ভ্যাম্পায়ার_লাভার,পর্বঃ-০৯,১০

0
1641

#ভ্যাম্পায়ার_লাভার,পর্বঃ-০৯,১০
লেখনীতেঃ- কাশপিয়া মেহজাবিন রিমশা।
পর্বঃ-০৯

সাদাফ হাসি থামিয়ে আবারও গম্ভীর ভাব নিয়ে বলে
—এইবার বিশ্বাস হলো আমি ভ্যাম্পায়ার?

শ্রুতি কি বলবে বুঝতে পারছে না। সাদাফের ভ্যাম্পায়ার রুপ দেখেও ওর প্রতি ভালোবাসা একটুর জন্যও কমে যায়নি। আর কি করলে শ্রুতি বুঝাবে ও সাদাফকে সত্যিই ভালোবাসে। শ্রুতিকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে সাদাফ বলে,
—চলো বাড়ি চলো।

এই বলে সাদাফ শ্রুতির হাত ধরে। শ্রুতি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়।

জানালার কাচ ভেদ করে রোদের আলো শ্রুতির মুখে লাগছে। কি অপরুপ লাগছে ওকে। শ্রুতির মা সায়নী চৌধুরী এসে শ্রুতিকে এভাবে দেখে। এতো সুন্দর মেয়ে তার না হলেও পারতো। যদি ইলহাম খানকে(শ্রুতির বাবা) বিয়ে না করতেন তাহলে হয়তো তার গর্ভে এই অপরুপার জন্ম হতো না। সায়নী চৌধুরীর অনেক টেনশন এই মেয়েকে নিয়ে। সবসময় ভয়ে তটস্থ থাকে তার মন। কি হবে এই মেয়ের ভবিষ্যত?মেয়েকে সঠিক মানুষের হাতে তুলে দিতে পারবে তো?

রোদের আলো লেগে শ্রুতির ঘুম ভেঙে যায়। শ্রুতি ওর মা’কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে থেকে কিঞ্চিৎ অবাক হয়।

—মা

শ্রুতির ডাকে সায়নী চৌধুরীর হুশ আসে। শ্রুতিকে নিয়ে ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলেন যে কখন শ্রুতির ঘুম ভেঙেছে ঠেরই পেলেন না।

—হুম উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো। ক’টা বাজে দেখেছো? কলেজের দেরী হয়ে যাবে।

—হুম মা তুমি যাও আমি আসছি।

শ্রুতির মা যেতে যেতে বলে,
—ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসো। আমি তোমার জন্য নাস্তা রেডি করে দিচ্ছি।

শ্রুতি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যায়। গিয়ে টেবিলে বসে। খাবার খেতে খেতে শ্রুতির মনে পড়লো কাল রাতের কথা। ও এখানে আসলো কিভাবে? কাল রাতের কি সব স্বপ্ন ছিলো? নাকি সত্যি? ওইদিকে শ্রুতির মা কখন থেকেই শ্রুতির সাথে বকবক করেই যাচ্ছে। কোনোটিই শ্রুতির কানে যাচ্ছে না। শ্রুতি এখন শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তি দুইটাই হারিয়ে ফেলেছে। শ্রুতির মা শ্রুতিকে হালকা একটু ধাক্কা দেয়।

—কি হয়েছে মা ধাক্কাচ্ছো কেনো?

—কি হয়েছে? আমি এতক্ষণ ধরে তোমাকে কি বলছি শুনতে পাওনি?

শ্রুতি এবার কি বলবে বুঝতে পারছে না। কালকে রাত্রের ঘটনা নিয়ে এতটাই মত্ত ছিলো যে মা কি বলেছে কিছুই শুনতে পায় নি। এখন যদি মা’য়ের কাছ থেকে কি বলেছে আবার জিজ্ঞেস করে তবে তো বকা দিবে।

শ্রুতি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,
—কি বলেছো মা? আসলে খেয়াল করিনি।

—ওহ তাই বলো।

ওহ তাই বলো কথাটা ওর মা এতই ঠান্ডা আর আস্তে করে বলল যে শ্রুতির বিশ্বাস হচ্ছে না মা ধমক না দিয়ে এতো ঠান্ডা মেজাজে কিভাবে কথা বলছে।

—তোমাকে বলছি আজকে আমরা সায়রার(শ্রুতির ফুপি) বাসায় যাবো। সায়রা অনেকদিন যাবত যেতে বলছে।

শ্রুতির এখন কেথাও যাওয়ার মুড নেই। ওকে কলেজে যেতে হবে,সাদাফের সাথে কথা বলতে হবে। শ্রুতি এখনও বুঝতে পারছে না কাল রাতে ঠিক কি ঘটেছে। কাল রাতের ওগুলো স্বপ্ন ছিলো নাকি সত্যি সেটা শ্রুতিকে জানতে হবে। তাই শ্রুতি মা’কে বলে

—মা আমি যাবো না।

—কেনো?

