#ভ্যাম্পায়ার_লাভার,পর্বঃ-১৬,১৭
লেখনীতেঃ- কাশপিয়া মেহজাবিন রিমশা।
পর্বঃ-১৬
শ্রুতির আবারও লজ্জা পেলো। মেহেরের সামনে সাদাফ এগুলো না বললে হতো না? এখন যদি মাঠি ফাঁক থাকতে তাহলে সেখানে শ্রুতি টুপ করে ডুকে যেতো।
শ্রুতি লজ্জায় মুখ নিচু করে রাখে।
—হয়েছে হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না আপনাকে।(বলল মেহের)
ওরা তিনজনে একত্রে হেসে উঠলো।
—–
পরদিন….
সাদাফ,শ্রুতি,মেহের আর আবির রওনা দেয় তান্ত্রিকের উদ্দেশ্যে।
রাত বারো’টা। চারিদিকে হালকা চাঁদের আলো। একটা পুরনো দ্বিতল বাড়ি। পাশেই জঙ্গল। ডাল-পালায় বাড়িটার একটা ইটও দেখা যাচ্ছে না। এই অন্ধকার চাদের আলোয় বাড়িটা দেখতে ভূতুড়ে বাড়ির মতোই দেখাচ্ছে। ঠিক যেমন হরর ফিল্ম গুলোতে দেখায়। নিশাচর রা ডেকে যাচ্ছে। ওরা ঢুকা মাত্রই আকাশে শত পাখি ডানা ঝাপটিয়ে চলে গেলো। এক কথায় বলতে গেলে সবমিলিয়ে গা চমচমে পরিবেশ।
শ্রুতি সাদাফের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করছে। অপরদিকে মেহের এই পর্যন্ত তিনবার কেঁদেও ফেলছে। আবির কি করে যে একে সামলায়?
—আবির এই বাড়িতে তোর দেখানো তান্ত্রিক থাকে?(বলল সাদাফ)
আবির কিছু বলতে যাবে ওমনি শ্রুতি আবিরকে থামিয়ে বললো,
—তোমরা না ওইদিন তুমি করে বলছো?
—বন্ধুকে কেউ তুমি বলে সম্মোধন করে?( বলল সাদাফ)
তারপর আবির বললো,
—আরেহ ওগুলো তো বলেছি যাতে তোমরা বুৃঝতে না পারো আমরা বন্ধু।
—আর ওই জন্যই তোমরা এতো চমকাচ্ছো!(সাদাফ)
সবাই হেঁটে ভিতরে যাচ্ছে। বাদলো আরেক বিপত্তি। মেহর হঠাৎ কিছু একটার সাথে হোঁটচ খেয়ে পড়ে যায়। আবির টর্চ মেরে দেখে মানুষের মাথার খুলি।
মেহেরের চিৎকারে পরিবেশ আরও গা থমথমে হয়ে যায়। ইতিমধ্যে শ্রুতির হাত পা’ও কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে।
তখন সাদাফ বললো,
—আবির চল তো,এগুলাকে এখানে রেখে আমরা ভিতরে যাই।
—খাঁটি কথা বলেছিস। ভেতরে এগিয়ে যা।
শ্রুতি ও মেহের ওদের কথা শুনে কাঁদবে নাকি পরিস্থিতি সামলাবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,
—আর হবে না।
সবাই ভেতরে পৌঁছে যাওয়ার পর আবির বলে,
—এখানে দাড়া।
—চলে এসেছি?(সাদাফ)
—হুম।
— কোন কক্ষ’টা?
—ওই যে আলো দেখা যাচ্ছে।
—চল।
শ্রুতির ভীষণ ভয় করছে। সাথের ভিতুর ডিম মেহের তো আছেই। শ্রুতি আগে যথেষ্ট সাহসী ছিলো। মেহের একটা আস্ত বলদ। মেহের অসম্ভব রকমের ভিতু। আজ যদি একটা সাহসী বান্ধবী থাকতো তাহলে শ্রুতি মোটেও ভিতু হতো না। শ্রুতি রাগে দাঁত কটমট করে বলে,
—শাঁকচুন্নি।
মেহের শাঁকচুন্নি কথাটা শুনে আবারও চিল্লিয়ে উঠে।
—হায় খোদা বাঁচাও বাঁচাও।
শ্রুতি শাঁকচুন্নি কথাটা মোটেও জোরে বলেনি। বাকিরা না শুনলেও যে শাঁকচুন্নি সে ঠিকই শুনে গেলো। উফফ। এখন শ্রুতির হিরো আলমের আরবিক গানটা গাইতে ইচ্ছে করছে।
গানটার শুরুতে কি যেনো বলে?
