গল্পঃ রাতের জোনাকি,প্রথম পর্ব
লেখা:ওমর ফারুক শ্রাবণ
দু’দিন পর আমার বিয়ে আর আমি আজ বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছি। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে যে শুধু মেয়েরাই পালিয়ে যায় এটা তাহলে ভুল কথা। ছেলেরাও পালাতে পারে বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু আমি আমার কোনো প্রেমিকার জন্য বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি না। আমার তো কোনো প্রেমিকাই নেই, কার সাথে পালিয়ে যাব? যাচ্ছি আমি একাই।
বাবা হঠাৎ করেই জোনাকির সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। আমি বিয়েতে রাজী কি না একবার জানার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করল না। আমি বলছি না জোনাকি দেখতে খারাপ। এটাও বলছি না জোনাকি আমার যোগ্য না। তবুও কিছু না জিজ্ঞেস করেই বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হয় কীভাবে? জোনাকি আমাকে পছন্দ করে বলে তাকেও আমাকে পছন্দ করতে হবে? এখানে পছন্দ কথাটি মানানসই হবে কি না বুঝতে পারছি না। আসলে জোনাকি আমাকে মনে মনে ভালোবাসে। আর আমি জোনাকিকে প্রায়ই বলতাম, দেখিস আমি ঠিকই একদিন এক রাজকুমারীকে নিয়ে হাজির হবো।
জোনাকিদের বাড়ি আমাদের তিনটা বাড়ি পরেই। বাবার ছোটোবেলার বন্ধুর মেয়ে। আহারে বন্ধু, আরে এক এলাকার ছেলেপুলেদের সাথে সবাই মিশে, তাই বলে বন্ধু হয়ে গেল? আমিও তো এলাকার কত ছেলেদের সাথে খেলাধূলা করি। আর জোনাকিও কেমন, বিয়ের কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা। লজ্জা শরম এতই বেড়ে গেছে বিয়ের কথা শুনে যে, একটিবারের জন্য আর আমাদের বাসায় আসার নাম নেই। অথচ আগে দৈনিক তিনবার আমাদের বাড়ি না এলে তার পেটের ভাতই হজম হতো না। ভেবেছিলাম, যদি জোনাকি এরই মধ্যে আমাদের বাড়ি আসে তখন বুঝিয়ে বলব। “দেখ জোনাকি, তুই অনেক সুন্দর, অনেক ভালো একটি মেয়ে। ঘরের দুয়ারে আমার শ্বশুর বাড়ি হোক আমি চাই না। আমি দূর দেশ থেকে কোনো এক রাজকুমারী নিয়ে আসব। অনেক দূরে হবে আমার শ্বশুর বাড়ি। তুই বিয়েটা ভেঙ্গে দে।”
জোনাকিও আসেনি। আমারও এত সাহস হয়নি যে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলব, বাবা আমি এই বিয়ে করব না। নিজে আগে একটা মেয়ে পছন্দ করে খুঁজে বের করি, তারপর বিয়ে।
বলা তো দূরের কথা, বাপজানকে দেখলেই আমার হাঁটু কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়।
কর্ণফুলী ট্রেণে উঠলাম। উদ্দেশ্য চট্টগ্রামে যাব। শুনেছি চট্টগ্রাম আর ঢাকা শহরে টাকার অভাব নাই। তবে ঢাকা শহরে থাকার জায়গা নেই। ফুটপাতে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে ঘুমাতে হয়। চট্টগ্রামে এমনটা হবে না। গিয়ে ভালো কাজকর্ম করে টাকা পয়সা ইনকাম করে একটা ব্যবসা করব। তারপর ব্যবসা করে লাখপতি, কোটিপতি হয়ে ফিরে আসব বাবার কাছে। তখন নিশ্চয় বাবা আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাগ করে থাকবেন না। তখন বিয়ে শাদির কথা চিন্তা করা যাবে। কিন্তু এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে এমন একজন ভবিষ্যত কোটিপতিকে কেউ দাম দিচ্ছে না। একটা সিটও খালি নেই আমার জন্য। সিটে বসা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলছি, তোরা আমাকে চিনতে পারলি না।
ঐদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পরিমানও কম না। আমি আর বেশিক্ষন এভাবে থাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যাব। ট্রেণ প্রতিটা স্টেশনে থামছে আর লোকজন শুধু বেড়েই যাচ্ছে। প্রথমে আমিরগঞ্জ, খানাবাড়ি, এবার থামল হাঁটুভাঙ্গা স্টেশন। সামনে মেথিকান্দা রেলস্টেশন। এরই মধ্যে টিটি চলে এলো টিকিট চেক করার জন্য। কর্ণফুলী ট্রেণে চড়া অর্ধেকের বেশি যাত্রীর টিকিট করা থাকে না। টিটির সাথে একটা রফাদফা করা হয় কিছুটা কম টাকায়। এই ভীড় ঠেলেও এক হাতে টিকিট নিয়ে টিটি আমার কাছাকাছি। পাশের একজন বলে উঠল, মিয়া আগে সিট দিবা পরে টিকিট।
টিটি বলল, আমার বাড়িতে সিট বানাইতে দিছি। পাহাড়তলী নেমেই বাড়ি থেকে সিট নিয়ে আসব, আপাতত কষ্ট করেন।
আমি পেছন পকেটে হাত দিয়ে বোকা বনে গেলাম। আমার মানিব্যাগ এরই মধ্যে পকেটমার মেরে দিয়েছে। তবুও ভালো করে সব পকেট খুঁজলাম, নিচে পড়ল কি না দেখলাম। কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। আমি টিটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, পকেটমার মানিব্যাগ নিয়ে গেছে।
টিটিও মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, সামনের স্টেশন নেমে যাবেন।
কী আজব! আমি কি মিথ্যে বলেছি? আমার মানিব্যাগ নেই মানে টাকা পয়সা সবই গেল। এমনিতেই তো চিন্তা ভাবনার শেষ নেই। তার উপর বলে দিলো, সামনের স্টেশন নেমে যাবেন। নামব না, আমি। এই ট্রেণে আমার মানিব্যাগ চুরি হয়েছে। মানিব্যাগ না পেলে আমাকে কিছুতেই নামাতে পারবে না। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে মানুষের চেহারা দেখছি। কে হতে পারে চোর? মানুষের গায়ে যদি লেখা থাকত কে চোর, কে ঘু্ষখোর বা কে ভালো মানুষ তাহলে মন্দ হতো না। সরাসরি চোরের কাছে গিয়ে বলতাম, ভাই আপনি কষ্ট করে চুরি করেছেন। আসেন টাকাটা ভাগাভাগি করে নেই। আর মানিব্যাগটা আমার ভাগে দিবেন, সেজন্য পাঁচ টাকা বেশি। চোরও হাসি মুখে দিয়ে দিত, কারণ মার খাওয়ার চেয়ে আধা পয়সা অনেক ভালো।
ট্রেণ এমনিতেই মেথিকান্দা স্টেশন থেমে গেল। ব্রাহ্মন-বাড়িয়ায় রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে দুইটি বগি রেলব্রীজ ভেঙ্গে নিচে পড়ে গেছে। স্টেশন মাস্টার এমনটাই বললেন। কখন লাইন পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। আমার রেলগাড়ীকে সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন মনে হতো। অথচ রেলগাড়ীতেও দুর্ঘটনা। দুনিয়াটা দুর্ঘটনায় ভরা। আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি এটা যেমন দুর্ঘটনা। তেমনি মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেছে এটিও দুর্ঘটনা। পেটের ভিতর মনে হচ্ছে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। অথচ মাত্র বাজে বেলা এগারোটা। সকালেও কিছু না খেয়েই এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছি টাকা আছে সাথে, বাড়ি থেকে পুরাতন কাপড় নিতে হবে না। এখন টাকাও নেই, কাপড়ও পরনে যা আছে তাই। “শূণ্য পকেট, ক্ষুধার্ত পেট তোমায় যা শিক্ষা দিবে, কোনো বইও তোমাকে সে শিক্ষা দিতে পারবে না।” এটা কোন মহান মানুষ যেন লিখেছেন, মনে পড়ছে না। হুমায়ূন স্যার লিখেছিলেন? হবে হয়তো।
মানুষ বলাবলি করছে, তিন চার ঘন্টায়ও লাইন পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। আমি উত্তর দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। একটু এলাকা ঘুরে দেখা যাক। গ্রামাঞ্চল মনে হচ্ছে সামনের দিকটা। কোনো কলা বাগান, পেঁপেঁ বাগান বা ফলের কোনো সন্ধান পাওয়া গেলে ক্ষুধার্ত পেটে কিছুটা চালান দেয়া যেত। এই প্রথম মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। জোনাকিকে বিয়ে করে বাবার সাথে দোকানে বসলেও বাকি দিনগুলো সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারতাম। কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এখন খালি পেট নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।
