মেঘলা মন-৬,৭
তারানা তাসনুভা
পার্ট:৬
ছোট চাচী গোমড়া মুখে বড় চাচীর ঘরে বসা। উনারা আজ চলে যাবেন। আবার কোন এক বৃহস্পতিবার আসবেন। শুক্রবার থেকে শনিবার বিকালে ঢাকা ফিরবেন।
• ভাবী ঐ পাগল মেয়ের সাথে থেকে থেকে আমাদের দিনাও জানি কেমন হয়ে গেছে, সাত চড়ে রা করেনা যেই মেয়ে সে কেমন করে কথা বললো, ভাবী এটা কি আমার অপমান না?
• বাড়িতে তিন মেয়ে এখন, সেটা তুমিও জানো। ওর জন্য খালি হাতে আসাটা উচিত হয়নি ছোট বৌ। দাদী জবাব দিলেন। বেচারির মা নেই, বাপ থেকেও নেই, আমরা যদি স্নেহ না করি তাহলে কে করবে ? পরের ঘরে গিয়ে তো আবার কষ্ট!
শাশুড়ির মুখের উপর কিছু বলেন না মাধবী । খুব জানা আছে এইসব আধ পাগল মেয়েরা কিভাবে ছেলে পটায়! সুখেই থাকে! কিন্তু সেটা সে আর মুখে আনলো না। তার স্বামী আর ভাসুর কেউ কথাগুলো ভালোভাবে নেবেনা। সে তো বড় ভাবীর ভালো চেয়েছে। ভালোর কোন দাম আছে?
• দেখ ছোট বৌ তোমার তো দুই ছেলে, তুমি নিয়ে রাখবা মেয়েটারে?
• না মা, আমরা কিভাবে….
• হ্যা, আমি সেটা চাপিয়ে দেব না। তুমিও তোমার চিন্তাভাবনা তোমার মধ্যে রাখ। বড় বৌকে অন্তত দায়িত্ব পালন করতে দাও।
সবাই চলে গেল,
বাড়িটা কেমন নীরব। দিশা আপুও আজ কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। রাকিন মেসেজ করেনি। আমি টাকা ভরে জবাব দিয়েছিলাম। সে বোধহয় সময় পায়নি। আমি বই খুলে বসে আছি। বিদায় বেলায় আমি দাদীর ঘরে বসে ছিলাম। দাদী আমায় ডাকলেন বিদায় দিতে। বাচ্চারা তিমিরপু আবার দেখা হবে বলে চিৎকার করলেও, চাচা চাচী কোন কথা বললেন না । এটা হতেই পারে। আমি যা পেয়েছি, অনেক পেয়েছি। এটাই বা ক’জন পায়?
দিনা আপু বললো ,
বই নিয়ে অভিনয় করিস না। যা ব্যাগটা আন। কি আছে দেখা আমাদের। আমার দেখাদেখি দিশা আপুও তারটা আনল। একটা থ্রিপিস আর সাজগোজের জিনিস। আমি তো সব চিনিও না। দিনা আপু নাম বলতে লাগলো। আর বললো,
• কাল আমার সাথে মার্কেট যাবি, আরো কিছু কাপড় কিনে একবারে বানাতে দিব। চাইলে ভালো ডিজাইনের বোরকা কিনে দিতে পারি। পরবি?
• হ্যা পরবো
• অনেক গরম, ও আমার দ্বারা হবেনা বলে দিশা আপু হাসলো
• তুই দুবাই যাবি। তখন পরিস। বলে হেসে দিল আপু। আপুর হাসিতে আমরাও হাসলাম।
বড় চাচা ডেকেছেন বাহির ঘরে,
এক পুলিশ কনস্টেবল এসেছে, আমাদের ঘরের চাবি দিতে। আর ঘরের সিল ভাঙার লিখিত অনুমতি।
বড় চাচা চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন,
• কাল হামিদা আর তৈয়ব কে নিয়ে যেয়ে সবকিছু গুছিয়ে আনবা। ও বাড়িতে সাফ সুতরো করে আপাতত তালা দিয়ে রাখব। এখনই ভাড়া হবেনা।
• জি যা ভালো মনে করেন।
আমি চাবি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি ঘরে, দাদী ডাকলেন,
• শোন আয়াতুল কুরসি মুখস্থ আছে?
