রাতের জোনাকি পর্বঃ পাঁচ (শেষ পর্ব)

0
1818

গল্পঃ রাতের জোনাকি
পর্বঃ পাঁচ (শেষ পর্ব)

সন্ধ্যারাতে মায়ের কোলে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে বাবা রুমে এসে চেয়ারে বসলেন। আমাদের ঘরে কোনো বেতের চেয়ার নেই। দাদার বাড়িতে বেশির ভাগই বেতের চেয়ার।
বাবাকে দেখে আমি শোয়া থেকে বসে পড়লাম। আমি জানি এতদিন রাগ যা ছিল কিছুটা হলেও এখন দেখাবেন। বাবা বললেন, “তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো এমন করার কারণটা কী? এলাকায় আমার মান সম্মান নষ্ট করল কেন?”
আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। ইচ্ছে করছে একগ্লাস পানি পান করে ফেলি এক চুমুকে। বাবা আবারো প্রশ্ন করলেন, “জিজ্ঞেস করো তোমার ছেলেকে কেন এমন করল?”
মা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “এতদিন কোথায় ছিলি বাবা? খেয়েছিস কোথায়? থাকছিস কোথায়?”
বাবা এবার রাগের স্বরে বললেন, “তোমাকে বলেছি জিজ্ঞেস করতে এমনটা করল কেন? আর তুমি জানতে চাচ্ছ এতদিন কোথায় ছিল?”
আমি এবার সাহস নিয়ে মুখ খুললাম।
-আসলে আমি চেয়েছিলাম আরো কিছুদিন পর বিয়ে করতে। তাছাড়া জোনাকির সাথে আমার ছোটো বেলার বন্ধুত্ব, বিয়ে করতে হবে সেটা মানতে পারিনি।
-কেন? জোনাকি মেয়েটা ভালো না? আমাদের এলাকায় আর এমন একটা ভালো মেয়ে দেখাতে পারবি তুই?
এই প্রশ্নের জবাবে আমার কোনো উত্তর নেই।
বাবা এবার প্রশ্ন করলেন, “কোথায় ছিলি এতদিন? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিস?”
-না, দাদার বাড়িতে ছিলাম।

বাবা আর মা দু’জনেই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। আমিই পুরো ঘটনাটা বলতে শুরু করলাম। সেই হাঁটুভাঙ্গা স্টেশন থেকে একদম দোকানে চাকরি নেয়া পর্যন্ত। বাবা একবার চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরেই পায়চারি করে আমার কথা শুনছেন, আরেকবার চেয়ারে বসে পড়ছেন। এমন কিছু নিশ্চয় বাবা কখনো আশা করেনি। মা জানতে চাইলো, “তোকে ঐ বাড়িতে আদর করেছে? কেউ বকা দেয়নি? বের করে দেয়নি বাড়ি থেকে?”
আমি বললাম, “না, প্রথমে তো আর ঐ বাড়ির কেউ জানত না আমি কার ছেলে। যখন হীরা চাচার মেয়ে শানুর বিয়ের কথা উঠল, দাদার ইচ্ছে আমি শানুকে বিয়ে করি। তখন দাদা আমার ঠিকানা, পরিচয় জানতে চাইলে আমি বলে দিয়েছি। যদিও দাদা ছাড়া বাকি সবাই আমার পরিচয় জানত।”
বাবা আবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। বললেন, “হীরা ভাইয়ের মেয়ে শানুর বিয়ে মানে? শানুর বিয়ে তো একবার ভেঙ্গে গেছে। জামাই বিদ্যুৎ পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।”
আমি জানতে চাইলাম, “বাবা তুমি জানো কীভাবে?”
-হীরা প্রতি মাসে একবার আমার দোকানে আসে। ভাইয়ের মুখেই শুনেছি। শানুর সাথে তোর বিয়ে অসম্ভব।
আমার হঠাৎ কী হলো আমি জানি না, রাগ ছিল মনে হয়। আমি বলে দিলাম,
-কেন অসম্ভব? মানিক চাচাকে তো তুমি মারোনি। দাদাও সেটা জানে, হয়তো গ্রাম্য ভূত প্রেত এর কাজ ছিল।

