ইতি মাধবীলতা – ৭ (১ম অংশ)
আভা ইসলাম রাত্রি
খাবার ঘরের টেবিলে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার রাখা। চেয়ারে চেয়ারে বসা জমিদার বাড়ীর সকল পুরুষ। বাড়ীর স্ত্রীরা পুরুষদের খাবার বেড়ে দিতে ব্যস্ত। কিন্তু এত নারীর মধ্যে মাধবীলতার সুন্দর মুখখানা নিলাংসুর নজরে এলো না। খাবার চিবুতে চিবুতে একবার রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলো নিলাংসু। নাহ, সেখানেও তো নেই সে। কোথায় গেলো?
— বাবু, আরো একটা মাছের মাথা দেই তোকে?
রেখা দেবীর হাতে মাছের কৌটা। হাতে চামচ নিয়ে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন নিজের ছেলের দিকে। ছেলে একটা হ্যাঁ বলুক, মাছের বড় মাথাটা ছেলের পাতে তুলে দিতে একটুও বিলম্ব করবেন না তিনি। অথচ, নিলাংসু মাছের মাথার বদলে জিজ্ঞেস করে বসলো,
— মা, মাধবীলতা কোথায়? ওকে দেখছি না কেনো?
রেখা দেবী নিছক অসন্তুষ্ট হলেন বটে। চেহারাখানা থেকে থেকে থমথমে রূপ ধারণ করছে। ছেলে যে তার এত বউ পাগল হবে, সেটা তিনি কস্মিককালেও ভাবেন নি বাপু। না জানি, পাড়া-পরশি ছেলের এই বদল কি রূপে দেখে? বাইরে মুখ দেখাতেও আজকাল লজ্জা লাগে রেখা দেবীর। রেখা দেবী খচখচ কণ্ঠে জানালেন,
— সে তার ঘরেই বসে আছে। আমাকে সাঁধ দেওয়ার সময় কই তার?
নিলাংসুর বদন গম্ভীর হয়ে গেলো। সে নিছক স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— তাকে কাজ করার জন্যে সুযোগ দিলেই তো সে তোমায় সাঁধ দেবে, মা। তাকে ছোট জাত বলে অবহেলা না করে, একবার কাছে টেনে নিলেই পারো। তোমার কাছে সে অনন্য নারী রূপেই ঠেকবে।
রেখা দেবী উত্তর দিলেন না। মনে মনে সুধালেন, ‘ হুহ, ওই বেহায়া জাতের মেয়েকে আমি নাকি উনুন স্পর্শ করতে দেবো? এতটাও বাজে দিন আসে নি আমার! ‘ তবে ছেলের সামনে এ কথা ভুলেও মুখ ছিঁড়ে বের করেন নি। নাহলে ছেলে তার গৃহত্যাগ করতে দুবারও ভাববে না। কি জেদী ছেলে তার!
— বাবা, একটা কথা জানানোর ছিলো!
সমরেশ ভট্ট চোখ তুলে তাকালেন। ভরাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— কি কথা?
— আমি এ মাসের শেষে শহরে চলে যাবো। ওখানের অনেক কাজ পড়ে গেছে। তাই ভাবছি, বাড়িতে বসে আর সময় নষ্ট না করার চেয়ে শহরের কাজগুলো শেষ করে ফেলা উত্তম।
— ওহ, সে খুব ভালো কথা!
— আমি মাধবীলতাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই, বাবা!
