#প্রেমসরনী,#পর্ব ৩
#নাজমুন_বৃষ্টি
নিহি রুমে এসে বসে রইলো মেঝেতে। চাচির এই অত্যাচার’গুলো এতদিন সহ্য করলেও এখন যেন সব অসহ্য হয়ে উঠছে। আজ ভীষণ করে বাবা-মা’কে মনে পড়ছে।
নিহি ব্যলকনিতে গিয়ে সকালের ব্যস্ত শহরটা’র রাস্তার দিকে তাকাতেই এক জায়গায় চোখ আটকে গেল।
রাস্তা দিয়ে একটা বাইক যাচ্ছে। যেটাতে একটা ছোট-খাটো হাসি-খুশি পরিবার ফুটে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সব সুখ এই ছোট-খাটো একটা বাইকেই এসে ধরা দিয়েছে। বাইকের সামনে বাবা, বাবা-মা দুজনের মাঝখানে একটা হাসি খুশি পিচ্চি মেয়ে স্কুল ড্রেস পড়া, মেয়েটি’র হাতে একটা হাওয়ায় মিঠাই। মাঝে মাঝে মেয়েটির মা ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা টেনে তার স্বামীকে কিছু একটা বলছে আর মেয়েটি মাঝখানে গাল ফুলিয়ে তাকাচ্ছে। বাবা পিছনে ফিরে মেয়েটির গালে একটা চুমু দিতেই মেয়েটির রাগ মুহূর্তের মধ্যে পড়ে গিয়ে হেসে দিল। বুঝাই যাচ্ছে, হয়তোবা বাবা অফিস যাচ্ছে আর মা-মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এই ছোট খাটো পরিবারটাতে হয়ত সুখের অভাব নেই।
নিহির মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এর চাইতে সুন্দর জিনিস বোধহয় আর নেই। এসব দেখতে দেখতে নিহির চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। একসময় তারও এমন একটা সুখের পরিবার ছিল। বাবারো একটা বাইক ছিল। নিহিকে তার মা স্কুল ড্রেস পড়িয়ে বাবার সাথে বের হতো। বাবা নিহি আর নিহির মা’কে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে নিজে অফিসে চলে যেত। আহা! কী সুন্দর সুখের সময় ছিল। আজ কই সেই দিনগুলো! ভাবতেই নিহি ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রাহান নিহির রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে ভাবছে, ঢুকবে কী ঢুকবে না! কিন্তু এতদিন পরে এসে তার নিহুর সাথে কথা বলবে না তা কিভাবে হয়! রাহান দরজায় হাত দিতেই বুঝতে পারলো দরজা খোলা। সে রুমে ঢুকে দেখলো রুমে নিহি নেই। হাঁটতে হাঁটতে ব্যাল্কনিতে গিয়ে দেখলো নিহি রাস্তার দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে অঝোরো ধারায় পানি পড়ছে। রাহান নিহির দৃষ্টি অনুযায়ী রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা বাইকের দিকে নিহি তাকিয়ে আছে। যেখানে একটা ছোট-খাটো সুখী পরিবার ফুটে উঠছে। নিহি কল্পনার রাজ্যে এতটাই ব্যস্ত যে, তার পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে-সেটাই বুঝতে পারলো না। রাহানের মুহূর্তের মধ্যে নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। যেরকম খুশি খুশি মনে নিহির রুমে এসেছিলো তার চেয়ে বেশি দুঃখী হয়ে গেল। সে বাইকটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো কেন নিহি কান্না করছে!তার নিহুপাখির কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা ভাবতেই আরো বেশি খারাপ লাগলো। রাহান আস্তে আস্তে করে পিছন দিকে সরে নিহির রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