বাবা রাগে চোখ লাল করে ফেললেন, কিন্তু আমাকে কিছু বললেন না। মা আমাকে চড় দিয়ে বললেন, “চুপ কর। কী বলছিস এসব?”
বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কিছু না বলে। দশ পনেরো মিনিট পর আবার ফিরে এলেন। এসে আমাকে বললেন, “তোর দাদা যদি জানতই তাহলে সেদিন আমাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিত না।”
-তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। মার খেতে খেতে তুমিই বাড়ি থেকে চলে এসেছো।

বাবা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারের পাশ থেকে স্কেল নিয়ে আমাকে পিটাতে শুরু করলেন আর মুখ দিয়ে বলতে লাগলেন, “তুই আমার চেয়ে বেশি জানোস? তোর জন্ম হয়েছিল তখন? মুকে মুখে তর্ক করা শিখেছিস? আজ তোর বেয়াদবগিরী ছুটাচ্ছি।”
মা বাবাকে ফিরাতে পারছে না। আমার হাতের বাহুতে, পিঠে, পায়ে যেভাবে পেরেছে বাবা তার রাগ ঝরাচ্ছিল। হঠাৎ বললেন, “শাওনের মা এমন বেয়াদব ছেলের আশা ছেড়ে দাও। যেখান থেকে এসেছে ওখানে চলে যেতে বলো।”

আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আসলেই বাবার সাথে তর্ক করা আমার বেয়াদবি ও বোকামি দুটোই হয়েছে। আমি ঘণ্টা খানেক পর বাবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলাম। বাবা কথা না বলে চুপ করে রইলেন। মা বললেন, “ছেলেই তো ভুল করেছে। বুঝতে পারে নাই, তুমি মাফ করে দাও।”
বাবার চোখে পানি ছল ছল করছে। এরই মধ্যে বাবা বললেন, “জোনাকির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পুরো এলাকা জুড়ে মানুষ দাওয়াত করেছিলাম। তোমার ছেলে চলে গেল। এলাকায় আমার মান সম্মান কোথায় রইলো? এখন আবার ফিরে এসেছে। এখন যদি জোনাকিকে বাদ দিয়ে আমার ভাইয়ের মেয়ে বিয়ে করাই। এলাকাতে আমার মুখ থাকবে? তাছাড়া যে বাড়িতে আমার জায়গা হয়নি সে বাড়িতে আর আমি কোনোদিন যাব না। তোমার ছেলেকে বলো জোনাকিকে যেন বিয়ে করে।”
আমি আমতা আমতা করে তবুও বললাম, “দাদার খুব ইচ্ছে ছিল আমি শানুকে বিয়ে করি। দাদাই পাঠিয়েছিল তোমাদের নিয়ে যেতে।”
বাবা আমার হাত চেপে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বললেন, “আমি জানি শানু মেয়েটা ভালো। তাছাড়া আমার ভাইয়ের মেয়ে, আমাদের রক্তের, খারাপ হতে যাবে কেন? হীরা ভাইকে আমার দোকানে বসিয়ে বলেছিলামও, যদি আমি নয়াচরে থাকতাম তাহলে আমার ছেলের সাথেই তোমার মেয়ের বিয়ে দিতাম। কিন্তু শাওন তোকে একটা কথা বলি। মনে কর তুই বাবা আর আমি ছেলে। এলাকাতে লোকজনের কটুকথা শুনতে তোর কেমন লাগবে? একবার বিয়ে ভাঙ্গা, দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পরও যদি জোনাকিকে রেখে অন্য কোথাও বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়, তোর বিবেক কী বলে? তুই বল।”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “ঠিক আছে আমি জোনাকিকে বিয়ে করব।”