—মা তুমি তো জানো আমার কোত্থাও যেতে ভালো লাগে না। তাছাড়া সামনের মাস থেকে আমাদের মিডল টার্ম পরীক্ষা। এখন কি যাওয়ার সময় বলো? আর সাগরের ওতো সামনে টেস্ট পরীক্ষা। মা এই সময় তোমার মাথায় বেড়াতে যাওয়ার ভুত কি করে চাপলো? উফফ

—বেশি উফফ টুফফ করলে কান ছিড়ে হাতে ধরিয়ে দেবো বেয়াদব মেয়ে। আমি কি জানি না তোমাদের পরীক্ষা কখন? মাত্র দু’দিন থাকবো।

—মা আমি যাবো না। আমি এখন কলেজে যাবো।

—তো যেতে কে না করছে?

—তুমিই তো বললে ফুপির বাসায় যাবে।

—সে-তো আমরা রাত্রে যাবো। মাইশার(শ্রুতির একমাত্র ফুফাতো বোন) আজ আকিকা। ভুলে গেলে?

শ্রুতির এখন মনে পড়েছে মাইশার আজ আকিকা। বয়স মাত্র পনেরো দিন হচ্ছে ওর।
শ্রুতিকে চুপ থাকতে দেখে ওর মা বলে,

—যাও রেডি হয়ে কলেজে চলে যাও।

—ঠিক আছে মা।

শ্রুতি কলেজ চলে যায়। মেহেরও আসে। মেহের দেখে শ্রুতি একদম স্বাভাবিক।ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার কষ্ট,হতাশা কিচ্ছুই ওকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না।

—কেমন আছিস শ্রুতি?

—যেমনটা থাকার কথা,তুই কেমন আছিস?

—ভালোই।

—শুন না কাল,পরশু এই দুদিন কলেজে আসতে পারবো না?

—কেনো? তুই কলেজ না আসলে আমিও এসে কি করবো?

—ফুপির মেয়ের আকিকা তাই বেড়াতে যাবো।

—ওহ।

মেহেরের মন খারাপ হয়ে যায়। শ্রুতিই একমাত্র ব্যাক্তি যে ওর লাইফে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। শ্রুতিকে ছাড়া ওর এক মুহুর্তও ভালো লাগে না।

—আমার মেহেরজানের মন খারাপ হইছে? হুম?

—আমার কেনো মন খারাপ হতে যাবে?

—বইন রাগ করিস না,মা’কে অনেক বুঝিয়েছি লাভ হয়নি।

—হুহ্

—এখনও রাগ করে আছিস? আচ্ছা তুইও আমাদের সাথে গেলে কেমন হয়? তুই তো জানিস ফুপি তোকে কতটা দেখতে পারে।

—সত্যি?

—হ্যাঁ রে বাবা।

মেহের শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—ঠিক আছে আমি যাবো।

শ্রুতিরা হাসে,
শ্রুতিরা কাঁদে,
শ্রুতিরা অভিমান করে,
শ্রুতিরা রাগ করে,
শ্রুতিরা কষ্ট পায়,
পরক্ষণে শ্রুতিরা আবার সুখ পায়,
শ্রুতিদের মন ভালো হলে নাচে,গায়।
শ্রুতিদের মন খারাপ হলে বেলকনিতে গিয়ে একাকি সময় কাটায়,
শ্রুতিরা ভালোবাসতে পারে,
শ্রুতিরা প্রচন্ড ঘৃণাও করতে পারে,
শ্রুতি রাঁধে-বারে আবার চুলও বাঁধে,
শ্রুতিরা সব পারে।

শ্রুতির চোখ খুঁজে যাচ্ছে তার প্রিয়তমকে। কাল ওভাবে ভালোবাসার কথা না জানালে হয়তো ও এখন সাদাফের সাথে থাকতো। ভালোবাসা তুমি কেনো এমন?