অনেক দূর হেঁটে এলাম। এক পেঁপে বাগানের দেখা পেলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করলাম, কতটা দূর এসেছি। আবার ফিরতেও হবে, নয়তো অন্য কোনো ট্রেণে উঠলে অবশ্যই টিকিট করতে হবে। এমনিতেই বাকি পথ এই ট্রেণে যেতে পারব কি না সন্দেহ।
একটা গাছ পাকা পেঁপেঁ খুঁজে পেলাম না। সবই কাঁচা পেঁপে। একটা তবুও নজরে এসেছে সেটা এখনো গাছ পাকা হয়নি। সবুজের সাথে মাত্র একটু হলুদ রং হয়েছে। আমি আর দেরি না করে পেঁপেঁ গাছ বেঁয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করলাম। অমনি আমিসহ পেঁপেঁ গাছ মাটির দিকে লুটিয়ে পড়ার উপক্রম, হঠাৎ ঠাঁশ। পেঁপেঁ গাছটা ভেঙ্গে গেল। ভাঙ্গার সময় শব্দটা ঠাঁশ হয়েছিল কি-না মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। এরই মধ্যে চোর চোর বলে দুই লোক পাশের ক্ষেতের ভিতর থেকে কাঁচি হাতে বেরিয়ে এল। আমি যে দৌড় দিয়ে পালিয়ে বাঁচব সেই উপায় নেই। পেটের ক্ষিধে পেটেই রয়ে গেল, তার উপর নতুন করে ঝামেলা লাগিয়ে বসে আছি।
-এই মিয়া গাছ ভাঙ্গছ কেরে? এক্ষন গাছের টেহা দিবা। নাইলে যাইতে দিমু না।
এমন কথা শুনে আমার ভেতর শুকিয়ে গেল। পকেটমার মানিব্যাগ না নিলে এখন টাকাটা দিয়ে দিতে পারতাম। তবুও আমতা আমতা করে বললাম,
ভাই, আমার মানিব্যাগ পকেটমার নিয়ে গেছে। নয়তো দিয়ে দিতাম।
-ক্ষেত থেইকা রাস্তায় উঠো মিয়া আগে। পরে বুঝাইতাছি।
আমার পরনের টির্শাটে আর প্যান্টে কিছুটা মাটি লেগে আছে। রাস্তায় উঠার পর তারা আমাকে তাদের বাড়ির দিকে যেতে বলে। তাদের পঞ্চায়েত নাকি আমার বিচার করবে। একটি পেঁপেঁ খেতেও পারিনি, গাছ ভেঙ্গে পড়ে ব্যথাও পেলাম। আরো না-কি বিচারের বাকি আছে। আমি এবার একটু জোর গলায়ই বললাম, “ভাই আমি তো চোর না। ক্ষিধে লেগেছে তাই খেতে চেয়েছি। বিচারের কী হলো এখানে?”
-কিও মিয়া কী অইছে?
রাস্তা দিয়ে ছাতা মাথায় যাওয়ার পথে এক মুরব্বির প্রশ্ন শুনে পেঁপেঁ বাগানের মালিক বলল, “এই বেডায় পাপ্পা গাছ ভাইঙ্গা কয় পেডো বুক লাগজে হের-লাইগ্যা এই কাম করছে। টেহা দিতে কই, কয় মানিব্যাগ পকেটমাইরে নিছেগা।”
মুরব্বি পকেট থেকে একটা টাকার গোল বান্ডেল বের করল। গোল বান্ডেল বলতে পাঁচশত আর একশত টাকার নোট একত্রে গোল করে পেঁচিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিল। একশত টাকা পেঁপেঁ বাগানের মালিকের হাতে দিয়ে বলল, “আসলেই মনে অয় টাকা নাই হের কাছে। দেহেন, দেখতে তো ভালো ঘরের পোলা মনে অয়। এই টাকাটা রাহেন। আর এই ছেলে, তুমি আইয়ো আমার লগে। সামনে দোকান আছে, কী খাইবা খাও।”
ভালো মানুষ না থাকলে অনেক আগেই পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেত এটা সত্যি কথা। আমি মুরব্বির পেছন পেছন হাঁটছি। আমি বললাম, “আঙ্কেল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
তিনি থেমে গেলেন। ছাতা মাথা থেকে সরিয়ে গুটিয়ে নিয়ে বললেন, “আমারে আঙ্কেল মনে অয়? তোমার সমান নাতি নাতনি আছে আমার জানো? আমি পাকিস্তান আমল দেখেছি, যুদ্ধের সময় আমার বাড়িত মুক্তিরা থাকছে, খাইছে। দাদা বলবা আমারে দাদা। আমার বয়স জানো কত? সত্তরের উপর আরো দুই। তা যাইবা কই?
