#মায়ারণ্যে,পর্ব-২৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
ইরিন কে টানতে টানতে নিয়ে এসে ইরিনের রুমে এলো। দরজা আটকে দিয়ে ইরিনকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে ইহান বলে উঠলো।
–কি করতে চাইছিলে তুমি হ্যাঁ? তোমাকে একটু ছুট কি দিয়েছি তুমিতো দেখছি পালানোর প্ল্যান করে নিয়েছো। কোন সাহসে তুমি ওই বুড়োকে বিয়ে করতে রাজি হলে হ্যাঁ? আমাকে বিয়ে করতে তোমার সমস্যা। অথচ ওই বুড়োটার সামনে সঙ সেজে বসে থাকা হচ্ছে তাইনা? খুব শখ জেগেছে অন্যকে নিজের রুপ দেখানোর? বলো?
ইরিন মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো।
–কি হচ্ছে এসব? ছাড়ো আমাকে। আমার জীবন, আমি যা খুশী তাই করবো। তুমি বলার কে?
–আমি কে তাইনা? শুধু আজ রাত টা পার হতে দাও তারপর বুঝিয়ে দেবো আমি কে? কালই যদি তোমাকে বিয়ে না দেখিয়েছি তাহলে আমার নামও ইহান না।
–এটা কখনোই হবে না। কারণ আমি এই বিয়েতে কখনোই রাজি হবো না।
–আর তোমার এটা কেন মনে হচ্ছে যে, তোমার চাওয়া না চাওয়াই কিছু যায় আসে। অনেক হয়েছে ভালো মানুষি।অনেক রিকুয়েষ্ট করেছি তোমাকে। আর না। এখন তুমি রাজি হও বা নাও বিয়েতো তোমার আমাকেই করতে হবে। বাই হুক, অর বাই ক্রুক। দরকার হলে হাত পা বেঁধে জোর করে বিয়ে করবো। তবুও বিয়েতো আমি তোমাকেই করবো।
–দেখ ইহান পাগলামি করো না। তোমার মা তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। তোমার ফুপির মেয়ে। তাঁকে বিয়ে করে জীবনে সুখী হও। আর আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও।
ইহান ভ্রু কুঁচকে বললো।
–বিয়ে? কিসের বিয়ে? আর মা এসব তোমাকে বলেছে?
–হ্যাঁ। আন্টি কাল বাসায় এসেছিল।
–ওও আচ্ছা। তো এই ব্যাপার। আর এইজন্যই বুঝি তুমি ওই বুড়োকে বিয়ে করে আমার লাইন ক্লিয়ার করতে চাইছিলে তাইনা? তবে তুমি হয়তো এটা জানো না। তোমাকে ছাড়া আমি কখনো কাওকেই বিয়ে করবোনা। আর আজ তোমার এই ঘটনার পরে তো আর এক সেকেন্ডের জন্যেও তোমাকে একা রাখার রিস্ক নিবো না। কালই তোমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবো।
–কখনোই না। আমি এই বিয়েতে কখনোই রাজি হবো….
আর বলতে পারলোনা ইরিন। ইরিনের না বলার আগেই ইহান ওর ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। রাগের মাথায় ইরিনের ঠোঁটে কামড় বসালো ইহান। সব ক্ষোভ ছাড়তে লাগলো ইরিনের ঠোঁটে। ইরিনের ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। ইরিনের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে ইহানের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। কিছুক্ষণ পর ইহান ইরিনের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বললো।
–এরপর থেকে যতবার না বলার চেষ্টা করবে।এই শাস্তিটাই পাবে। তাই না বলার আগে একটু ভেবেচিন্তে বলো। যদিও আমার তোমাকে বারবার এই শাস্তি দিতে ভালোই লাগবে। আর হ্যাঁ এটা তোমার আরেকটা অপরাধেরও শাস্তি। বুড়োটার সামনে এভাবে সেজেগুজে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে বসেছিলে না? এটা তারই শাস্তি। পরবর্তীতে আর এমন কিছু করার চেষ্টা করলে শাস্তি আরও বেশি ভয়াবহ হবে।
ইহান এবার বুড়ো আঙুল দিয়ে স্লাইড করে ইরিনের ঠোঁটের রক্ত মুছে দিয়ে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো।
–ভালোবাসি ইরাবতী। এবার আর তোমাকে কিছুতেই দূরে যেতে দিবো না। কিছুতেই না।
কথাটা বলে ইরিনের কপালে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ইহান।
আর ইরিন ওখানেই দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো। কাল কি হতে যাচ্ছে জানা নেই ওর। তবে ইহানের আজকের পাগলামি দেখে ইরিন বুঝে গেছে। ইহান ওকে এতো সহজে ছাড়বে না। কিন্তু ও কি পারবে ইহানের সাথে নতুন সম্পর্ক গড়তে?