—শ্রুতি কাউকে খুঁজছিস?

—হুম সাদাফকে।

শ্রুতির মুখে সাদাফের নাম শুনে মেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। মেহের জানে এখন মেয়েটার মনে কি চলছে।

—ধুর বাদ দে তো।

—হুম।

—আচ্ছা তোর কি হয়েছে বল তো? চোখ ফুলা ফুলা লাগছে কেনো? কাল রাতে ঘুমাসনি?

মেহেরের কথা শুনে শ্রুতির কাল রাতের ঘটনা গুলো মনে পড়ে যায়। এবং মেহেরকে সব বলে।

—মেহের আমি বুঝতে পারছিনা আমি বাসায় কি করে আসলাম। আর আমি তো সাদাফের কাছে যাওয়ার সময় সদর দরজা টা খুলেই গেছি। কিন্তু ওইজন্য সকালে মা কোনো টু শব্দো করলনা। নিশ্চয়ই মা দরজা বন্ধ দেখেছে।দরজা খোলা দেখলে চেচামেচি করতো। কিন্তু আমার ক্লিয়ারলি মনে আছে সব। শুধু বাসায় আসলাম কিভাবে সেটাই মনে পড়ছে না।আবার এটাও বুঝতে পারছি না সেটা সত্যি নাকি?

—শ্রুতি আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। ওয়েট ওয়েট, তুই বলছিস তুই সাদাফের রক্ত দেখেছিস। যেখানে যেখানে সাদাফ আঘাত পেয়েছে?

—হুম দেখেছিতো।

—তুই কি রক্তের রং দেখেছিস?

—হ্যাঁ, ওর কপাল আর হাত পায়ের কয়েকটা অংশে ছিড়ে গেছিলো যেখান থেকে রক্ত পড়ছিলো।রক্তে লাল হয়ে গেছিলো ওর কপাল আর হাত পা।

—কারেক্ট এটাই পয়েন্ট।

—মানে? মেহের কিসের পয়েন্ট?

—শ্রুতি শোন স্বপ্ন যাই হউক,যেমন হবে হউক স্বপ্নে কখনও রং দেখা যায়না। স্বপ্নের রং হয় সাদা-কালো। স্বপ্নের মধ্যে যদি রং দেখতে পাস তাহলে ধরে নিতে হবে সেটা সত্যি সত্যিই ঘটেছিলো।

—বাব্বাহ মনে হচ্ছে এইবার ডিটেক্টিভ অব দ্য ইয়ার তোরই পাওয়া উচিত।

—সত্যি বলছিস?

—অবশ্যই সত্যি বলছি।

—হায় তো মে মার যাউঙ্গা।

—পুরো দুনিয়া উল্টে গেলেও তোর এই ভুলভাল হিন্দি বলা যাবে না।

—দেখতে হবে না আমি কার বেস্টফ্রেন্ড?

—ওই তুই ভুলভাল কাজ করার পর বুক ফুঁলিয়ে আমার নাম বলবি না। যত ভুলভাল কাজ করবে উনি আর গর্বে বুক ফুলিয়ে বলবে আমার নাম। শাঁকচুন্নি আমার জীবনটাই ত্যানাত্যানা করে দিলি।

—আচ্ছা বাবা ঠিক আছে আর বলবনা। এবার বল কি বুঝলি?

—আমার এখনও কিছু বোধগম্য হচ্ছে। আদৌ কি সত্যি নাকি স্বপ্ন?

অন্যদিকে সাদাফ শ্রুতিকে দেখে চলেছে। শ্রুতির পাশেই আছে সাদাফ তবে অদৃশ্য হয়ে। শ্রুতির কথা শুনে সাদাফের হাসি পাচ্ছে।আর মনে মনে বলছে,

— কাল রাতের সব ঘটনা সত্যি শ্রুতি। তোমার হাত ধরে তখন তোমাকে অজ্ঞান করেছিলাম আর তোমার বাসায় এনে তোমাকে শুইয়ে দিয়েছিলাম। আর শেষের স্মৃতি গুলো এমনভাবে মুছে দিছি যাতে তোমার মনে হয় এটা স্বপ্ন। তাই এখন এখন তুমি দ্বিধায় আছো।

শ্রুতিকে চিন্তিত দেখে মেহের বলে উঠে,
—ওই কোন ড্রেসটা পড়ে যাবি?

