প্রেমসরনী,#পর্ব ২

0
1606

#প্রেমসরনী,#পর্ব ২
#নাজমুন_বৃষ্টি

বিকেলের দিকে রেহেনা খালার সাথে সব কাজ শেষ করে নিহি রুমে এলো। এতো এতো কাজ করার ফলে শরীরটা যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে। হয়তো এতদিনের জ্বরটা আবারো ক্রমশঃ বাড়ছে। নিহি গোসল সেড়ে শুয়ে পড়লো। চাচি নির্দেশ দিয়েছে এর ভেতর যাতে আর বের না হয়। রাহান ভাইয়ার আসতে আর বেশিক্ষন লাগবে না। উনার সামনে যেন নিহি না যায়।

নিহি বিছানায় শুতেই ক্রান্ত শরীরে এক রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো।
রাত হতে-ই সব জ্বররা এসে ভর করলো।

—————

সকালে পারভীন বেগম রান্নাঘরে নিহিকে না দেখে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো।

-‘নবাবজাদি’র এখনো ঘুম ভাঙেনি, রেহেনা? এতো সুখের ঘুম আসে কোথ থেকে ওর! দাড়া ওর ঘুম আমি বের করছি।’

-‘মেডাম, নিহির শরীরে বড্ড জ্বর, তাই আর কী,,, আমি আর ডাকিনি। মেয়েটা এই শরীরে কাজ কীভাবে,,,’

-‘চুপ কর তুই। ইদানিং বেশি হাত করে ফেলছে তোকে ওই ফকিন্নিটা। মুখে দুইটা তাপ্পর পড়লে ওর ঘুম ছুটে বের হয়ে যাবে। ফকিন্নি হয়ে রাজকন্যার মতো দেরিতে ঘুম থেকে উঠা বের করছি আমি।’
পারভীন বেগম রাগী-স্বরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথাগুলো বলে নিহির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিলেই পিছন থেকে কারো কণ্ঠ শুনে থেমে গেলো।

-‘মা, এরকম অসভ্য ভাষায় গালি কাকে দিচ্ছ তুমি?’

এমন কথা শুনে পারভীন বেগম পিছন ঘুরতেই রাহানকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে চেহেরার রাগী ভাবটা আড়ালে ঢেকে হাসি টেনে এনে কোনোমতে বললো,

-‘তততুই,, কখন উঠলি বাবা।’

-‘উঠছি তো অনেক আগেই, জগিংয়ে গিয়েছিলাম। এসেই দেখি তুমি এভাবে চিল্লাচিল্লি করছো। কার উপর এভাবে রেগে,,,,’ বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলো রাহান ।

নিহি নিচ থেকে চাচির এতো চিল্লাচিল্লি শুনে ঘুম থেকে ধরফড়িয়ে উঠে বসলো। সে বুঝতে পেরেছে চাচির এমন চিল্লাচিল্লি’র মূল হলো নিহি নিজেই। রাতে শরীর খারাপ হওয়ায় বোধহয় ঘুম থেকে উঠতে পারেনি । সে কোনোমতেই মুখে কয়েকফোঁটা পানি দিয়ে অগোছালো চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। রুম ছেড়ে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নিলে দীর্ঘদিন পরে মানুষটাকে দেখে আপনাআপনি তার পা থেমে গেল।

কতগুলো বছর পর দু’জনের আবারো দেখা হলো। নিহি এতগুলো বছর পর প্ৰিয় মানুষটাকে দেখার স্বাদ পাচ্ছে। প্রথমে চিনতে না পারলেও এখন আন্দাজে ধরলো এইটাই হয়ত রাহান ভাইয়া । আর সাত বছর আগের চেহেরাটার সাথেও মিলে। অন্তত সাত বছরে এই মানুষটাকে ভুলে যাওয়ার মেয়ে নিহি নয়। সদ্য যৌবনে পা রাখা একটা মেয়ের সব অনুভূতি-ই না-কি সামনের এই মানুষটার ভেতর। কিন্তু বিপরীত পক্ষ থেকে এমন কোনো অনুভূতি-ই নেই। আর এসব কিছু তার ক্ষতি। এটা তার অবাধ্য মনকে বোঝাতে চাইলেও বারবার ব্যর্থ হয়। পুরোপুরি বদলে গিয়েছে মুখশ্রীটা।
এসব ভাবতে ভাবতেই নিহি নিজেকে নিজে গালি দিলো।

