বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ৩৪

0
638

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ৩৪
#লেখা: ইফরাত মিলি

কয়েক দিন ধরে আষাঢ় বাড়িতে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে। ঘোরাঘুরি নেই, হাসাহাসি নেই, নেই কোনো ধরণের পাগলামি। সে প্রায় মনমরা। সামান্য একটা ঘটনা এত তির্যকভাবে হৃদয়ে প্রভাব ফেলবে ভাবেনি। ভেবেছিল খরসান বাতাসের তরে স্মৃতিটুকু উড়ে যাবে। কিন্তু গেল না। নোয়ানার সাথে দেখা হয়নি আজ অনেকদিন। না, নোয়ানাকে দেখার জন্য তার মন আকুল হচ্ছে না। চাইলে বাইনোকুলারের সাহায্যে নোয়ানার শ্যাম বরণ কোমল মুখখানি অনেক দূর থেকেই সে দেখতে পারতো। কিন্তু অভিমানে তার অন্তর গাঁট হয়ে আছে। রাগ জমে আছে। নোয়ানার মুখ দেখলে হয়তো এই রাগ আরও বাড়বে। যেটা সে চাইছে না। মেয়েটা দশ বছর আগের মতোই তার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইছে। কিন্তু এবার কি পালিয়ে যেতে পারবে? উহু, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না তাকে।
আষাঢ় সোফায় হেলান দিয়ে মাথার পিছনে দুই হাত ফেলে বসে আছে। মাথাটাও পিছনের দিকে হেলিয়ে রেখেছে। মন অসুখে ধরেছে। সুস্থ হওয়ার প্রতীক্ষায় সে। মনের এত অসুস্থতা নিয়ে থাকা যায় না। বন্ধ নেত্রপটে ভাসছে রঙিন কিছু চিত্র। সমস্ত চিত্রে নোয়ানা গাঢ়ভাবে লেপ্টে আছে। রঙিন চিত্রের মাঝে বিষাদের রং আলতো করে তুলির আঁচড় টানতে চাইছে। টেনেও দিলো শেষমেশ। পুরো রঙিন চিত্র ক্যানভাসটাই সেই তুলির আঁচড়ে কুৎসিত হয়ে গেল।
কানে আলতো করে ভেসে এলো মায়ের ডাক,
“আষাঢ়!”

ডাকের সাথে সাথে আষাঢ় চোখ খুললো। মাকে দেখে হাত সোজা করে ভদ্র হয়ে বসলো। ভদ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবে?”

“সন্ধ্যার পর তুমি আর কারিব মিহিকদের বাড়িতে এসো।”

আষাঢ়ের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। গভীর প্রশ্নের এক আঁচ ফুঁটে উঠলো মুখে। হঠাৎই এমনভাবে নোয়ানাদের বাড়ি যাওয়ার প্রসঙ্গ কেন?

“ভাবিদের বাড়ি কেন যাব?”

লায়লা খানম ছেলেকে অজ্ঞ অনুধাবন করলেন,
“তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না। ছোট-খাটো অনুষ্ঠান হবে। নোয়ানার এনগেজড আজ। শোনোনি?”

মায়ের কথা কান দিয়ে শ্রবণ হয়ে হৃদয় পর্যন্ত স্তব্ধ করে দিলো আষাঢ়ের। এক সূক্ষ্ম ব্যথায় হৃদয় পাণ্ডুর হয়ে এলো। বসা থেকে চকিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কার এনগেজড? নোয়ানার?”

আষাঢ়ের এমন অভিপ্রায় দেখে লায়লা খানম একটু অবাক হলেন। অপ্রস্তুত হয়েই উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ।”

আষাঢ়ের মাথায় ব্যথা চিনচিন করে উঠলো। হৃদয় হাঁসফাঁস করছে। কীভাবে সম্ভব এটা? ওই ভীতু মেয়ে কোন বোকামি করছে?