রাত তখন একটা। আমি বারান্দায় বসে আছি। মনে মনে ভাবছি শানুকে বলেছিলাম ফিরে যাব। দাদার কাছেও আর ফিরে যাওয়া হলো না। ঐ বাড়ির সবাই আমাকে আর বাবাকে আবারো ঘৃণার চোখে দেখবে।
-ঘুমাসনি এখনো?
বাবা চেয়ার নিয়ে এলেন একটা হাতে করে। আমার পাশে বসলেন।
-না, ঘুম আসছে না।
-জানি, তোর দাদার বাড়ির কথা মনে পড়ছে। আমারো মনে পড়ছে। তুই বল, আমি কি জানতাম তোর মানিক চাচাকে সাথে নিয়ে গেলে সেদিন এমন অঘটন ঘটবে? আর আমি কেন তাকে মারতে যাব? আর আমার মনে হয় ভূত প্রেতও কিছু ছিল না।
আমি আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলাম, “তাহলে বাবা কীভাবে হলো?”
বাবা বললেন, “তোর ছোটো চাচার ছোটোবেলা থেকেই হাঁপানি ছিল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। মৃগীও ছিল, তবে সেটা বছরে হয়তো দুয়েকবার হতো। যেদিন আমরা লাইট নিয়ে মাছ ধরতে গেলাম সেদিন সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হয়েছে। দুইপাশে কচুরি দিয়ে ভরা দুইটা পুকুর। দুই পুকুরের মাঝখানের পাড়টি ভাঙ্গা। তার উপর সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়ে পিচ্ছিল হয়ে আছে। আমি সামনে, তোর চাচা পেছনে মাছের ব্যাগ নিয়ে। আমার মাছের নেশা খুব। আমি লাইট তাক করে আছি মাছের দিকে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পেছনে কেউ নেই। আমি খুব ভয় পেলাম। লাইট দিয়ে এদিক সেদিক দেখি তোর চাচা নেই। তারপর আমি ভয়ে দৌড়ে বাবাকে এসে নিয়ে গেলাম। মানিকের লাশ পাওয়া গের কচুরির নিচে। আমার ধারণা, হয়তো পিচ্ছিল খেয়ে পাড় থেকে পুকুরে পড়ে গেছে। হয়তো আর উঠতে পারেনি। থপাস করে পড়লে শব্দ পেতাম, কিন্তু এক হলো আমার লাইট তাক করা মাছের দিকে, খেয়ালটাও সেদিকে। আর পিচ্ছিল খেয়ে পড়াতে পা আগে সামনের দিকে গিয়ে চলে গেছে কচুরির নিচে।”
আমি বাবার হাত ধরলাম। বললাম, “থাক বাবা মন খারাপ করো না। তোমার কোনো দোষ নেই।”
বাবা চোখ মুছে বললেন, “যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

জোনাকির সাথে আমার আবারো বিয়ে ঠিক হলো তিনদিন পর। কিন্তু আমি বাড়িতে আসার পরদিনই জোনাকির সাথে দেখা হয়। অনেক অভিমান নিয়ে শুধু একটি প্রশ্নই করেছিল, “আমাকে এত অপছন্দ?”
আমি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কারণ বললাম জোনাকিকে। এটাও বললাম, যদি একদিন তাকে কথাগুলো বলার সুযোগ পেতাম তাহলে কখনো বাড়ি ছেড়ে যেতাম না। জোনাকি জানতে চাইলো, “এবারো পালিয়ে যাবে?”
আমি বললাম, “না আর পালাব না।” জোনাকি ঠেস দিয়ে জানতে চাইলো, “কেন রাজকুমারীর দেখা মেলেনি?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ দেখা হয়েছে। রাজকুমারী আমার জন্য পথ চেয়েও আছে। কিন্তু আর যাওয়া হবে না। আমার যাওয়ার পথ বন্ধ।”
জোনাকির মন খারাপ হলো আমি জানি। কিন্তু যেহেতু তাকে বিয়ে করব, তার কাছে লুকানো আমার ঠিক হবে না। আমি জোনাকির কাছে দাদার বাড়ির পুরো ঘটনা খুলে বললাম। জোনাকি মন খারাপ নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল।