নিলাংসুর কথা শুনে সমরেশ ভট্টের চেহারার রঙ পাল্টে গেলো। অদ্ভুত চোখে তাকালেন নিলাংসুর পানে। অথচ, নিলাংসু নির্বিকার। সে স্থির চিত্তে খাবার গলাধঃকরনে ব্যস্ত। রেখা দেবীও নিজ স্বামীর মুখে চাওয়া-চাওয়ী করছেন। সমরেশ ভট্ট স্ত্রীর দিকে ‘ খেয়ে ফেলা ‘ ধরনের ইশারা দিয়ে নিলাংসুর পানে তাকালেন। না চাইতেও বললেন,,
— তোমার স্ত্রীকে তুমি কোথায় রাখবে তা তুমিই ভালো জানো। আমাদের এখানে কি লেনা দেনা।
নিলাংসুর মন প্রসন্ন হলো। সে খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজ কক্ষে চলে এলো।
_______________________________
মাধবী বারান্দায় আরাম কেদারায় নির্বিঘ্নে বসে ছিলো। মাথার কেশ খোলা, হাওয়ার তালে দুলছে ইতি-ওতি। পায়ের রূপালি নূপুর ঝনঝনিয়ে শব্দ তুলে সম্মোহন করছে আশপাশ। এমন সময়ে সেথায় আগমন ঘটলো নিলাংসুর।
নিজের চুলের ভাঁজে কারো মুখশ্রীর উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো মাধবীর। মাধবী জানে, সে কে? মাধবীর রাগ হলো খুব। সে সরে যেতে চাইলো। তবে, পেটের উপর রাখা নিলাংসুর হাতের বন্ধনে আটকা পড়লো আকস্মিক। নিলাংসুর থুতনি মাধবীর ঘাড় স্পর্শ করলো। নিলাংসু চোখ বুজে ফিসফিসিয়ে বললো,
— মেয়েরা হলো পৃথ্বীর সবচেয়ে রহস্যময়ী। তাদের মুখের লাবণ্যতা হলো সে রহস্যের সর্বোচ্চ পর্যায়। যে একবার নারীর মুখের পানে তাকায়, সেই কবি হয়ে যায়, দেওলিয়া হয়ে যায়। উন্মাদতা তার রক্তে রক্তে মিশে যায়। যেমনটা হয়েছি, আমি স্বয়ং।
নিলাংসুর কণ্ঠে প্রেমপ্রেম বাক্য শুনে মাধবীর আত্মা যেনো কিছুক্ষণের জন্যে দেহ ত্যাগ করলো। সে নিসার হয়ে বসে রইলো নিজ স্থানে। পরক্ষণেই, নিজের রণমূর্তি রূপে ফিরে এসে এক ছিটকে সরে এলো নিলাংসুর থেকে। অথচ, নিলাংসু নির্বিকার হয়েই রয়।
রাগে মাধবীর ঠোঁট কেপে উঠলো। সে গা কাপিয়ে বললো,
— আপনি হলেন আস্ত এক কাপুরুষ। নাহলে আমার সম্মতি ছাড়া বিয়ে করে আমায় এ নরকে আমায় এনে ফেলতে পারতেন না। আমার ভালবাসা অর্জন করে আমায় যথাযথ সম্মান দিয়ে এ জমিদার বাড়িতে তোলার যোগ্যতাই আপনার নেই। কিসের জমিদার পুত্র আপনি?
মাধবীর কথা শুনে নির্বিকার নিলাংসুর মাথায় এবার যেনো আগুন চেপে উঠলো। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো মাধবীর পানে। মাধবীর নরম গাল দু আঙুলের সাথে চেপে ধরে গড়গড় কণ্ঠে বললো,
— তোমায় আমি আমাকে ভালবাসার অধিকার দিয়েছি। কিন্তু আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার আমি তোমায় একটুও দেইনি। আর কিসের যোগ্যতার কথা বলো তুমি? আমি তোমায় বলিনি,আমি তোমায় ভালোবাসি? বলেছি, হাজারবার বলেছি। বারবার তোমার মনের দরজায় কড়া নেড়েছি। কিন্তু তুমি কি করেছ? আমায় বারবার ফিরিয়ে দিয়েছ। যে ছেলের স্ত্রী হওয়ার জন্যে নারীর অভাব হবে না, সেই ছেলে বারবার এক সামান্য বেদের মেয়ে পেছনে ঘুরে বেড়িয়েছে। শুধুমাত্র তোমার একটুখানি ভালোবাসার জন্য! সমাজের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি শুধুমাত্র তোমায় বিয়ে করেছি। এ সব কিছুর মুলে আছে এইটাই কারণ! আমার তোমার প্রতি ভালোবাসা। অথচ, আফসোস! তুমি তা বুঝলে না!
মাধবীর গাল নিলাংসুর আঙ্গুলের চাপে পিষে যাচ্ছে। গালের হাড্ডি বোধহয় আজ ভেঙেই যাবে। নিলাংসু যা যা বলছে সবই সত্যি। সে মাধবী জানে। কিন্তু এতদিন যে ভয়ের জন্যে নিলাংসুকে বারবার অবহেলা করে এসেছে, আজ সেই ভয়টাই মাধবীর জন্যে মহাকাল ডেকে এনেছে। অথচ, আফসোস! নিলাংসু তা বুঝলো না!
#চলবে