• জি দাদী!
• আয়াতুল কুরসি পড়ে শরীর বন্ধ করে নিবি। আত্মহত্যা যদি হয় তাহলে বদ জ্বিনের উপস্থিতি থাকতে পারে। দিনের বেলা যাবি। তিনজন বা তার বেশি মানুষ নিবি সাথে।
• জি দাদী!
ঘরে যেতেই দিনা আপু চাবি দেখে বললো,
• তুই না বলেছিলি তোদের ঘরে পূর্ণিমার সৌন্দর্য অন্যরকম?
• হ্যা, কিন্তু দাদী দিনের বেলা যেতে বলেছে, তিনজন বা তার বেশি মানুষ নিয়ে ।
• আমরা তিনজন, বাবাকে রাজি করাবো আমি! তুই শুধু পূর্ণিমার তারিখ বের কর।
• আচ্ছা
কড়িকাঠের দড়ি কি পুলিশ নিয়ে গেছে নাকি আছেই? রাতে গেলে ভয় লাগবে না তো? আরে আরো দুইজন তো আছেই। দরকার হলে হামিদা খালাও যাবেন।
আমি ভেবেছিলাম দাদী কিছুতেই অনুমতি দিবেন না। কিন্তু তিনি অনুমতি দিলেন। তার বক্তব্য এতে আমাদের তিন বোনের ভালোবাসা বাড়বে৷ তবে সাথে দুজন দারোয়ান যাবে৷ দিনা আপু আপত্তি করলেন না। আমাদের বাড়িতেই রান্না হবে। হামিদা খালা আর আমরা মিলে রান্না করব। কিছু বাজার সদাই নেওয়া হলো। দিশা আপু প্যাক করলো চিপস আর পাপড়! দিনা আপু বললো, ভালো বুদ্ধি আমরা ভূতের মুভি দেখব আর চিপস খাবো। সাথে ল্যাপটপ ও নেওয়া হলো। চলে এলো সেই পূর্ণিমার রাত। আমরা বিকেলে গিয়েছি। আসর, মাগরিবের নামাজ পড়ে, দোয়া করেছি মায়ের জন্য। না! কড়িকাঠের দড়িটা নেই। পুলিশ খুলে নিয়ে গেছে। আর সবকিছু আগের মতোই। আমি আমার বিছানায় বসলাম চার মাস পর! আমার না পড়া গল্পের বইটা ব্যাগে নিলাম। মায়ের আলমারি কাল সকালে ঘাটবো। অবাক হলাম মাগরিবের পর রাকিন কে দেখে!
• আরে আস এত লজ্জার কিছু নাই। দিনা আপু আমাকে দেখে হাসল।
• কখন এলে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
• তোমার নম্বর থেকে টেক্সট এসেছে, বাসায় আসো, তুমি নাকি ভয় পাচ্ছ!
• আমি লিখিনি। অবাক কন্ঠে বলি।
• আমি লিখেছি। দিনা আপু হাসে।
• কি ভেবেছিলে? একা পাবে তিমিরকে?
• না খাদিজাকে একা পাওয়ার বাসনা ছিল না আমার। আমি ও কে সত্যিই সাহায্য করতে এসেছি। রাকিন মাথা নিচু করে জবাব দেয়।
• আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। আবার নামও দিয়েছ!
• না এটা ওর পুরো নাম!