পরদিন, বিয়ের দুইদিন আগে জোনাকি অঘটন ঘটিয়ে বসল। এবার জোনাকি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। এলাকায় হাসাহাসির অবস্থা। একবার বর পালিয়েছে এবার বিয়ের কনে পালিয়ে গেল। জোনাকির মা বারান্দায় বসে মুখে আঁচল দিয়ে বিলাপ করে কান্না করছে। “কই গেলিরে জোনাকি, কার সাথে চইলা গেলিরে মা জোনাকি।”
আমিও ভেবে পাই না জোনাকি কার সাথে পালাবে? সে তো আমাকে ভালোবাসত। না-কি আমি যখন দাদার বাড়িতে ছিলাম, জোনাকি তখন অন্য কারো প্রেমে পড়েছিল। হতেই পারে, আমি বিয়ে ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। আসার নাম গন্ধ নেই। তখন জোনাকির অন্য কাউকে পছন্দ হতেই পারে।
তবে এবার বাবা প্রচণ্ড রাগ হলেন, কষ্টও পেলেন। দুইবার চেষ্টা করেও তিনি ছেলের বিয়ে দিতে পারলেন না। জোনাকির বাবা মা’কে আমার বাবা আর কিছুই বলেননি। রেগে বাড়ি এসে মা’কে বাবা বললেন, “এই শাওনের মা রেডি হওতো।”
মা জানতে চাইলেন, “কিসের রেডি?”
বাবা বললেন, “রেডি হইতে বলছি হও। শাওনের বিয়ে আমি করাবই। দুইবার ভুল হইছে, তৃতীয়বার আর ভুল করতে চাই না। শাওনের দাদার বাড়ি চলো, দুয়েক দিনের মধ্যে আমার ভাইয়ের মেয়েকে শাওনের বউ করে নিয়ে আসব।”
মা মনে হয় খুশিই হলেন, বলা মাত্র তৈরী হচ্ছেন। আমি খুশি হয়েছি কি-না বুঝতে পারছি না। শুধু দাদার ছলছল চোখের আকুতি আমার মনে পড়ে। বাহাত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধ তার শেষ বয়সে পরিবারের সুখ কামনা করে। শানুর কথা ভাবাচ্ছে। সে বলেছিল, যদি করুণা করে বিয়ে করতে চাই, তবে যেন ফিরে না যাই।
আমি করুণা করে নয় শানু, আমি গোটা তোমাকেই চাই।

রাধাগঞ্জ বাজারে সিএনজি থেকে নেমে বাবাকে বললাম, “তুমি আর মা দাদার বাড়ি যাও, আমি দাদাকে পাটের গুদাম থেকে নিয়ে আসি।”
মনে মনে ভাবলাম, বাবা মা বাড়িতে গিয়ে পরিবেশ একটু স্বাভাবিক করুক। দাদীর কান্নাকাটি শেষ হোক। পরে দাদাকে নিয়ে যাই।
দাদা আমাকে দেখে মনে হচ্ছে কেঁদেই দিবে। এক পা দু’পা করে আমার কাছে এসে বলল, “নরসিংদী থেকে আসতে এতগুলো দিন লাগে? তবে আমার মন বলছিল তুই ফিরবি নাতি। কারণ তুই ফিরলে রতনও ফিরবে। তোর বাবা কোথায়?”
-তুমি আগে দোকান বন্ধ করো, বাবা আর মা তোমার বাড়িতেই আছে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
দাদার মুখ হাসি হাসি, কিন্তু রাগের অভিনয় করে আমাকে বলছে, কী? এত বড়ো সাহস হয় কী করে তোর বাপের? আমার অনুমতি ছাড়া আমার বাড়ি ঢুকল কীভাবে? দাঁড়া, একটা লাঠি ব্যবস্থা করি। পিটিয়ে যদি আজ বাড়ি থেকে বের না করি, আমি মফিজ উদ্দিন খন্দকার না। বয়স কিন্তু সত্তরের উপর আরো দুই।
আমার হাসি পেলেও দাদা সত্যি সত্যি লাঠি নিলেন। গাছের ডাল-পালা লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করে বাজারে। সেখান থেকে সোজা এক মোটা ডাল নিয়ে আমাকে বললেন, “দেখ এটা কেম হবে! তুই কিন্তু আজ তোর বাপকে বাঁচাতে আসবি না। চল আমার সাথে।”
কখনো মনে হচ্ছে দাদা অভিনয় করছে। কখনো মনে হচ্ছে দাদা মনে হয় অতি খুশিতে পাগল হয়ে গেছে।