পরদিন সকালেই ইহান ওর কথামতো ওর মা বাবাকে নিয়ে হাজির। যদিও ইহানের অনেক খাটতে ওর মা বাবাকে মানাতে। ইহানের মা তেমন আপত্তি না জানালেও ওর বাবা রাজি হচ্ছিল না। ইহানও কম যায় না। পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিল। এমনকি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে। অগত্যা ছেলের জেদের কাছে হার মেনে যায় ইহানের বাবা। ছেলে যে বিয়ে করবে এটাই এখন বড়ো ব্যাপার। তাই শেষমেশ দুজনেই রাজি হয়ে যায়।
ইরিনের মা বাবাও খুব খুশী এই সম্বন্ধে। ইহানের মতো একটা ছেলে তাদের মেয়ের জীবনসঙ্গী হলে এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে। সবাই খুশির সহিত ওদের আপ্যায়ন করছে। ওরা আজকেই ইহান ইরিনের বিয়ে করাতে চায়। ইরিনের মা বাবারও কোন আপত্তি নেই।
রাইসাও ওর হাসব্যান্ড নিশান এর সাথে এসেছে। রাইসা আর মায়া মিলে ইরিনকে রেডি করছে। ইরিনের ভেতর আপাতত কোন অনুভূতি কাজ করছে না। কেমন মৌন হয়ে বসে আছে। খুশী বা নারাজি কোনটার আবির্ভাব ঘটছে না। মনের মাঝে কি চলছে তা নিজেও জানে না ইরিন। সবকিছুই কেমন এলেমেলো অগাছালো।
ইরিনকে এমন চুপচাপ দেখে মায়া ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো।
–আপু তুমি আমার বড়ো। যদি কিছু মনে না করো তাহলে কিছু কথা বলতে চাই।
ইরিন বললো।
–হ্যাঁ বলোনা।
–আপু আমি জানি তোমার মনের মাঝে কি ঝড় চলছে। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন আমিও হয়েছি। যেখানে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক সেটার সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল হয়ে যায়। আমি মনে করি হয়তো আমার জন্য সামনের ব্যাক্তির জীবনে খারাপ ইফেক্ট পরবে। মনে করি আমি তার যোগ্য না। সে হয়তো আমাকে চেয়ে ভুল করছে। আমার কাছ থেকে দূরেই হয়তো সে ভালো থাকবে। আমি নিজের মতো এসব ভেবে বসে থাকি। অথচ হয়তো পরিস্থিতি তার উল্টো। আমি যা ভাবছি ভুল ভাবছি। সামনের ব্যাক্তির জীবন হয়তো আমার জন্য নষ্ট না বরং আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। আমি কারও দুঃখের না বরং সুখের হয়ে উঠবে। তুমি নিজেই দেখেছ আমার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তোমার ভাই কতটা কষ্ট ভোগ করেছে। যার অপরাধ বোধ সারাজীবন আমার মনে থেকে যাবে। আমি চেয়েও সেটা ভুলতে পারি না। তাই বলছি তুমিও আমার মতো সেই ভুলটা করোনা। নিজেকে ইহান ভাইয়ার ভুল না ভেবে তার জীবনের খুশী ভাবো।নিজেকে এতো ছোট ভেবনা। তোমাকে পেয়ে সে অসুখী না বরং সুখীই হবে। তাই তাকে মন থেকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করো। দেখবে দুজনেই অনেক সুখী হবে। ইহান ভাইয়ার চোখে আমি তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। তুমি শুধু একটা কদম বাড়াও। দেখবে সে তোমার জন্য হাজার মাইল দৌড়ে আসবে।
মায়ার কথায় ইরিনের এলোমেলো চিন্তাধারা গুলো কেমন সঠিক পথে আসতে শুরু করলো। তবে কি মায়া ঠিক বলছে? ইহান কি সত্যিই আামকে এতটা ভালোবাসে? আমি কি পারবো পূর্ণ রুপে ইহানের অর্ধাঙ্গিনী হতে। ওকে সুখী রাখতে।
