চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৩৭

0
3459

#চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৩৭
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

নির্বাণ কণ্ঠনালিতে খানিকটা আক্রোশ মিশিয়ে বলল, “ওর বিরুদ্ধে সাইবার-ক্রাইমের মামলা আছে। হি ইজ এ ব্লাডি ক্রিমিনাল।”

কথাটা শুনে ভিসির কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। কন্ঠটা উদগ্রীব শোনালো তার, “বলছ কি তুমি?”

প্রশ্নের বিপরীতে জবাব এলো এইটাই, “সাইবার ট্রাইবুনালকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা রাস্তায়, আসছে।”

নির্বাণের কথা শেষ হওয়ার পরমুহূর্তেই রুদ্র আত্মরক্ষার জন্য চেঁচিয়ে উঠে বলে, “মিথ্যে আরোপ সব। কিসের ক্রাইম,কিসের কি? কিছুই করিনি আমি। নির্দোষ আমি! আপনি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এমন করতে পারেন না আপনি।”

নির্বাণ রুদ্রের অভিমুখ বরফের ন্যায় অতি শীতল দৃষ্টিপাত করে, “আমার কথা বাতাসে ভেসে বেড়ানোর মত নয়। যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলে আমি কখনো কারো বিরুদ্ধে কথা বলি না। বাকি তুমি বুঝদার।”

নির্বাণের সুব্যক্ত কটাক্ষ ধরতে পেরে রুদ্রের মুখ পাংশুটে দেখালো। বিবর্ণ,করুণ অভিলাষ দৃষ্টিতে তাকালো নিজের বাবা-মায়ের পানে। কিঞ্চিৎ প্রত্যাশা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “কিসের প্রমাণ? আমি যেখানে কিছু করিনি সেখানে প্রমাণ কিসের? মিথ্যে বলা বন্ধ করুন। বাবা-মা তোমরা কিছু বলছ না কেন? আমি সত্যি কিছু করিনি৷ বিশ্বাস কর!”

“কে কি করেছে তা একটু পরই জানা যাবে। তোমার বলতে হবে না তখন, প্রমাণই সব বলবে।”

নির্বাণের কথা শেষ হতে না হতেই রুদ্রের মা রাবেয়া ইসলাম নিজের সন্তানের পক্ষ নিয়ে বলে উঠে, “আপনাদের কোথাও হয়তো বা ভুল হচ্ছে। আমার ছেলে মোটেও এমন না, আজ হয়তো সে ভুল করেছে কিন্তু সে কখনোই কোন অনৈতিক কাজ করতে পারে না৷ ওকে একটা সুযোগ দিন আপনারা।”

রুদ্রের বাবা ইকবাল শেখও রাবেয়া কথার সাথে তাল মিলান। নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে নিজের সকল জোর দেখান তিনি। অবিলম্বে উগ্রবীর্য কন্ঠধ্বনিগুলো অনুদ্ধত পরিবেশটি কোলাহলে পরিপূর্ণ করে তুললো। ভারসাম্য রক্ষার্থে ভিসি রুদ্রের বাবা-মাকে তিনি বেরিয়ে যেতে বললেন সাথে অতিরিক্ত সকল মানুষজনকেও। আপাতত তিনি কোনরকমের হট্টগোল চাচ্ছেন না। তার নির্দেশে বাধ্য হয়ে সকলকে বেরিয়ে যেতে হলো। রুমে থেকে গেল শুধু রুদ্র,নির্বাণ,তাপসি আর একজন অচেনা ব্যক্তি। যদিও ইকবাল,রাবেয়া যেতে চাচ্ছিলেন না তাপসি ম্যাম তাদের জোড়পূর্বক বের করে দেন।
রুমের পরিবেশ আগের ন্যায় হতেই ভিসি নির্বাণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমাকে কোন কিছু না জানিয়ে সাইবার ট্রাইবুনালদের ডাকেন কিভাবে আপনি? কিসের ভিত্তিতে আপনি তাদের ডাকছেন? কি করেছে ও?”