• ওহ! তাই তো! আজ আমাদের পূর্ণিমা দর্শন, চড়ুইভাতি আর হরর মুভি দেখার প্ল্যান। তাই ভাবলাম তিন মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে মুশকিল না? আর চাঁদটা একা একা আর কত দেখবে তিমির! দিনা আপুর রসিকতায় দিশা আপু হাসছে। চা আর পাপড় ভেজে আনল হামিদা খালা, সবাইকে, এমনকি দারোয়ান চাচাদেরও দেয়া হলো। দিনা আপু খুব ভালো মনের মানুষ। রাকিন চা খেয়ে বিদায় নিল। সে রাতে বাসার বাইরে থাকতে পারবে না। এটা শোভনীয় না! দিনা আপু হেসে বিদায় দিল। শুধু আমার মন চাইছিল আরেকটু থাকুক। কিন্তু সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ!
আমরা উঠানে বসলাম। দিনা আপু বলে উঠলো,
• কী দুর্ভাগ্য সে-হৃদয়ের
যে জানে না কেমন করে ভালোবাসতে হয়
জানে না ভালোবেসে বুঁদ হয়ে থাকার মানে।
তুমি যদি প্রেমে মত্ত না থাকো তাহলে
কেমন করে চোখ অন্ধ করে দেওয়া সূর্যের আলো
কিংবা চাঁদের কোমল রশ্মি উপভোগ করবে? কার লেখা জানিস?
• নাহ!
• ওমর খৈয়ামের!
• তুমি তার লেখা পড়?
• আরে না! চাঁদ নিয়ে কবিতা পড়তে পড়তে এটাও পেলাম! দারুণ না?
• হু, আমি চুপ করে রইলাম। পূর্ণ চাঁদের আলোয় ঝলমলে করছে উঠান পেয়ার, লিচু আর আম পাতার ফাঁকে চুইয়ে পড়তে রূপালি আলো! এ এক অপার্থিব সৌন্দর্য।
রাতের খাওয়ার ডাক পড়লো। খাবার খুব সাধারণ খিচুড়ি, আচার, ডিম ভাজি। কিন্তু আমার নিজের ঘরে বসে খেয়ে অমৃত মনে হচ্ছে। আচারটা মায়ের হাতের। খেতে খেতে চোখ ভিজে এলো।
• আমি জানতাম এই আচার খেলে খারাপ লাগবে তোর। কিন্তু চাচীর এই শেষ স্মৃতিটুকু বুকে আগলে রাখ। রাগ পুষে রাখিস না। মানুষটা জীবনে কিছুই পায়নি। এখন তোর দোয়া থেকে বঞ্চিত করিস না।
আমি প্লেট রেখে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। দিশা আপু আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমরা তিন বোন কাঁদছি। আমার পাগল মায়ের জন্য কেউ কাঁদেনি, কথাটা ভুল। হামিদা খালা এসে আমাদের বসালেন।
• আরে তোমরা করো কি? দোয়া কর। বেশি বেশি আল্লাহর কাছে হাত পেতে দোয়া কর। আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান করে নিক ভাবিজানকে।
আমরা স্বাভাবিক হয়ে খাওয়া শেষে ভূতের মুভি দেখতে বসলাম। দিনা আপু মায়ের ঘরেই বসতে চাইল। এই ঘরেই মা….. কিন্তু আমার ভয় করছিল না আর। মাকে আর ভয়ের কিছু মনে হয় না, বরং আমার এতদিনের আশ্রয়, ভালোবাসার জায়গা ছিল মা। দিনা আপু এই অনুভূতি জাগ্রত করেছে আমার ভিতরে।
(চলবে)
মেঘলা মন
(৭)