-আসলে দাদা আমি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম, আমার একটা কাজ দরকার।
-কয় ক্লাস পড়ছ? লেহাপড়া জানো কিছু?
-জ্বি আমি অনার্স থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ছি।
-আমি ওসব বুঝি না। আমার নাতি নাতনিরা বুঝে। ওরা কলেজে যায়, রায়পুরা কলেজ। হিসাব রাখতে পারবা? রাধাগঞ্জ বাজারে আমার দুইটা দোকান আছে।
-পারব দাদা, অবশ্যই পারব।
-তোমার কাপড় চোপড় কই?
-ট্রেণ থেকে কে যেন নিয়ে গেছে।
এটা অবশ্য মিথ্যে বলেছি আমি। নয়তো বাড়ি থেকে বিয়ে করব না বলে পালিয়ে এসেছি এটা বলব কী করে? বাহাত্তর বছর বয়সেও এতদূর হাঁটতে পারে। দেখলে মনে হয় বয়স ষাটের কাছাকাছি। আমার চেয়েও লম্বা, আর দেহের গঠন দেখে মনে হয় দাদা আমাকে তুলে আছাড় দিতে পারবে। আমার দাদার কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ার কথাও না। কারণ আমি কোনোদিন আমার দাদাকে দেখিনি। বেঁচে আছে কি-না তাও জানি না। বাবা কেন দাদার বাড়ি যায় না তাও জানি না। নানীর বাড়ি কাছে থাকার কারণে দাদা দাদীর অভাব কিছুটা পূরণ হয়েছে। তাই আমিও জোর দিয়ে কখনো জানতে চাইনি বাবার কাছে। তবে মায়ের মুখে শুনেছি আমার দাদার বাড়ি রায়পুরা থানার রাধাগঞ্জের কাছাকাছি। যিনি আমাকে হিসাব রক্ষকের কাজ দিবেন বলে নিয়ে যাচ্ছেন তার দুইটা দোকান আছে সেই বাজারে। উনার বাড়িও আশেপাশেই হতে পারে। বাবার কাছে শুনেছি দাদার নাম ছিল মফিজ উদ্দিন খন্দকার। যিনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন তার চেনার কথা। কিন্তু প্রথম দিনেই যদি এই প্রশ্ন করি, অন্য কিছু মনে করতে পারে। আগে চাকরিটা করি কয়েকদিন, তারপর দেখা যাক।
রাধাগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখি এই মুরব্বির একটা দোকান, খন্দকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ভিতরে দুইজন লোকও আছে। আমাকে দেখিয়ে কী যেন বলে আবার আমার কাছে ফিরে এলো। নিয়ে গেল পাটের গুদাম ঘরে। এটাকেও তিনি দোকানই বলেছেন আমার কাছে। পাইকারী পাট কিনে এখানে গুদামজাত করা হয়। তারপর আমার হাতে পাঁচশত টাকা দিয়ে বললেন, কম দামে কয়ডা কাপড় লও। পরে মাসের শেষে পছন্দ মতো কিনবা।
রাধাগঞ্জ বাজার থেকে আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর দিয়ে একটি বাঁশের সেতু। এটা বাঁশের সাকু নয়, বাঁশ দিয়ে মাচার মত করে সেতু তৈরী করা হয়েছে। তিনি আমাকে নিয়ে নদীর ঐপাড়ে গেলেন। আবারো মাটির রাস্তা ধরে হাঁটার পালা। আমার মনে হচ্ছে পেটের ক্ষিধায় এবার বসে পড়ব। রাধাগঞ্জ বাজারে থাকতে জোহরের আজান হয়েছে। সকালেও কিছু না খেয়ে বেরিয়ে পড়েছি। আমাকে তো টাকা দিয়েছিল কাপড় কেনার জন্য। কাপড় তো কিনলামই, কিছু খেয়ে নিলেই পারতাম। তখন কেন যেন ক্ষিধেটা মাথা চাড়া দেয়নি।
