মায়ারণ্যে,পর্ব-৮

0
1749

#মায়ারণ্যে,পর্ব-৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার কে রাতের ঘনকালো অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে। সময় গড়িয়ে নয়টার কাটায় থেমেছে। মায়া এবাড়িতে এসেছে সেই দুপুর বেলা। আসার সময় যতটা ভয় আর জড়তা কাজ করছিল। এখন সেটা অনেকটাই কেটে গেছে। মায়া এবাড়ির লোকজনের সাথে খুব সহজেই মিশে গেছে। এবাবড়ির লোকজনও মায়ার সাথে সহজেই কম্ফোর্টেবল হয়ে গেছে। যেন মনেই হচ্ছে না সে এবাড়ির মেহমান। মায়া নিজেও বিষয় টা দেখে একটু অবাক হয়েছে। ওতো ভেবেছিল ধনী লোকেরা বুঝি অনেক অহংকারী হয়। ওর সাথে হয়তো কথাও বলতে চাইবে না। কিন্তু এরা কতো সুন্দর ওকে নিজের পরিবারের মতো আপন করে নিয়েছে।

মায়াকে অরণ্যের পরিবারের সবার কাছে ভালো লেগেছে। মেয়েটা সত্যিই ভারি মিষ্টি এবং মায়াবী। চেহারায় এক নিস্পাপ মায়া আছে। সবার সাথে সময় কাটাতে কাটাতে কখন সময় কেটে বুঝতেই পারেনি মায়া।

অরণ্য অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে ড্রয়িং রুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। শরীরের সাথে মনটাও ক্লান্ত আজ। আজও মায়াকে ভার্সিটিতে দেখতে পায়নি অরণ্য। তাইতো আজকের দিনের শান্তির খোরাক টুকু পায়নি অরণ্য। সোফায় বসে পেছনে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো।
–মা.. একটু পানি দাও তো।

তনিমা বেগম রান্নাঘরে কিছু কাজ করছিলেন। মায়াও ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল আর টুকটাক হেল্প করছিল। অরণ্যের আওয়াজ কানে আসতেই মায়ার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সারাদিন ভালোই ছিল। তবে এখন মনের মাঝে আবারও সেই উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল। মায়ার মনের তোলপাড়কে আরও শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তনিমা বেগম বলে উঠলো।
— মায়া একটা কাজ করোতো একটু। আমার হাতে আটা লেগে আছে। তুমি একটু অরণ্যের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে যাবে?

মায়া চমকে উঠে বললো।
–আ আমি?

–হ্যাঁ। আসলে রিয়া বউমাও নিজের রুমে আছে বোধহয়। তাই তোমাকে বলতে হচ্ছে। একটু যাবে?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তনিমা বেগমের কথার মান রাখতে মায়া পানির গ্লাস ট্রেতে করে বাইরে নিয়ে গেল। অরণ্যেকে দেখে বুকের কম্পন আরও বেড়ে গেল। অরণ্য এখনো ওভাবেই হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মায়া অরণ্যের সামনে এসে গলা খাঁকারি দিলো। অরণ্য চোখ খুলে মাথা তুলে সামনে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। মায়াকে চোখের সামনে দেখে অরণ্যের মনে হলো ও নিশ্চয় কোন ভ্রম দেখছে। হ্যাঁ ভ্রমই হবে। মায়া কি করে এখানে থাকবে? আমার মাথাটা সত্যিই গেছে। সব জায়গায় শুধু মায়কেই দেখতে পাচ্ছি। মনে মনে এসব ভেবে মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললো।
–কেন এতো জ্বালাচ্ছ? কেন যাওনা মনের ঘর থেকে?

মায়া ভ্রু কুঁচকে বললো।
–জ্বিহ?? কিছু বললেন?

মায়ার কন্ঠ কানে আসতেই ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো অরণ্য। বিস্মিত চোখে তাকালো মায়ার দিকে। ওকি সত্যিই দেখছে? তাহলে কি মায়া সত্যিই এখানে? অরণ্য উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো।
— মায়া? তুমি সত্যিই এখানে?