রাহানের উপরে তাকানো দেখে পারভীন বেগম রাহানের দৃষ্টি অনুসারে উপরের দিকে তাকাতেই নিহিকে দেখে মুহূর্তের মধ্যে তার মুখটা রাগে পরিণত হলো। সে রাগী দৃষ্টিতে নিহির দিকে তাকালো।
নিহির দৃষ্টি পারভীন বেগমের দিকে পড়তেই চাচির রাগী চেহেরা দেখে যা বোঝার বুঝে ফেললো। বুঝতে পারলো আজ তার কপালে শনি আছে। চাচি নিহিকে বারে বারে বারণ করে দিয়েছিলো-যেন সে রাহানের সামনে না পড়ে। কিন্তু এখানে নিহির’ই বা কী দোষ! সে আর কিছু না ভেবে মাথা নিচু করে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রাহানের পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে’ই বুকে হাত দিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। তা দেখে রেহেনা মুচকি হাসলো।

অন্যদিকে রাহানের মেয়েটার মুখটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু পুরোপুরি মনে করতে পারছে না। সদ্য ঘুম থেকে উঠা অগোছালো মুখটা কী বিশুদ্ধ লাগছে মেয়েটা’র! কিন্তু কে এই মেয়ে! মনে হচ্ছে যেন একসময় অনেক প্ৰিয় একটা মুখ ছিল-কিন্ত সময়ের সাথে সাথে হয়তো স্মৃতি’র পাতাটা ঝাঁপসা হয়ে উঠেছে।

-‘রাহান বাবা, তুই রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নেয়। আমি নাস্তা আনছি।’

মায়ের কথায় রানার ঘোর ভাঙলো। সে পিছনে রান্নাঘরের দিকে এক পলক তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

রুমে ঢুকেই রাহান মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
.
.
নিহি রান্নাঘরে রুচি ভাজার সময় পারভীন বেগম এসে গালে তার মুখ বরাবর পরপর দুইটা তাপ্পর মারলো।

-‘ফকিন্নি’রজি কয়বার বারণ করছিলাম যাতে তুই আমার ছেলের সামনে না পড়িস। তাও কথায় হয় না তোরে? কী, আমার ছেলেটাকেও হাত করতে চাস?’

নিহির গালে তাপ্পর পড়ায় নড়ে উঠার কারণে কিছু ফুটন্ত তেল তার হাতে ছিটকে পড়লো। ব্যথায় চোখ দিয়ে অঝোরে ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মারের কারণে ফর্সা গালটা মুহূর্তের মধ্যে লাল আকার ধারণ করলো। সে গালে অন্য হাতটা দিয়ে অশ্রুমাখা দৃষ্টিতে চাচির দিকে শান্ত-চোখে তাকিয়ে রইলো।
রান্নাঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে রেহেনা খালা এসব দেখেও কিছু বলতে পারলো না। মেয়েটার জন্য তার ভীষণ মায়া হচ্ছে। কখন যে এই ডায়নি’র অত্যাচার-গুলো থেকে মেয়েটা মুক্তি পাবে! রেহেনা শুধুই দোয়া করে, মেয়েটার জীবনে যাতে এমন কেউ আসুক- যে এই সব কষ্টগুলো আড়ালে ঢেকে শান্তিতে ভরিয়ে দিবে।