মেহেরের কথায় শ্রুতি কিছু বুঝতে পারে না,
—কোথায় যাবো?

—আরেহ বুদ্ধু তোর ফুপির বাসায়।

—ওহহ হুম। জলপাই কালারের কুর্তিটা পড়ে যাবো।

—ঠিক আমরা ম্যাচিং করে যাবো।

শ্রুতিরা ক্লাস করে বাসায় আসে।বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটুপর মেহের আসবে।শ্রুতি মা’কে বলে,
—মা, ও মা

—কি হলো চেচিয়ে বাড়ির কান মাথায় তুলতেছো কেনো?

শ্রুতি আমতা আমতা করে বলে,
—মা আসলে মেহেরও যাবে আমাদের সাথে।

—ওহ তাহলে তো অনেক ভালোই হলো।ওকে পেয়ে তোমারও অনেক ভালো লাগবে। তো এটা আবার আমতা আমতা করে বলতে হয়?

—না মানে এমনি।

শ্রুতির মা হেসে বলে,
—তা মেহের এখানে কখন আসবে? ওর মা-বাবাকে ফোন করে বলবো?

—না মা ওইটা আমরা ব্যাবস্থা করে ফেলছি আর ও একটুপর এসে যাবে। তুমি নাস্তা রেডি করো মেহের আসলে একসাথে খাবো।

শ্রুতি নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। আজ একবারও সাদাফের দেখা মিললো না। সাদাফকে ভালোবাসার কথা বলে শ্রুতি কি খুব বেশি ভুল করে ফেলেছে? আর কাল রাতের ঘটনা টা কেমন জানি মনে হচ্ছে সত্যি। আবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন।

আজ যেন সবই হয়ে গেলো কল্পনা,সময়টা হয়তো সুখের স্বপ্ন ছিলো যা এখন ভেঙে গিয়েছে বিষাদের ছোঁয়ায়!আজ যেন সব ক্ষতদাগে পরিণত। তবে বিশ্বাস তার সাথে একদিন ফের হবেই দেখা, রাস্তাতে বা অলৌকিকে।

মেহের চলে এসেছে। শ্রুতি আর মেহের মিলে নাস্তা করে নেয়। একটু পরই ওরা বেরুবে।

শ্রুতিরা যাচ্ছে। চারিদিকে কত আলো মনেই হচ্ছে না এখন রাত। মা বলেছে আজ নাকি পূর্ণিমা। শ্রুতির কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। চটপট করছে ও।

আমি আবারও তোমাকে চাই,
আমি তোমাকে চাইতেই থাকবো।
তোমাকে চাইতে চাইতে আমি মরে যাবো,
তাও তোমাকে আমি চাই।
তোমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চাই। মনে মনে বলে শ্রুতি।

শ্রুতির অস্বস্তি লাগার মাত্রাটা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। গা দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে। মুখটা টকটকে লাল গোলাপের মতো লাল হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটোর রং কেমন জানি পাল্টাচ্ছে। শ্রুতির এমন অবস্থা দেখে মেহের বলে,
—শ্রুতি কি হয়েছে এমন করছিস কেনো?

—কই?

—কিরে শ্রুতি কই মানে? তোর চেহেরা এরকম হয়ে যাচ্ছে কেনো?

শ্রুতি বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। শ্রুতি বলে,
— এররকম ভারি ড্রেস পড়ে আছি,মা কুর্তি টাও পড়তে দিলো না। তার উপরে এতো গরম। তাই হয়তো।

—ওহ।

শ্রুতিরা ফুপির বাসায় পৌছে যায়। রাত আটটা। শ্রুতি আর মেহের নাস্তা সেরে কাজিনদের সাথে আড্ডায় বসেছে। তারমধ্যে শ্রুতির খারাপ লাগার মাত্রাটাও খুব করে বেড়ে চলেছে।

—তোরা একটু বস আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।

—শ্রুতি আমি যাবো তোর সাথে?

—না,আমি একা যেতে পারবো।

—ওকে তাড়াতাড়ি আয় তাহলে।

শ্রুতি দৌড়ে ওর ফুপির বাসা থেকে বের হয়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলের মত কোনো একটা জায়গায় ঢুকে পড়ে। শ্রুতির পুরো শরীর জ্বলছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি শরীর ঝলসে যাবে,পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। খুব অস্থির লাগছে। শ্রুতির হাতের নকের পরিবর্তন হচ্ছে। চোয়ালের পাশে দুইটা সূচালো দাঁত বের হয়ে আসছে। চোখ দুটো নীল বর্ণের হয়ে আসছে। এর মধ্যে শ্রুতি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

কি হতে চলেছে শ্রুতির সাথে?

