ধ’ই হলো। তার চোখে অবাক, বিস্ময় খেলা করলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো সে,
— আমার বাবা? কোথায় তিনি?

মেঝো কাকী চুলোয় লাকড়ি ঠেলতে ঠেলতে জবাব দিলেন,
— কোথায় আবার? সদরের সামনে। যেই না উৎসবের খবর পেয়েছে, ওমনি নাক শুঁকতে শুঁকতে এ বাড়ি অব্দি চলে এসেছে। এইজন্যেই বলে, নিচু জাত তো বেহায়ার জাত। আমি বাপু…

মাধবী আর একটুও কথা শুনলো না। ছুঁটতে ছুঁটতে চললো সদর দরজার দিকে। তার বাবা এসেছেন? কতদিন পর?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here