বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ১২

0
510

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ১২
#লেখা: ইফরাত মিলি

দু’দিন পর মিহিক এবং শ্রাবণকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিহিকের বাবা এলেন। মিহিকের যাওয়ার মন নেই। যে বাড়ির লোকেরা তাকে বুঝলো না সে বাড়িতে পা রাখতে ইচ্ছা করছে না তার। সে শাশুড়িকে বললো,
“আম্মু, পাশাপাশিই তো বাড়ি। না গেলে হয় না?”

লায়লা খানম বললেন,
“না মা, না গেলে হয় না। একটা নিয়ম আছে না? কয়েক দিন থেকে তারপর আবার আসবে।”

মিহিক আর বলার কিছু পেল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ক্ষুণ্ন মন নিয়ে।
লায়লা খানম মিহিকের ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছেন। বউমার জন্য এ কদিনে অনেক পোশাক-আশাক কিনে সে জড়ো করেছে। তার ভিতর থেকে সবচেয়ে সুন্দরগুলো সে প্যাকিং করে দিচ্ছে। বার কয়েক সে মিহিককে দেখলেন। বুঝতে পারছেন তিনি মেয়েটার অবস্থা। মেয়েটা সব কিছুর সাথে এডজাস্ট করে নিতে পারছে না। মুখের উপর কেমন একটা অসুখী ভাব। তবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে তার আশা। ছেলেটা তো তার। তিনি জানেন তার ছেলে ঠিক কেমন। শ্রাবণের সাথে থেকে মিহিক নিজেকে একদিন ভাগ্যবতী মনে করবে। লায়লা খানম হঠাৎ নিজের কাজ রেখে মিহিকের হাত দুটি আলতো করে ধরে বললেন,
“আমার ছেলেটা ভালো মিহিক। ওর মাথা থেকে একবার রুমকি চলে গেলেই বুঝতে পারবে ও কতটা ভালো। তুমি আমার ছেলেটার মাথা থেকে রুমকির ভূত তাড়াতে সাহায্য করো মা।”

শাশুড়ির অকস্মাৎ এই কাণ্ডে মিহিক হতবিহ্বল হয়ে গেল। স্তব্ধ আঁখিতে কীয়ৎক্ষণ শাশুড়ির মুখপানে চেয়ে রইল। তার আবারও মনে হলো, এই বিয়েটা একটা চরম ভুল তার জীবনে!

_______________

মিহিকের বাড়ি থেকে লোক আসবে শুনে আষাঢ় খুব খুশি খুশি মুডে ছিল। কিন্তু তার আনন্দে ভাঁটা পড়লো, যখন দেখলো নোয়ানা আসেনি। ইদ্রিস খান এবং তিন্নি এসেছে শুধু। আষাঢ় নোয়ানার না আসার কারণটা তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারলো, নোয়ানা অসুস্থ বোধ করছিল সেজন্য আসেনি। আষাঢ় ভালো করেই বুঝতে পেরেছে নোয়ানার ওসব অসুস্থ বোধ কিছু না। নোয়ানা আসলে তার কাছাকাছি আসতে চাইছে না। কিন্তু না এসে থাকবে কতদিন?

মিহিক আর শ্রাবণকে নিয়ে ইদ্রিস খান বিকেলে চলে গেলেন। সাথে জুনও গিয়েছে। আষাঢ় আর কারিবের যাওয়ার কথা উঠলে আষাঢ় বললো, সে এবং কারিব আগামী কাল দুপুরে তাদের ওখানে গিয়ে খেয়ে আসবে।

শ্রাবণ মিহিকদের বাড়িতে গিয়ে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, কিছুক্ষণ পরই আবার বাড়ি চলে এলো। একেবারে পাশাপাশি বাড়ি। আসা যাওয়া কোনো ব্যাপার না। লায়লা খানম ছেলেকে বাড়ি দেখে বললেন,
“এ কি! তুমি এখানে কেন?”

“ও বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছিল না আম্মু। অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই চলে এলাম।”

“বলছো কী তুমি? ভালো লাগছিল না মানে? তাই বলে চলে আসবে? যাও, এক্ষুণি ফেরত যাও।”

“প্লিজ আম্মু! এরকম করো না। বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকি। তারপর না হয় আবার যাব।”

রুপালিও উপস্থিত আছে এখানে। সে মুখ বুজে থাকলো না। বললো,
“ওই বাড়িতে গেছো এক ঘণ্টাও হয় নাই, এর মাঝেই চলে আসছো? ভাগ্যিস স্যার এখন বাড়িতে নাই, বাড়িতে থাকলে খুব রাগারাগি করতেন। তুমি এখনই ওই বাড়িতে ফেরত যাও। জামাই মানুষ এত ঘোরাঘুরি করা ঠিক না। মানুষ খারাপ ভাববো। যাও, ফেরত যাও।”

শ্রাবণের আর বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হলো না। লায়লা খানম আর রুপালি মিলে নানান কথা বলে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিলো তাকে। শ্বশুর বাড়িতে এসে প্রথমে দেখা হলো মিহিকের সাথে। দরজা অতিক্রম করে রুমে ঢুকতেই মিহিক প্রশ্ন করলো,
“কোথায় গিয়েছিলেন?”