অরণ্যের এমন আজব প্রশ্নে মায়া কপাল কুঁচকে বলে উঠলো।
–জ্বিহ??

অরণ্য নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো।
–সরি আসলে হঠাৎ করে তোমাকে দেখলাম তো,তাই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তা কেমন আছ? কখন আসলে?

মায়া জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
— জ্বি ভালো আছি। আর দুপুরে এসেছি।

তখনই সারা এসে বললো।
–আমি মায়া আপুকে নিয়ে এসেছি। রাইসা আপুর বিয়ের জন্য। বিয়ে পর্যন্ত আপু আমাদের এখানেই থাকবে। অনেক মজা হবে। ভালো করেছি না ভাইয়া?

তারমানে মায়া বিয়ে পর্যন্ত এবাড়িতেই থাকবে? অরণ্যের চোখের সামনেই থাকবে? যখন খুশি মায়াকে দেখতে পাবে অরণ্য? অরণ্যের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। এ যেন মেঘ না চাইতেই সোজা বর্ষণের ঘনঘটা। নিজের খুশী ব্যাক্ত করার কোন উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছে না। সারার প্রতি আজকে যেন সব ভালোবাসা উপসে পড়ছে অরণ্যের। এমন একটা মহৎ কাজের জন্য সারাকে অসকার দিতে ইচ্ছে করছে ওর। অরণ্যের বিস্ময়ে ছেদ পড়ে মায়ার কথায়। মায়া পানির গ্লাস রাখা ট্রেটা একটু সামনে এগিয়ে ধরে বললো।
–আপনার পানি।

অরণ্য নিজের ইমোশনকে একটু কন্ট্রোল করে নিয়ে মুচকি হেসে পানির গ্লাস টা হাতে তুলে নিলো। এক চুমুকে সব পানি খেয়ে নিল। যেন একটুখানি পানিও গ্লাসে অবশিষ্ট থাকলে মায়া ওকে লাঠিপেটা করবে। আসলে অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে অরণ্য কি রেখে কি করবে বুঝতে পারছে না। পানি খাওয়া শেষে গ্লাসটা আবারও মায়ার হাতে থাকা ট্রেতে রেখে মায়ার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ বললো। মায়া সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে আবারও কিচেনের দিকে চলে গেল। অরণ্য মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।

মায়া যেতেই অরণ্য সারার দিকে ঘুরে হঠাৎ সারাকে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা জড়িয়ে ধরায় সারা একটু অবাক হয়ে বললো।
–কি হয়েছে ভাইয়া?

অরণ্য সারাকে ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো।
–আই লাভ ইউ বইনা। তুই আমার সত্যিকারের বোন। আজ আমি অনেক খুশী বল তুই কি চাস? যা চাবি তাই পাবি। আজ তোর প্রতি বেশিই ভালোবাসা আসছে আমার।

সারা খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে বললো।
–সত্যিই? ওয়াও ঠিক আছে আমি এখনি গিয়ে সবকিছুর লিস্ট করে আনছি।
কথাটা বলেই সারা নিজের রুমের দিকে দৌড়ালো। এতোবড় অফার হাতছাড়া করা যাবে না। ভাইয়ার মন বদলানোর আগেই লিস্ট দিয়ে দিতে হবে।

আর অরণ্য ওখানেই সোফায় বসে পড়লো। ওর আর এখান থেকে রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেও রুমে ঢুকে রিয়াকে দেখলেই অরণ্যের মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। অরণ্য চেষ্টা করেও রিয়ার সামনাসামনি থাকতে পারে না । ইদানীং তো রিয়ার উপস্থিতিও কাঁটার মতো বিঁধে ওর কাছে। তাইতো অতিরিক্ত দরকার ছাড়া অরণ্য নিজের রুমে বেশিক্ষণ থাকেই না। রাতেও অরন্য অনেক দেরি করে রুমে ঢুকে ততক্ষণে রিয়া ঘুমিয়ে যায়। আর অরণ্য গিয়ে ব্যালকনির ডিভানে গিয়ে ঘুমায়। রিয়ার সাথে এক বেডে তো দূরের কথা, এক রুমে থাকতেও ওর অস্বস্তি লাগে।

