#একটুখানি_আশা,পর্ব ৫,৬
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
#পর্ব ৫
রাশিদা আহমেদ একনাগাড়ে মুখ চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। পাশেই বাকিরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মুন গিয়ে তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-‘মা তুমি এভাবে কান্না করলে আমার কী যেতে মন চাইবে? কান্না করো না তো, আমাদের প্রতিদিনই কথা হবে, আমাকে প্রতিদিন দেখতে পারবে।’ মুন দুইহাতে ওর মায়ের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল।
-‘দেখতে পারবো কিন্তু ছুঁতে তো পারবো না।’
-‘আহা মা। কয়েকবছরেরই তো ব্যাপার।’
রাশিদা আহমেদ চোখ মুছে নিয়ে নাক টেনে বলল,’প্রতিদিন সময় করে কল দিবি, খাবার ঠিকমতো খাবি, খাবারের অনিয়ম করবি না একদম।’
মুন রাশিদা আহমেদকে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ালো। তাঁর ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে কয়েকবছর আর এই মাকে সে পাশে পাবে না, ছুঁতে পারবে না, জড়িয়ে ধরে মায়ের আঁচলের ঘ্রান নেওয়া হবে না, এটা-সেটার বায়না ধরা হবে না। মুন মনে মনে ভেঙে পড়ছে কিন্তু উপরে সে শক্ত। দূরেই বিদায় দেওয়ার জন্য শফিক আহমেদ দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো বা কান্না করছে, কান্না ঢাকার জন্যই ঐখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মুন একে একে চাচা, চাচি থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা ধরলো। পাশেই আরিফা মুনের হাত ধরে আছে।
-‘আপু আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আর কিছু সময় পর তোমাকে আর পাবো না।’
-‘আরে সবসময় কথা হবে আমাদের।’
-‘তোমাকে ছাড়া আমার একা একা লাগবে আপু।’
-‘কেন রিহান আছে না?’ মুন হাসি চেপে ধরে বলল।
আরিফা মুনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই মুন আরিফাকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠলো।
বাবার কাছে যেতেই তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’ঠিকমতো থাকবে মা। বাবার দোয়া সবসময় তোমার সাথে আছে।’
হঠাৎ উপরে মনিটর থেকে আওয়াজ আসলো বোর্ডিং আওয়ার শেষ, যাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে স্পিকারে বলছে। মুন উঠেই সবাইকে সালাম করে নিলো। যাওয়ার সময় কোনো কথা বলতে পারছে না। এতক্ষন উপরে শক্ত থাকলেও এখন আর পারছে না। কান্নারা যেন গলায় আটকে আসছে। নিজেকে যতাসম্ভব শান্ত রেখে মুন সবাইকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে পড়লো। অস্বচ্ছ কাঁচের দরজা দিয়ে কিছুসময় বাবা-মার দিকে তাকিয়ে রইল মুন। বাবা-মা ওখানে দাঁড়িয়েই হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে।কাঁচ দিয়ে ঝাপসা দৃশ্যটুকু আবদ্ধ করে নিলো মুন । এরপর পা বাড়ালো নতুন জীবন সন্ধানের উদ্দেশ্যে।
সবকিছু ঠিকঠাক করে প্লেন ছাড়তেই মুন জানালা দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে নিলো। এখন বাবা-মায়ের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু এটা যে তাঁর ইচ্ছে। ছোটকাল থেকেই এই ইচ্ছেটা মনের ভেতর পোষণ করে আসছিলো মুন। আহানের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মনে করেছিলো সবকিছু এখানেই শেষ। কিন্তু না! সে আবার সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগটা আর হাত ছাড়া করতে চায়নি মুন। আর আহান আগে-পরে কিছুদিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাবে। তখন সে আবারও আসবে। এতকিছুর পরেও এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। সবকিছুর উপরই আল্লাহ ভরসা। মুন জানে না ওই ভিনদেশে সে কীভাবে থাকবে! অবশ্য ফুফি আছে। শুনেছে ফুফির না-কি দুইটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে। ছেলে একটা মুনের বড় আর দুজন যমজ। দুজনেই মুনের একবছরের ছোট। ফুফিকে কলে দেখলেও এদেরকে দেখা হয়নি। মুন জানে না এদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কীনা, মিলেমিশে থাকতে পারবে কিনা, অস্বস্তি হচ্ছে। মুন এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