দাদা তার ঐ দোকানে গিয়ে বড়ো চাচাকে বলছে, “দোকান বন্ধ কর। রতন আসছে বাড়িতে। শানুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে। মিষ্টি নিয়ে বাড়ি আয়।”
আমার মন খারাপ হলো কিঞ্চিত। আমার তো মিষ্টি নিতে মনেই নাই। দাদাকে বললাম, “দাদা এতদিন পর বাবা খন্দকার বাড়িতে আসছে। তাছাড়া বিয়ের আলোচনা। আমি তো মিষ্টি কিনতে ভুলে গেছি।”
দাদা কোমড় থেকে টাকার গোল বান্ডেল থেকে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, কয় কেজি কিনবি কিনে নে।
আমি বললাম, টাকা লাগবে না। আছে আমার কাছে। দাদা বললেন, “এমনি দেই নাই। তোর বেতন থেকে কেটে রাখব। তোর চাকরির তেইশ দিন হইছে। সাতদিন দোকানে বসবি তারপর বেতন নিবি।”

বাড়িতে ঢুকে দেখি বাবা আর দাদীর কান্নার পর্ব শেষ। মা আর চাচী বসে কথা বলছে। শানুকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি আর দাদা ঢুকার পর বাবা বেতের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দাদা লাঠি হাতেই এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি বারান্দায় মিষ্টিগুলো রাখতেই দাদা বললেন, “শাওন। তুই কিন্তু আজ আমাকে ফিরাবি না। জিজ্ঞেস কর তোর বাপকে এখন কার বাড়িতে আসছে? যেদিন চলে গিয়েছিল, সেদিন এভাবে ফিরে এলে কী হইতো?”
বাবা বারান্দা থেকে নেমে দাদার পায়ের কাছে বসে বললেন, “সেদিন মার বেশি খেয়ে আর সহ্য করতে পারিনি। তাই চলে গিয়েছিলাম। এখন মনে হয় পিঠ শক্ত হয়েছে, এখন সহ্য করতে পারব বাবা।”

বহুদিন পর আমার চোখ ভর্তি করে পানি এলো। শুধুই কী আমার? এই বাড়ির সবার চোখেই পানি। যেন কান্নার মেলা বসেছে। বাবা দাদার বুকে জড়িয়ে আছে। কারো ছাড়ার নাম গন্ধ নেই। আমি কেবল শানুকে দেখিনি এখনো। একটু পর শানু আর শানুর বাবা একসাথে বাড়িতে ঢুকল। শানু কলেজে গিয়েছিল। দাদা বলেছিল তার নাতনি রায়পুরা কলেজে পড়ে। শানুর বাবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। চাচা মিষ্টি উঠানেই রেখে দিয়ে বাবার কাছে এলেন। বাবা আর বড়ো চাচা ইদের দিনের মতো কোলাকোলি করছেন। দাদার আবার সেই বিখ্যাত রাগ। দাদা বললেন, “আমার সামনে আর অভিনয় করতে হবে না হীরা। তুই যে আমার ঘরের পাতিলের খবরও নরসিংদী গিয়ে তোর ভাইয়ের দোকানে বসে আলাপ করে বলে দেস এটা এতদিনে জানা হয়ে গেছে। মেয়ে তো দিয়েই দিবি শাওনের কাছে। তো তোর ভাই কী নরসিংদীই থাকবে নাকি এই বাড়িতে আসবে, কোনটা?”
বাবা বললেন, “নরসিংদী আমি বাড়ি করেছি। তাই বলে এখানে আসতে পারব না, তেমন বাঁধাও নেই। আপাতত নরসিংদীই থাকি। সিএনজিতে ঘন্টাখানেকের পথ। যখন খুশি আসতে পারব।”

শানুর সাথে ঐদিনই আমার বিয়ে হলো। কোনো তারিখ নেই, কোনো বড়ো ধুমধাম অনুষ্ঠান নেই। কাজী ডেকে বিয়ে। অনুষ্ঠান দরকার হলে পড়ে করবে। শানুরও বিয়ে ভেঙ্গেছিল একবার, আমারও। আমারটার খবর দাদা এখনও জানে না। জানলে আবার উনার সে বিখ্যাত রাগ দেখতে হবে। দাদার মতো বাবাটাও হলো রাগী। আমিই কেমন যেন, রাগ নেই।