দূর…
হিরো আলমের আরবিক গানটা মুখস্থ করার অনেক চেষ্টা শ্রুতি করেছে। বরাবরই ব্যার্থ হয়েছে। শ্রুতির মনে হচ্ছিলো হিরো আলমের গানটা লোহার চাইতেও শক্ত কিছু। নইলে তার দাঁত ভাঙার উপক্রম হতো না।
এসব গান হিরো আলমই গাইতে পারবে।
আবির মেহেরকে শান্ত করায়।
বলে,
—কোথাও শাঁকচুন্নি নেই।
—তাহলে যে আমি শুনলাম?
—তুই’ই শুনবি। নিজের নাম কি কেউ না শুনে?(শ্রুতি)
তখন সাদাফ আর আবির হেসে উঠে,সাথে শ্রুতিও। মেহের মুখ ফুলিয়ে থাকে। মেহের এখন সবার সাথে কথা না বলার মিশনে নেমেছে। কারোর সাথেই সে কথা বলবে না।
ওরা সবাই ভেতরে ঢোকে। অমাবস্যার রাতের চাইতেও ঘরটা বেশি অন্ধকার। সাদাফ টর্চ নিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলে আবির বারণ করে। আবির বলে তান্ত্রিকটার কাছে এভাবেই যেতে হবে।
সবাই নিশ্চুপ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শ্রুতির ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ছুটে পালাতে। মেহেরও চটপট করছে।
—এতো উত্তেজিত হস না তোরা।
অদ্ভুদ একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসে সবার কানে। শ্রুতি আর মেহের দুজনেই চমকে উঠে। যেনো ভুত দেখেছে। সাদাফ বুঝতে পারে শ্রুতির চমকানো’টা। তাই সে শ্রুতির হাত শক্ত করে ধরে রাখে। অন্যদিকে আবিরও মেহেরের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। যাতে ওরা দুজনে ভয় না পায়।
আবারও সেই কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
—এখানে দু’জন মানুষ আর বাকি দু’জন রক্তচোষা। তোরা এখানে কেনো এলি?
—বাবা তোমার কাছে মানুষ তো সাহায্য চাইতেই আসে। আমরা সাহায্যপ্রার্থী।(বলল সাদাফ)
তখনই নানান রঙের আলো জ্বলে উঠে। তান্ত্রিক মশাইকে দেখা যাচ্ছে। লম্বা লম্বা দাড়ি, মেয়েদেন মতো কোমর ছড়ানো চুল। মনে হচ্ছে কোনোদিন চুল আর দাড়ি কাটেনি। উনার চুল আর দাড়ি দেখে সহজেই বুঝা যাচ্ছে অনেক ঝট হয়েছে। বোধহয় কখনও চিরুনি লাগায়নি। বড় বড় চোখ দুটো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না উনার।
তান্ত্রিক বলল,
—বল তোরা, তোদের সমস্যা আমাকে পরিষ্কার করে বল। আল্লাহ তায়ালা চাইলে আমি তোদের নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবো।
তান্ত্রিক সাদাফ আর শ্রুতির মুখ থেকে প্রথম থেকে এই পর্যন্ত কি কি ঘটেছে সব কথা শুনে। তারপর তিনি চোখ বন্ধ করে।
সাদাফ আর শ্রুতি ওদের সাথে ঘটে যাওয়া সব প্যারানরমাল ঘটনা গুলো বলার অনেক্ষণ পরেও তান্ত্রিক চোখ খুলছে না। সাদাফ আর শ্রুতি একপ্রকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। এসবের খোলাসা কখনও হবার নয়।
প্রায় অনেক্ষণ পর তান্ত্রিক চোখ খুলে। আর বলে,
—তোদের ব্যাপারটা বেশ জটিল। একজন আগে থেকেই রক্তচোষা অপরজন মানুষ থেকে রক্তচোষা হয়ে গেলো। আমার তান্ত্রিক জীবনে এরকম ঘটনার মুখোমুখি আমি কখনও হইনি।
—তাহলে কি আমরা আপনার থেকে কোনো সাহায্যই পেতে পারি না?(বলল সাদাফ)
—তোরা আমার দুয়ারে এসেছিস আমি তোদের ফিরিয়ে দিবো না।