অরণ্য এখানে থাকলে হয়তো আবারও আসতে যেতে মায়াকে দেখতে পাবে। সেই আশায় এখানেই বসে রইলো সে। টিভি চালু করে বসে রইলো। আর আরচোখে মাঝে মধ্যে কিচেনের দিকে উঁকি দিয়ে মায়াকে দেখার চেষ্টা করছে। অরণ্য জানে ও যা করছে তা হয়তো অনুচিত। ভাগ্যের নির্মম খেলায় ভুল মানুষের হলেও,সেতো এখন বিবাহিত। আর বিবাহিত পুরুষ হয়ে এভাবে অন্য নারীর প্রতি মুগ্ধ হওয়া টা ঠিক না। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। মনের হাতে যে পরাস্ত সে। সে চাইলেও মায়াকে ভুলতে পারে না।চেষ্টা তো কম করেনি। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। মায়ার প্রতি তার অনুভূতি গুলো দিনদিন বাড়ছে বই কমছে না। মায়াকে শুধু একনজর দেখার জন্য সে হাজারও কষ্ট সহ্য করতে পারবে। তবে মায়াকে দেখতে না পেলে যে তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে। তাইতো বেঁচে থাকার তাগিদে হলেও মায়াকে তার দেখতেই হবে।

মায়া সেই যে গেল আর বের হচ্ছে না। অরণ্যের আবারও একটু মায়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে। অরণ্য একটু গলার আওয়াজের বাড়িয়ে বলে উঠলো।
–মা আআ, আমাকে এক কাপ কফি দাও তো।

অরণ্য অধীর আগ্রহে বসে রইলো। মনে মনে শুধু আশা করছে মায়াই যেন ওর কফিটা নিয়ে আসে। পাঁচ মিনিট পর সত্যি সত্যিই মায়া এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে হাজির হলো। অরণ্যের খুশি আর দেখে কে।মায়া কফির মগটা অরণ্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো।
–আন্টি কাজ করছিল তাই আমাকেই আনতে বললো।

অরণ্য মুচকি হেসে কফির মগটা হাতে নিয়ে মায়াকে সোফায়া বসতে বললো। মায়া একটু ইতস্তত করলেও অরণ্যের কথা রাখতে সোফায় বসে পড়লো। অরণ্য বললো।
— ধন্যবাদ মায়া। আর সরি তোমাকে কষ্ট দিলাম।

মায়া স্মিত হেসে বললো।
–আপনার বোধহয় সরি বলাটা হ্যাবিট। কথায় কথায় সরি বলে দেন। থ্যাংক ইউ আর সরি এই দুটো শব্দ যেন বাঙালির ফেবারিট। ঠুস ঠাস বলতে পারলেই নিজেকে ইংরেজ মনে করে।

অরণ্য হালকা হেঁসে বললো।
–বাপরে তুমিতো দেখছি ঝাঁসি কি রানীর মতো রীতিমতো আন্দোলন শুরু করে দিয়েছ। এখন তো তোমার সামনে থ্যাংক ইউ, সরি বলতেই ভয় লাগবে।

— তেমন কিছু না। তবে কথায় কথায় থ্যাংক ইউ সরি বলাটা আমার মোটেও পছন্দ না। যে জিনিস মন থেকে ফিল করে না বলেন তার কোনো মূল্য থাকে না। শুধুমাত্র তখনই বলা উচিত যখন এটার সঠিক কারণ থাকে। আর আপনি মন থেকে ফিল করে কথাটা বলেন। তখনই কথাটার সঠিক গুরুত্ব পায়।