“কার সাথে এনগেজড?” ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো আষাঢ়।

“ওদেরই রিলেটিভ…”

‘রিলেটিভ’ শব্দটা শুনে আষাঢ়ের নাঈমের কথা মনে পড়লো। এটা কি নাঈম হতে পারে? আষাঢ়ের মাঝে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠছে। নোয়ানার এত বড়ো স্পর্ধা? তার পরানো আংটি খুলে ফেলে নাঈমের হাতে আংটি পরতে চাইছে নির্দয় মেয়েটা?

“ছেলের নাম কি নাঈম?”

“হ্যাঁ, এরকমই কিছু বলেছিল। তুমি চেনো না কি ওকে?”

“তেমন ভাবে চিনি না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভালো করে চেনা-জানার পরিচয়টা শুরু করতে হবে।”

আষাঢ় কারিবের রুমের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।

কারিব ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। কয়েকদিন ধরে কাজের খুব প্রেশার তার উপর। হঠাৎ করে এমন কাজের উপদ্রব শুরু হবে জানতো না। ইদানিং কাজ-কর্ম করতে বড্ড আলসেমি লাগে তার। কাজ না করতে করতেই এই আলসেমির উদ্ভাবন। আষাঢ় বাংলাদেশ থাকতেও তার এরকম কাজ করতে হচ্ছে ব্যাপারটা দুঃখজনক!

আষাঢ় দরজা খুলে ঢোকার পরপরই প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তুমি এত বড়ো একটা খবর আমার থেকে গোপন রাখলে কেন কারিব?”

কারিব যারপরনাই অবাক। আষাঢ়ের কণ্ঠে আক্রোশ। শ্যামবর্ণের আননে ক্রোধের রক্তিম ছটা লেগেছে। কারিবের মনে দুম করে একটা ভয় গেড়ে বসলো। কোন খবর আবার গোপন রাখলো আষাঢ়ের কাছ থেকে? তার ভাণ্ডারে তো কোনো খবরই নেই। তাহলে গোপন রাখলো কী?

“কোন খবরের কথা বলছেন আষাঢ় ভাই?”

“কোন খবরের কথা বলছি তুমি জানো না? নোয়ানার এনগেজড এটা জানতে না তুমি?” আষাঢ়ের কণ্ঠ ক্ষিপ্ত। ক্ষিপ্ততার ঝড় উপচে উঠছে। হৃদয়ে চলমান ঝঞ্ঝার ক্ষুদ্র একটি অংশ এই ক্ষিপ্ততা।

আষাঢ়ের কথা শুনে কারিবের ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেল। বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে বলে উঠলো,
“ভাবির এনগেজড মানে?”

“এত বড়ো কথাটা কেন গোপন রেখেছিলে তুমি?”

“বিশ্বাস করুন আষাঢ় ভাই, আমি কিছুই গোপন রাখিনি। আমি তো জানতামই না ভাবির এনগেজড।”

“ও, তুমি জানতে না? এটা বিশ্বাস করতে হবে আমার? সকল খবর থাকে তোমার কাছে, আর এই খবরটা তুমি জানতে না? এটা কেন করলে? এটা আমার থেকে গোপন রাখার কী কারণ?”

“আমি সত্যিই জানতাম না। যদি জানতাম তাহলে এটা কেন গোপন রাখবো আপনার কাছ থেকে? কী কারণ এর পিছনে? আমি জানতাম না আষাঢ় ভাই। এমনকি রূপ খালাও আমাকে একটা শব্দ বলেনি এ সম্পর্কে। বিশ্বাস করুন। জানতাম না আমি। একেবারেই জানতাম না।”

আষাঢ় শান্ত হলো। বুঝতে পারলো অহেতুকই সে কারিবের উপর ক্ষেপছে। কারিব জানতে পারলে সেটা গোপন না রেখে তার কাছেই বলতো সর্বপ্রথম। অসহায়ত্ব তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরলো।