নিহি’র এসব ভাবনার মাঝেই ওই বাইকটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। সে চোখ মুছে রুমে এসে মুখটা আবারো ধুয়ে নিলো । এরপর আবারো নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। সে জানে, এখন নিহিকে রান্নাঘরে না দেখলে চাচি আবারো চেঁচামেচি শুরু করে দিবে। চাচা অফিসে থাকে সবসময় – শুধুমাত্র শুক্রবারেই চাচা বাসায় থাকে , যার ফলে শুক্রবার ছাড়া এমনি প্রতিটা দিনই চাচির রাজত্ব চলে এই বাসায়। এই ঘরে প্রতিটা দিনই নিহির জন্য অসহনীয়। তবুও নিহি এই মানুষগুলোর কাছে ঋণী। তার অসহায় সময়ে থাকার জন্য মাথার উপর অন্তত একটা ছাদ হলেও পেয়েছে। নাহলে বাবা-মা চলে যাওয়ার পর কই থাকতো নিহি, কীভাবে বেঁচে থাকতো! বাবা-মা রিলেশন করে বিয়ে করেছে যার ফলে বাবা-মায়ের বিয়ের পরেই মায়ের সাথে তার নিহির নানুরবাসার সবার সাথেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। নিহির নানাই সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। নিহি তার চাচার কাছ থেকে শুনেছিল, নিহির একটা মামা ছিল-যিনি চুরি করে নিহির মায়ের সাথে যোগাযোগ করতেন কারণ তিনি বোনদের মধ্যে নিহির মা’কে ভীষণভাবে ভালোবাসতেন কিন্তু একদিন তিনিও তার বাবার কাছে ধরা খেয়ে যান। যার ফলে সেইদিনই সব যোগাযোগ ছিন্ন হয় আর কোনোদিন কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। এমনকি নিহির মায়ের মৃত্যুও তারা জানতে পারেনি হয়তো। জানলে অন্তত তার ওই মামাটা আসতো নিহির জন্য। নিহির চাচা নিহির মায়ের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন ওরা অনেক আগেই সবাই মিলে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। যার ফলে নিহির বাবা-মায়ের ব্যাপারটা আর বলতে পারেনি তার চাচা।
নিহি এসবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে নিচে যেতেই চাচির অগ্নিদৃষ্টি নিহির উপর পড়লো। নিহি ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
নিহি রান্নাঘরে ঢুকে রেহেনা খালার সাথে হাতে হাতে কাজ করতে লাগলো কারণ রেহেনা খালা ইতিমধ্যে সব কাজই শেষ করে ফেলেছে।
গত বিকেল থেকে নিহির পেটে কিছু পড়েনি যার ফলে খিদায় পেট চো চো করছে। বারে বারে গা গুলিয়ে উঠছে। রেহেনা খালা এটা বুঝতে পেরে নিহির দিকে নাস্তা এগিয়ে দিলো।
-‘এই ধর। খেয়ে নেয় এগুলো। কাল থেকে কিছুই তো খাসনি। এখন এই সবগুলো ফটাফট শেষ করে ফেল তো দেখি।’
-‘তুমি খেয়েছো খালা?’
নিহি হাসিমুখে প্লেট হাতে নিয়ে রেহেনা খালার দিকে তাকিয়ে উক্ত কথাটি বলতেই রেহেনা খালার চোরা চোরা দৃষ্টিতে যা বুঝার বুঝে ফেললো। কারণ সে জানে, চাচি কোনোদিনও এতো বেশি নাস্তা নিহির জন্য রাখবে না। নিহি কাল থেকে কিছু না খাওয়ার কারণে রেহেনা খালা হয়তো সকালের নিজে নাস্তা না করে নিজেরটা সহ নিহির জন্য বাঁচিয়ে রেখে দিয়েছে। নিহি মাঝে মাঝে ভেবে পায় না, এই মানুষটা’র কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পাওয়ার আধো কী নিহি যোগ্য?