উনার কথায় সাদাফ আর শ্রুতি আস্বস্ত হয়।
উনি কিছু একটা ভেবে আবার বলে,
—এই মেয়েটা একটা অভিশপ্ত রক্তচোষা।
তান্ত্রিকের এহেন কথায় সবাই চমকে উঠে। শ্রুতি বিষম খায়। কাশতে থাকে। সাদাফ উঠে গাড়ি থেকে পানি আনতে গেলে ওকে থামিয়ে তান্ত্রিক বলে,
—বসে থাক।
উনার মুখ থেকে “বসে থাক” কথাটা সাদাফ নিতে পারছে না। তার প্রিয়তমার কাশি উঠেছে, সে কি করে দেখে থাকবে।
তখন তান্ত্রিক শ্রুতির দিকে একটা বোতল এগিয়ে দিলো।
শ্রুতি না দেখে বোতল থেকে তরলটা গটগট করে খেয়ে নিলো। তরল পানীয়টি খাওয়ার পর শ্রুতির বুকে কেমন জানি ব্যাথা হচ্ছে। খুব অস্বস্তি লাগছে। শ্রুতি সাদাফের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়। এতে সাদাফের বুক ধক করে উঠে। আবির মেহেরের বুকও অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে।
কি এমন আছে এই তরলে?
চলবে…..
#ভ্যাম্পায়ার_লাভার
পর্বঃ-১৭
লেখনীতেঃ- কাশপিয়া মেহজাবিন রিমশা।
তরল পানীয়টি খাওয়ার পর শ্রুতির বুকে কেমন জানি ব্যাথা হচ্ছে। খুব অস্বস্তি লাগছে। শ্রুতি সাদাফের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়। এতে সাদাফের বুক ধক করে উঠে। আবির মেহেরের বুকও অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে।
কি এমন আছে এই তরলে?
সাদাফের রাগ চরম পর্যায়ে উঠে গেছে। কারও কিভাবে সাহস হয় তার প্রিয়ষীকে কষ্ট দেওয়ার। শ্রুতি মিশে আছে তার শিরায়, উপশিরায়। শ্রুতির কষ্ট হলে সেটা সাদাফের বুকেও লাগে। স্তব্ধ হয়ে আছে চারিদিক। সব যেনো থমকে আছে।
সাদাফ রাগে, দুঃখে তান্ত্রিককে থাপ্পড় মারার জন্য হাত বাড়াতেই তান্ত্রিক কি যেন বুঝে সাদাফকে বললো,
—থাম।
সাদাফ অসহায় চোখে তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর শ্রুতির দিকে তাকায়। একদম সুস্থ লাগছে শ্রুতিকে। আগের মতো আর চটপট করছে না। সাদাফ তাড়াতাড়ি শ্রুতিকে ঝাপটে ধরে।
—শ্রুতি তুমি ঠিক আছো? আর কোথাও কষ্ট হচ্ছে না তো?
শ্রুতি হেসে সাদাফের প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেয়,
—আমি ঠিক আছি।
তান্ত্রিক তখন বলে,
—ওই তরলটা মন্ত্রপুত পবিত্র জল। ওটা খেলে শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
সাদাফ তান্ত্রিকের কথায় একটু ভরসা পায়।
—বাবা এবার বলুন শ্রুতি কেনো অভিশপ্ত রক্তচোষা হবে?(বলল সাদাফ)
— মেয়েটা জন্ম থেকেই মানুষ। অভিশপ্ত না হলে কেউ হঠাৎ করে রক্তচোষা হয়ে যেতে পারে না। আর যদি বলিস উপরওয়ালা তোদের মিলিয়ে দিতে এরকমটা করেছে তবে আমি বলবো এটাও হতে পারে।
—আপনার কথা কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। আপনি তো দোটানায় ফেলে দিলেন।(সাদাফ)
—শোন, শ্রুতি মেয়েটা আগে সুস্থ, স্বাভাবিক একজন মানুষ ছিলো একদিন হঠাৎ সে রক্তচোষা হয়ে যায়। এটা অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার আর এটার থেকে আমি তোদের কোনো সমাধানই দিতে পারছি না। কিন্তু তোদের আমি সাহায্য করতে পারবো!