কারিব আষাঢ়কে বিস্ময়াবিষ্ট চোখে দেখছে। এই মানুষটার ভিতরে এখন কী চলছে অনুধাবন করতে পারছে না সে। নোয়ানার এনগেজড খবরটা কার কাছ থেকে পেয়েছে, কবে, কখন এনগেজড প্রশ্নগুলো ঘুরছে তার ভিতর। কিন্তু প্রশ্ন করার মতো পরিস্থিতি অনুভব করছে না। দ্বিধা দুরুদুরু একটা মন নিয়ে চেয়ে রইল।
আষাঢ় একই ভঙ্গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। মৌন ঝঞ্ঝা কিছুটা সামলে নিলো। ঘোলাটে চোখ মেলে চেয়ে বললো,
“সন্ধ্যার পর তৈরি হয়ে থেকো, আমাদের যেতে হবে এনগেজমেন্ট ফাংশনে।”

আষাঢ় এটুকু বলে বেরিয়ে গেল। কারিবের হৃৎপিণ্ড ডিগবাজি খাচ্ছে। কোত্থেকে কী হচ্ছে? সবই অগোছালো, নিথর লাগছে!

__________________

ইদ্রিস সাহেবের বাড়িতে সাদামাটা উৎসব উৎসব ঠেকছে। নোয়ানার এনগেজড উপলক্ষে ছোটখাটো একটা আয়োজন না রাখলেই যেন হচ্ছিল না। বড়ো মেয়ের বিয়েতে এসব কিছুই হয়নি। কেমন এক নীরবতায় মিহিকের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। তাই নোয়ানার বিয়ে উপলক্ষে সে সব কিছুতে আয়োজনের ছোঁয়া রাখতে চায়। জমকালো আয়োজন না হলেও সাদামাটা আয়োজনও অনেক কিছু। কবির সাহেবের বাড়ি থেকে সবাই এসেছে। আরও কিছু আত্মীয় স্বজন আছে। নাঈমের পরিবার থেকে এসেছে, নাঈম, তার মা-বা, দাদা, চাচা এবং বোন-দুলাভাই। কয়েক মাসের মধ্যে নাঈম সৌদি আরব যাচ্ছে। নাঈমের মা-বাবা চাইছিল ছেলে বিদেশ যাওয়ার আগে বিয়েটা হয়ে যাক। নাঈমের সাথে এ নিয়ে কথা বলেছিল তারা। নাঈম অমত করেনি। বরংচ মনে মনে মা-বাবার থেকে তার চাওয়াটাই বেশি ছিল। কারণ, সে বিদেশ থাকার ফাঁকে যদি এদিকে নোয়ানার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যায়, সেই সংশয়ে ছিল সে। নাঈমের মা-বাবা অবগত ছিল নাঈম পছন্দ করে নোয়ানাকে। নোয়ানাকে তাদেরও পছন্দ। তাই সরাসরি পাত্রী হিসেবে নোয়ানার কথাই বলেছিল। তাদের ধারণা ছিল হাফিজাদের থেকে কোনো অমত প্রকাশ পাবে না। পায়নি। নোয়ানাও সম্মতি জানিয়েছে। নোয়ানাসহ সকলেই রাজি। বিদেশ যাওয়ার পর সব কিছু ঠিকঠাক করে নোয়ানাকেও সেখানে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এমনই পরিকল্পনা করে রাখা। আজ এনগেজড হয়ে গেলে আর দশ-পনেরো দিন পরই বিয়ে কার্য সম্পন্ন হবে ইনশাআল্লাহ!

