সাঁঝক বাতি,০৮,০৯

0
569

সাঁঝক বাতি,০৮,০৯
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[০৮]

দিগন্ত আর ওর মা মুখোমুখি বসে আছে। অদূরে ওর বাবা আর প্রশান্ত চা খাচ্ছেন। মা ছেলের কী কথা হচ্ছে? অন্যরা জানে না। তারা আছে অন্য কথার তালে। তবে দিগন্ত মায়ের কথা শুনে বেশ বিরক্ত। শিফা বড্ড বার বেড়েছে। এই মেয়েটার পাখা না কাটলে হচ্ছে না। উড়তে দিয়েছে বিধায়
সাপের পাঁচ পা দেখেছে। এবার একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়! নিহা ওর রুমে শুয়ে নাটক দেখছে।
আফরান নিশোকে ওর খুব পছন্দ। ক্রাশও বটে।
কাজ ফেলে নিশোর নাটক দেখতেও বসে যায়। এই নিয়ে বকাও খায়। তাতে কি? নিশোকে দেখে সব ভুলে যায়। নিশোকে যেভাবে দেখে প্রশান্তকে সেভাবে কখনো দেখেছে কি না সন্দেহ আছে। তা
গর্বের সাথে বলতেও পারবে। প্রশান্ত খুবই বিরক্ত বউয়ের কার্যলাপে। বলেও, কোনো কাজ হয় না।
তাই আর কিছু বলে না। এখন রাত দশটা সাত! বাসার সবাই খেতে বসেছেন। নিহা খাবার নিয়ে দৌড়ে টিভির সামনে চলে গেল। দেখে কেউ কিছু বললেন না। কারণ নাটক হচ্ছে। তাও নিশোর নাটক। শিফা বাবার বাসায় গেছে। কবে ফিরবে, জানাই নি! দিগন্তও কল দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। তাই দেয় নি। আর শিফা প্রাণ থাকতে দিবে কী না সন্দেহ। দিগন্ত আশাও করে না! যে জেদী মেয়ে! ভাঙবে তবুও মচকাবে না। ওকে সে চিনে ফেলেছে। তখন দিগন্তের মা বললেন,
-‘শিফা, কবে আসবে দিগন্ত?’
-‘জানি না।’
-‘কালকে গিয়ে নিয়ে এসো।’

দিগন্ত সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। তারপর খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। ওইদিকে, শিফা রুমের দরজায় খুলেনি। ওর বাবা-মা ভাই এত ডেকেও দরজা খুলাতে পারেনি। মেয়েটার কী হলো, কেউ
বুঝতে পারছেন না। ডাকলেও জবাব দিচ্ছে না। শিফার বাবা বাধ্য হয়েই দিগন্তকে কল করলেন। দিগন্ত তখন বসে গান শুনছিল। পছন্দের শীর্ষে থাকা ইংলিশ গান! এই অসময়ের শশুরের কল পেয়ে বিরক্তও হলো। এখন কল দেওয়ার সময়?
নিশ্চয়ই, এখন মেয়ের গুনগান গাইবে। নয়তো যাওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করবে। উফ, বিরক্তকর পরিবার! প্রায় সাতবারের বেলায় কলটা রিসিভ করল সে। এতক্ষণ বসে বসে দেখছিল! তারপর অত্যন্ত বিনয়ীভাবে সালাম দিয়ে বুঝালো, ব্যস্ত থাকায় কল ধরতে পারে নি। তাই খুব লজ্জিত! শিফার বাবা জামাইয়ের অস্বস্তি বুঝে হাসিমুখে বললেন,
-‘বাবা, একটু আসতে পারবে? শিফা তো রুমের দরজা খুলছে না।’
-‘কেন, কি হয়েছে? শিফা ঠিক আছে তো বাবা?’