“বাড়িতে।”

“বাড়িতেই যখন গিয়েছিলেন তখন আবার ফেরত এলেন কেন? ওখানেই থাকতেন। এখানে আসার আবার কী দরকার ছিল?” রুক্ষ-তিক্ত কণ্ঠ মিহিকের।

শ্রাবণের যা শুনতে ভালো লাগলো না। সে বললো,
“আপনি আমার সাথে এরকম করে কথা বলেন কেন?”

“তাহলে কেমন করে কথা বলবো আমি তোর সাথে?”

শ্রাবণের রুহু কেঁপে উঠলো। ওষ্ঠদ্বয় নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়। কণ্ঠে অবিশ্বাস ধরে বললো,
“আপনি তুই-তোকারি করছেন?”

“হ্যাঁ করছি, কী করবি তুই?”

“আপনি দেখছি অন্য সব বউদের মতো করছেন। বাবার বাড়িতে এসে আপনার পাওয়ার বেড়ে গেল?”

“আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা নেই, ধারণা দিতেও চাই না। আজ দিনের ভিতর যদি একবারও দেখেছি রুমকির সাথে ফোনে কথা বলছিস, তাহলে একেবারে শ্বশুর আব্বুর কাছে বলে দেবো।”

“আপনি হঠাৎ ডাকাতদের মতো বিহেভ করছেন কেন? আপনার কি জ্বর এসেছে? দেখি…”

শ্রাবণ মিহিকের কপালে হাত দিয়ে জ্বর পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে, মিহিক পিছিয়ে গিয়ে বললো,
“খবরদার! আমাকে স্পর্শ করবেন না। রুমকি আপনার সব না? ওর কপালে হাত রেখেই জ্বর এসেছে কি না চেক করুন।”

মিহিক আর দাঁড়ালো না, লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
শ্রাবণ স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ করে কী হলো মিহিকের? দজ্জাল মেয়ে একটা! রুমকিকে হিংসা করছে?

_______________

রাতে আবারও শ্রাবণ বাড়ি এলো। লিভিং রুমে লায়লা খানম, রুপালি, কারিব, আষাঢ় সবাই মিলে গল্প-গুজব করছিল। এমন সময়ে শ্রাবণকে দেখে সবাই অবাক হলো। কারিব বললো,
“শ্রাবণ ভাই, আপনি এসময় এখানে কেন?”

দিনের বেলা মিহিকদের বাড়িতে থাকা সম্ভব হলেও, রাত্রি ক্ষণে ওখানে থাকা সম্ভব হলো না শ্রাবণের পক্ষে। কিছুতেই থাকতে পারবে না সে ওখানে মিহিকের সাথে। মিহিক যে খারাপ ব্যবহার করলো আজ, এছাড়াও তাদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেখানে এক্সট্রা কিছু আছে বলে মনে হয় না। রুমে আছে একটা ছোট ওয়ার্ডোব, একটা আলনা, দুটো আর্ম চেয়ার, একটা র‍্যাক, একটা খাট। খাটের উপর বিছানা। এক্সট্রা তোষক বা চাদর থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। একটা মানুষ বিছানায় ঘুমালে আরেকটা মানুষ ঘুমাবে কোথায়? তাই চলে আসাটাই সঠিক মনে হলো। বাড়িতে এসে কী বলবে সেটা আসতে আসতেই ঠিক করে রেখেছে। তাই সহজেই উত্তর দিতে পারলো।

“আসলে ও বাড়িতে খুব গরম। গরম আমি সহ্য করতে পারি না। তাই চলে আসতে বাধ্য হলাম।”

লায়লার হৃদপিণ্ড ভয়ে ধকধক করছে। কবির সাহেব বাড়িতে আছেন এখন। লাইব্রেরি রুমে কী যেন কাজ করছেন। সে যদি টের পায় শ্রাবণ রাতের বেলা শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছে তাহলে বড্ড রেগে যাবেন। লায়লা খানম ছেলেকে বললেন,
“ও বাড়িতে গরম এসেছে কোত্থেকে? ও বাড়িতে কি ফ্যান নেই?”