ইদ্রিস সাহেবের বাড়িতে সবাই-ই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেমন এক ব্যস্ততাও পরিলক্ষিত। এর মাঝে নোয়ানার রুমটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ আগেও মানুষ ছিল, কিন্তু এখন শূন্য। মিহিক ছিল। হাফিজা কী এক সাহায্যের জন্য ডাকলে চলে গেল। সব কিছুর মাঝে নোয়ানার মন হয়ে আছে বিদঘুটে। বিদঘুটে মনটা বার বার তলিয়ে যাচ্ছে ঝাপসা অন্ধকার কষ্টপঞ্জরে। আয়নায় নিজের মুখটা দেখছে। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে। ঠিক নিজের প্রতি নয়, নিজ জীবনের প্রতি। জীবনটা যেন শেকল প্যাঁচানো খাঁচার ভিতর আবদ্ধ বন্দি একটা পাখির মতোন! যে পাখি উড়তে পারে না। খাঁচার ভিতরের অন্ধকারে যার নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়। এ জীবন নিয়ে নিজের সম্পর্কে নিজের কোনো কথা বলতে গেলে দ্বিধা হয়। এ জীবনে আবেগের দেয়াল ডিঙিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টায় কষ্টের তটিনীতে ডুবতে হয়। কষ্টের তটিনীতে ডুবলেও একটা কথা মনে রাখতে হবে, অনেক কষ্ট প্রাপ্তিও স্বস্তির হয়। এটাও ঠিক তেমনই। যদি এখন নাঈমের সাথে বিয়েতে অসম্মতি জানাতো, তাহলে সেটা ভুল হতো। হৃদয়ে কষ্টের নীড় গড়ে নাঈমের সাথে বিয়েতে সম্মতি দেওয়াই হচ্ছে নির্ভুল। কষ্ট তুমি একা পাও, নিজের মনের ঠুনকো সুখের জন্য কেন বাকি দশটা মানুষের মনে কষ্ট দেবে? অসুখী তুমি একা, সুখী থাকার অভিনয়ে সুখীদের মাঝে হারিয়ে যাও। অসুখীর প্রকাশ্য ঘটিয়ে সুখী মানুষগুলোকে কেন দুঃখের স্বাদ দেবে? নোয়ানার চিন্তা ধারা এরকম, নিজে কষ্ট পেলেও অন্যদের কষ্ট মুক্ত রাখাই শ্রেয় এবং উচিত কাজ। সে কখনোই অন্যদের কষ্টের কারণ হতে চায় না। চাচা-চাচির মনে কখনও কষ্টের সূচ ফুঁটাতে পারবে না সে। যাদের জন্য একটা সুষ্ঠ জীবনে আছে, যাদের আশ্রয়ে বড়ো হয়েছে, তাদের প্রতিদান তো কষ্ট দিয়ে দেওয়া যায় না। এমনিতেই তাদের ঋণ শোধ করার মতো না। এই মানুষগুলো যদি আগলে না রাখতো তাহলে জীবন কোথায় তলিয়ে যেত চিন্তা করতে পারে না!

নোয়ানা এক চোখে তাকিয়ে ছিল আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিতে। শূন্য রুমে শুধু সে একলা। আর কিছুক্ষণ পর আংটি বদলের কাজ সমাপ্ত হবে। আঁখি ক্যানভাস সিক্ত হয়ে ওঠে তার। হৃদয় ভেজা পদ্ম পাতার মতো নরম কষ্টের নিখুঁত আলপনা আঁকে।
অকস্মাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। হৃদপিণ্ড হালকা দোদুল্যমান হয়। তড়িৎ গতিতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে চোখের অশ্রু লুকাতে। লুকাতে পারে সহজেই। সে মানুষটা যে বড়ো কঠিন।
আয়নায় চোখ পড়তে থমকে যেতে হলো। আগন্তুক আষাঢ় হবে এটা তার দুর্ভাবনীয় ছিল। জানতো আষাঢ় কখনো না কখনো কথা বলতে আসবে। কিন্তু এরকম ভাবে, এই সময় রুমে চলে আসবে ভাবেনি।
আষাঢ় দরজা লক করলো ভিতর থেকে। নোয়ানা চকিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে পিছন ঘুরে বিস্ময়ে বিমোহিত হয়ে বললো,
“আপনি এখানে এসেছেন কেন?”

আষাঢ় নির্লিপ্ত। নোয়ানার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো।
নোয়ানার অন্তর কাঁপছে ভয়ে। সে অনুনয়ের সুরে বললো,
“দরজা বন্ধ করলেন কেন? আপনি প্লিজ চলে যান। আমি চাইছি না কেউ আপনাকে এখানে দেখুক। আ…”
নোয়ানা কথা সমাপ্ত করতে পারলো না। আষাঢ় তার আগেই ধীর পা দুটোকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে নিয়ে এসে নোয়ানার ঠোঁটে তর্জনী ঠ্যাকালো। ক্রোধ মিশ্রিত চাপা স্বরে বললো,
“চুপ করো। একদম চুপ করে যাও। আমি কিছুক্ষণ দেখবো তোমায়।”

“মানে?”