ভিসি স্যারের কথা শুনে রুদ্রের বর্ণহীন মুখশ্রীটি ঈষৎ উজ্জ্বল দেখালো৷ চিত্তে প্রত্যাশার ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলে উঠলো যেন। নির্বাণ মন্থর কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলো, “রুদ্র সোশাল মিডিয়ায় ভার্সিটির গ্রুপে আমার ওয়াইফকে বুলি,হ্যারাস,মানহানি করার উদ্দেশ্যে কিছু ছবি ছেড়ে ছিল, যা এখন ভাইরাল। ভার্সিটির সকলেই এখন এসব নিয়ে কথা বলছে,কটুক্তি করছে। বিষয়টা এখন এত নিম্ন পর্যায়েই চলে গিয়েছে যে তারা সকলে আমার ওয়াইফের চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছে।”

ভিসি বলল, “সেটা আপনার পার্সোনাল ইস্যু, আপনি কেন সেটা ভার্সিটির ভিতরে টানছেন? রুদ্রকে আপনার পুলিশে দেওয়ার হলে ভার্সিটির বাহিরে গিয়ে দিন, এখানে না। আপনি ট্রাইবুনালদের এখনই ফোন করে আসতে মানা করুন। আমি ভার্সিটির ভিতরে কোনরকম ঝামেলা চাচ্ছি না।”

“সরি বাট এইটা পার্সোনাল ইস্যু না। আমি আমার পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফ নিয়ে খুব সর্তক। আমি কখনো দুইটা মিক্সড আপ হতে দেই না। ইস্যুটা পার্সোনাল হলে আমি কখনোই ভার্সিটির ভিতরে এই কথা তুলতাম না। ট্রাইবুনালদের ডাকা তো দূরের কথা। কিন্তু জিনিসটা এখন আমার পার্সোনাল লাইফ কম, প্রফেশনাল লাইফে প্রভাব ফেলছে বেশি৷ তাই আমি বাধ্য হয়েছি এমনটা করতে। আর ইমার্জেন্সি ইস্যুতে টিচারদের অধিকার আছে পুলিশদের ডাকার।”

ভিসি উগ্রস্বর বলে উঠেন, “এটা আমার কাছে মোটেও ইমার্জেন্সি ক্যাস লাগছে না মি. নির্বাণ সাইয়্যেদ। ভার্সিটির এটার সাথে কোন সম্পর্ক নেই।আপনি পার্সোনাল লাইফের শত্রুতা এখানে টেনে আনছেন। তাও আমার পারমিশন ছাড়াই।”

নির্বাণের কপালে দৃঢ় ভাঁজ পড়লো, “বিষয়টা ভার্সিটির সাথে রিলেডেড না সেটা আপনি কিভাবে বলতে পারছেন? এই পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ভার্সিটির গ্রুপ থেকেই। আমি এই ভার্সিটির শিক্ষক আর আমার ওয়াইফ এখানের স্টুডেন্ট, আমাদের দুইজনের অনুমতি ছাড়াই আড়াল থেকে ছবি তুলে সেটা গ্রুপে অতি নিম্নপর্যায়ে নিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। বাজে কথা বলা হয়েছে, প্রশ্ন করা হয়েছে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে। এমনকি, আমার ওয়াইফ ভার্সিটিতে আসলে তাকে অপমানিত,লাঞ্চিত করা হয়েছে সকলের সামনে। এমনকি আঘাতও করা হয়েছে। কলঙ্ক লাগানো হয়েছে আমাদের দুইজনের গায়ে। সম্মানহানি হতে হয়েছে আমাদের দুইজনকেই৷ আপনার ভার্সিটির শিক্ষক,স্টুডেন্টের মানহানি হচ্ছে,বুলি-হ্যারাস হচ্ছে সেটা এখন ভার্সিটির দেখার বিষয় নয় কি? নাম কিন্তু আমার একার না, ভার্সিটিরও হচ্ছে। ভেবে দেখুন একটু।”

কথাটা বলে নির্বাণ একটু দম নেয়। তারপর বলে, “এখনো বলবেন কি এইটা আদৌ ভার্সিটি ইস্যু না?”

