মেঘলা মন-(১২)

0
1768

মেঘলা মন-(১২)

এইচএসসি পরীক্ষা এসে গেল। রাকিন পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা চলে গেল কোচিং করতে। আমি এখানেই নিজের মতো পড়তে লাগলাম। দিশা আপুকে বেশ কয়েক পরিবার দেখে গেছে। এক পরিবার পছন্দ করে আংটি পরিয়ে আকদের আগের দিন বিয়েতে অস্বীকৃতি জানালো। কিন্তু আমি অবাক আপু একদম ভেঙে পড়েনি। সে মাস্টার্সে ভর্তির জন্য ঢাকা যেতে চাইল। দিনা আপু এসে নিয়ে গেল। আমি আবার একদম একা! দাদীর শরীর ভালো না। যাই আসি অবস্থা। ছোট চাচা প্রতি সপ্তাহে আসেন। বাবা এসে দেড় মাস থেকে ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে চলে গেল। একবারও ও বাড়িতে ডাক পড়েনি আমার। তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা! মনে মনে কষ্ট পাওয়াও ছেড়ে দিয়েছি। বাড়ির নারিকেল ,সুপারি, পেয়ারা, আমড়া, পুকুরপাড়ের বাকি ফলগাছগুলোর ফল গাছিরা এসে নিয়ে যায় আমার তত্ত্বাবধানে। বিক্রি করে যা টাকা হয় চাচীকে বুঝিয়ে দেই৷ ছোট চাচী আমাকে কল করেন আসার আগে।
ভর্তি পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো, আমি তখন পুরোদস্তুর গিন্নী! চাচার উৎসাহে পরীক্ষা দিতে গেলাম কয়েক জায়গায়। কখনো কোথাও যাইনি। তাই ভালোই লাগছিল ,যদিও জানতাম কোথাও হবেনা। রাকিন সামনের সারির সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স পেল। ওর সম্মানে আমাদের অংক স্যার সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। আমার যাওয়ার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। আমি তো স্বেচ্ছায় পরাজিত সৈনিক। কি লাভ! এদের সাথে আর দেখা করে। কিন্তু চাচী পাঠালেন জোর করে। শাড়িও পরালেন। রাকিন এসে আমার পাশে বসলো। ওর পরনে পাঞ্জাবি। বাকি মেয়েরা বেশ উৎসাহের সাথে আমাদের দেখছিল। আমি কেন যেন খুব নির্লিপ্ত চোখে দেখছিলাম সবকিছু। ভেতরের আগুন কারো বোঝার সাধ্য ছিল না। হাসিমুখে খেয়ে বিদায় নিলাম। রাত হয়ে গেছে। আসন্ন শীতের রাত । লোক সমাগম কম। স্যার রাকিনকে বললেন এগিয়ে দিতে। সে সানন্দে রাজি,

• তোমাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। একটা মেসেজেরও জবাব পাইনি। কি ক্ষতি হতো বন্ধুত্বটা থাকলে?
• যখন কেউ কোন রাস্তায় এগিয়ে যায়। কিন্তু সাথের জন পিছিয়ে পড়ে তখন আর বন্ধুত্ব থাকেনা। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমান৷ সামনে অনেক বন্ধু পাবে। আমাদের পথচলা এটুকুই!
• যদি আমি ফিরে আসি?
• হয়তো আমাকে অপেক্ষমাণ পাবে৷

আমাদের বাড়ির গেট এসে গেছে৷ অনেক কিছু বলার ছিল, কিছুই বলা হলো না। এই বিদায়ের স্মৃতিটুকুই আমার সম্বল।

দুই মাস পর এলাকার কলেজে অনার্সে ভর্তি করালেন চাচা৷ আমি ঘরের কাজের ফাঁকে পড়ি। আমাকে প্রমাণ করতেই হবে, আমি পাগল মায়ের পাগল মেয়ে নই।