“ফ্যান আছে, তবে এসি নেই। আর যে ফ্যান আছে তাতে খুব কম বাতাস হয়। গায়ে লাগার মতো নয় সে বাতাস। আমার পক্ষে এত গরম সহ্য করে থাকা সম্ভব নয়। আজকে রাতে আমি এখানেই থাকবো।”

শ্রাবণের বানোয়াট কথা সবাই-ই ধরতে পারলো। আষাঢ় বলে উঠলো,
“তুমি তোমার বউকে বাবার বাড়িতে ফেলে রেখে এখানে থাকবে? এটা কেমন ধরণের আচরণ ব্রো?”

আষাঢ়ের কথার পরপর লায়লা খানম বললেন,
“তুমি কি তোমার আব্বুর হাতে আবার থাপ্পড় খেতে চাও শ্রাবণ? কোন আক্কেলে এখন তুমি এখানে থাকতে এসেছো? তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকদের কি জানিয়ে এসেছো এসব?”

“না, তাদের কিছু জানাইনি।”

লায়লা খানম স্বস্তি পেলেন। বললেন,
“তোমার আব্বু কিছু টের পাওয়ার আগে ওখানে ব্যাক করো। নয়তো এর ফল ভালো হবে না। মিহিককে আমি খুব আহ্লাদ করে আমার বাড়িতে বউ করে এনেছি, তুমি তার মান রাখছো না। মেয়েটাকে কষ্ট দিলে তুমি নিজের কষ্টও হিসাব করে উঠতে পারবে না। শ্বশুর বাড়িতে ফেরত যাও। এসব কর্ম কাণ্ড বন্ধ করো। রুমকিকে ঝেড়ে ফেলে দাও। আমার ছেলে বিয়ের পর এমন করবে এটা আমার আশা যোগ্য ছিল না। মনে হচ্ছে মিহিকের জীবনটাই নষ্ট করে দিলাম!”

লায়লার চোখে পানি দেখা গেল।
মায়ের চোখে পানি দেখে শ্রাবণের ভিতরটা অপরাধে অভিযুক্ত হলো। সে কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বললো,
“শ্বশুর বাড়িতে ব্যাক করছি আমি। মিহিককে রেখে এখানে আসা উচিত হয়নি আমার।”

কথাটা বলেই শ্রাবণ চলে গেল।

আষাঢ় ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হেসে ফেললো। কারিবের হাতে থাকা প্লেট থেকে একটা পাকোড়া উঠিয়ে সেটাতে কামড় বসিয়ে বললো,
“কিছু বুঝলে কারিব?”

কারিব পাশ ফিরে আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কী বুঝবো?”

“আমার ভাই বড়ো-সড়ো প্রেমে ডুববে। রুমকির জন্য ওরকম প্রেমে না, সত্যিকারের গভীর প্রেমে ডুববে।”

রুপালি আষাঢ়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। ক’দিন ধরে সে আষাঢ় আর কারিবের উপর খুব ভালো করে নজর রাখছে। আষাঢ় আর কারিব চুপিচুপি কী করে বেড়ায় এসব জানার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। আষাঢ় এবং কারিব দুজনই খুব চতুর!

______________

শ্রাবণ শ্বশুর বাড়িতে ব্যাক করে লিভিং রুমে একই সাথে তিন বোনকে বসা দেখলো। তারা নিজেদের মাঝে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল। শ্রাবণের আগমন তাদের থামিয়ে দিলো। নোয়ানা জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় গিয়েছিলেন ভাইয়া?”

শ্রাবণ হাসার চেষ্টা করলো। এখানে তিন বোনের সাথে তার বসা ঠিক হবে কি না ভাবলো। বসলো সে। বললো,
“বাইরে গিয়েছিলাম একটু।”
বলতে বলতে তার চোখ গেল একবার মিহিকের উপর। মিহিকের মুখে রাগের লেপন লক্ষ্য করলো সে। যখন লিভিং রুমে এসে প্রথম পা রেখেছিল তখন রাগের কোনো চিহ্ন ছিল না মেয়েটার মুখে। হাসছিল মেয়েটা। মিথ্যা বলবে না, মেয়েটার হাসি মুখ তার ভালো লেগেছিল। কিন্তু সে আসাতে মেয়েটার মুখ এখন কেমন গম্ভীর, রাগী দেখাচ্ছে। শ্রাবণ মিহিকের এই মুখের সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারবে না। সে নিজের শালিকাদের উদ্দেশ্যে বললো,
“ঠিক আছে, তোমরা বোনেরা মিলে গল্প করো। আমি একটু ক্লান্ত বোধ করছি। রুমে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছি আমি। আর জুনকে দেখছি না যে, জুন কোথায়?”