চলবে…

#ভ্যাম্পায়ার_লাভার
পর্বঃ-১০
লেখনীতেঃ- কাশপিয়া মেহজাবিন রিমশা।

শ্রুতি দৌড়ে ওর ফুপির বাসা থেকে বের হয়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলের মত কোনো একটা জায়গায় ঢুকে পড়ে। শ্রুতির পুরো শরীর জ্বলছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি শরীর ঝলসে যাবে,পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। খুব অস্থির লাগছে। শ্রুতির হাতের নকের পরিবর্তন হচ্ছে। চোয়ালের পাশে দুইটা সূচালো দাঁত বের হয়ে আসছে। চোখ দুটো নীল বর্ণের হয়ে আসছে। এর মধ্যে শ্রুতি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

কি হতে চলেছে শ্রুতির সাথে?

শ্রুতির যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে জঙ্গলে পড়ে থাকতে দেখে ভীষণভাবে ভয় পেয়ে যায়। একটু আগে কি হয়েছে তা মনে করার চেষ্টা করে। শ্রুতির কিছুই মনে পড়ছে না। ইচ্ছে করছে মাথাটা কেটে সেটা দিয়ে ফুটবল খেলতে। আজকাল কোনো ঘটনাই যেন শ্রুতির স্মৃতিতে জায়গা পায়না। পাজি স্মৃতি।

শ্রুতির ভীষণ ভয় করছে। সে একা বাড়ি কি করে যাবে। শ্রুতির ক্রন্দন যেন পরিবেশ টা’কে আরও গা ছমছমে করে তুলেছে। পূর্ণিমার রাতও এত ভয়ংকর দেখায় শ্রুতির জানা ছিলো না। চারিদিকে শুনশান নিরবতা।

এমন সময়ে পাতার উপরে কারও খচখচ করে পায়ের আওয়াজ শ্রুতির কানে আসছে। শ্রুতির শরীরের সব লোম দাড়িয়ে গেছে। যদি কোনো ভ্যাম্পায়ার এসে ওর রক্ত চুষে নেয়? কথাটা ভাবতে শ্রুতির ভয় আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। সাথে সেই খচখচ আওয়াজ। শ্রুতির প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে সাথে সেই আওয়াজ টাও আরও গভীর হয়। খচ-খচ-খচ….

কি ভয়ংকর ভুতুড়ে পরিবেশ। শ্রুতির হৃদয় আত্মা বার বার কম্পিত হয়ে উঠছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফুপির বাড়িতে শ্রুতি যে ঘরে নেই সেটা জানাজানি হয়ে গেছে। শ্রুতিকে এখান থেকে কে বাঁচাবে? সাদাফ যদি পাশে থাকতো একবার। সাদাফকে খুব মনে পড়ছে এখন। শ্রুতি মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে নেয়। সেই খচখচ আওয়াজ টা শুনে মনে হচ্ছে কাছে চলে এসেছে। শ্রুতির ওর পেছনে কিছু একটার অবয়ব দেখতে পায়। কেমন জানি নেগড়েদের মত। উঁচু চোয়াল, লোমশ শরীর, হাতে বড় বড় নক, অন্য সব বর্ণনা নেকড়ে দের মতো মিললেও দেখতে মানুষদের মতো। সেই বিদঘুটে অবয়বটা আরও কাছে এসে গেছে সাথেই সেই খচখচ শব্দ।

এই মূহুর্তে শ্রুতির প্রাণ ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। ঘা দিয়ে অজস্র ফোঁটার ঘাম বের হচ্ছে। শ্রুতির আবার মাথা ঘুরছে। সবকিছু ঝাপসা লাগছে।

কিছুক্ষণ পর….