বাবা এসেছেন পরিবার নিয়ে। তার স্ত্রীকে আমি আন্টি ডাকি। একদিন বাবা ধরে বসলেন,
• আন্টি ডাকিস কেন? মা ডাকতে পারিস না?
• সমস্যা কি? যাই ডাকুক সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হবে কি? জবাব দিলেন বড় চাচী।
আর কিছু বললেন না বাবা এই প্রসঙ্গে।
দিন যাচ্ছিল নদীর স্রোতের মতো। আমি তাতে আমার নৌকা ছেড়ে দিয়েছি। রাকিনের টুকটাক সংবাদ পেতাম। ওদের চার পরীক্ষার একটা পাস করেছে। দিনা আপু জানালো। আরো জানালো সোহেল ভাইয়ের এক কলিগ আসবেন দিশা আপুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ভালো লাগছিল। বাড়িটা খা খা করত। কিছুদিন আবার উৎসবমুখর হবে। কিন্তু আমার ধারণায় ভুল ছিল। চাচা চাচী যেভাবে বাড়ির ভার ধীরে ধীরে আমার উপর তুলে দিয়েছেন, সেটা বাবা আর আন্টির পছন্দ ছিল না। রান্না, সোফার কভার, পর্দা সবকিছুর ত্রুটি বের হতে লাগলো। আমার কোন কাজ তাদের পছন্দ না।
আমাদের ঘর ছেড়ে দাদীর ঘরে জায়গা হলো আমার। দিনা আপু রাকিনদের বাড়ি উঠেছে। দিশা আপুর আবারো ফোনের ব্যস্ততা বেড়েছে। আমি আবারও সীমাহীন একাকিত্বে ডুবে যাচ্ছি। রোজ ঘুম ভাঙে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। সারারাত দাদী কথা বলে, নাহয় ব্যথায় শব্দ করে ,একদম ঘুম হয়না। ভোরে উঠে রান্নাঘরে যেতে হয়। কদিন কলেজ মিস যাচ্ছে।
এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম নোটস আনতে, সন্ধ্যা হয়েছিল ফিরতে আন্টি চেঁচামেচি শুরু করলেন, ভদ্র ঘরের মেয়েরা এর রাত অব্দি বাড়ির বাইরে থাকে না। বাবাও সুর মেলাতে ভোলেননি। আমি চুপ করে আছি। বড় চাচা এসে বললেন,
• আমি এখনো মরিনি। ও কে যা শাসন করার তা আমি করবো। তোমরা মেহমান হয়ে এসেছ, মেহমানের মতো থাক।
• কি? আমরা মেহমান? আমাদের কোন হিস্যা নাই? বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন।
• তোমাকে কোন হিস্যা দেওয়া হবে না, সেটা কখন বলা হয়েছে? কথা বেশি বুঝবে না। কথা বেশি বুঝেই চাকরি হারালে। এখন পরিবারটা ঠিক রাখ। মেয়েটার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আল্লাহ সহায় হলে ও কে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়ে তবে মরব। তার আগে না।
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ছাদে উঠে বসে রইলাম। খুব ইচ্ছে করছিল রাকিনকে একটা কল করি। করেই ফেললাম,
• হ্যালো কে?
আমি কোন জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। আমার নম্বর আর সেভ করা নেই রাকিনের কাছে। রাকিন বাইরে ছিল বোধহয়, বেশ হই হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে এলো, ও ভালো আছে, ভালো থাকুক। আমি আমার কষ্ট ছড়িয়ে না দেই।