—বলুন কিভাবে সম্ভব সেটা?(সাদাফ)
—উপরওয়ালা প্রত্যেকটা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠায় কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। আর তোদের ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই, ব্যাতিক্রম নয়!! আচ্ছা শ্রুতি মা বল তো যেদিন তুই রক্তচোষা হয়ে গেলি সেদিন অমাবস্যা ছিলো নাকি পূর্ণিমার রাত ছিলো?
সাদাফ আর শ্রুতি দুজনেই একসাথে বলে উঠে,
—পূর্ণিমার রাত।
তান্ত্রিক কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শ্রুতিকে আবারও জিজ্ঞেস করে,
—মা তোর বয়স এখন কত হবে?
শ্রুতির সোজাসাপটা জবাব,
—২৩।
—এটা কতদিন আগের ঘটনা? তখন কি তোর জন্মদিন বা কোনো আকর্ষনীয় দিন ছিলো?
শ্রুতি বলল,
—হ্যাঁ সেদিন আমরা ফুপির বাসায় গিয়েছিলাম।ফুপির মেয়ের আকিকা ছিলো। তখন আমার ২৩ বছর ১দিন ছিলো।
—ঘটনাটা রাত ক’টায় হয়?(তান্ত্রিক জিজ্ঞেস করল)
—ঘরির কাটা ১১টা ছুঁই ছুঁই।
—ব্যাস, আমি এখন নিশ্চিত কোনো অভিশাপের ফলে আজকে তোর এই অবস্থা। তুই যদি অভিশপ্ত রক্তচোষা হস সেই অনুযায়ী এই ছেলেটারও(সাদাফ) অভিশপ্ত রক্তচোষা হওয়ার কথা ছিলো।
আবির বলল,
—বাবা দুজনেরই অভিশপ্ত রক্তচোষা হতে হবে কেনো?
তখন তান্ত্রিক বললো,
—সাদাফ আগে থেকেই রক্তচোষা, আর শ্রুতি মানুষ থেকে রক্তচোষায় পরিণত হয়েছে। উপরওয়ালা তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছে। আর ওদের পেছনে অদৃশ্য শয়তান পিছু নিয়েছে।
তোরা ভেবে দেখ,
গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। চাইলে সাদাফ ওদেরই জগতের কোনো এক রক্তচোষা মেয়েকে ভালোবাসতে পারতো।ঘটনাটা এরকম হয়নি, হয়েছে উল্টা। আর এর জন্য শ্রুতি কেনোই বা রক্তচোষা হলো?