শ্রুতির জ্ঞান আসার পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে। নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে দেখছে বেঁচে আছে কি-না।

—আউচ…

—বেঁচে আছো।

“বেঁচে আছো” কথাটা পুরুষালী কন্ঠের কেউ বলেছে। খুব মধুর সেই কন্ঠ। শ্রুতির বার বার এই কন্ঠ শ্রুবণ করতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে তাকে বলতে শ্রুতির পছন্দের একটা গান গাইতে।

—তুমি গাইতে বললে গাইবো।

আবার সেই ভেসে আসা কন্ঠ। শ্রুতির খুব চেনা চেনা লাগছে কন্ঠ টা। শ্রুতি এখন বুঝতে পারছে ওর মাথা কারও কোলের উপর দিয়ে শুয়ে আছে। শ্রুতি দোয়া দরুদ পরে সেই আদলখানার দিকে তাকায়। এই মুখের আদলের মানুষটাকেই তো এতক্ষণ মনে মনে খুঁজছিলো সে৷ শ্রুতি আর এক মুহুর্তও দেরি না করে সেই মিষ্টি কন্ঠের ব্যাক্তিটিকে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণে শ্রুতির প্রাণ আত্মা শান্ত হয়েছে।

—ত-তু-তুমি? (তোতলিয়ে)

—হ্যাঁ আমি। অন্যকাউকে আসা করছিলে বুঝি?

—না আমি তো তোমাকেই মনে মনে খুঁজছিলাম সাদাফ।

(হ্যাঁ পাঠকগণ ঠিক ধরেছেন ওই ব্যাক্তিটিই সাদাফ)

—আর আমি হাজির। তা তুমি এখানে আসলে কিভাবে?

—আমারতো একই প্রশ্ন তুমি এখানে আসলে কিভাবে?

—আগে তোমার টা বলো।

—না তোমারটা আগে শুনবো।

—ওকে ওকে বলছি। কিন্তু
শ্রুতি তোমার তো অজানা কিছু নয়।

—কেনো আমি সবজান্তা শমসের নাকি?

সাদাফ হাসলো আর বলল
— তুমি সবজান্তা শমসের কেনো হতে যাবে? তুমি হবে সবজান্তা শ্রুতি।

এবার শ্রুতিও হাসে আর বলে,
—আচ্ছা এবার বলো এখানে কিভাবে?

—তোমার অজানা নয় বলতে বুঝিয়েছি আমি যে একজন ভ্যাম্পায়ার তা তুমি জানো। এমনি খাবার দাবারের পাশাপাশি আমাদের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এমন না যে অন্য সব খাবার দাবার না খেলে আমরা মারা যাবো। তা নয়। আমাদের রক্ত খেতে হয় আয়ু বাড়ানোর জন্য। কারও রক্ত খেতে পারলে আমাদের আয়ু এক বছর বাড়ে। এছাড়াও আমাদের রক্ত খেতে হয় তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। যেই তৃষ্ণা টা তোমাদের পানি ছাড়া মিটে না ঠিক তেমন আমাদেরও রক্ত ছাড়া সেই তৃষ্ণা টা মিটে না।

কথাগুলে শুনে শ্রুতির মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে।কেমন জানি গা গুলিয়ে বমি আসতে চাচ্ছে। মনে হচ্ছে গরগর করে বমি করে দিলে হয়তো সাদাফের কথাগুলো হজম হবে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাদাফ বলে।

—আমি কলেজে সারাদিন অদৃশ্য হয়েই ছিলাম। অদৃশ্য হওয়ার শক্তিটা সব ভ্যাম্পায়ারদের নেই আর থাকেও না। কিন্তু আমার আছে,কেনো আছে তা জানিনা। আজ সারাদিন কলেজে অদৃশ্য হয়ে তোমার পাশে পাশেই ছিলাম। তুমি বুঝতে পেরেছিলে আমার উপস্থিতি। তাই তুমি বারবার মনে মনে বলছিলে “আমার মনে হচ্ছে সাদাফ আমার আশেপাশে আছে” ঠিক এই কথাটা বারবার বলছিলে।

সাদাফকে থামিয়ে শ্রুতি বলে,
—থামো থামো, তুমি কিভাবে আমার মনের কথা বুঝে গেলে? কারও মনের কথা বুঝার এই শক্তিটাও কি তোমার আছে?

—হ্যাঁ আছে তবে সবার কথা বুঝতে পারিনা যারা আমাকে ভাবে আর আমার প্রিয়জনদের ক্ষতি করার কথা ভাবে,শুধু তাদের কথাই শুনতে পাই।

—আচ্ছা বুঝলাম। তা এখানেও অদৃশ্য হয়ে আসলে আমার সাথে?