ইরিনের ভাবনার মাঝেই অরণ্য পেছন থেকে এসে বললো।
–মায়া ঠিকই বলেছে আপু।
অরণ্যের কথায় ইরিন অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্য এগিয়ে এসে ইরিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ইরিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো।
–মায়া ঠিকই বলেছে আপু। ইহান সত্যিই তোকে অনেক ভালোবাসে। আর এটা আমার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ জানে না। আমি অনেক বছর আগেই বুঝে গিয়েছিলাম ইহান তোকে অন্য চোখে দেখে। তবে ও কিন্তু আমাকে কখনো এই ব্যাপারে কিছু বলে নি। তবুও আমি বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি এই ব্যাপার ওর সাথে কখনো কথা বলিনি। কারণ এতে আমাদের অকওয়ার্ডনেস চলে আসতো। ভেবেছিলাম সময় আসলে ও নিজেই বলবে। কিন্তু আমরা বিদেশে যাওয়ার পর তোমার সাথে এসব হয়ে গেল। তাই আর ও কখনো একথা বলেনি। আর আমিও কিছু বলিনি। তুমি হয়তো জানো না আপু যেদিন তোমার বিয়ের খবর আমরা শুনেছিলাম সেদিন ওর অবস্থা অনেক করুন হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। পুরো একটা সপ্তাহ হসপিটালাইজড ছিল ও। পরে ও সুস্থ হলেও মানুসিক ভাবে অনেক ভেঙে পরেছিল। সারাদিন ঘরের ভেতর বন্দী থাকতো।কারো সাথে কথা বলতো না। ওর নরমাল হতে অনেক সময় লেগেছিল। এবার ভাবো কতটা ভালোবাসে ও তোমাকে। আজ পর্যন্ত ও কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেনি। সবসময় শুধু তোমাকেই ভালোবেসে এসেছে। এবার ওর ভালোবাসাকে সফলতা দাও আপু।ওকে একটা সুযোগ দাও। দেখবে ও তোমাকে পেয়ে অনেক সুখী হবে। আর তোমাকেও সুখে রাখবে।
অরণ্যের কথাগুলো শুনে ইরিনের দু চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে। কেউ ওকে এতদিন ধরে এতটা ভালোবেসে এসেছে আর ও কিনা জানেই না। এবার ইরিনের মনের সব সংশয় পুরোপুরি দূর হয়ে গেল। ইরিন ওর সঠিক পথ খুঁজে পেল। সে নিজেকে আর ইহানকে দিবে আরেক টা চাঞ্চ।পুরানো সবকিছু ভুলে ইহানের সাথে সে নতুন করে পথ চলবে।
একটু পরে ইরিনকে নিচে নিয়ে আসা হয়। ইহান তাকিয়ে আছে ওর ইরাবতীর দিকে। আজ ফাইনালি সেই দিন এসে গেছে। যখন সে ইরাবতীকে নিজের করে পাবে। কাজী সাহেব আগেই চলে এসেছে। ইরিন এসে বসলে বিয়ে পড়ানো শুরু হয়। বিয়ের পর খাওয়া দাওয়া শেষে সবার কাছে বিদায় জানিয়ে চলে যায় ওরা।
ইহানের ঘরে বসে আছে ইরিন। কেমন যেন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে ওর। আসলে একটা মেয়ের যখন দ্বিতীয় বিবাহ হয়। তখন ব্যাপার টা আরও বেশি অকওয়ার্ড হয়ে ওঠে। অন্য একটা পুরুষের সাথে সহজে কম্ফোর্টেবল হতে পারে না। অনেক জড়তা কাজ করে। একটু পরেই ঘরে ঢুকলো ইহান। বুকটা হালকা কেঁপে উঠে ইরিনের। ইহান ঘরে ঢুকে কোনকিছু না বলে সোজা কাবার্ড খুলে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ইরিন একটু অবাক হলো ইহানের কাজে।
একটু পরে ইহান চেঞ্জ করে এসে ইরিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার তুমি বসে আছ কেন? চেঞ্জ করবে না? নাকি শাড়ী পড়েই ঘুমাবে?