আষাঢ় জোরে তর্জনী চেপে ধরলো।
“শসস…একটা কথাও বলো না। কথা বলার অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো টিউলিপ!”

নোয়ানা স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। আষাঢ়ের সাথে তার অনেকদিন পর দেখা হলো। এই অনেকদিনের সময়টাতে তো এই মানুষটাকেই একবার দেখার জন্য মন কেমন করতো তার। সকল মন কেমনের ইতি ঘটাতে হবে। আষাঢ় নামক মন কেমনের বৃষ্টি শুকিয়ে হৃদয় করতে হবে শুষ্ক। এটাই চির উত্তম আর এটাই সমাধান!

আষাঢ় নিজের রক্তিম চক্ষু জোড়া দিয়ে এত গভীরতা নিয়ে কী দেখছে নোয়ানার কঠিনতার প্রলেপ আঁকা মুখখানিতে? তার সন্ধানী সারবস্তু অজানা। কী গভীর পর্যবেক্ষণীয় দৃষ্টি আষাঢ়ের! মুখ দেখে মন পড়ার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে না কি? না কি আবার ‘বৃথা চেষ্টা’ কথাটাকে ডিঙিয়ে সাফল্যে পৌঁছাবে সে?
আষাঢ়ের এই দৃষ্টির সামনে নোয়ানার কঠিনতায় একটু একটু করে ভাঙন ধরছে। যেটুকু ভাঙছে সেটুকু আবার মেরামত করে সেরে নিচ্ছে। তার মনে এখন কঠিনতার ভাঙা-গড়া চলছে। এটা ভাঙা সহজ, কিন্তু গড়া অধিক কঠিন।
আষাঢ়ের দৃষ্টি নোয়ানার চোখ জোড়াতে বেশি স্থায়ী। নোয়ানার চোখে শীতল দৃষ্টি স্থাপিত রেখে বললো,
“কী দারুণ নির্দয় তুমি! কী দারুণ অভিনেত্রী!”

আষাঢ়ের কথায় কী মেশালো ছিল জানে না নোয়ানা। এক দৈত্য হাওয়া বইয়ে দিলো হৃদয়ে। যে দৈত্য হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল কঠিনতা মেরামত করার শক্তিটুকু। হৃদয় এখন কেবল একটু একটু করে ভাঙতে লাগলো। এই ভাঙনে কী অসহনীয় ব্যথা! ইচ্ছা হচ্ছে কেঁদে সেই কান্না জলে সকল অসহনীয় ব্যথা ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু চাইলেই যে কাঁদা যায় না। তার কান্নার নিয়ম আরও বেশি জটিল।

“এটাই কি কারণ ছিল টিউলিপ? আমার পরানো রিং খুলে ফেলে দিয়েছো কারণ নাঈমের দেওয়া রিং পরবে সেজন্য?”
আষাঢ়ের কণ্ঠ অভিযোগী। হৃদয়ে উন্মাদিনী কষ্টের দাপাদাপি চলছে তার। পাগলা হাওয়ার মতো হৃদয়ের প্রতিটা প্রান্তে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে ক্লেশ।

নোয়ানা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। হৃদয় কি শুধু আষাঢ়ের একারই পুড়ছে? তার হৃদয়েও তো কঠিন অগ্নিকাণ্ড লেগেছে। অগ্নিকাণ্ড থেকে নির্গত ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করে দম বন্ধ করে দিচ্ছে। এখন কি সেও আষাঢ়ের মতো পাগলামি করবে? না, এই পাগলামিতে তো তাকে মানায় না।

“ভালোবাসো একজনকে, অথচ রিং অন্য কারো হাতে পরার দুঃসাহস কী করে দেখাতে পারো তুমি? কী করে নাঈমের সাথে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছো? কীভাবে করলে এটা?”