দিগন্ত ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে কথাটা বলল। যেন চিন্তায় ওর হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ মুখে চিন্তার রেশমাত্র নেই! বরং আরাম করে শরীর এলিয়ে বসল। পায়ের উপর পা তুলে, পা নাচাচ্ছে। সে জানে; শিফা মরবে না! আত্মহত্যা করার মেয়ে সে নয়। হয়তো মরা বান্ধবীর কথা মনে পড়েছে, তাই নখরা শুরু করেছে। কাজকর্ম না থাকলে যা হয় আর কি! দিগন্ত বিরক্ত হয়ে ফোন কান থেকে নামিয়ে রাখল। শিফার বাবা অনবরত হ্যালো! হ্যালো! করেই যাচ্ছেন। দিগন্ত সব শুনেও জবাব দিচ্ছে না। নেটওয়ার্কের সমস্যা ভেবে উনি কল কেটে দিলেন। তবে পুনরায় কল দেওয়াতে ফোন বন্ধ পেলেন। ফোনের চার্জ শেষ তাই হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। নাহলে দিগন্ত ফোন বন্ধ করার ছেলে না। পুরো কথাটা বলতে না পেরে হতাশ হলেন। দিগন্তই ছিলো উনার শেষ ভরসা। কিন্তু, তা তো হলো না। মেয়েটার কি যে হলো? আদরের মেয়ে উনার। মেয়ের সামান্য কিছু হলেও ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কারণ, মেয়েটা উনার প্রাণ!

ওইদিকে, দিগন্ত ড্রেসিংটেবিলের সামনে নিজেকে ঘুরেফিরে দেখছে। মুখে শীষ বাজাচ্ছে! এটা তার পছন্দের কাজের একটা।দিগন্ত বরাবরই সুদর্শন। স্বাস্থ্য সচেতন বিধায় সর্বদা ফিট থাকে। এজন্য ডায়েটও করে। চুল, দাঁড়ি, ত্বকসহ, সে শরীরের যথেষ্ট যন্ত করে। এজন্য সপ্তাহে দু’একবার জেন্স পার্লারেও যায়।

দিগন্ত সময় নিয়ে নিজেকে পরখ করে ভাবল, চুলে আর দাঁড়িতে নতুন কাট দিলে মন্দ হয় না। হুম, কালকেই যাবে পার্লারে। তারপর হেলেদুলে পছন্দের কালো টি-শার্ট শরীরে জড়ালো। একটু
সময় নিয়ে চুলগুলো ব্রাশ করল। সুগন্ধি হাতে নিয়েও রেখে দিলো। সুগন্ধি দেওয়া ঠিক হবে না। তারপর গাড়ির চাবিটা নিয়ে টি-শার্ট, টাওজার, আর পায়ে স্লিপার পরেই ছুটল; শিফার বাসার উদ্দেশ্যে।শশুড়বাড়িতে বোঝাতে হবে, বউকে সে অনেক ভালোবাসে। চোখে হারায়! বউকে ছাড়া সে অচল। দিগন্ত খুব ধীর গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। শশুড়কে টেনশনে রাখতে বেশ লাগছে।
শশুড়কে চাপে না রাখলে কেমন ধাঁচের জামাই সে? এভাবেই পারফেক্ট জামাই হতে হয়। তাছাড়া প্রতিটা ছেলের উচিত শশুড়কে খুব চাপে রাখা। নয়তো সে জামাই নামের কলঙ্ক। মেয়েরা বরকে অত্যাচার করবে। আর বর তার শশুড়কে! বাহ, তবেই না হিসাব বরাবর হবে। এসব বুদ্ধিমানের কাজ। দিগন্ত শিফার বাসার একটু আগেই গাড়ি থামাল। পরিপাটি চুলগুলোকে এলোমেলো করে মুখে পানির ছিঁটা দিলো। র্টি-শার্ট’টা টেনে টুনে
অগোছালো করল। মুখে চিন্তার ভাব ফুটিয়ে মৃদু হাসল। হুম, এবার ঠিক আছে। যাক এখন মনে হচ্ছে; বউয়ের চিন্তায় আধমরা হয়ে ছুটে এসেছে। একমাত্র বৈধ শত্রু থুক্কু বউ বলে কথা। টেনশন হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিজের কুটিল বুদ্ধির দেখে বরাবরের মতো গর্ববোধ করল। নিজেকেই নিজে বাহবাও দিলো! তারপর শিফাদের বাসার গেট দিয়ে প্রবেশ করলো। মুখটা করুণ করে, গাড়ি থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বাসার দিকে। তার প্রাণ যেন যায় যায় অবস্থা। বাসার দরজা খোলা তাই কলিংবেল চাপাতে হলো না। দিগন্তকে ছুটে আসতে দেখে সবাই খুব খুশি হলেন। তারমানে, তখন সত্যিই নেটওয়ার্কের সমস্যা ছিল। এজন্য কথা বলতে না পেরে ছেলেটা ঘেমে নেয়ে চিন্তিত হয়ে ছুটে এসেছে।