-‘আর যদি এমন কিছু দেখি, তাহলে তোর চুল একটাও রাখবো না। এই বাড়িতে তোর ঠায় হবে না আর বলে দিলাম। যেখানে ইচ্ছে আমাদের মুক্তি দিয়ে বিদায় হো। মা-বাবাকে খেয়ে এখানে আসছিস আমাদের অশান্তি দেওয়ার জন্য? মা-বাবার সাথে সাথে তুইও মরতি, আমাদের আপদ বিদায় হতো।’
পারভীন বেগম আবারো রাগী রাগী স্বরে কথাগুলো বলে উঠলো।

নিহি আর না পারতে কান্না করতে করতে রান্নাঘর ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিলেই কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে সে মানুষটা এক হাতে ধরে ফেলে। যার কারণে সিঁড়ি থেকে পড়তে পড়তে নিহি বেঁচে যায়।

রাহান ভ্রু-কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকালো।

-‘এই যে মিস! দেখে চলতে পারেন না? এখন এত উপরের সিঁড়ির ধাপ থেকে পড়ে গেলে কী হতো?’

-‘উটকো ঝামেলা, মরে যেতাম।’

নিহি চোখ মুছতে মুছতে বাকি সিঁড়ি’র ধাপগুলো পেরিয়ে রুমে ঢুকে গেলো।
আর রাহান হতবাক দৃষ্টিতে নিহির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না-মেয়েটা তার সাথে এভাবে কেন কথা বলল! আর মুখ দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা কান্না করছে আর মুখের একপাশ লাল। কী হয়েছে মেয়েটার!
সে আর কিছু না ভেবে নিচে নেমে সোফায় বসে মা’কে ডাক দিলো।

পারভীন বেগম রাহানের ডাকে ক্রুর-পূর্ণ দৃষ্টিটাকে আড়াল করে রেহেনাকে রাহানের জন্য নাস্তা আনতে বলে হাসি-মুখে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে সাদাফের পাশে গিয়ে বসলো।

-‘ মা ওই মেয়েটা কে?’ রাহান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো।

-‘ওইটা নিহি , তোমার চাচা-চাচির মেয়ে।’ রান্নাঘর থেকে নাস্তার প্লেট নিয়ে আসতে আসতে রাহানের জবাব দিয়ে ফেললো রেহেনা খালা। আর তা দেখে পারভীন বেগম রেহেনার দিকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করলো। রেহেনা পারভীনের সেই দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো।

-‘আরে রেহেনা খালা যে! কেমন আছো?’ রাহান উৎফুল্ল কণ্ঠে রেহেনা খালাকে জিজ্ঞেস করলো।

রেহেনা খালা এই বাসায় অনেক আগে থেকেই কাজ করে। সেই সুবাদে রাহান যাওয়ার আগেও তিনি ছিলেন। রাহান-নিহিকে ছোট কাল থেকে তিনি আরেক মায়ের মতো করে মমতা দিয়ে আগলে রাখতেন। তাই রাহান-নিহিও রেহেনা খালাকে ভীষণ ভালোবাসে।
-‘হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা।’

-‘তার মানে মা, ওই মেয়েটা আমার শাহেদ চাচার মেয়ে? ও মাই গড! সেই পিচ্চি মেয়েটা সাত বছরে কত বড়ো হয়ে গেলো! সময়ের সাথে সাথে চেনাই যাচ্ছে না নিহুকে! আমি তো চিনতেই পারিনি।’

-‘হ্যাঁ সময়ের সাথে সাথে বদলেও গেলো অনেক। মা-বাবা মরার পর একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। কত সুখের ছিল- রাজকন্যা ছিল । নিয়তি আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে!’ রেহেনা পারভীন বেগমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাস্তার প্লেট রেখে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

রাহানের মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সে তার নিহিকেও চিনতে পারলো না! কতই না দুস্টু ছিল মেয়েটা! রাহানকে তো ভাইয়া ভাইয়া বলে তার পিছুই ছাড়তো না। তার এখনই নিহুর সাথে দেখা করতে হবে। তার পিচ্চি নিহুপরী!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here