সাউন্ড আর ঝাঁকুনি অনুভব হতেই মুনের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেই দেখল প্লেন ল্যান্ড করছে আর সাউন্ডে বলছে। একে একে সবাই নামার পরে মুনও নামল। নেমেই দেখল একেকজন একেকদিকে চলে যাচ্ছে। সবকিছুর উপর মাথায় আসলো তাঁর ফুফি তাঁকে নিতে আসবে। কিন্তু আশে-পাশে খুঁজে ফুফিকে দেখতে পেলো না মুন। এখন জাপানের সকাল। মুন এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে কাওকে না পেয়ে এক জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। মুনের এখন ভীষণ ভয় লাগছে। এই অচেনা দেশে ওর ফুফি ছাড়া আর কেউ পরিচয় নেই। ফুফির বাসার ঠিকানাও নেওয়া হয়নি, ফুফি বলেছিলো উনি নিতে আসবে। মুন চারদিকে তাকালো। কান্না পাচ্ছে খুব। কী করবে ও এখন? ভাবতেই ভয়ে দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো মুনের। মুন মাথা নিচু করে রইল। হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে মুন মাথা উঁচু করে দেখল এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। মুন তাকাতেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,’মুন? রাইট?’
মুনের যেন এতক্ষনে কলিজায় পানি আসলো। সে তাড়াতাড়ি করে চোখের পানিটুকু মুছে নাক টেনে যুবকটির দিকে তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়লো। মুন বুঝতে পারলো ইনি হয়তো ফুফির বড়ো ছেলে।
যুবকটি মুনকে ইশারায় ওর পিছনে হাটতে বলে পা বাড়াতে নিলেই মুন ডাক দিল। মুনের ডাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই মুন তাঁর পাশের ব্যাগটা ইশারা করল। মুন এত ভারী ব্যাগটা তুলতে পারছে না।
যুবকটি ব্রু কুচকে মুনের সামনে এসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল,’আমাকে কী চাকর মনে হয় যে তোমার ব্যাগ আমি বহন করব?’
মুন ওর কথা শুনে বোকা বোকা চাহনি দিয়ে ‘না’ বোধক মাথা নাড়ালো। ‘অতিথিকে কই সম্মান করে কথা বলবে তা তো দূর ব্যাগটা পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছে, কেন কান্না করছিলাম একটু ভদ্রতা দেখিয়ে জিজ্ঞেসও করল না। একটু হেসে পরিচয়ও হলো না।’ মুন আপন মনে বিড়বিড় করে উঠলো।
যুবকটি আর কিছু না বলে ওভাবেই মুনকে ফেলে হাঁটা ধরলো। মুন তা দেখে কোনোমতেই ব্যাগটা নিয়ে ওর পিছনে দৌড় দিল।
গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছাড়লো যুবকটি। মুন আড়িচোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কাটলো।
গাড়ি এসে একটা সুন্দর বাড়ির সামনে এসে থামলো। যুবকটি গাড়ি থেকে নেমে মুনকে ফেলে আগে আগে হেটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। মুন কোনোমতে ব্যাগটা নামিয়ে দরজার কাছে যেতেই ফুফি ব্যাগটা টেনে মুনের হাত থেকে নিয়ে একটা মহিলাকে ডেকে রুমে রেখে আসতে বলল। ফুফি মুনের মুখে হাত রেখে হাসি-মুখে বলল,’কত্ত বড়ো হয়ে গিয়েছিস আমার মুন মা-টা। কেমন আছিস মা? আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? রাফিন কোনোভাবে কী গাড়ি স্পিডে চালিয়েছে?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ফুফি। আরে না সমস্যা হয়নি। ঐটা কে?’
-‘এটা আমার বড়ো ছেলে রাফিন । পরিচয় হসনি?ছেলেটা একটু বেশিই গম্ভীর। আচ্ছা তুই আমার সাথে আয়। অনেক টায়ার্ড মনে হচ্ছে তোকে। আয় রুম দেখিয়ে দিই।’
মুন মাথা নেড়ে ফুফির পিছন পিছন হাঁটা ধরলো। রুমে ঢুকে ফুফি বলল,’তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি তারপর ঘুমাইস।’
-‘আরে না ফুফি। আমি ফ্রেশ হয়ে আগে একটু ঘুমাবো। আর ফুফি বাসায় কী কেউ নেই? কাওকে দেখলাম যে?’