ভিসি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “বিষয় যাই হোক, যেহেতু এখানে ভার্সিটির মানসম্মান জড়িত সেহেতু আপনাকে আগে আমাকে ইনফর্ম করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আপনি সেটা করেন নি। যদি এখন ভার্সিটির নাম খারাপ হয় তাহলে এর দায় কে নিবে? আপনার এই পদক্ষেপের জন্য আমি আপনাকে সাসপেন্ড করতে পারি বা চাকরি থেকে বের করে দিতে পারি সেটা কি জানেন?”

“সেটা আপনি করতে পারেন এতে আমার আপত্তি নেই। তবে তার আগে এই মানুষটাকে আইনের হাতে তুলে দিতে চাই, যত যাই হোক না কেন।”

নির্বাণের অনড় কথা শুনে ভিসি থমকালেন। অতঃপর কিছু বলার পূর্বেই সাইবার ট্রাইবুনাল টিম এসে হাজির হয় সেখানে। সাইবার টিমকে দেখে নির্বাণ এগিয়ে যায় এবং কথা বলে নিয়ে রুদ্রকে তাদের হেফাজতে নেওয়ার আহ্বান জানায়। সাইবার টিমও ফটাফট রুদ্রকে নিজের আন্ডারে নিয়ে তার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দেয়। পালানোর সুযোগ ছিল না বিধায় রুদ্র পালাতে পারিনি,তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অযথা চেঁচিয়ে গিয়েছে ঠিকই। নির্বাণ কথা দীর্ঘ না করে তাপসী এবং অচেনা সেই ব্যক্তির কাছ থেকে তাদেরকে নিয়ে আপ দেওয়া সকল পোস্টের এবং শিরোনামের ছবির প্রিন্ট আউট তুলে দেয় একজন কর্মরত অফিসারের নিকট। অতঃপর একটা মেমোরি চিপ দেয় যেখানে রুদ্রের কর্মকাণ্ড, তাদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ পোস্ট-কথাবার্তার স্ক্রিনশট, স্ক্রিনভিডিও ছিল। সাথে আজকে সকালে ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনার লাইভ ভিডিও-ও ছিল। এছাড়া আরও কিছু বুলি,হ্যারাসমেন্ট,এবিউজের রিপোর্ট, কমপ্লেইন ছিল সেগুলোও নির্বাণ অফিসারের নিকট সাবমিট করলো। চোখের পলকেই সকল প্রমাণ সাইবার ট্রাইবুনাল টিমের হাতে দিয়ে রুদ্রের উপর সাইবার বুলিং আর মানহানির মামলা পাকাপোক্তভাবে করে ফেলে নির্বাণ। ট্রাইবুনাল টিমও প্রমাণ সব বুঝে নিয়ে ভিসি এবং নির্বাণের মাধ্যমে কিছু ফরমালিটি পূরণ করিয়ে নেয়। আর জানান, কোনধরনের তথ্য লাগলে তারা যেন সাহায্য করতে আগ্রহী হয়। অতঃপর রুদ্রকে তারা নিয়ে যেতে নিলে নির্বাণ তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে এবং স্থিরচিত্তে রুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। রুদ্রের কান বরাবর মুখ রেখে বলে, “বলেছিলাম না, নিজের সকলের কর্মের ফল পাবে তুমি। নাও, হিয়ার ইজ দি লাস্ট চেকম্যাট।”

কথা বলে নির্বাণ রুদ্রের এমন অংশে আঘাত করল যা কি-না বর্ণনায় প্রকাশ করার মত নয়। তবে, রুদ্রের অবস্থা যে করুণের চেয়েও করুণ হলো সেটা তাকে দেখেই বুঝা গেল। সাইবার টিমের একজন পরিস্থিতি প্রতিকূলে যেতে দেখে দ্রুত নির্বাণকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং রুদ্রকে নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে। রুদ্রকে নিয়ে যাওয়া হলে নির্বাণ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনে। অতঃপর পারমিশন নিয়ে নির্বাণ ভিসির রুম থেকে বেরিয়ে আসে এবং একজনের কাছে এসে দাঁড়ায়। তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে হ্যান্ডশেক করে স্মিত মুখে বলে, “এত শর্ট নোটিশে আসার জন্য,হ্যাল্প করার জন্য থ্যাংক্স। তুই না থাকলে হয়তো এসব সম্ভব হতো না আজ।”