দিনা আপুকে আজ দেখতে আসবে। বাসায় সাজ সাজ রব। রান্নার বিরাট আয়োজন। ছেলে ঢাকায় ভালো চাকরি করে। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ছোট। মা, বাবা নিয়ে এখন ছোট সংসার। চাচা আর আপত্তি করেননি। আপুও চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। ছেলের পরিবারে চাকরি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমি আর দিশা আপু রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় পাচ্ছি না। দাদী এসে তাড়া লাগালেন, আপুকে সাজাতে হবে। আমি মেকাপের ম ও জানিনা। দিশা আপুই ভরসা। আমাকেও পাঠালেন দাদী। বিছানায় জামদানীর দোকান বসেছে যেন। চাচীও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কোনটা পরাবেন। দিনা আপু বলে তিমির তুই বল। আমি ঘন নীল জামদানীটা হাতে তুললাম, এত মোলায়েম! আপু বললো,
• বাহ! তোর পছন্দ ভালো। আমি এটাই পরব। দিশা ছোট একটা নীল কানের টপ দে
• উহু, কানে, গলায়, হাতে সোনার কিছু পর। চাচী বললেন। নিজের ঘর থেকে পাতলা সোনার চেন, চুড়ি আর ছোট ঝুমকা এনে দিলেন।
আপুকে সাজানোর পর বেশ লাগছে।ছেলের বাড়ির কয়জন এসেছে গুনতে গিয়ে থমকে গেলাম রাকিনের মামা ,মামি উপস্থিত। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ! মামী যদি বলে দেন তাদের বাড়িতে আমি মিথ্যা বলে এক রাত কাটিয়েছি! যদি বিয়েটা ভেঙে যায়? ফুলি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে ,
• আপা কয় কাপের পানি বসামু?
• আহ! দাড়া! বারো কাপ
• আইচ্ছা!
আমি পারতপক্ষে সামনে যাব না ঠিক করলাম। আপুকে দিশা আপু দিয়ে এলো। আমি রান্নাঘরেই আছি।
চাচী বললো ,
• যা একবার সালাম দে, এদের ঘরে আরো ছেলে আছে। ভালো পরিবার। যা যা!
• থাক চাচী!
• আরে থাকবে কেন? আয়
চাচী আমাকে টেনে নিয়ে পরিচয় করালেন। পাত্র রাকিনের মামীর ভাইয়ের ছেলে। রাকিনের মামী আমাকে দেখে কিছুই বললেন না। তিনি কি ভুলে গেলেন? সকালে তার সামনে দিয়ে বাসায় ফিরেছি আমি।
আমাদের রুমে একা কথা বলতে পাঠানো হলো আপু আর ভাইয়া কে, আমি দিশা আপু বাইরে। আজ দিশা আপুর একটাও ফোন আসেনি। সে খুব বিষন্ন হলেও বোনের খুশিতে সামিল হয়েছে।
দিনা আপু আর ভাইয়া অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ভাইয়া শ্যামলা, মাঝারি গড়নের, চেহারায় কোন বিশেষত্ব নাই। দুজন পেছনের টানা বারান্দায় চলে গেলেন। আপুআড়ষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলছে। শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। আমার হাসি পেল! রাকিন যদি আমাকে এভাবে দেখতে আসত! আমি কি এমন নীল শাড়ি পরতাম, খোলা চুল, কপালে ছোট্ট কালো টিপ,হাত ভর্তি নীল কাচের চুড়ি …..
আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। বড় চাচীও উশখুশ করছেন, কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। উনারা ফিরে এলো হাসিমুখে। রাতের খাবার খেয়ে ছেলেপক্ষ চলে গেল। আমাদের রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করলেন ছেলের বাবা, মা। রাকিনের মামা,মামীকেও খুশিই মনে হলো। রাতের খাবার খেয়ে তারা চলে গেলেন। ফোনে সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমরা খেতে বসলাম। দিনা আপু লজ্জায়, খুশিতে খেতে পারছেন না। আমার খুব ভালো লাগছে। আমরা দিশা আপুর দিকে কেউ মনোযোগ দেইনি। সে ও মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করেনি। পুরো দিন একবারও তার ফোন বাজেনি এটা নিয়ে সবাই ভ্রুক্ষেপহীন।
পরদিন সকালে,
ছেলেপক্ষের সবার আপুকে ভীষণ পছন্দ। তারা দ্রুত বিয়ের তারিখ পাকা করতে চায়। তবে এবার তাদের বাড়িতে যেতে হবে। ছেলের বাড়ি ঢাকা, এখানে ফুপুর বাড়ি মানে রাকিনদের বাড়ি। থেকে থেকেই আমার গাল লাল হচ্ছে। দাদীর পান দিতে এসে সব শুনলাম। আজ কলেজে যাইনি। রাকিন মেসেজ করেছে কোচিং এ যাবো কিনা। বললাম যাবো। বাড়িতে একটা বিয়ে, পড়াশোনার তো একটু ক্ষতি হবেই। রাকিন সেটা মানতে রাজি না। সে কলেজ থেকে সোজা কোচিং এ যাবে। স্যারকে বলা আছে, সেখানে বসে পড়বে৷ আমারও জানা আছে, শুধু পড়বে তা না, স্যারের বৌয়ের রান্নাও খাবে! রাকিনকে স্যারের পুরো পরিবার খুব ভালোবাসে।
চলে এলো সেই শুভক্ষণ,
দিনা আপু আর সোহেল ভাইয়ের চার হাত এক হলো ধুমধাম করে।ছেলেপক্ষের আত্মীয়দের জন্য বাড়ির সব ঘর পরিস্কার করে খুলে দেওয়া হলো। ব্যাপক রান্নাবান্না। চারজন রাধুনি রাখা হয়েছে, প্রতিবেলার রান্না তারাই করছে, আমাদের দায়িত্ব পর্যবেক্ষণ করা। বাবা আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারেনি। কারণটা জানিনা।আমার এতে কোন মন খারাপ লাগছে না। বাবাকে প্রথম দেখা নিয়ে কারো মনে স্বপ্ন থাকার কথা না। বাবাকে মানুষ প্রতিদিন দেখবে। প্রতিদিন পাবে ছাতা হিসেবে বর্ষায়, বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেবে প্রখর রোদে! যদি আমার খারাপ না লাগবে, তাহলে আমি কেন তার কথা বলছি? চাচা কেন এত ইতস্তত ঘুরছেন? একটু পরপর কেন জিজ্ঞেস করছেন আপুর কিছু লাগবে কিনা? ফজর পড়ে আমার হাতে চায়ের কাপ দেখে কেন তার দীর্ঘশ্বাস? বলেই বসলেন,
• এখন থেকে নামাজ পড়ে তোর হাতেই চা খাব! অভ্যাস হতে সময় লাগবে!
দিনা আপুই চা বানিয়ে আমার হাতে পাঠিয়েছেন। আমি চাচাকে বলিনি কথাটা। চায়ের স্বাদেই বুঝে নেবেন। বাবা, মেয়ের এই মায়ার দৃশ্যটা আমার ভালো লাগছে না, আমি ছাদে এলাম। ছাদে এসে যা দেখালাম, তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না! দিশা আপু রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ড মনে হচ্ছে গলায় উঠে এলো। কাকে ডাকব? কি করবো? এটা বিয়ে বাড়ি! আজ আপুর আকদ, এত এত আত্মীয় স্বজন উপস্থিত !
• ভয় নাই! আমি মরব না! লাফিয়ে নামলো দিশা আপু। তোদের বিপদে ফেলব না। আপুকে আমি অনেক ভালোবাসি। আপু আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তাহমীদকে ভালোবেসেও আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল বিনা দ্বিধায়! এই মানুষকে আমি কষ্ট দেব? তুই বল?