‘ আর বলিস না! এই বাড়িতে একেকজন একেকসময়ে উঠবে ঘুম থেকে। সব আমার প্যারা। ছোট ছেলে-মেয়ে দুইটাও হলো বাবার মত। দুপুরে ঘুম থেকে উঠবে, কোথায় পড়াশোনা কোথায় কী? শুধু আমার বড়ো ছেলে রাফিন হলো আমার মত। সব কথায় শুনবে সে। তাই তো এত্তো সকালে ঘুম থেকে ডাকছিলাম আর উঠে তোকে আনতে গেছে। সবাইকে রাতে একসাথে পাবি তখন পরিচয় করিয়ে দিব। আচ্ছা এখন তাহলে ঘুমা মা ‘ বলেই ফুফি হাসিমুখে বেরিয়ে গেল।
মুন একটা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে এসেই শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুতেই চোখে সব ঘুম রা এসে ধরা দিল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
#একটুখানি_আশা
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
#পর্ব ৬
ঘুম ভাঙলো ফুফির ডাকে।
-‘এত ঘুমালে চলবে? সেই কখন সকালে এসে ঘুমাইলে এখনো খাবার খাসনি ক্ষিদে লাগেনি? উঠ মা,তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়, সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।’ বলেই ফুফি হাসিমুখে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
মুন ফ্রেশ হয়ে এসে রুমে বসে রইল। অস্বস্তি লাগছে ভীষণ,এতগুলো মানুষের সামনে কীভাবে যাবে। নিচ থেকে ফুফির ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো। মুন উঠে নিচে নেমে দেখল টেবিলে একজন আধ-বয়স্ক বাবার বয়সী আঙ্কেল, আদ্রাফ ভাইয়া, আর দুজন তাঁরই সমবয়সী ছেলে-মেয়ে সম্ভবত দুজনে দুয়েকবছরের বড়ো-ছোট হবে।
মুন ওখানে যেতেই ফুফি মুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,’আরে মুন মা, এসো এখানে সবার সাথে পরিচয় করে দিই।’
-‘এই হচ্ছে তোমার ফুফা।’মুনকে বসিয়ে খাবার বাড়তে বাড়তে ফুফি বলল।
মুন ফুফার দিকে তাকিয়ে সালাম দিতেই ফুফা মিষ্টি হেসে সালামটা নিয়ে বলল,’কেমন আছো মা? তোমার বাসায় সবাই কেমন আছে? তোমার কথা অনেক শুনেছি তোমার ফুফি থেকে, একমাত্র বড়ো মেয়ে, ওই বাড়ির রত্ন তুমি। তোমার বাবা আমাদেরকে বিশ্বাস করে তাঁর একমাত্র রত্নকে এখানে পাঠিয়েছে তাই কোনো কিছুর কমতি হবে না ইনশাআল্লাহ। আমাদেরকে তোমার আরেকটা পরিবার ভাবতে পারো মা। যখন যেটা ইচ্ছে মন খুলে বলবে। এখন থেকে তুমিও আমার আরেকটা মেয়ে। তাই এই বাবা-মাকে কোনোকিছু বলতে সংকোচ করবে না, ঠিক আছে মা? আর আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো মা?’
মুন মুচকি হেসে জবাব দিল,’জি ফুফা সবাই ভালো আছে আর আসতে কোনো সমস্যা হয়নি।’
ফুফি এবার তাঁর ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল,’মুন এ হলো আমার বড়ো ছেলে আদ্রাফ।সকালে তো দেখছোই। আর এ হচ্ছে ছোট ছেলে শাফিন আর এ হচ্ছে আমার ছোট মেয়ে অহনা, ওকে আমরা অহু বলেই ডাকি। শাফিন তোমার দুইমাসের বড়ো সমবয়সী ভাবা যায় আর অহু তোমার এক বছরের ছোট।’
মুন এবার একে একে সবার দিকেই তাকালো। শাফিন আর অহু উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। বোঝায় যাচ্ছে মুনের সাথে কথা বলার জন্য। মুন এক নজর ফুফির বড়ো ছেলে আদ্রাফের দিকে তাকালো কিন্তু আদ্রাফ এক মুহূর্তের জন্যও মুনের দিকে তাকালো না, সে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে ব্যস্ত। খাওয়ার মাঝে কিছুসময় পর পর কপালটা কুঁচকে ফেলছে, হয়তো বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু বিরক্তি ভাবটা প্রকাশ করতে পারছে না। মুন বুঝতে পারলো না এভাবে বিরক্ত কেন? মুন এখানে আসাতে সে কী কোনো কারণে ডিসটার্বড? মুন এসব আর না ভেবে আর দুজনের দিকে তাকালো। শাফিনকে উদ্দেশ্য করে হাত নেড়ে বলল,’হ্যালো ভাইয়া, আই এম মুন।হাও আর ইউ?’