“আমি সব দিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমার সিদ্ধান্ত সঠিক।” উত্তর দিলো নোয়ানা। কণ্ঠে তার দৃঢ়তা। যদিও এই কণ্ঠ দৃঢ়তা একটু নড়বড়েই অনুভব হলো।

“সঠিক সিদ্ধান্ত? এটাকে তোমার সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছে? কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছ আমায়? কী পাচ্ছ এরকম কষ্ট দিয়ে? সেই নিজেও তো বিনিময়ে কষ্টই পাচ্ছ। যতটা কষ্ট দিচ্ছ এতটা কষ্ট কিন্তু ধারণ করতে পারছে না আমার হৃদয়!”

নোয়ানার কঠিনতার শেষ খুঁটিও নড়ে উঠছে। মুখ বেঁকে কান্না আসছে। কিন্তু নিজেকে কোনো রকমভাবে সামলে নিলো সে। বললো,
“আপনি চলে যান হিমেল। আমি চাই না আপনি আর এখানে থাকেন। চলে যান। আমার এনগেজমেন্টে আসা উচিত হয়নি আপনার। না আসাই উচিত ছিল। এসে বড়ো একটা ভুল করেছেন। আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করতে আসা উচিত হয়নি আপনার।”

আষাঢ় নোয়ানার কথা শুনে অবিশ্বাস্য চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“একবার হৃদয় খুলে বলো টিউলিপ, বলো তোমার কষ্ট হচ্ছে। শুধু একবারই বলো। ওই একবারই যথেষ্ট আমার জন্য।”

সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নোয়ানার চোখ অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারলো না। অশ্রু কণা এসে ভিড় জমালো অক্ষি কোটরে। নড়বড়ে দৃঢ়তার রেশ বিদ্যমান রেখে বললো,
“আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। আপনি চলে যান।”

আষাঢ় এবার ধৈর্যহারা ক্ষিপ্র মানবের ন্যায় হয়ে গেল। আরও খানিক নোয়ানার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি কী নোয়ানা? তুমি ঠিক কী? তুমি খুব খুব বিরক্তিকর একটা মেয়ে। মানুষ এমনও বিরক্তিকর হতে পারে? তোমার এমন রূপ দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত। আমি কোনো প্রকার ঝামেলা চাইনি। আমি শান্তিপূর্ণ একটি মানুষ। এত এত গার্লফ্রেন্ড সামলে রাখতেও আমায় কোনোদিন ঝামেলায় পড়তে হয়নি, কিন্তু একা তোমাকে সামলে রাখতে পুরো জীবনটাই এখন ঝামেলাপূর্ণ মনে হচ্ছে। ধারণা করেছিলাম নাঈম তোমাকে পছন্দ করে, কিন্তু ছেলেটা যে এত দূর এগিয়ে যাবে কল্পনাও করিনি কখনও। এনগেজমেন্ট করবে ভালো কথা, ভালোয় ভালোয় করে নাও এনগেজমেন্ট। কিন্তু এই এনগেজমেন্ট যে বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে এটা ভাবাও ভুল। তুমি আমার মানুষ। একজনের মানুষ কখনও অন্য কারো স্ত্রী হতে পারে না। তুমি কেবল আমারই স্ত্রী পরিচয় পাবে, নাঈমের নয়। কোনোদিনও হবে না এটা।”

“হবে, নাঈমের সাথেই বিয়ে হবে আমার।”

আষাঢ় রুষিত হয়ে নোয়ানার হাতের দু বাহু শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো। নোয়ানার চোখে চোখ বললো,
“হবে না। অনেক আগেই তুমি মানুষটা আমার হয়ে গেছো। কাজেই অন্য কাউকে বিয়ে করার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারবে না তুমি।”

নোয়ানার হাতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা ছেয়ে গেছে। এমন ভাবেও তার ধরতে পারে আষাঢ়? টলমলে চোখে চেয়ে বললো,
“ছাড়ুন, ব্যথা পাচ্ছি।”

আষাঢ় তো ছাড়লোই না, বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,
“এটুকুতেই ব্যথা পাচ্ছ? তাহলে ভেবে দেখো আমি কতটা ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি! এটা তো শারীরিক কষ্ট, আর তুমি তো আমাকে মানসিক কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ প্রতিনিয়ত। শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর মানসিক যন্ত্রণা। যেটা তুমি আমাকে দিচ্ছ। কেন টিউলিপ? কেন তুমি এরকম? তোমার বিরক্তিকর অভিনয়টা থামাও। বলো, তোমারও মানসিক কষ্ট হচ্ছে। তুমিও ভীষণ কষ্টে আছো। নির্দয় পরিচয় দিয়ো না আর।”