এদের মাঝে নিরব দর্শক মেহের।
আবির আবারও বলে উঠলো,
—বাবা ভালোবাসা তো কাল,গোত্র,আকার,রং ইত্যাদি দেখে হয়না।
তখন তান্ত্রিক বলল,
— আলবাত। এটাই বুঝাতে চাচ্ছিলাম। কারন উপরওয়ালা চায় সাদাফ আর শ্রুতির মিল হউক। যে মিলনে বাঁধা সেই অশুভ অদৃশ্য শয়তানটা। সে কেনোই বা ওদের ভালোবাসায় বাঁধা হতে যাবে? তারও নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য আছে।
তান্ত্রিকের এসব কথায় সাদাফ আর শ্রুতির মাথা ভনভন করে ঘুরছে। এনার কাছে এসেও কোনো সাহায্য পাওয়া গেলো না। তান্ত্রিক যা বলছে কিছুই পরিস্ফুট করে বলছেন না।
সাদাফ আর শ্রুতি হতাশ। আবির আর মেহের নিরুপায়। এবার সঠিক পথ ওদের নিজেদেরই বেঁচে নিতে হবে।
তান্ত্রিক আরও অনেক কথা বললো। এর থেকে স্পষ্টত বুঝা গেছে শ্রুতি অভিশপ্ত রক্তচোষা। কিন্তু কার অভিশাপে তার জীবন আজ নরক সেটা জানা যায়নি। সবাই তান্ত্রিকের সাথে কথা বলে বের হয়ে আসছে। হঠাৎ সাদাফের কী মনে হতেই সে দৌড়ে আবার ভেতরে প্রবেশ করে।
সাদাফের এমন কাজে শ্রুতি বিরক্ত, মেহের স্তব্ধ। ওরা কেউ আর এখানে থাকতে চায় না। কিছুতেই না।
সাদাফের পেছনে আবিরও দৌড়ে ভেতরে যায়। শ্রুতি আর মেহেরও আবিরের সাথে দৌড়ে যায়। সাদাফকে অনেক ডাকার পরও সে দাড়ালো না।
তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে সাদাফ থামে। সাথে শ্রুতি, আবির আর মেহরও থামে। গিয়ে ওরা দেখে সাদাফ তান্ত্রিকের সামনে হাটু গেঁড়ে বসে আছে।
তান্ত্রিক ওদের ফিরে আসায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়। সাদাফকে এভাবে বসে থাকতে দেখে তান্ত্রিক বলে,
—কিছু বলবি?
হাঁপাতে হাঁপাতে সাদাফ বলে,
—হ্যাঁ
তান্ত্রিক বলল,
—নির্দ্বিধায় বল।
তখন সাদাফ বলতে শুরু করলো।
আবার বাবা ভ্যাম্পায়ারদের রাজা। আমাদের রাজ্যে কেউই ভ্যাম্পায়ারদের মতো বা ভ্যাম্পায়ারের রুপে চলাফেরা করে না। সবাই মানুষের মতোই থাকে সারাক্ষণ। রক্ত খাওয়ার সময়ে এরা নিজেদের রুপে আসে। ওখানে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সব আছে। আমাদের ওখানের সবাই মুসলমান রক্তচোষা। আমাদেরও জাত কূল আছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে আমার ১৫ বছর বয়সের আগের কোনো স্মৃতিই মনে পড়ে না। আমি কে ছিলাম? কিরকম দেখতে ছিলাম? কিভাবে কেটেছে আমার ছেলেবেলা? কিভাবে খেয়েছি মায়ের আদর আর ভালোবাসা?আমার এসব কিছুই মনে পড়ে না, অনেক চেষ্টা করি তাও মনে পড়ে না। কিন্তু, আমার ১৫ বছর বয়সের পরের সব মনে আছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বলে,১৫ বছর বয়সে আমার নাকি কোনো একটা এক্সিডেন্ট হয়। তখন মাথায় দরুন আঘাত লাগার ফলে আমার নাকি স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে যায়। আমি আর এ বিষয় নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এখন খটকা লাগে তার কারণও বলবো আপনাকে। আর শুনেছি আমার মা নাকি আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। ভ্যাম্পায়ারদের মতে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো ভ্যাম্পায়ার মহিলা মারা যান তাহলে তার জন্ম সদ্য নেওয়া শিশুটি নাকি প্রবল শক্তির অধিকারী হয়। আমিও হয়েছি তেমন। আমি হাওয়ায় ভাসতে পারি,আমাকে নিয়ে এবং আমার প্রিয়জনদের কেউ ক্ষতি করার কথা মনে মনে চিন্তা করলে সেটাও আমি শুনতে পাই। যেগুলো বাকি ভ্যাম্পায়াররা পারে না। তাই আমি সবার চোখের মণি। আমার ইচ্ছা ছিলো মানুষদের সাথে পড়ার। তাই আমি মানুষদের সাথে পড়ি।