ইতি মাধবীলতা – ৬ (২য় অংশ শেষ)
আভা ইসলাম রাত্রি
সদরের সামনে শীতল পাটি পেতে রাখা। তাতে গরীব মানুষের ভোগ খাওয়ানো হচ্ছে। নিজের বাবাকে সেখানের এক স্থানে ঠায় বসে থাকতে দেখে মাধবীর আত্মা যেনো ছলকে উঠলো। নিজের ভগবান তুল্য পিতার এরূপ অপমান মাধবীর একটুও সহ্য হলো না। মাধবী এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুঁটে গেলো বাবার পানে।
— বা-বাবা?
এতদিন পর বহু প্রতীক্ষিত মেয়ের কণ্ঠে নিজ সম্বোধন শুনে রামনাথ ফিরে তাকালেন। মাধবীর ছলছল করা চোখে দৃষ্টিপাত করতেই তার বক্ষপিঞ্জরে লুকিয়ে থাকা হৃদপিন্ড আঁতকে উঠলো। মাধবী দৌঁড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। মাধবীর চক্ষু থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে রামনাথের ঘাড় স্পর্শ করলো। রামনাথ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিয়ে মগ্ন। মাধবী বলতে লাগলো,
— এতদিন কই ছিলে, বাবা? আমি খবর পাঠিয়েছিলাম বেদপুরে!! কিন্তু খবর দেইনি কেউ। এতদিন কেনো এলে না তুমি?
রামনাথ উত্তর খুঁজে পেলেন না। আসল বিষয় তো কোনো অন্য! মেয়ের প্রতি রাগ, ক্ষোভ তাকে এতদিন অন্ধ করে রেখেছিল। চোখ থাকতেও তিনি বেপরোয়া ছিলেন। আজ মাধবীর মা, কাজল কত করে বলেছে, মেয়েকে দেখে আসতে। তাই কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে রওনা হয়েছিলেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ীর দিকে। রামনাথ উত্তরে মনযোগ দিলেন না। নিজে প্রশ্ন করে বসলেন,
— তুহ সুখ আছিস তোহ, মেরি বাচ্চা?
মাধবী সরে দাঁড়ালো। কণ্ঠনালি স্বাভাবিক করে নতমুখে বললো,
— খুব আছি বাবা। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না।
রামনাথ যা বোঝার বুঝে গেলেন। মেয়ের মুখের রেখা বলে দিচ্ছে, মেয়ে তার বেশ অসুখেই আছে! এ কদিনেই চোখের নিচে কালশিটে হয়ে গেছে। যে চোখে সারাক্ষণ কাজলের রেখায় ডুবে থাকতো, আজ সেই চোখে নির্ঘুমের দুর্বিষহ চিন্হ! রামনাথের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতে পারলো, তার মেয়ে সুখে নেই। তবে তিনি তার একটুও বুঝতে দিলেন না মেয়েকে। বললেন,
— সোন, মেরি বাচ্চা! তু যে সামাজ মে এসেছিস, এ সামাজ হাম লুগোকে লিয়ে নেহি হে। এ সামাজ সাপের মত বিষে ভরা। এরা শুধু ছোবল দেনে কি মওকা ঢুন্তে হে। সাবধানে থাকবি মেরি বাচ্চা! হামারি আশীর্বাদ হামেশা তেরি উপার হে।
মাধবী ডানে বায়ে মাথা নাড়লো। মাধবীর বুকখানা কান্নার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। সমাজের জাত নিয়ে এরূপ তারতম্য তাকে অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছে। তবুও সে দমবে না। সে বেদপুরের সরদারের মেয়ে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবার মত ছোট মন নিয়ে তার জন্ম হয়নি। তার চিন্তা বিকশিত, তার মন সুগঠিত!
— আরে, কাকামশাই! আপনি এখানে?
নিলাংসুর কথা শুনে মাধবী সামনে তাকালো। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবিতে আচ্ছাদিত এক ভয়ঙ্কর পুরুষকে দেখামাত্রই যে কেউ বলতে বাধ্য, ‘ এ এক খাঁটি সুপুরুষ বটে ‘ এতক্ষণ কাজ করার দরুন তার কপাল, গলা ঘেমে উঠেছে। গলায় বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা বলিষ্ট বুকের গহ্বরে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। নিলাংসু রামনাথের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
— ভেতরে আসুন না, কাকামশাই! উৎসবের ভোগ খেয়ে যাবেন। আসুন!
রামনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। নিলাংসুকে পূর্বে মাঝেম্যেই বেদপুরে দেখা যেত। ইতি-ওতি ঘুরে বেড়াতো, আর খামখেয়ালী ভাবে খানিক পর উঁকি দিত সরদার বাড়ির জানালার দিকে। তখনো তিনি জানতেন না, এ ছেলে তার মেয়ের এইরূপ ক্ষতি করে দিবে। রামনাথ গম্ভীর সুরে বললেন,
— তার দরকার নেহি হে, বাপু! এসেই যা খাতিরদারি পেলুম, তাতেই পেট হামারা ভারগায়া। ওর নেহি চাহিয়ে হামকো!
নিলাংসুর ভ্রুতে সূক্ষ্ম এক ভাঁজ পড়লো। রামনাথের এহেন কথার প্যাঁচ বুঝতে তার বেশ সময় লাগলো। সে উত্তরের আশায় মাধবীর দিকে তাকালো। তবে নিরুত্তর মাধবীকে দেখে সে আশায়ও ঝরঝর করে পানি পড়লো। নিলাংসু হঠাৎ করে মনে পড়লো, রামনাথ এই গরীবশালায় কি করছেন? তার তো এখন বাড়ীর ভেতরে থাকার কথা! নিলাংসু মাথায় খানিক চাপ প্রদান করলো। অতঃপর, পুরো বিষয়টা তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো। নিলাংসু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কাকা, আপনাকে কেউ বাড়ীর ভেতরে যেতে বলে নি?
— উসকি কই জরুরত নেহি হে, বাপু। রেহনে কে লিয়ে হামারি ঘর আছে। আচ্ছা বেটি, এখন হাম যাই। তেরি মা একলা হে না? তুহ সাবধানে থাকিস, মেরি বাচ্চা!
অতঃপর, মাধবীর মাথায় কতক্ষণ হাত বুলিয়ে রামনাথ জমিদার বাড়ি প্রস্থান করলেন।
রামনাথ চলে যেতেই নিলাংসু মাধবীর বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরলো। মাধবী নিলাংসুর দিকে তাকালে নিলাংসু বেশ রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার বাড়িতে তোমার বাবার এরূপ অপমান হচ্ছিল, তুমি কিছু বলো নি কেন?
মাধবী খুব অবাক হওয়ার ভান করলো। আকাশ থেকে টপকে পড়ার মত চেহারা নিয়ে বললো,
— আমার বাড়ি? কোনটা আমার বাড়ি? ওহ হ্যাঁ, এই জমিদার বাড়ি যেখানে আমার বিন্দুমাত্র ইজ্জত নেই, এটা আমার বাড়ি? যে বাড়ীর প্রতিটা বস্তু ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই, এটা আমার বাড়ি? বাহ্, রসিকতা করা তো কেউ আপনার কাছে শেখে!
নিলাংসুর ভ্রু কুচকে মাধবীর পানে চেয়ে রইলো। মাধবীর বদনে স্পষ্ট কিছু কষ্ট! এ নারী ভাঙবে, তবু মচকাবে না! হে বিধাতা, নারী মনের কি বৈচিত্র্য!
#চলবে