দিগন্ত এবার শিফার রুমের দরজায় থাবা দিতে থাকল। যেন টেনশনে ওর পাগলপ্রায় অবস্থা। অদূরে দাঁড়িয়ে সবাই দেখছে। শিফা তাও সাড়া দিচ্ছে না। এই চিন্তায় সবার মুখটা চুপসে গেছে।
দিগন্ত তখন দরজাতে স্বজোরে থাবা দিতে দিতে বলল,
-‘আমি সরি! আর এমন হবে না! এবার থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিবো। ব্যস্ত ছিলাম, এজন্য ফোন দিতে পারি নি। শিফা! এ্যাইই শিফা! সরি তো! প্লিজ দরজা খোলো।’

শিফার গভীর ঘুমের তলিয়ে ছিলো। দরজা কেউ ধাক্কাচ্ছে! ঘুমের ওষুধের প্রভাবে দু’চোখ খুলতেও পারছে না। ওদিকে শিফার আম্মুর ইচ্ছে করছে, মেয়েটা থাপ্পড় লাগাতে। ছেলেটা সারাদিন ব্যস্ত থেকে ক্লান্ত শরীরে ছুটে এসেছে। আর বেয়াদবটা ঢং করছে। অহেতুক এসবের কোনো মানে হয়?
শিহাব, রাফি দরজা ভাঙ্গতে গেলে, শিফা বের হলো। ঘুমের তোড়ে দাঁড়াতেও পারছে না। দিগন্ত সবাইকে ইশরায় বোঝাল, সামলে নিবে। সবাই গিয়ে যেন শুয়ে পড়ে। অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে কথা হবে। তারপর নিশ্চিন্তে সবাই রুমে চলে গেল। দিগন্তও শিফার রুমে ঢুকে দরজাটা আটকে দিলো। উফ, অবশেষে নাটকের সমাপ্ত হলো। দিগন্ত রেগে শিফাকে বেডে ধাক্কা দিলো।
রাগে ওর শরীর জ্বলছে। শিফা ব্যথা পেয়ে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল। খুব কড়া ওষুধের প্রভাবে হুশ নেই। গালি শুনে দিগন্ত ভ্রু কুঁচকে নিলো। আস্ত বেয়াদব মেয়ে! কত্ত সাহস, ওকে গালি দিলো। সে ফ্রেশ হয়ে এসে পাশে শুয়ে পড়ল। কালকে দেখে নিবে।
________________________________

কানাডার একটা হসপিটালে স্বপ্নীলকে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে কেউ শুট করেছে। বুলেটটা বাহুতে এসে লেগেছে। হঠাৎ আক্রমণে স্বপ্নীলও ঘাবড়ে গেছে। ওকে শুট করার কারণ কী? কে বা করবে?
এখানে শত্রু কোথা থেকে আসবে? কেউ মারতে চাচ্ছে? এসব ভেবে আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
তাছাড়া, রক্তে ফোবিয়া থাকায় স্বপ্নীল সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। খুব ছোট থেকেই ওর এই সমস্যা। এজন্য ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছেটাও অপূর্ন রাখতে হয়েছে। দেহরক্ষীরাই তাকে হসপিটালে এনেছে। আচমকা এমন হবে ওরাও বুঝে উঠতে পারে নি। স্বপ্নীল ক্লাসে ছিল! আর ক্লাসে প্রবেশ নিষেধ! তাই বাইরে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল।
তখন ঘটনাটা ঘটে! তবে ডাক্তাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় বুলেট বের করা হয়ছে। দেহরক্ষীদের ব্যাপারে স্বপ্নীল এখনো কিছু জানে না। শিফার বারণ আছে। তাই দূর থেকেই নজর রাখতে হয়।