—হ্যাঁ তোমার সাথেই এসেছি। কলেজে তুমি এখানে আসার কথা মেহেরকে বলছিলে। আমার বার বার মনে হচ্ছিলো কিছু একটা হবেই। তাই তোমাকে একা ছাড়তে মনে সায় দিলো না।

শ্রুতি অবাক হয়ে শুনছে, আর সাদাফ বলছে,

—তুমি যখন তোমার কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলে তখনও তোমার সাথেই ছিলাম। তখন হঠাৎ আমার তেষ্টা পেয়ে যায়, রক্তের তেষ্টা। সহ্য করে অনেক্ষণ বসে ছিলাম তোমার পাশে। বার বার মনে হচ্ছিলো আমি উঠলেই তোমার কিছু হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সেই তেষ্টার সাথে যুদ্ধ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। আমাকে যেতেই হলো। আসার সময় দেখেছিলাম এইদিকটার জঙ্গলটা। তাই ছুটে এসেছিলাম এখানে। পেয়েও গেলাম শিকার। তাড়াতাড়ি তোমার কাছে ফেরার জন্য দ্রুতবেগে হাঁটছিলাম। তখনই এদিকে কালো কিছু একটার অবয়ব দেখতে পাই। অভয়বটার পিছু নিই। পিছু নিতে নিতে এখানে এসে দেখি তুমি পিছু ফিরে বসে আছো আর কাঁপতেছো। অবয়বটার কিসের তা জানিনা। আমি দৌড়েই আসছিলাম যাতে ওই প্রাণীটা তোমাকে ছুঁতে না পারে। দেখলাম সেই মুহুর্তেই তুমি মাঠিতে লুটিয়ে পড়েছো। কোনো অজানা আশঙ্কায় বুকটা তখন ধক করে উঠলো। আমাকে দেখে অবয়ব টা দ্রুতবেগে পালালো। আমি সেদিকে আর মাথা ঘামাই নি। তোমাকে নিয়ে ভয় হচ্ছিলো। আর যখন তোমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমারও প্রাণ ফিরে আসে।

সাদাফ একনাগাড়ে কথা গুলো বলে। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে দেখে শ্রুতি কাঁদছে। আবারও সাদাফের বুকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। শ্রুতির কান্নায় কেনো এত লাগে সে বুঝতে পারে না।

—এই মেয়ে কাঁদছো কেনো?

শ্রুতি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—তুমি না থাকলে আজ আমার কি হতো?

—আমি সবসময় থাকবো তোমার সাথে তোমার কিচ্ছু হবে না। চলো এখন তোমার ফুপির বাসায় চলো।

শ্রুতিরা ফুপির বাসায় গিয়ে দেখে সব স্বাভাবিক। কেউ ওকে খুঁজছে না। শ্রুতি স্বস্তির একটা নিঃস্বাস ফেললো।

মেহের একটানে শ্রুতিকে নিয়ে ছাদে চিলেকোঠার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।
—কিরে শ্রুতি এতক্ষণ কই ছিলি তুই? জানিস সবাই তোকে নিয়ে কত টেনশনে পড়ে গেছিলো৷ আমি কোনোমতে ম্যানেজ করছি।

—মানে?

—মানে মারাচ্ছেন আবার? আপনি ওয়াশরুমে যাবেন বলে এই দেড় ঘন্টা কই ছিলেন?

শ্রুতি মেহেরকে সব জানায়। কিন্তু শ্রুতি এটা জানালো না তার শরীরের পরিবর্তনের কথা। কারন সেটা শ্রুতির মনেই নেই।

—থ্যাংক গড। শ্রুতি তুই খুব বাঁচান বেঁচে গেছিস। আজ যদি সাদাফ না থাকতো তোর কি যে হতো ভেবেই আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।

শ্রুতিকে চুপ থাকতে দেখে মেহের আবারও বলে,
—আমার কি মনে হয় জানিস শ্রুতি?

—জানি।

—দেখি বল তো?

—ভুলভাল হিন্দি ছাড়া তোর মনে আর কিছুই হয় না।

—শ্রুতি বেবি তুমি কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করছো।

—এটা ইনসাল্টের কি হলো? আচ্ছা বাবা কানে ধরলাম এই দেখ৷ এবার বল তোর কি এমন মনে হয়।

—আমার মনে হয় সাদাফ তোকে ভালোবাসে।

—এটা কেনো মনে হলো তোর?