বাড়ির গেইটের কাছে সাদা পাথরের মধ্যে লেখা খন্দকার ভিলা। বুকের ভিতরটা কেমন করে যেন উঠে। আমি আমার দাদার বাড়ি চলে এসেছি? কিন্তু মা বলেছে আমার দাদার বাড়ি রাধাগঞ্জের কাছাকাছি। আর এই বাড়িতো নদীর এইপাড়ে, আরেক গ্রাম। বাড়ি ভিতরে ঢুকেই তিনি আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বাড়ির বারান্দায় বেতের চেয়ারের সাথে কাঠের টেবিল। নদীর কোল ঘেষে রাস্তা, সেই রাস্তার পাশে বাড়ি। বাড়ির উঠান দেখলে মনে হবে এটি কোনো ফুটবল খেলার মাঠ। এই মাঠের চতুর্দিকে মোট ছয়টা ঘর। আমি খাওয়ার সময় দাদা আমার পাশেই বসা ছিলেন। একটু দূরে একটি ডালিম গাছ। ডালিম এখনো ছোটো ছোটো। ডালিম গাছকে একটু আড়াল করে তিন চারজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমি খেতে লজ্জা পাচ্ছি, কিন্তু ক্ষিধের কারণে লজ্জা ভুলে খেতেই লাগলাম।
-নাতি, খাইতে কেমন অইছে? আওয়ার সময় যে নদী দেখছ, এই নদীর মাছ।
-অনেক ভালো হয়েছে দাদাজান।
-তোমার নামটাই তো জানা হলো না।
-জ্বি দাদা, আমার নাম শাওন।
আমি যে প্রান্তের ঘরের বারান্দায় বসে ভাত খাচ্ছি তার বিপরীত পাশের ঘর অর্থ্যাৎ উঠানের ঐ প্রান্তের ঘর থেকে একটি মেয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে বেরুতেই দাদার ডাক,
-এই শানু তোর বাপে কই?
-আমি জানি না দাদা।
-বাড়িত আইলে আমার লগে দেহা করতে কইবি। আর তোর মা’কে বল উত্তরের ঘরডা একটু ঝাড়ু দিয়া পরিষ্কার কইরা দিতো। থাক, থাক তুই নিজেই পরিষ্কার করে দে।
-আচ্ছা দাদা।
মেয়েটিকে একনজর দেখা হয়েছে। দূর থেকে ওড়না মাথায় দেয়া মেয়েটিকে পুরোপুরি দেখতে পারিনি। তবে বুঝতে পেরেছি এই মেয়েটিও দাদার ছেলের ঘরের নাতনি। আমার খাওয়া শেষ করলাম। দাদা জানতে চাইলেন, ঢাবা খাওয়ার অভ্যাস আছেনি? খাইলে সাজাইয়া আনি দুইজনেরডা।
আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। কিসের ঢাবা খাওয়া? আবার সাজিয়ে আনবে।
-ঢাবা কী দাদাজান?
-ঢাবা চিনো না নাতি? হুক্কা চিনো হুক্কা? আর তোমার না চেনারই কথা। থাক খেতে হবে না, বাজে অভ্যাস।
আমার ঠিকানা হলো উত্তরের ঘরটিতে। একটু আগে মেয়েটি বিছানাপত্র পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। দাদা বলল, “আজ বিশ্রাম করো কাল থেইকা আমার লগে পাটের ঘরে যাইবা।” আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বেতনের কথা বলা হয়নি। তিনি খুব ভালো মানুষ সেটা এতক্ষণে আমার বুঝা হয়ে গেছে। তিনি আমাকে ঠকাবেন না। কিন্তু কতদিনে লাখপতি আর কোটিপতি হতে পারব?
কয়েকদিন গেলে উনাকে জিজ্ঞেস করব মফিজউদ্দিন খন্দকারকে চেনেন নাকি। রাধাগঞ্জে যেহেতু দোকান, তিনি চিনতেও পারেন।
————(চলবে-)