মায়ার কথাগুলো সত্যিই মনোমুগ্ধকর। যেমন মায়া, তেমনি তার চিন্তাধারা। মায়ার কথায় বোঝা যায় মেয়েটা কতো সুশৃঙ্খল আর গোছানো। অরণ্য মুগ্ধ হয়ে মায়ার বাণী শ্রবণ করছে। মায়া অরণ্যের দিকে তাকাতেই মায়ার চোখাচোখি হয়ে গেল। মায়া অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। ও ভেবে পায়না এই লোকটার সামনে এতো নির্দ্বিধায় কিভাবে কথা বলে ফেলে ও? যেন কতো আপন কেউ। আপন? কি ভাবছি আমি এসব? এসব ভাবা ঠিক না। আমি তো একজন অপরাধী। সত্যি টা জানলে সে বা এই পরিবারের কেউই আমাকে মাফ করবে না। তাই এসব মিথ্যে মোহে নিজেকে ডোবানো যাবে না। এসব ভেবে মায়া কিচেনের কথা বলে আবারও উঠে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সবাই ডিনারের জন্য নিচে এলো। রিয়াও নিচে এসে সোজা ডাইনিং টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। যেন সে এবাবাড়ির মেহমান। ব্যাপার টা মায়ার কাছেও কেমন যেন লাগলো। বাড়ির বউয়ের এমন উদাসীনতা টা কেমন চক্ষুসুলভ মনে হলো না। অন্তত বাড়ির কাজে কিছুটা হেল্প তো করা উচিত। মায়া আরও একটা বিষয় খেয়াল করলো। রিয়া অরণ্যের ব্যাপারেও কেমন উদাসীন। অরণ্য সেই কখন অফিস থেকে ফিরেছে। অথচ রিয়ার সেদিকে কোন উদ্বেগই নেই। থাক, আমার এসব ভেবে লাভ নেই। এটা ওদের পার্সোনাল ব্যাপার।

খাবার টেবিলে সবাই এসে বসেছে মায়া তনিমা আর এলিসা বেগমের হেল্প করছে খাবার সার্ভ করতে। সারা এসে মায়াকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসালো। পাশেই অরণ্য বসেছিল। মায়া পাশে বসতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগলো অরণ্যের নাকে। ঘ্রাণ টা কেমন নেশা ধরানো। যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে। অরণ্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা সত্যিই অনেক ভালো। আজ এতো কাছ থেকে মায়াকে দেখতে পাচ্ছে, আর কি চাই ওর।

সার্ভ করা হলে তনিমা বেগম আর এলিসাও খাবার খেতে বসে পড়লো। এ বাড়িতে সাধারণত সবাই একসাথেই খায়। খাবার খেতে নিয়ে এলিসা বেগম হঠাৎ কাজের মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা নিলু শোন আমার খাবারে চুন (নুন) কম দিয়েছিস তো? তুই তো জানিস আমি আবার বেশি চুন খেতে পারি না। চুন বেশি হলে আমার সমচা (সমস্যা) হয়। পেটে জমজ (হজম)হতে সমচা হয়।

এলিসা বেগমের মহান বাণীতে বাকি সবাই তেমন অবাক না হলেও, বেচারি মায়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এলিসা বেগমের সবকথা মাথার ওপর দিয়ে বাউন্সার গেল। মায়া সারার কানে আস্তে করে বললো।
–এলিসা আন্টি কি প্রেগন্যান্ট নাকি? আর ওনার পেটে কি জমজ বাচ্চা আছে?

মায়ার কথায় সারা উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। মায়া বেচারি আবারও থতমত খেয়ে গেল। সবাই সারাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? সারা কোনরকমে হাসি থামিয়ে সবাইকে মায়ার বলা কথাটা বললো। এবার বাকি সবাইও হেঁসে দিল। সাহিল তখন মায়ার উদ্দেশ্যে বললো।
–আরে বিয়াইন সাহেবা আপনি তো দেখছি চরম বিনোদন দিতে পারেন। আমাদের জমবে ভালোই। তো বিয়াইন সাহেবা আসলে আমাদের এলিসা মামী ফরেনার তো। তাই বাংলা ঠিকমতো বলতে পারে না।

সাহিলের বিয়াইন বলাটা অরণ্যের কেমন যেন পছন্দ হলো না। তাই অরণ্য বলে উঠলো।
–এসব বিয়াইন টিয়াইন শুনতে কেমন অড লাগে। এসব বলার দরকার নেই।