দিশা আপুকে আজ দেখতে আসবে। বিরাট পিঠাপুলির আয়োজন। দিনা আপু ,আমি আর চাচী মিলে বানাচ্ছি। খাটি গুড় এসেছে সরাসরি গুড় ওয়ালার বাড়ি থেকে, মানিক ময়রার ছানার সন্দেস, দুধ এসেছে প্রায় বিশ কেজি। দিনা আপুর শ্বশুরবাড়ি থেকে মানুষ আসবে। বিরাট আয়োজন। আমি মনে মনে একজনকে কামনা করছি। কিন্তু জানিনা সে আসবে কিনা….. যথারীতি মেনু নিয়ে আন্টি অশান্তি শুরু করলেন, তার বাচ্চারা নাকি এসব খায় না। অথচ তার অনুপস্থিতিতে তারা দৌড়ে দৌড়ে এসে পিঠা নিয়ে গেছে। বড় চাচী শান্ত গলায় তারা কি খাবে জানতে চাইলেন, বাবা এসে সহজ ভঙ্গিতে পিঠা নিয়ে খেতে খেতে পুকুর পাড়ে বসলেন চাচাদের সাথে, ছোট চাচাও উপস্থিত। আন্টি আর কথা খুঁজে না পেয়ে, অকারণ জেদে সারা সকাল না খেয়ে বসে রইলেন। তিনি সারাদিন নাকি ভাত খাননা। কিন্তু এখানে কোন উৎসবে রুটির ব্যবস্থা থাকেনা। ভাত নাহয় পোলাও। আমি রুটি করে দিতে চাইলাম, উনি আমার হাতে খাবেন না। এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা কেন বলছেন আমি জানিনা। কাজ সেরে তিন বোন ঠিক আগের মতো করে এক সাথে সাজলাম। আমার মনে আবারও খুশির রঙ লেগেছে। রাতে পাত্রপক্ষ এসে আনুষ্ঠানিকতা করে, পরদিন সকালে চলে গেলেন। আপুর সাথে তাদের দেখা সাক্ষাৎ ঢাকায় হয়েছে, এখানে শুধু আংটি পরানো হয়েছে। আমি রাতে খাবার ফ্রিজে তুলছি, দেখি আন্টি এসে হাজির, সারাদিন উনি বের হননি। বাবাও তেমন পাত্তা দেননি। দুজনের ঝামেলা চলছে, সেটা স্পষ্ট। তাতে আমার কিছুই না। আমরা আবার তিন বোন অনেক দিন বাদে ছাদে আড্ডা দিচ্ছি। দিনা আপু বলে উঠলো,
• রাকিনের খবর জানিস?
• না কোন যোগাযোগ নেই
• সোহেল বলছিল, কোন এক ব্যাচমেট কে পছন্দ করে, তাকেই বোধহয় বিয়ে করবে
• ভালো তো!
• আমি তোকে এসব বলছি, কারণ ছেলেদের মন মর্জি বোঝা মুশকিল
• না, ও এমন না। আমার সাথে সে শুধুই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। আর কিছু না। সেটা স্পষ্ট বলেছে সে।
• দেখ, আমি বলি কি, আমার বিয়ের পর তুইও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নে। বিয়েটা করে ফেল। বাবাও নিশ্চিন্ত হোক। দিশা আপু বলে
• হ্যা দিশা ঠিক বলেছে। তুই রাজি থাকলে আমিও দেখব। সোহেল কেও বলবো।
• পাস করি আগে
• পাস করার মতো কাজ তো করিস না। সারাদিন ঘর গৃহস্থালি কাজ করলে পাস করবি কিভাবে?
• সে হয়ে যাবে। কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়।
• হ্যা তা ভালো বলেছিস। তবে বিয়েটাও দরকার।

ওরা দুইবোন আমার বিয়ের চিন্তা শুরু করে দিল। আমি একটু সরে গেলাম। আমার ভাবতে ভালো লাগছে না। আবার কে আমার মা, কে আমার বাবা শুরু হবে। অনার্সের ক্লাসে প্রথম দিনই প্রত্যেকটা বিষয়ের শিক্ষক এমন জেরা করেছিলেন মাকে নিয়ে আমার ভাবলেই জ্বর আসে!
বাবা স্পষ্ট বলেছে চাচা কে সে কোন দায়িত্বের মধ্যে নাই। পরিচয় দিতে হলে দিতে পারি এর বেশি কিছু না। তার স্ত্রীর পাগলামির কারণ এবার স্পষ্ট। বড় চাচা আবারও নিজের কাধেই নিলেন দায়িত্ব।

ধুমধাম করে দিশা আপু পাড়ি দিল শ্বশুরবাড়ি। পুরো বাড়ির জৌলুস যেন সাথে করে নিয়ে গেল। আমার আবার ক্লাস, পরীক্ষা। আবার সেই একাকীত্বের ঘেরটোপ!

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here