-‘হেই মুন,আ’ম ফাইন। নাইস টু মিট ইউ আর হ্যাঁ আমায় ভাইয়া বলো না, মা বলেছে আমরা সমবয়সী তাহলে নাম ধরেই ডেকো আর ভাইয়াটা তুমি আদ্রাফ ব্রো এর জন্য রেখে দাও।’ শাফিন মুচকি হেসে বলল।
মুন মুচকি হেসে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে অহুকে ইশারা করে হাত নাড়লো।
-‘হ্যালো অহু।’
-‘হেই আপু। তুমি অন্নেক কিউট।’ অহু উৎসুক হয়ে বলল।
-‘তাই? তুমিও একদম বার্বিডলের মত। একটা পুতুলের মত।’অহু তা শুনেই মুনকে এসে জড়িয়ে ধরে ইংরেজিতে বলল,
-‘জানো আপু আমি অন্নেক খুশি হয়েছি তোমাকে এখানে পেয়ে। মামনির কাছে অনেক শুনেছি তোমার কথা।’
মুন বুঝতে পারলো এরা বাংলা তেমন পারে না কারণ এদের কথার ধরণেই বোঝা যাচ্ছে। সেও মুচকি হেসে অহুর গাল দুটো টেনে দিল। এর ভেতর ফুফার খাবার শেষে সবাইকে ‘শুভ রাত্রি’ বলে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে রুমে চলে গেল। আর অহু আর শাফিন তো কথার ঝুড়ি নিয়ে বসছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে দুজন ঝগড়াও করছে। মুন এসব দেখে মুখ টিপে টিপে হেসে চলল। বোঝায় যাচ্ছে ভীষণ মিশুক ওরা।
-‘অহু, শাফিন।’গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ডাক দিল আদ্রাফ ভাইয়া।
-‘সরি ভাইয়া।’ অহু আর শাফিন দুজনেই একসাথে বলে উঠলো আদ্রাফ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে এরপর চুপ হয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিল।
মুন এদের ব্যবহার কিছুই বুঝতে পারলো না। বড়ো ভাই নাম ধরে ডাকতেই চুপ হয়ে গেল।
আদ্রাফ ভাইয়া এটা বলেই সাথে সাথে টেবিল ছেড়ে উঠে রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।
উনি যাওয়ার সাথে সাথে ফুফি অহু, শাফিন দুজনের মাথায় এসে টোকা মেরে বলল,’তোরা জানিস না? আদ্রাফ খাবারের টেবিলে বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। আরেকবার যাতে না দেখি। আর মেয়েটাকেও আসার সাথে সাথে ঠিকমতো খাবারটাও খেতে দিচ্ছিস না দুজনে, তোদের আড্ডার জন্য সে খাবারটাও শেষ করতে পারেনি। চুপচাপ খেয়ে রুমে যা দুজনেই। আড্ডা কাল সকালে দিস।’
দুজনেই কাঁদো কাঁদো ফেইস করে রইল।
-‘আহঃ ফুফি বকছো কেন? এদের দোষ নেই আমিই কথা শুরু করছিলাম।’
-‘তুই জানিস না কিরকম ফাজিল এগুলো।’
অহু আর শাফিন দুজনেই আর কোনো কথা না বলে টেবিল ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।
-‘রাগ করেছে ওরা। এভাবে বকলে কেন ফুফি?’