তিন্নি বললো,
“জুন রুমে শুয়ে আছে।”

শ্রাবণ কথা বাড়ালো না, উঠে দাঁড়ালো। শেষবার একবার মিহিকের দিকে তাকিয়ে সোজা চলে গেল। সে চলে যেতেই মিহিক বোনদের উদ্দেশ্যে বললো,
“ওনার বাইরেটা দেখে ভিতরটা কেমন সেটা যাচাই করতে পারবি না। ওনার বাইরেটা মিঠা হলেও, ভিতরটা লবণ তিক্ত শরবত। লবণ তিক্ত শরবত কেউ মুখে তুলতে পারে না, আমিও পারছি না।”

নোয়ানা বোনকে একটু একটু বুঝতে পারছে। মিহিক কিছুই খোলাসা করে বলেনি তাদের, বললে হয়তো পুরোটাই বুঝতে পারতো। যা বুঝেছে তার দরুণ হিসেবে বললো,
“আশা করছি শ্রাবণ ভাইয়া খুব ভালো একজন স্বামী হয়ে দেখাবে তোমাকে।”

মিহিক শ্লেষের সাথে হেসে উঠলো।
“সে আর ভালো স্বামী! হুহ! বাদ দিয়ে রাখ।”

নোয়ানা আর তিন্নি বোনের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। তারা মিহিকের দিকে তাকিয়ে রইল। আর মিহিক অন্যদিকে।
টি টেবিলের উপর থাকা নোয়ানার মোবাইলটা টিং করে বেজে উঠে জানান দিলো ম্যাসেজ এসেছে। আর কারো মনোযোগ সেদিকে না পড়লেও নোয়ানার মনোযোগ মোবাইলে গিয়েই আটকালো। সে মোবাইল তুলে নিলো হাতে। আষাঢ় ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। এই প্রথম ম্যাসেজ পাঠালো।

‘আজকে তুমি এলে না কেন? দুঃখ পেয়েছি তো। দুঃখ কাটানোর জন্য তাই কাল নিজেই চলে আসছি তোমাদের বাড়ি। খুব সুন্দর করে সেজে থেকো, ও কে?’

এর পরই আবার একটা ম্যাসেজ এলো,
‘আচ্ছা, তোমাদের ব্যালকনিতে লাইট নেই কেন? একটা লাইট লাগাতে পারো না? দ্রুত একটা লাইট লাগিয়ে নিয়ো ব্যালকনিতে। নয়তো নিজেই লাইট লাগানোর ব্যবস্থা করবো।’

শেষের ম্যাসেজটা দেখে নোয়ানার ভ্রু কুঁচকে গেল। মোবাইলটা দ্রুত অফ করে আবার রেখে দিলো টেবিলের উপর। ভাবনা চলতে লাগলো মনে।

__________________

রাতে কে কোথায় ঘুমাবে এ নিয়ে গভীর ভাবনা চলছিল শ্রাবণের মনে। এখন ঘুমানোর সময়। ডিনার শেষ করেছে প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। এই এক ঘণ্টা ধরে সে একলা রুমে। মিহিক এখনও নিজের বোনদের সাথে বোনদের রুমে আছে। শ্রাবণ রুমটার উপর চোখ বুলাচ্ছে। দুটো আর্ম চেয়ারের বদলে একটা সোফা থাকলে কী ক্ষতি হতো?
যদিও সোফাতে ঘুমানো অসম্ভব শ্রাবণের কাছে। সোফায় ঘুমালে রাতে এক কাত থেকে আরেক কাতে ফিরলে পড়েও যেতে পারে। সেজন্য সোফাতে ঘুমানোর দুঃসাহস কখনও দেখায়নি সে। অবশ্য দেখানোর প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু আজ এমন একটা দুঃসময়ে সে সোফার কথা ভাবতেও ভুললো না। দুজনের একজনকে এখন এই আর্ম চেয়ারে বসে রাত্রি যাপন করতে হবে। কিন্তু কে করবে এই কাজ? সে? না কি মিহিক? শ্রাবণের মনে ভয় হলো। তার মন বললো, মিহিক তাকেই আর্ম চেয়ারে ঘুমাতে বলবে। অসম্ভব! এটা কিছুতেই পারবে না সে। না তো সারারাত এই আর্ম চেয়ারে বসে বসে ঘুমাতে পারবে, আর না তো মিহিকের পাশে এক বিছানায় শুতে পারবে। মিহিকের পাশে এক বিছানায় ঘুমানোর কথা দুঃস্বপ্নেও ভাববে না সে, তাতে যদি সারারাত দাঁড়িয়েও কাটাতে হয়, তাও শান্তি।