তবে কাজটা দিগন্তের বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ওর লোকদেরও এখানে দেখা যাচ্ছে।এটা শিফাও জানে। তাই সতর্কও করেছিল। সে জানে দিগন্ত বিবেকহীন। শিফাকে দূর্বল করতে কাছের মানুষদেরই আগে আঘাত করবে। হলোও তাই!
স্বপ্নীল এখন ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার জানিয়েছে ভয়ের কিছু নেই। স্বপ্নীলের দেহরক্ষীরা দেশে এই খবর পাঠিয়েছে। তবে শিফা এখনো কিছু জানে না। ফোন বন্ধ! শিফার সহকারী হাসিবুল দেহরক্ষীকে খেয়াল রাখতে বলেছে। চিকিৎসার যেন ত্রুটি না থাকে। এতবার বলার পরেও, এই ঘটনা ঘটল। শিফা জানলে কি করবে, কে জানে! মেয়েটা কত ভয়ংকর তার অজানা নয়। শিফাকে সে বিগত সাতবছর ধরে চিনে। তাও খুব কাছে থেকে।তাই শিফার সব ব্যাপারে অবগত। হাসিবুল শিফাকে মেসেজ করে দিলো। শিফা ফোন অন করলেই মেসেজটা দেখতে পাবে। এই খবর শুনে শিফার রিয়েকশন দেখার অপেক্ষা।

পরেরদিন সকালে, শিফার দেরী করে ঘুম থেকে উঠল। মাথা ঝিমঝিম করছে! ঘড়ির দিকে দৃষ্টি
যেতেই ওর চোখ চড়কগাছ। সাড়ে দশটা বাজে! দিগন্ত রাতে এসেছে খেয়ালেও নেই। কারণ রাতে সে ঘুমে বেহুশ ছিল। কোনোমতে, উঠে দরজাটা খুলে আবার ঘুম। সারারাতে একটু জাগেও নি।
বেলা হয়ে গেছে! শিফা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হতেই ধাক্কা খেলো। দিগন্তকে দেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকেও গেল। অমানুষটা কখন এসেছে? আসার কারণ কি? ওহ, নিশ্চয়ই ভালো সাজতে এসেছে। উনি আবার অভিনয়ে খুব পারদর্শী কী না! অসভ্য একটা! দিগন্ত ফোনে কথা বলতে বলতেই রুমে ঢুকল। আর শিফা ছুঁটে রান্নাঘরে গেল; খাবার খুঁজছে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে! গতকাল দুপুরের পর কিচ্ছু খাওয়া হয় নি। সে খাবার নিয়ে খেতে বসে গেল। তমা এসে হাসতে হাসতে গতরাতের ঘটনা বলল। শিফা চুপ করে শুনল। ইচ্ছে নেই, কিছু বলার। তখন দিগন্ত এসে বাসায় যাওয়ার তাড়া দিলো। জরুরি পড়েছে ফিরতে হবে। শিফা হাত ধুয়ে বলল,
-‘আমি পরশুদিন যাব।’
-‘না, এখনই আমার সাথে যাবে।’
-‘কেন?’
-‘তোমাকে ছাড়া রুমটা শূন্য লাগে।’

দিগন্তের কথা শুনে রাফি, তমা, শিহাব উচশব্দে হাসল। আহা! কত্ত ভালোবাসা। শিফার বাবাও মৃদু হাসলেন। এদের দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেই পারে না। দু’টোতে সারাজীবন এমনই থাকুক। উনি অশ্রু মুছে মন থেকে দোয়া করলেন। শিফার আম্মু এসে তাড়া দিলেন। দিগন্ত যা বলেছে, তাই হবে। অর্থাৎ ওর যেতে হবে। কিছুদিন পরে নাহয় আবার বেরিয়ে যাবে। শিফা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রেডি হতে গেল। গোপন ফোন সঙ্গে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। সেটা অন করে মেসেজটা দেখেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। হাসিবুলকে মেসেজ করে তথ্য জেনে নিজেকে সামলে নিলো। স্বাভাবিক
থাকতে হবে ওকে। নয়তো দিগন্ত সন্দেহ করবে।
শিফা চোখে মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে বের হলো।
দিগন্ত সোফায় বসে পা নাচাচ্ছে। শিফা নিশ্চুপ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বিদায় নিলো। তনয়কে আদর করে গাড়িতে গিয়ে বসল। দিগন্তও বিদায় নিয়ে বসলে দু’জনেই বেরিয়ে গেল। সবাই ওদের দেখলেন আর দোয়া করলেন। শিফা সিটে বসে চোখ বন্ধ করে আছে। দিগন্ত শিষ বাজিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
-‘প্রাক্তনের জন্য কষ্ট হচ্ছে বুঝি? আহারে, থাক কষ্ট পেও না।’