বাসর ঘরে শানুকে বলছি, “আমি কিন্তু ফিরে এসেছি।” শানু বলল, “কখন? আমি তো দেখলামই না।”
-দেখলে না মানে?
– যদি দেখেই থাকি সেটা সেই সকালেই দেখেছি। আর উনি এসেছে এখন আমার কাছে বলতে, আমি তো ফিরে এসেছি।
মনে মনে ভাবলাম, কত শান্ত নম্র ছিল মেয়েটা। আমিও ভেবেছিলাম আমিও নীরব শানুও নীরব প্রকৃতির। এখন দেখি আমার চেয়ে কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির শানু।

শানুকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসার ছয়দিন পর জোনাকি ফিরে এলো। তবে সে একা এসেছে। আমি যেমন পালিয়ে গিয়ে একা এসেছিলাম। কিন্তু জোনাকির সাথে তো তার স্বামী থাকার কথা ছিল। মেয়েরা তো এমনি এমনি পালিয়ে যায় না। তাহলে কী তার স্বামী পড়ে আসবে? জোনাকি আগে বাড়ির পরিস্থিতী স্বাভাবিক করতে এসেছে?
তার সাথে একবার দেখা করা দরকার। জোনাকির ছোটো ভাইকে দিয়ে খবর পাঠালাম। জোনাকি এলো আমাদের বাড়ির পাশে পরিত্যাক্ত বাড়ির ছাদে। আমাকে দেখে মিথ্যে হাসি মুখে নিয়ে বলল, “কী রে? শুনলাম এবার রাজকুমারী নিয়েই বাড়ি আসলি।”
আমি বললাম, “আগে তোর কথা বল। তোর স্বামী কোথায়? পালিয়েছিস কার সাথে?”
জোনাকি হাসতে হাসতে বলল, “আমার স্বামী কোথায় মানে? আমি তো বিয়ে করিনি। বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম। তুই আমাকে রেখে একবার পালিয়েছিলি। এবার আমি তোকে রেখে পালিয়ে গেলাম। সমান সমান কাটাকাটি।”
-না জোনাকি, সমান সমান না। তুই একটা মেয়ে মানুষ। তুই এভাবে বাড়ি ছেড়ে যেতে পারিস না। মান সম্মানের কথা চিন্তা করতে হবে।
-তুই যখন আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলি, তখনও আমি মেয়ে মানুষই ছিলাম। আমার সম্মান কি তখন খুব বেড়েছিল?

আমি জোনাকির কথার কোনো উত্তর দিতে পারিনি। জোনাকি বলল, “তুই আমাকে ভালোবাসিস না। আর কখনো বাসতেও পারবি না। মনের বিরুদ্ধে আমাকে বিয়ে করতে হচ্ছিল তোর। তোর আর আমার বিয়ে হলে আমি সুখী হতাম না। না সুখী হতি তুই না হতো তোর রাজকুমারী। তার চেয়ে ভালো একজন বরং অসুখী থাকি, বাকি দু’জন তো সুখে থাকা হলো। শাওন, তুই কখনো রাতের জোনাকি দেখেছিস? মিটমিট করে আলো দেয়। পোকাটা থাকে অন্ধকারে, তাই না? তার পুরোটা অন্দকারে রেখেই সে আলো ছড়ায়। আমিও সেই রাতের জোনাকি। আলো ছড়িয়ে যাই।”

জোনাকি চলে যাওয়ার পরও আমি অনেক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাদা বাড়িতে থাকতে দু’দিন দুইটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। রাতের অন্ধকারে যখন আমি খুব একা তখন জোনাকি আলো দিয়ে আমার ভয় দূর করছিল। স্বপ্নের সেই জোনাকি কি তবে এই জোনাকি? আমার মনে হয় এই জোনাকিই স্বপ্নের জোনাকি। নিজে অন্ধকারে থেকে মিটি মিটি আলো ছড়ায়। রাতের জোনাকি।

—-সমাপ্ত

লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,,
,,,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here