সাহিল মুচকি হেসে বললো।
–ওকে ভাই। এমনিতেও আমি মজা করছিলাম। সবসময় কি আর এভাবে সম্বোধন করতাম নাকি।

এভাবেই হাসি আনন্দের সাথেই সবাই খাওয়া দাওয়া করতে লাগলো। সবাইকে এভাবে একসাথে হাসিখুশি দেখে মায়ার মনে হলো, ঠিক এমনই একটা পরিবার সে নিজের জন্য চেয়েছিল। যেখানে সবাই মিলেমিশে হাসিখুশি থাকবে। কেও কাওকে ছোট করে দেখবে না। দুর্ভাগ্যবসত আজ এমন একটা পরিবার পেয়েও সে পেল না। হয়তো তার কপালে পরিবারের সুখই নেই। কথাগুলো ভেবে বুক চিঁড়ে এক হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মায়ার। খাবার শেষ হলে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল মায়া। এদের সাথে যত কম জড়ানো যায় ততই ভালো। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে কি লাভ।
_______

মায়ার অভ্যাস অনুযায়ী সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল ওর। সারা আর রাইসা এখনো ঘুমে কাঁদা। মায়া ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গায়ের চাদর টা ঠিক করে টেনে দিল। মেয়েগুলো সত্যিই ভারী মিষ্টি। কতরাত পর্যন্ত গল্প করে করে তারপর ঘুমিয়েছে। মায়া বিছানা ছেড়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালো। সকাল বেলার প্রাকৃতিক ঠান্ডা বাতাস টা ওর কাছে অনেক ভালো লাগে। তাই রোজকার মতো আজও ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে চলে এলো। ব্যালকনিতে এসে দুই হাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির ঠান্ডা শীতল বাতাস অনুভব করতে লাগলো। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর মায়া চোখ খুলে ফিরে আসতে নিলেই পাশের বারান্দায় চোখ পড়লো ওর। সারাদের রুম আর অরণ্যের রুমের ব্যালকনি পাশাপাশি হওয়ায় এক ব্যালকনি থেকে আরেক ব্যালকনিতে দেখা যায়।

মায়া দেখলো অরণ্য ব্যালকনির ডিভানে ঘুমিয়ে আছে। এটা দেখে একটু অবাক হলো মায়া। উনি কি সারারাত এখানেই ছিলেন? কিন্তু কেন? আচ্ছা উনি কি রোজই এখানেই ঘুমান? না না কিসব ভাবছি? রোজ কেন এখানে ঘুমাতে যাবেন? হয়তো এমনি কোন কাজে এসে এখানে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমনিতেও এসব বিষয়ে আমার না ভাবাই ভালো। তাই মায়া আর দাঁড়িয়ে না থেকে ফ্রেশ হতে চলে গেল।।

ইহান অনেকক্ষণ হলো এসেছে বাসায়। কিন্তু ইরিনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও। তাই এবার ইরিনের রুমের দিকেই পা বাড়ালো ও। ইরিনের দরজার কাছে এসে দেখলো দরজা খোলাই আছে তাই ইহান হাসিমুখে বলে উঠলো।
–হ্যাল্লো মাই ডিয়ার ইরাবতী…

কথাটা বলতে বলতে ইহান ইরিনের রুমে ঢুকে পড়লো। ইরিন বেডের ওপর বসে ছিল। হঠাৎ ইহানকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি করে নিজের চোখ মুছে নিল। তবে ইহানের চোখ ফাঁকি দিতে পারলোনা। ইহান ভ্রু কুঁচকে ইরিনের পাশে বসে চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়েছে ইরাবতী? কাদছ কেন? বলনা?

ইরিন জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
–কই কি হবে? কিছুই হয়নি।

–দেখ ইরাবতী মিথ্যে বলার চেষ্টা করোনা। তুমি জানো আমাকে বোকা বানানো অতো সহজ না। তাই জলদি করে বলো কি হয়েছে?