—ওর কাজ কর্মে তো এটাই প্রকাশ পায়।

—হ্যাঁ আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসে। ও এসব লুকিয়ে রাখে কারন আমি মানুষ ও ভ্যাম্পায়ার।

পরক্ষণে শ্রুতি আবার বলে উঠে।

—আচ্ছা এবার বল আমি যে বাসায় ছিলাম না সেটা কিভাবে জানাজানি হলো?

—তোর মা এসেছিলো আমাদের খেতে ডাকতে। আমি বললাম আন্টি এখন খাবো না। কিন্তু তোর মা নাছোড়বান্দা মেহমানের সমাগম বাড়ছে তাই তোকে আর আমাকে খাওয়ার জন্য যেতে বলছে। আমি বললাম আন্টি শ্রুতি আসুক তারপরে না হয় একসাথে খাবো।
তো উনি বললেন,

—শ্রুতি কই?

—আন্টি ও ওয়াশরুমে গেছে।

—আচ্ছা ও আসলে ওকে বলিও তোমাকে নিয়ে ডাইনিং আসতে।

—ঠিক আছে আন্টি।

প্রায় এক ঘন্টা পর তোর মা আবার আসলো বললো,

—মেহের আসো খেতে,শ্রুতি কই?

তখন আমারও টেনশন হচ্ছিলো এতক্ষণ হয়ে গেলো তুই ওয়াশরুমে কি করছিস?

—আন্টি শ্রুতি তো ওয়াশ…

কথাটা বলার আগেই তোর মা বলে উঠলো,
— কিহ এতক্ষণ হয়ে গেলো ও ওয়াশরুমে কি করছে। তোর মা ওয়াশরুমের দিকে একপ্রকার দৌড়েই যায়। তোর মায়ের দৌড় দেখে তোর কাজিনেরা সবাইও একসাথ ওয়াশরুমের সামনে যায়। গিয়ে দেখে ওখানে তুই নেই। সবাই অনেক ভয় পেয়ে গেছিলো। সবাই খুঁজতে লাগলো তোকে। তোর সাথে ইদানিং যে আজগুবি ঘটনা গুলো ঘটছে আমার মনে হচ্ছে এইবারও ওইরকম কিছু ঘটতে চলেছে তোর সাথে। যেটা কাউকে জানানো যাবে না,তাই তখন আমি বলি,

—আন্টি আমাকে তো পুরো ঘটনা বলতে দিবেন। শ্রুতি।তো ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেডরুমে গেছে চেঞ্জ করতে, গিয়ে দেখে ওখানে মেহমানরা বসে আছে। সব রুমেই মেহমান ভর্তি কোনো রুম খালি নেই তাই ও চিলেখোঠার রুমে গেছে। আপনারা দাড়ান আমি ওকে নিয়ে আসছি। উনারা আমার কথায় আস্বস্ত হয়। তখন আমি গিয়ে তাড়াতাড়ি এই কুর্তি টা নিয়ে ছাদে চলে আসছি। সেই থেকে এখন অবদি ছাদে দাড়িয়ে আছি। তোকে নিচ দিয়ে আসছিস দেখা মাত্রই আমি গিয়ে টেনে তোকে এখানে নিয়ে আসছি।

মেহেরের কথা শুনে শ্রুতি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।

শ্রুতি মনে মনে বলে এতো মেহমানের ভিড়ে ওকে না খুঁজলেই কি চলতো না? উফফ অসহ্য।

—এখন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার সময় না। নে ঝটপট চেঞ্জ করে নে।

শ্রুতি তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নেয়। দুজনে ঝড়ের গতিতে ছাদ থেকে নেমে যায়। গিয়ে মা’কে না বলে দুজনে তাড়াতাড়ি খেতে বসে যায়। কারন এখন মায়ের কাছে গেলে হাজারটা প্রশ্ন করবে। তখন মুখ ফসকে সব বেরিয়ে আসবে দুজনের। অনেক ভয়ে আছে দুজনে। যদি মা চলে আসে তাহলে কেল্লাফতে।

ওরা দুজনে গোগ্রাসে গিলছে। খিদার ছুটে কি খাচ্ছে না খাচ্ছে তার হুশ নেই দুজনের।
ওমনি চেনা কোনো কন্ঠস্বর দুজনের কানে ভেসে আসে,

—এতক্ষণে আসা হলো আপনার?

দুজনে ভয়ে রিতিমতো কাঁপছে।
কথায় আছে না?
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।
শ্রুতিদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো…..

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here