ইহানের কথায় ইরিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ইহান এগিয়ে এসে ইরিনের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে বসে বললো।
–দেখ ইরাবতী। আমি জানি তুমি এখনো আমাদের সম্পর্ক টা মেনে নিতে পারোনি। তবে তুমি চিন্তা করোনা। আমি কখনো তোমার ওপর স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবো না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে এটাই আমার জন্য এনাফ। আর কোন দাবি নেই আমার। এখন তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে আরামে ঘুমিয়ে পড়ো।
কথাটা বলে ইহান বালিশ নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আর ইরিন শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। কেউ এতটা ভালো কিভাবে হয়। কই ওর প্রথম স্বামীতো প্রথম রাতেই ওর ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। একটা জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করেনি। তবে কি আমিই ভুল ছিলাম? সব ছেলেরা সত্যিই এক হয়না। ইরিনের খুব বলতে ইচ্ছে করছে, ইহান চাইলে বেডেও শুতে পারে। এতটুকু ভরসা আছে ওর ইহানের ওপর। কিন্তু কেন যেন জড়তার কারণে মুখ ফুটে সেটা বলতে পারলোনা ইরিন। অগত্যা উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে সে নিজেও শুয়ে পড়লো।
____
অরণ্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে রেডি হচ্ছে অফিসে যাওয়ার জন্য। আজ ওর খুবই ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে। মায়া ওর পাশেই ওকে হেল্প করছে। হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই অরণ্য মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–আরে আজকে তো তোমার রিপোর্ট আনার ডেট। আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। আর আমার তো অফিসে অনেক ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। এক কাজ করি মিটিং আজ ক্যান্সেল করে দেই।
মায়া বলে উঠলো।
–আরে না না মিটিং কেন ক্যান্সেল করবেন? আমি অন্য কারো সাথে চলে যাবো। আপনি চিন্তা করবেন না।
–কিন্তু…
–কোন কিন্তু না। প্লিজ নিজের কাজের কোন ক্ষতি করবেন না। আমি অন্য কারোর সাথে চলে যাবো।
অরণ্য মায়ার গালে হাত বুলিয়ে বললো।
–ওকে ঠিক আছে। তবে কিন্তু অবশ্যই যাবে। আমি সাহিলকে বলে যাবো,ও যাবে তোমার সাথে। বাসার গাড়ি নিয়ে যেও কেমন?
মায়া মুচকি হেসে মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। অরণ্য মায়ার কপালে চুমু দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
বেলা ১২ টা
মায়া সাহিলের সাথে হসপিটালে এসেছে। সাহিল বাইরে বসে আছে। মায়া ভেতরে ডক্টরের সামনে বসে আছে। ডক্টর রিপোর্ট গুলো চেক করছে। চেহারায় তার কেমন গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। মায়ার একটু ভয় লাগছে। রিপোর্টে কোন খারাপ কিছু এলোনা তো?
একটু পরে ডক্টর সাহেবা তার চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে দুই হাত ভাজ করে বলে উঠলো।
–আপনার সাথে কি আপনার হাসব্যান্ড এসেছে?
–জ্বি না ডক্টর। উনি একটু কাজে ব্যাস্ত ছিল তাই আসতে পারেনি। কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলুন।
–দেখুন আপনার জরায়ুতে অনেক গুলো কমপ্লিকেশন আছে। অনেক দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, আপনি ভবিষ্যতে কখনো মা হতে পারবেন না।
মায়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। পুরো শরীর যেন অসার পাথর হয়ে এলো। কানের ভেতর এখনো শুন শন
করছে। হাত পা অসম্ভব কাপছে। এ এটা কি শুনছে ও? না না এটা হতে পারে না। আমি মা হতে পারবো না? মায়া ধরা গলায় বললো।
–আ আপনার নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আ আপনি প্লিজ আরেক বার চেক করুন। রিপোর্টে কোন ভুল হয়নিতো?
–দেখুন ম্যাম আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি।তবে এটাই সত্যি। রিপোর্টে কোন ভুল নেই।
মায়ার সামনে পুরো পৃথিবী যেন গোলগোল ঘুরছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। এমন কেন ওর নিয়তি? সুখের সময়কাল এতো কম কেন ওর জীবনে? মাত্রই তো সুখের মুখ দেখেছিল ও। আবারও নতুন ঝড় এসে ওর সবকিছু এলোমেলো করে দিল। এবার কি করে ঠিক করবে ও? এতো বদনসিব কেন ও? কেন ওর সাথেই বারবার এমনটা হয়?