শিফা চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলে খুব শান্ত কন্ঠে বলল,
-‘ সর্বদা আমার হৃদয়েই আঘাত করেন কেন?’
-‘খু্ব বেশিই কষ্ট হয় বুঝি?’
-‘ সুযোগ বুঝে করেই নাহয় বুঝিয়ে দিবো।’
-‘অপেক্ষায় রইলাম।’

দিগন্ত পুনরায় শিষ বাজাতে গেলে শিফা চোখ খুলল। দিগন্তের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। দিগন্ত খেয়াল করে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে মৃদু হাসল। অর্থাৎ কি দেখো? শিফা দৃষ্টি না সরিয়ে তাকিয়েই রইল। সাফা ঠিক বলেছিল দিগন্ত খুব সুদর্শন। শ্যামবর্ণের হলেও নজরকাড়া। বিশেষ করে ভ্রু আর চোখজোড়া। কিছুক্ষণ চুপ থেকে
শিফা বলল,
-‘আপনি দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর!’
-‘কাহিনী কী বলো তো?’
-‘কাহিনী নেই। সত্যিটা বললাম।’
-‘রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি।’
-‘উহুম, শুধু সত্যিটা বললাম। ওহ হ্যাঁ আপনার আম্মু সেদিন বললেন, ওই রয়েল হসপিটালের মালিক দেশের বাইরে থাকেন। প্রশান্ত ভাইয়াকে তিনি সব দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তাহলে দলিলে মালিকের নামের জায়গায় আপনার নাম কেন?’

To be continue……!!

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[০৯]

হসপিটালের কথা শিফা তাহলে জেনেই গেছে। তাতেও কি? শিফার আরো জানা উচিত ছিল।
দিগন্তের মধ্যে হেলদোল দেখা দিলো না। কারণ জানে, শিফাকে বলে লাভ হবে না। তাই বলাও
বৃথা! শিফা কতটা উড়তে পারে? ধৈর্য্যের ও তেজ
কতদিন থাকে? ওর চোখের আড়ালে আরো কি কি করতে পারে? ক্ষমতা, বুদ্ধি, জোর, জেদ কত দিন থাকে? এসব দেখতেই ওকে ছেড়ে রেখেছে।
সব রকমের সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছে। যদিও ডানা কাটার সময় চলে এসেছে। প্রস্তুতও আছে! শুধু মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা। তারপর বরবাদ।
এই গতকালই তো, স্বপ্নীলকে শুটের পারমিশন দিয়েছে। তবে, বুকে নয় হাতে। সহজে মরে গেলে মজা আসবে না। মজা ছাড়া খেলাও জমে না। স্বপ্নীলের কিছু করতে মায়াও লাগে। বেচারা খুব ভীতু! কিন্তু কিছু করার নেই। করাও অাবশ্যিক।
শিফাকে খোঁচাতে হলে স্বপ্নীলকে আঘাত করতে হবে। নয়তো শিফা রাগবে না। আর না রাগলে ভুলও করবে না। কিন্তু ভুল করাটা খুব দরকার।
দিগন্ত চাচ্ছে, শিফাকে রাগাতে। নয়তো অনেক কিছুর হদিস পাবে না। সব ওর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তা কি আর হতে দেওয়া যায়? উহুম, না মোটেও না। শিফা যত রাগবে তত ভুল করবে। অথচ মেয়েটা রাগছেই না। বরং শান্ত হয়ে বসে আছে। আহা, কি সুন্দর করে কথা বলছে। যেন হসপিটালের কথা বললে সে থতথম খাবে। হ্যাঁ, রয়েল হসপিটালটা তার। আর নিজের জিনিসে
নিজের নাম থাকবে; এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটা গাধী একটা! সহজ কথাটা বুঝছে না। দিগন্তকে হাসতে দেখে শিফা পুনরায় বলল,

-‘মালিককে গুম করে হসপিটালটা নিজের নামে করে নিলেন। দারুন ব্যাপার। আচ্ছা, আপনার কি বিবেক বলে কিছু আছে?’

দিগন্ত একহাতে চুলে হাত বুলিয়ে শিষ বাজিয়ে গাড়ির গতি অনেকটাই কমিয়ে দিলো। তারপর
বামে মোড় নিয়ে শিফার দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘হুম নিলাম। তাতে কী? আর কি বললে, বি বি হ্যাঁ বিবেক। বাপ্রে, কী কঠিন শব্দটা। যাই হোক, এটা আবার কি?’