ব্যক্তিটি হেসে বলে, “ফরমালিটি করিস না, এসব ব্যাপার না। আর আমার কাজই এটা, তুই বরং আমার হ্যাল্প করলি ওর মত একটা ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দিয়ে৷”

নির্বাণ বলল, “তবুও মৃন্ময়, তোর হ্যাল্প ছাড়া পসিবল ছিল না।”

মৃন্ময় পুনরায় হেসে বলল,”হয়েছে, আর প্যারা খেতে হবে না। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”

“ওকে! বাট মেক সিউর, ও যাতে কঠোর থেকে কঠোর শাস্তি পায়।”

“পাবে,চিন্তা করিস না। তা বাসায় যাস কিন্তু! মা প্রায়ই তোর কথা জিজ্ঞেস করে। আর এবার আসলে ভাবীকে সাথে নিয়ে আসিস। বিয়ে-সাদি করে তো বউকে একদম লুকিয়ে রেখেছিস।”

নির্বাণ বলল,”ইনশাআল্লাহ নিব একদিন। তুইও বাসায় আসিস সুযোগ হলে।”

“আচ্ছা। আসি তাহলে এখন,কাজ আছে।”

নির্বাণ সম্মতি জানাতেই মৃন্ময় চলে যায়। মৃন্ময় হচ্ছে নির্বাণের স্কুল লাইফের বন্ধু। দুইজনের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো হওয়ায় যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। মৃন্ময় সাইবার ট্রাইবুনালের একজন অফিসার হওয়ার সুবাদে, রুদ্রের সকল কর্মকাণ্ডের সম্পর্কে জানার পর নির্বাণ যখন মৃন্ময়ের সাথে যোগাযোগ করে তখন মৃন্ময় ওকে বলে দেয় কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে আর কিভাবে সেটা গুছাতে হবে। সে সাথে, চলমান ঘটনার যাবতীয় প্রমাণ একত্রে জমা করে রিপোর্ট করার বুদ্ধি মৃন্ময়-ই দেয়৷ এমনকি প্রমাণ জোগার করতে সাহায্যও করে। যার দরুন, বিষয়টা হ্যান্ডেল করা নির্বাণের পক্ষে সহজ হয়ে উঠে।

নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এখনো অনেক কাজ বাকি,আগোছালো রয়ে গিয়েছে কিছু বিষয়। সেগুলো গুছাতে হবে, সব যে এখানেই শেষ না। তবে আপাতত এসব নিয়ে নির্বাণের মাথা ব্যথা নেই। স্পর্শীকে একবার দেখা প্রয়োজন তার। ঘন্টাখানেক আগে সেখানে বসিয়ে রেখে এসেছিল, আরাম করতে আর বের না হতে। যদিও নির্বাণ মুখে বলেছিল অন্য তবে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্পর্শীকে এসব ঝামেলা থেকে দূরে রাখার। সে চাচ্ছিল না কোনধরনের ভোগান্তিতে সে পড়ুক বা তাকে আর কোন কথা শুনতে হোক। তাই স্পর্শীকে এসব হতে দূরেই রাখতেই রুমে রেখে আসে আর নিজেই সবদিক সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন স্পর্শী কি করছে কে জানে? যদি খারাপ লাগে বা কিছু দরকার হয়? কেয়া বা নিধিও তো নেই ওর পাশে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়েই নির্বাণ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল টাপসির কেবিনের দিকে। কেবিনের সামনে এসে দরজা খুলে স্পর্শীর নাম নিতে গিয়েও থমকে গেল। চোখ বুলালো চারদিক। রুমটি নীরব,শূন্য। নেই কেউ সেখানে। ক্ষণেই নির্বাণের ভ্রু কুঁচকে এলো। প্রশ্ন জাগলো মনে, “স্পর্শী কোথায়?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here