সন্ধ্যা ৭ টা।
ব্যালকনির গ্রীল ধরে বসে আছে মায়া। শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে ও। কাওকে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে ও। বলবেই বা কি? এই বাড়ির বউ তাদের কে নতুন প্রজন্মের মুখ দেখাতে অক্ষম। কোন মুখে বলবে এই কথা? আর অরণ্য? তাকেই বা কিভাবে বলবে যে এই মুখপুড়ি তাকে কোনদিন বাবা হওয়ার সৌভাগ্য দিতে পারবে না। তাকে আমি কষ্ট ছাড়া কোন খুশীই দিতে পারিনি।আমার মতো কুলক্ষণে বউ হয়তো দুনিয়াতে আর একটা নেই। আমি কাউকে কোন খুশি দিতে পারি না। আমি মরে কেন যাইনা?
দরজায় নক পরার শব্দে বুক কেঁপে উঠল মায়ার। ও জানে এখন অরণ্যই এসেছে।এখন অরণ্যকে কি বলবে ও? অরণ্য নিশ্চয় এসে রিপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইবে। অরণ্যের সামনে নিজেকে কিভাবে ঠিক রাখবে ও? তবুও নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে নিজেকে একটু নরমাল করে নিয়ে দরজা খুলে দিল। অরণ্য ভেতরে ঢুকে বললো।
–কি ব্যাপার? দরজা লক করে ছিলে কেন? শরীর কি বেশি খারাপ করছে?
মায়া জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
–না না তেমন কিছুই না। আমি একদম ঠিক আছি। আসলে একটু শুয়ে ছিলাম তো তাই দরজা লক করে ছিলাম।
–ওও আচ্ছা। তা তোমার রিপোর্ট সব ঠিক আছে তো? ডক্টর কি বললো?
মায়া একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো।
–আ আরে আপনি এসেই কি রিপোর্ট নিয়ে বসে পরলেন? আগে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিন। তারপর বাকি সব হবে।
অরণ্য মুচকি হেসে বললো।
–ঠিক আছে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর রিপোর্ট দেখবো।
কথাটা বলে অরণ্য ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে। মায়ার এদিকে হাত পা কাঁপছে। কিভাবে ও অরণ্যকে এই কথাটা বলবে? নিউজ শুনে নাজানি কতবড় থাক্কা খাবেন উনি। উনার তো মনটাই ভেঙে যাবে। আমি সত্যিই একটা অপয়া। উনার এত ভালোবাসার বিনিময়ে, উনাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারি না আমি। নিজেকে এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো বোঝা মনে হচ্ছে।
একটু পরেই অরণ্য ফ্রেশ হয়ে বের হলো। তারপর বেডের ওপর বসে মায়ার উদ্দেশ্যে বললো।
–কই এখন নিয়ে এসোতো রিপোর্ট গুলো। দেখি কি এসেছে রিপোর্টে। আর ডক্টর কি বলেছে তোমাকে?
মায়া আবারও কথা ঘোরানোর জন্য বলে উঠলো।
–আগে খাওয়া দাওয়া করে নিন।তারপর ওসব দেখবেন। তেমন জরুরি কিছুই না।
–না না আমাকে দেখাও আগে। নাহলে আমার স্বস্তি হবে না।
এবার কি করবে মায়া? এখন তো আর কোন বাহানাও দিতে পারছেনা। তাই অগত্যা উঠে গিয়ে কাবার্ড থেকে রিপোর্টের ফাইল টা কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে এনে অরণ্যের দিকে এগিয়ে এলো। বুকটা কাঁপছে ওর। অরণ্যের কষ্টের কথা ভেবে মায়ার হাজারও মরমে মরছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইল টা অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিল মায়া। অরণ্য হাত বাড়িয়ে ফাইল টা নিতে যাবে তখনই হঠাৎ বাইরে থেকে কিছু হৈচৈ এর শব্দ এলো ওদের কানে। দুজনেই ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, কি হয়েছে বাইরে। ব্যাপার টা দেখার জন্য ফাইল রেখে দুজনেই বাইরে বেড়িয়ে এলো।
নিচে এসে দেখলো ড্রয়িং মাঝখানে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াকে দেখে অরণ্যের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অরণ্য রাগী কন্ঠে বললো।
–এই নির্লজ্জ মেয়েটা এখানে কি করছে? ওকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে কে?
রিয়া তখন উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–আমি এখানে ইচ্ছাকৃত ভাবে আসিনি। আসতে বাধ্য হয়েছি। কারণ এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। আপনার দায়িত্বের ভার তো আপনাকে নিতেই হবে।
অরণ্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মানে???
–মানে, আমি প্রেগন্যান্ট। আমার গর্ভে আপনার সন্তান।
রিয়ার কথায় যেন সবার মাথায় বাজ পড়লো। সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল।
চলবে….