ফুফি মুচকি হেসে বলল,’দুইমিনিটে এদের রাগ ভেঙে যাবে, সকালে দেখিস রাগ নেই। সারাদিন ফাজলামি করে, পড়াশোনার নাম-বালাই নেই, বন্ধুদের সাথে ট্যুর, এদিকওদিক ঘোরাঘুরিই করে। তুই এই দুইটার পাল্লায় পড়লে বুঝবি। আচ্ছা, যা ঘুমাতে যা মা। শুভ রাত্রি।’
-‘তুমি ঘুমাবে না ফুফি?’
-‘আমি এগুলো গুছিয়ে রেখে যাব। তোর কোনোকিছু লাগলে ফুফিকে বলিস।’
মুন ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কিছু একটা মনে পড়তেই আবার পিছনে ফিরলো। ফুফির উদ্দেশ্যে বলল,’ফুফি বাবা-মাকে বলতে ভুলেই গিয়েছি আমি এসেছি সেটা আর আমার সিমও নেই।’
-‘ভাইজান আর ভাবীর সাথে আমি কথা বলেছি দুপুরে। তুই তখন ঘুম ছিলি তাই আর জাগাতে বারণ করেছিল ভাইজান। আর এখন তো অনেক রাত হয়েছে। তুই গিয়ে ঘুমা। কালকে উঠে আদ্রাফকে বলবো তোকে শপিং এ নিয়ে গিয়ে তোর জরুরি সব জিনিস কিনে দেওয়ার জন্য। চিন্তা করিস না সব পেয়ে যাবি মা।’ মুচকি হেসে বলল ফুফি।
মুন ‘আচ্ছা’ বলে হাসিমুখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
সিঁড়ির সামনে বরাবর দু’রুমের মধ্যে মুনের রুম কোনারটা। রুমে যাওয়ার সময় আগের রুমে চোখ পড়লো মুনের। দরজা একটু ফাঁক করে খোলা। পুরোপুরিভাবে লক করেনি। মুন সেই ফাঁক দিয়ে দেখেই বুঝতে পারলো রুমটা ওই আদ্রাফ খাটাশের। মুন আপনমনে বিড়বিড় করে নিজের রুমে ঢুকে গেল। এখানে আসার আগে যতটুকু অস্বস্তি লেগেছিলো এখন তাঁর ছিটে-ফোঁটাও নেই। সবাই মাত্র কিছু সময়ের ভেতর আপন করে নিলো তাঁকে। কী অমায়িক ব্যবহার সবার। ফুফাও ভীষণ ভালো। যথেষ্ট সুদর্শনও বটে। ফুফিও সুন্দর আর তাঁর ছেলে-মেয়েগুলোও সুন্দর। সবাই খুব মিশুক শুধু ওই আদ্রাফ খাতাশটা ইতর। অহংকারের শেষ নেই, হু, হাসতেও জানে না, মুখের কথাতে একটু মধুও নেই। মুন আদ্রাফের কথা বলতেই মুখ ভেংচি কাটলো। এসব ভাবতে ভাবতেই মুন ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুইলো কিন্তু ঘুম আসছে না। পুরো একটা দিন ঘুমানোর পর আর ঘুম আসছে না। অনেক রাত হয়ে গেল এভাবেই। মুন উঠে রুমের ভেতর কিছুক্ষন হাঁটা-হাঁটি করল। হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা-মা, আরিফা, চাচা-চাচীদের মনে পড়ছে ভীষণ। এই মন খারাপের ওষুধ হচ্ছে চাঁদ দেখা। বাসায় থাকাকালীন রাতে ঘুম না আসলে মুন একা একা চন্দ্রবিলাস করতো। মুন ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুসময় চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চাঁদ দেখার সময় পাশের রুমের ব্যালকনিতে চোখ যেতেই দেখল ওই রুমের আলো। মুন একটু ভাবনায় পড়ে গেল, এতরাতে ওই খাতাশটা এখনো ঘুমাইনি?কী করছে এতরাত অব্দি।হঠাৎ করেই ভীষণ পানির তেষ্টা পেল। রুমে এসেই দেখল পানি নেই। তাই পানির উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হতেই অন্ধকারে কেউ একজনের সাথে জোরেসোরে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই ওই মানবটা মুনকে ধরে টেনে তুলতেই মানবটার বুঁকের মধ্যে গিয়ে পড়লো। মুন ভয়ে চোখমুখ কিচে চিৎকার করে উঠলো,
-‘ভুততততততত..’
#চলবে ইনশাআল্লাহ