শ্রাবণের শেষ ভাবনার সাথে সাথে রুমের দরজাটা খুলে গেল। তার চোখ চলে গেল দরজার দিকে। দরজায় মিহিককে দেখতে পাওয়া গেল। মিহিক ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। শ্রাবণ মিহিককে আগে প্রশ্ন করে দেখলো,
“আচ্ছা, আমরা কে কোথায় ঘুমাবো?”

“বিছানায় ঘুমাবেন, আর কোথায় ঘুমাতে চান?”

“আর আপনি?”

“চেয়ারে ঘুমাবো।”

মিহিকের কথা শুনে খুশি হওয়ার কথা ছিল শ্রাবণের। কিন্তু সে খুশি হতে পারলো না। মিহিককেও তার চেয়ারে ঘুমাতে দিতে ইচ্ছা করছে না। একটা মেয়ে সারারাত বসে বসে পার করবে আর সে শুয়ে থাকবে? না এটা বড্ড বেমানান দেখায়।

“আপনি বিছানায় ঘুমান, আমি চেয়ারে বসে দেখি ঘুমানোর চেষ্টা করা যায় কি না।” শ্রাবণ নিজের প্রতি নিজে অবাক। এটা কী বললো সে? সে বললো? না কি তার অপরাধী মন বললো?

মিহিক বিরক্ত হলো না খুশি হলো বোঝা গেল না। তার মুখটা কাঠিন্য। বললো,
“আমি আপনার বউ না, আমার প্রতি আলগা দরদ দেখাবেন না। ওসব দেখাতে হলে রুমকির কাছে যান।”

“রুমকিকে টানেন কেন বার বার? আমাকে যা বলার বলুন, ওকে টানবেন না দয়া করে। আর আপনি আমার বউ না তো কী? তিনবার কবুল বলে আমাকে বিয়ে করেছেন আপনি।”

মিহিকের বেজায় রাগ হলো।
“দেখুন, আমি আপনার সাথে ঝগড়া করতে চাইছি না।”

“সে আমিও চাইছি না।”

মিহিকের রাগের তীব্রতা বেড়ে গেল। গটগট করে জানালার দিকে হেঁটে গেল সে।

শ্রাবণ পিছন থেকে অস্ফুট স্বরে বললো,
“দজ্জাল মেয়ে!”

মিহিকের কানে কিঞ্চিৎ সাউন্ড এসে লাগলো। শ্রাবণ কী বলেছে ঠিক বুঝলো না। পিছন ফিরে গম্ভীর স্বরে বললো,
“কী বললেন আপনি?”

“আপনার আম্মু তো খুব ভালো মানুষ, আপনি তার মেয়ে হয়ে এমন হলেন কেন?”

“হোয়াট ডু ইউ মিন? কেমন হয়েছি আমি?” জ্বলে উঠলো মিহিক।

শ্রাবণ উত্তর দিলো না। বললো,
“একটু ভালো আচরণ করুন।”

মিহিক কটমট করে বললো,
“লবণ তিক্ত শরবত!”

“কী বললেন? কীসের শরবত?”

“দশ চামচ লবণ দিয়ে শরবত গুলে খাওয়াবো আপনাকে।”

শ্রাবণের অন্তর কেঁপে উঠলো। কী সাংঘাতিক কথা! সে এটা নিয়ে আর একটাও টু শব্দ করলো না। মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে রইল। এ সময় তার নজরে পড়লো বিছানার উপর একটা কাঁথা রাখা আছে। এটা তো আগে একদম খেয়াল করেনি। সে চকচকে মুখ নিয়ে মিহিকের দিকে তাকালো।

“আপনাকে চেয়ারে বসে বসে রাত কাটাতে হবে কেন? এই তো একটা কাঁথা আছে। এটা নিচে বিছিয়ে শুয়ে পড়ুন। চেয়ারে বসে রাত্রি যাপনের চেয়ে এটা বেটার অপশন।”

শ্রাবণের কথা শুনে মিহিকের মুখ অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে এলো শ্রাবণের দিকে। বিছানা থেকে ভাঁজ করা কাঁথাটা উঠিয়ে, সেটাকে মেলে দিয়ে দিলো শ্রাবণের মাথায়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here