আমাকে জড়িয়ে দিশা আপু কাঁদতে লাগলো।
বিয়ের সব নিয়ম কানুন মেনে, এখন ছেলের বাড়িতে যেতে হবে। সাথে মেয়ের কাছের দুজন মানুষ। দিশা আপু কিছুতেই যাবেনা, অগত্যা আমাকে পাঠানো হলো। আমি ভাবতেই পারছিনা। আমি আমার স্বপ্নের মানুষের এত কাছাকাছি হতে যাচ্ছি। বাসে উঠে ভাবছি যদি রাকিনকে পাশে পাওয়া যেত! আমার পাশের সিট খালি। পাত্রের আত্মীয়েরা আমাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ, কোন খুত খুঁজে বের করতে পারেনি। তাদের আলোচনা ভালোই লাগছে। রাকিন এই বাসেই আছে, এটা ভেবেই আমি পুলকিত। চাচার সামনে পড়ার ভয়ে কথা হয়নি। কিন্তু এবার আর ভয় নেই। তাছাড়া দিনা আপু তো সব জানে। আমাকে দিনা আপুর ফোনটা দেওয়া হয়েছে। আপু আর ভাইয়াকে চাচা নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। আমি কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে রাস্তার দুপাশের সবুজ উপভোগ করছি। রাস্তায় থামা হলো, সবাই ফ্রেস হয়ে চা খেয়ে আবার জার্নি। রাকিন এলো চা হাতে,
• কেমন আছ?
• এইত ভালো! তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে না? ঢাকা যাচ্ছ যে?
• কি করবো ? তুমি যাচ্ছ! তোমায় একা ছাড়ি কিভাবে?
কথাটায় কি ছিল জানিনা, লজ্জায় রক্তিম হলো গাল। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে অন্য মেহমানদের দেখতে চলে গেল রাকিন।
ঢাকা পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তা খারাপ ছিল৷ ভীষণ ঝাকি। বমি পাচ্ছিল। রাকিন জিঞ্জারের কৌটা এনে দিল। মুখ দিতেই বমি ভাব কমলো। ছেলেদের নিজেদের বাসা খুব একটা বড় না। আমাদের জন্য একটা রেস্ট হাউস ভাড়া করা হয়েছে। ঢাকার সামান্য দূরে। আমাকে সহ বাকি আত্মীয়দের থাকার ব্যবস্থা এখানে। বৌভাত এখানেই হবে। আপুকে নেওয়া হয়েছে বাসায়৷ ওদের বাসর বাসাতেই হবে। রাকিন বললো এই ভালো হয়েছে বড়রা তেমন কেউ নাই। খুব মজা করা যাবে। জার্নি করেও তার যথেষ্ট এনার্জি! বারবিকিউ পার্টির জন্য বাজার সদাই করতে লেগে গেল। সে এখন ছেলেপক্ষ! জিঞ্জারের কৌটাই বলতে হবে আমার প্রথম প্রেমের উপহার। থেকে থেকে ব্যাগ থেকে বের করে দেখছি। আমাকে আরো তিন মেয়েকে একটা ঘর দেয়া হয়েছে। একে একে ফ্রেস হলাম। চা, নাস্তা এলো, আমরা গল্প করতে করতে খেলাম। কয়লার গন্ধ পাচ্ছি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি ছেলেরা গ্রিলের জন্য কয়লা জ্বালিয়েছে। মেয়েরা সালাদের আয়োজন করছে। বাচ্চারা ছুটাছুটি করছে। আমার দুই চাচাতো ভাইকেও দেখলাম। ওরাও খেলছে। দিনা আপুর ফোন,
• হ্যালো
• সবকিছু ঠিক?
• জি আপু
• তোমার সব ঠিক?
• আমার তো কেবল সব ঠিক হলো! বলে হাসতে শুরু করল দিনা আপু। ভাইয়ার রসিকতা। মুখ দেখার প্রথম গিফট! আপু খুশি খুশি গলায় বলছে। আমার খুব ভালো লাগছে শুনতে। মনে হচ্ছে একদিন আমার স্বপ্ন গুলোও সত্যি হবে!
রাকিন ইশারায় নিচে ডাকছে। স্বপ্ন সত্যি হবে কিনা জানি না। তবে আমি এখন স্বপ্নেই বসবাস করছি!
(চলবে)