কলেজ পাড়ি দিয়ে ভার্সিটিতে এসে শ্রুতিকে দেখি। আর প্রথম দেখায় ঘায়েল। তান্ত্রিকমশাই আপনাকে এগুলো বলার কারন হচ্ছে আমার মনে হয় এর পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে। ওহ হ্যাঁ, একদিন আমি আমার বাবার রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন কানে আসে বাবার ফিসফিসানি। তাই আমি কান পেতে শুনতে থাকি। কক্ষে বাবার সাথে ছিলো আবু-বিন-জাহিদ। উনি হলেন রাজ্যের মন্ত্রী। বাবার অনেক বিশ্বস্ত। আব-বিন-জাহিদ গোপনসূত্রে খবর পেয়েছে কে বা কারা আমাকে মারতে চায়। আমাদের রাজ্য দখল করাই হলো তাদের মোক্ষম উদ্দেশ্য। আর তাদের উদ্দেশ্যের সামনে বড় বাঁধা আমি। আমার জন্য নাকি তারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের রাজ্য দখল করতে ব্যার্থ হয়। আবু-বিন-জাহিদের কথায় আমি অনেক অবাক হই। কারণ আমি কিভাবে তাদের পরিকল্পনা ভেঙে দিই তা আমি নিজেও কখনো জানতে পারিনি। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাকে হত্যা করবে। বাবার একমাত্র দুর্বলতা আমি। আমাকে হত্যা করলে আমার বাবাকেও সহজে ঘায়েল করতে পারবে। মন্ত্রীর কাছ থেকে এসব শুনে বাবা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ে। উনার একমাত্র সন্তান আমি। ভ্যাম্পায়ারদের শুধু মানুষের জন্য দয়ামায়া থাকেনা কিন্তু নিজেদের গোত্রের ভ্যাম্পায়ারদের জন্য ঠিকই আবেগ,ভালোবাসা,দয়ামায়া এগুলো থাকে। সেগুলোর কারণে বাবা আমাকে হারানোর ভয়ে কাঁদতে থাকেন। বাবার কান্নায় তখন আমার মনে হচ্ছিলো হাজারও সুঁচ আমার বুকে খোঁচাচ্ছে। যেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরন হচ্ছে। তাও আমি চুপচাপ শুনেছিলাম সব। বাবা তখন বললেন ওদের আমি কি করে বুঝাই সাদাফ আমার ছেলে নয়। কথাটা বলেই বাবা আবার কাঁদতে থাকেন। এর কিছুদিন পর বাবা আমাকে এখানে মেসে পাঠিয়ে দেন। বাবার সাথে আমার এখন যোগাযোগ সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন। কারন বাবা চান না আমার কেউ ক্ষতি করুক৷ কিন্তু উনি জানেন না উনার আদরের ছেলে এখানেও নিরাপদ নয়।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সাদাফ চুপ হয়ে যায়। আর কোনো কথা বলে না। হাজারও সুঁচ দিয়ে খোঁচালে যেরকম ব্যাথা অনুভূত হয়,সাদাফও একই ব্যাথায় বেধিত। সময় থমকে আছে। পারই হতে চাচ্ছে না। সাদাফ বড় তরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
তান্ত্রিক সাদাফের নিঃশ্বাস শুনে ভীষণ অবাক হন। ছেলেটার বয়স আর কতই বা হবে। বড়জোর ২৫ নয়তো ২৬ হবে আর এটুকু বয়সে এত বড় দীর্ঘশ্বাস? এত বড় দীর্ঘশ্বাস শুনে মনে হচ্ছে ছেলেটা অনেক বড় কষ্টের বোঝা কাঁদে নিয়ে হাঁটছে। যার ভার সে বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।
সাদাফ মাথা তুলে শ্রুতির দিকে তাকায়। মেয়েটার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। আবির আর মেহের এখনও হা করে তাকিয়ে আছে সাদাফের দিকে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে হাজারটা মাছি ঢুকে, বের হলেও ওরা ঠের পাবে না। সাদাফ তান্ত্রিকের সামনে থেকে শ্রুতির সামনে আসে।
—শ্রুতি?
সাদাফের ডাকে শ্রুতি সাদাফের দিকে তাকায়। সাদাফ শ্রুতিকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে,চোখের পানি মুছে দেয়। এই মেয়েটার চোখের পানি সাদাফের বুকে রক্তক্ষরণ হয়,তা কি সে বুঝে না? আর কি করে বুঝাবে তাকে?