নোয়ানার বক্ষৎপঞ্জর কম্পমান। শরীরও শক্তিহীন দুর্বল হয়ে পড়ছে। আঁখি টলমলে। এই টলমলে আঁখি থেকে অশ্রু ঝরতে দেবে না বলে দৃঢ় সংকল্প করেছে। কিন্তু আষাঢ় যেন তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরাতেই উঠে পড়ে লাগলো। সে কিছুটা শান্ত হয়েছে। নোয়ানার জল টলমলে চোখে চেয়ে বললো,
“এই মেয়ে, চোখে অশ্রু ধরে রেখেছো কেন? কান্নার সাথেও কঠিন আচরণ করতে চাইছো? বেশ তো, ঠিক আছে। পৃথিবীর সবকিছুর সাথে কঠিন থাকো তুমি, কিন্তু আমার সাথে তোমার কঠিনতা চলবে না আর। নরমের থেকেও অতি নরম হতে হবে আমার সাথে। বুঝেছো?”

নোয়ানার জলে টলমল করা এক চোখ বেয়ে টুপ করে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো। গাল বেয়ে গলা পর্যন্ত গড়িয়ে গেল ধারাটি। মন আজকে এত আবেগি আচরণ কেন করছে? তবুও সে আবেগির বশীভূত হতে পারে না। এটা অন্যায় হবে। নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে তার। সিদ্ধান্তের খুঁটি নড়বড়ে হলে চলবে না।

আষাঢ় বললো,
“আমার সাথে নির্দয় হয়ো না টিউলিপ। তুমি তো নির্দয় নও। তোমার একটা কোমল হৃদয় আছে। কোমল হৃদয় নিয়ে কঠিন আচরণ করতে যেয়ো না। হৃদয়ও প্রতিবাদ করে উঠবে। এই এনগেজমেন্ট বন্ধ করো। আর যদি না করো তাহলে এনগেজমেন্ট করে নাও, কিন্তু এই এনগেজমেন্ট যে বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে, এটা দুঃস্বপ্নেও ভেবো না। এমন ভুল ভাবনা ভেবে সময় নষ্ট করো না। সঠিক চিন্তা করো, সঠিক সিদ্ধান্ত নাও। আমি এখন এলোমেলো কোনো ঝামেলা চাইছি না। ঝামেলা হুটহাট করে হয় না। দুজনের সম্মতিতে ঝামেলা হলে সে ঝামেলার ব্যাপার ভিন্ন। ভিন্ন ঝামেলাটাই চাই আমি। তাই শান্তভাবে সব কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। সময় দিলাম। তবে খুব বেশি না। আমি বড্ড ধৈর্যহীন টিউলিপ ফুল!”

আষাঢ় আর দাঁড়ালো না, দরজার দিকে এগোতে লাগলো। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না, দরজা থেকে কয়েক পা দূরেই থেমে গেল সে। দরজায় কেউ একজন কড়াঘাত করছে। একটু পর মিহিকের গলা শোনা গেল,
“নোয়ানা! দরজা বন্ধ করেছিস কেন? দরজা খোল। তোর হবু শাশুড়ি ডাকছে।”

নোয়ানার হৃদপিণ্ড আতঁকে উঠে গলার কাছে আটকে গেল যেন। দু চোখে ভয়ের নিদারুণ ছাপ! ভয়ার্ত বড়ো বড়ো চোখে আষাঢ়ের দিকে চাইলো।
আষাঢ় ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। ঠোঁটে দুষ্টু একটা হাসি। নোয়ানা আষাঢ়ের এমন ভাবমূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেল। আষাঢ় অনেকটা নিচু স্বরে নোয়ানাকে বললো,
“আমাদের প্রেমকাহিনী তোমার বোনের কানেই আগে পাচার করবো না কি?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here