নিহি হাসিমুখে প্লেটটা নিয়ে আগে খালার মুখে পুরে দিল খাবার।
-‘আরে! আমি খেয়েছি তো। এসব তোর জন্য।’
-‘হ্যাঁ, তা তো বুঝতে পেরেছি।’ নিহি এসব বলতে বলতেই আরকিছু খাবার নিজে খেতে খেতে আরকিছু খালার মুখে পুরে দিলো।
-‘সত্যি বলছি, এসব তুই খা নিহি। তোর খিদা পেয়েছে রে।’
নিহি হাসিমুখে নিজে কিছু খেয়ে আবার খালাকেও খাইয়ে দিল।
নিহি আর খালার খাওয়ার শেষ পর্যায়ে চাচি নিহিকে গালি গালি দিতে দিতে রান্নাঘরে ঢুকলো।
-‘ওই দেখ, ডায়নি আইসা গেছে।’ রেহেনা খালা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো।
পারভীন বেগম এসে নিহিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-‘এখানে তো সব কাজ শেষ। তুই এসে পুরো বাড়িটা মুছে ফেল। আগে নিচের তলাটা মুছবি এরপর উপরের সব রুম ভালো করে মুছে ফেলবি।’
-‘মেডাম, এত্ত বড়ো বাড়ি, নিহি কীভাবে একা মুছবে! আমি নাহয় উপরেরতলা মুছি আর নিহি নিচের তলা মুছুক।’
-‘তোরে আমি বলিনি। ক্যান নিহি মুছতে পারবে না? তিনবেলা নিয়ম করে করে গিলতে তো পারে। নিহি যা।’
নিহি মাথা নিচু করে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে পানি নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ মুছতেই চাচাতো বোন তিশা ঘুম থেকে উঠে উপর থেকে নিহিকে নাস্তার জন্য ডাক দিল।
-‘সিঁড়ির আর মাত্র কয়েকটা ধাপ আছে, ঐগুলো মুছে ফেলি? নাহলে কেউ আবার পা পিছলে পড়ে যাবে সিঁড়ি থেকে। আমি খালাকে বলি? তোমাকে নাস্তা দেওয়ার জন্য আপু?’
-‘না, তুই দিবি নাস্তা। আর তা এখনই।’ তিশা রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো।
-‘কিন্তু…’.
-‘আমার মামনি যা বলছে তাই কর। নাস্তা নিয়ে আয় তুই। মুখে মুখে তর্কের জন্য থাপ্পড় আর দুইটা পড়লে ঠিক হয়ে যাবি।’
নিহি আর কোনো কথা বলার সাহস পেলো না। সে বালতিটা একপাশে রেখে নিচে তিশার নাস্তার জন্য এগিয়ে গেল।
নিহি নাস্তা নিয়ে তিশার জন্য উপরে উঠলে তিশা নাস্তা খেতে খেতে নিহির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘নিহি তোর একটা ড্রেস আছে যে? বাবা কিনে দিয়েছিলো গত সপ্তাহে? এটা আমার জন্য একটু আন তো, আমি একটু পড়ব।’
নিহি মন খারাপ করে তার রুমে কাপড়টা নেয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলো। এটা তার প্ৰিয় কাপড় ছিল। দোকানে দেখার পর তার পছন্দের জামাটা চাচাকে বলার পর চাচা কিনে দিয়েছিলো। আর এখন সেটাও দিয়ে দিতে হচ্ছে। নিহি জানে এই কাপড়টা সে আর পাবে না।
তিশা নিহি রুমে যাওয়ার পর চুপি চুপি বেরিয়ে সিঁড়ির উপরের ধাপে নিহির রেখে যাওয়া পাউডারের পানির বালতিটা পায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। যার ফলে পুরো সিঁড়ির ধাপ গুলো পিছলা হয়ে গেল।
নিহি রুমে আসার আগে তিশা নিজের রুমে আগের মতো বসে পড়লো।
নিহি কাপড় নিয়ে আসতেই তিশা বলে উঠলো,
-‘ধন্যবাদ নিহি তোকে। এগুলো নিয়ে যা, আমি আর খাবো না।’
নিহি প্লেটটা নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি তে এক পা দিতেই পা পিছলে নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আর উপরে তিশা রুম থেকে বেরিয়ে নিহির দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল। নিহির মনে হচ্ছে সে বুঝি মারাই যাবে! মাথাটা ভীষণভাবে ব্যথা করছে। চোখগুলো খুলে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। চোখের কোনায় পানি এসে জমাট বাঁধলো। চোখ বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে আধো আধো চোখে ঝাপসা দৃষ্টিতে নিহি দেখতে পেলো, কেউ একজন উন্মাদের মতো তার দিকেই দৌড়ে আসছে। নিহি অস্পষ্ট সুরে ‘রাহান ভাইয়া ‘ বলে বিড়বিড় করে উঠলো।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।