তখনই ইরিনের ফোন ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ম্যাসেজ দেখে ইরিন কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। ব্যাপার টা দেখে ইহান ভ্রু কুঁচকে ফোনটা খপ করে হাতে তুলে নিলো। ম্যাসেজ টা দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। ম্যাসেজ টা ইরিনের এক্স হাসবেন্ড এর। ম্যাসেজ এ লেখা আছে,
“আমাকে জেলে পাঠিয়ে ঠিক করোনি তুমি। এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। তুমি কি ভেবেছ আমার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে গেছ? কখনোই না। অনেক জলদি আমি আবারও আসবো”

ইহান ইরিনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো।
–এই হারামিটা ছাড়া পেল কবে?

ইরিন বলে উঠলো।
–গতকাল।

–তারমানে কাল থেকে ওই রাসকেল টা তোমাকে এইসব থমকি ভরা ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে?

ইরিন আলতো করে মাথা ঝাকালো। মানে হ্যাঁ। ইহানের রাগী কন্ঠে বললো।
–আর তুমি কাওকে কিছু না বলে একা একা কেঁদে যাচ্ছো তাইনা? আমার তো ওর থেকে বেশি তোমার ওপর রাগ হচ্ছে। তোমার সাহস কি করে হলো ওর মতো বিচকে ভয় পাওয়ার? তোমার ওর প্রতি এই ভয়টাই ওর আসল জিত তা জানো তুমি?

ইরিন কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো। ইহান একটু শান্ত হয়ে বললো।
— আচ্ছা একটা কথা বলোতো। তুমি কখনো ওকে গালি দিয়েছ?

ইরিন একটু থতমত খেয়ে বললো।
–কি বলছ এসব? আমি আর গালি? কখনোই না।

— ঠিক আছে তুমি ওই রাসকেল টাকে এখুনি ফোন করো।

ইরিন ইহানের দিকে চমকে তাকিয়ে বললো।
–কিহহ? কি বলছ এসব? আমি কেন ওকে ফোন করবো? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?

–আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আর আজ তোমার মন মস্তিষ্কও একদম হালকা করে দেবো দেখ। তুমি হয়তো ওই মুভি দেখোনি যেখানে কারিনা তাঁর পুরানো প্রেমিক কে মন খুলে ইচ্ছে মতো গালি দেয়। এবং তার মনের সব ধাপ বের হয়ে একদম হালকা হয়ে যায়। তুমিও আজ ট্রাই করো দেখবে একদম মন হালকা হয়ে যাবে।

–কিসব আবোল তাবোল বলছ? এমনটাও হয় নাকি?

–আরে হয় হয়। তুমি ট্রাই তো করে দেখ। বায়দা ওয়ে তুমি গালি দিতে পারো তো?

–না না ছি ছি। আমি জীবনেও গালি গালাজ করিনি।

–আচ্ছা ব্যাপার না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে একটা কাগজে হাই লেভেলের কিছু এক্সট্রা পাওয়ারফুল গালি লিখে দিচ্ছি। যেটা শুনে ওই রাস্কেলের কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে যাবে।

কথাটা বলে ইহান একটা কাগজে গালি লেখা শুরু করে দিলো। লেখা শেষে ইরিনকে বললো তাকে ফোন করতে। ইরিন এখনও ইতস্তত করছে। বারবার মানা করছে কিন্তু কে শুনে কার কথা। শেষে ইহান নিজেই ইরিনের এক্স হাসব্যান্ড এর নাম্বারে ফোন দিয়ে লাউড স্পিকারে দিয়ে ইরিনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। ইরিন এখনো প্রচুর নার্ভাস। হাত কেমন কাপছে। ফোনে কল ঢুকছে। এবং একসময় কল রিসিভ হলো। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে লোকটি বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার ইরিন সোনা, এতো জলদি আমার কথা মনে পড়ে গেল? ভয় পেয়ে গিয়েছ বুঝি তাইনা? এতই যখন ভয় পাও তাহলে আমাকে জেলে দেওয়ার সাহস কি করে পেলে তুমি?