শ্রুতিকে ওইভাবে ধরে সাদাফ, আবির আর মেহেরের সামনে যায়।
—কি কথা গুলো এখনও হজম হয়নি তোদের?(বলল সাদাফ)
সাদাফের কথায় আবির আর মেহেরের হুশ আছে। কিছু বলতে চাচ্ছে দুজনে কিন্তু ওদের মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছেনা।
তখন তান্ত্রিক বললো,
আজ ৫০ বছর ধরে তান্ত্রিক, সাধনা নিয়ে আছি। অনেকের অনেক সমস্যাও সমাধান করে দিয়েছি। কাজ শেষে নিয়েছি ব্যাগ ভর্তি টাকা। এর আগে কখনও কারও সমস্যা বা দুঃখের কথা শুনে আমার হৃদয় বেধিত হয়নি। তোদের সমস্যার সমাধান কি আমি জানিনা। কিন্তু আমি তোদের সাহায্য করতে পারবো। দরকার হলে আমি যজ্ঞ করবো,অনেক বড় সাধনা করবো। তাও তোদের আমি যেভাবেই হোক সাহায্য করবো।
তান্ত্রিকের কথা শুনে সাদাফ কিছু বললো না। সে জানে তান্ত্রিক ওদের স্বান্তনা ছাড়া কিছুই দিতে পারবে না।
তান্ত্রিক আবার বললো,
—আমার একটা যজ্ঞ করতে হবে। এর মাধ্যমে জানতে পারবো তোরা অভিশপ্ত রক্তচোষা নাকি না। যদি তোরা অভিশপ্ত রক্তচোষা হস তাহলে সেই অভিশাপ টা ফিরিয়ে দিতে হবে,মানে ভাঙতে হবে। আর কিভাবে ভাঙতে হবে সেটাও আস্তে আস্তে জেনে যাবো। আমি তাহলে কালই যজ্ঞের আয়োজন করি। তোরা ধৈর্যহারা হস না।
সাদাফ এতে সম্মতি জানালো। তারপর সবাই রওনা দিলো ফেরার উদ্দেশ্যে।
সাদাফ ড্রাইব করছে। মাথায় হাজারও চিন্তা। শ্রুতি সেই তখন থেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। অন্যদিকে আবির মেহেরকে নিয়ে পড়েছে ঝামেলায়। মেয়েটা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে। সামনের বার এরকম কোথাও আসলে মেহেরকে আনবেনা -মনে মনে সিন্ধান্ত নেয় আবির।
জঙলের ভিতর রাস্তা দিয়ে সাদাফদের গাড়ি চলছে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। নিশাচর পাখিরা ডাকছে। কি আজব ব্যাপাার নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজটাও স্পষ্ট কানে আসছে সবার। কিছুক্ষণ পরপর শেয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে। তাও গাড়ির ভেতরে সবাই নিশ্চুপ। কারোর মুখে কোনো নাই। এতে পরিবেশটা আরও ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
হঠাৎ সাদাফ বুঝতে পারে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। তাও সে চুপ থাকে। সে চায় তার শ্রুতি বা বাকিরা ভয় না পাক। সাদাফ মনে মনে আল্লাহর কাছে বিপদ উদ্ধারের দোয়া পড়ছে। শ্রুতি, আবির আর মেহের বুঝে উঠার আগেই গাড়ি একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়।
——-
সাদাফ চোখ খুলে দেখে ওরা সবাই হাসপাতালে পাশাপাশি চারজন, চারটা বেডে শুয়ে আছে। সবার ক্ষত স্থানে বেন্ডেজ করা। সাদাফ ছাড়া বাকি কারোরই জ্ঞান এখনও ফিরেনি। কে বা কারা সাদাফদের এতো বড় উপকার করেছে সাদাফ জানেনা। সাদাফ মনে মনে সাহায্যকারীকে ধন্যবাদ জানালো।
আশ্চর্যের বিষয় হাসপাতালে কোনো শোরগোল নেই। হাসপাতালের ভেতর যে গন্ধটা থাকে সেটাও নেই। আশেপাশে নেই কোনো ডাক্তার, সেই কোনো নার্স, নেই কোনো মানুষ।
হঠাৎ সাদাফ খেয়াল করলো হাসপাতালটা কাঁপছে…
চলবে….