ইরিন ভয়ে বারবার ঢোক গিলছে। ওর চোখের সামনে ওই লোকটার নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য গুলো ভেসে উঠছে। ইহান শুধু বারবার ইরিনকে গালি দেওয়ার ইশারা করছে। ইরিন কোনরকমে নিজেকে একটু শক্ত করে কাগজের দিকে তাকালো।

ওইপাশের লোকটা এখনো বলেই যাচ্ছে।
–যাইহোক আমাকে যদি আর রাগাতে না চাও তাহলে জলদি আমার কাছে চলে…

আর বলতে পারলোনা লোকটা। ইরিন কাগজের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
–কু কুত্তা..

–হোয়াট??

–কুত্তা, হারামি,

লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো।
–এই এই কি বলছিস এসব?

–সয়তান,কাপুরুষ, নাজায়েজ বাপের জারজ সন্তান…
ইরিন আবারও গালি দেওয়া শুরু করলো। ধীরে ধীরে ইরিনের কনফিডেন্স আসা শুরু হলো। নিজের মনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ পেতে লাগলো। নিজের সাথে করা জুলুম গুলোর কথা মনে করে এবার ক্ষিপ্ত সুরে বলতে লাগলো।
–মাতা*** পু*, শুয়ো** হাজারো বাপের একমাত্র সন্তান।আরে তোকে জানোয়ারের গালি দিলে জানোয়ার কেউ অপমান করা হবে। তোর সাহস কি করে হলো আমাকে ম্যাসেজ দেওয়ার ? তুই কি ভেবেছিস তোকে দেখে আমি ভয় পেয়ে যাবো? সালা নামরদ, তোকে ভয় পাবে আমার জুতা। আর কোনদিন যদি আমার নাম্বারে ম্যাসেজ বা ফোন দিয়েছিস, তাহলে বাড়িতে এসে চাকু দিয়ে তোর পেট কেটে তোর নাড়িভুড়ি টেনে বের করে তোকে নর্দমায় ফেলে দিয়ে আসবো। সালা ইতর, গন্ডারের বাচ্চা, জানোয়ারের পটি খাইয়ে দেব তো…

ব্যাস আর শুনতে পারলোনা বেচারা। ওর কানে যেন বোম ফাটছে। তাই ঠাস করে ফোনটা কেটে দিল।

ইরিনের যেন সত্যিই অনেক হালকা লাগছে। মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেক শান্তি লাগছে। ইহান ওর দিকে তাকিয়ে বললো।
–কেমন লাগছে এখন? ভালো লাগছে না?

ইরিন হঠাৎ আবেগি হয়ে ইহানকে জড়িয়ে ধরলো । যদিও এটা শুধুই একটা ফ্রেন্ডলি হাগ ছিলো। তবে ইহানের কাছে যে এটাই পরম পাওয়া। ইহানের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। ইহান আলতো করে নিজের হাতটা ইরিনের পিঠে রেখে চোখ বন্ধ করে মুহূর্ত টা অনুভব করতে লাগলো। মনে হচ্ছে সময় টা এখানেই থেমে যাক। ইরিন সারাজীবন এভাবেই ওর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থাকুক।

একটু পরে ইরিন ইহানকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
–সরি আমি একটু বেশিই আবেগি হয়ে পড়েছিলাম। থ্যাংক ইউ সো মাচ ইহান। আজ সত্যিই অনেক হালকা লাগছে। তুমি না বললে হয়তো আমার মাঝে এতো সাহস কখনোই আসতো না।

ইহান দুষ্টু হেসে বললো।
–দেখেছ আমি কতো ট্যালেন্টেড বান্দা।এখনো বলছি আমাকে বিয়ে করে নাও। লাইফ সেট হয়ে যাবে।
কথাটা বলে ইহান একটা চোখ টিপ মেরে দিল।

আর সবসময়ের মতোই ইরিন হাসির ছলে সব উড়িয়ে দিল। আর ইহান মায়া ভরা চাহনিতে তার ইরাবতীর হাসি দেখতে লাগলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here