-‘না চেনারই কথা। ওটা তো মানুষদের থাকে।’
-‘আমাকে গরু মনে হয়?’
-‘ গরু হবেন কেন? আপনি, আপনি তো হলেন অমানুষ। হ্যাঁ, এই একটা শব্দ’ই আপনার জন্য পারফেক্ট। পছন্দ হয়েছে শব্দটা?’
-‘হুম খুব-ব। এজন্য কাছে এসো একটা আদর দেই।’

শিফা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। পশুর চামড়াও নেই এর শরীরে। নয়তো এত বেহায়া, নিলজ্জ, হতো না। একে অমানুষ বলতেও রুচিতে বাঁধে।
এরচেয়েও নিকৃষ্ট সে। শিফা ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। থুথু ছুঁড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু এটা করাও সম্ভব নয়। শিফার মুখভঙ্গি দেখে দিগন্ত হাসল। তার শরীরে রক্ত ফুটছে। তবুও স্বাভাবিক আছে।
অবলীলায় অপমান করল। না, মেয়েটাকে কিছু করা দরকার। আজকাল একটু বেশি মুখ ছুটছে। দিগন্ত দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিলো। হাবভাব এমন, শরীরের আলসেমী ঝারছে। না, করলেই নয়। শিফা ঘুরে এদিকে তাকাতে; দিগন্তের কনুঁই লাগল, ঠোঁট বরাবর। ব্যস, দাঁতে লেগে ঠোঁটটা কেটে রক্ত গড়িয়ে গেল। শিফা ঠোঁট চেপে ধরল।
আচমকা স্বজোরে লাগাতে মাথাটাও ঘুরে গেছে। জ্বলছেও খুব। দিগন্তের ইচ্ছেকৃত করা বুঝতে ওর বাকি নেই। শিফা নিশ্চুপ! দিগন্ত মুখটা বাঁকিয়ে বলল,
-‘সরি, ইস রে, খুব ব্যথা পেয়েছো?’
-‘না, চাইলে আবার দিতে পারেন।’
-‘এটা আগে হজম করো মনে করে পরে দিবো।’

কথাটা বলে দিগন্ত হাসল। শিফা চুপ করে হাতে লেগে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের রক্ত! তবে ভুলে ব্যথাতুর শব্দটুকু করল না।ওর ঠোঁটটা ফুলে গেছে। এটা দেখেও দিগন্ত হাসছে। আজকে ওকে হাসির রোগে ধরেছে। না চাইলেও হাসি পাচ্ছে। প্রথমে নিঃশব্দে হাসলেও পরে শব্দ করে হাসতে লাগল। হাসতে বেশ লাগছে।
_________________________________

বেশ কিছুদিন পর,

দিগন্ত এখন হসপিটালের কাজে প্রচুর ব্যস্ত। তা কিসের এত ব্যস্ততা? কেবল সেই জানে! কাউকে বলেও না। বাসাতে আসা-যাওয়ারও ঠিক নেই।
হুট করে আসে; চলেও যায়। শিফাও কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে দেখে যায়। তবে দিগন্ত আঘাত করতে ছাড়ে না। সুযোগ পেলেই হেসে কাজ সেরে ফেলে। আঘাত করার ধরণও নেই! মানসিক বা শারীরিক! যে কোনো একটা হলেই হয়। তবে হ্যাঁ,
আঘাতটা করেই ছাড়ে। এখন নিত্যদিনের কাজ হয়েই দাঁড়িয়েছে। এটা করে সে বেশ মজাও পায়।
তবে শিফা প্রত্যুত্তরে কিচ্ছু বলে না। দিগন্তকেও খোঁচায় না। সে আগের তুলনায় থম মেরে গেছে৷ চঞ্চলতাও নেই! যে যা বলে মুখ বুঝে মেনে নেয়। শাশুড়ি আর নিহার মতো সংসারে মন দিয়েছে। স্বামীর সেবাতেও মগ্ন থাকে। দিগন্ত উস্টা দিলেও, উঠে দিগন্তের কাছ ঘেষেই দাঁড়ায়। ওর কটু কথা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, সব সহ্য করে নেয়। এই শিফা যেন অন্য কোনো শিফা। তেজী ও সাহসী শিফা নয়। কেউ যেন জাদুর প্রভাবে ওকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। পূর্বের তেজী রুপটাও চাপা পড়ে গেছে। এহন পরিবর্তনে দিগন্তের মাথাব্যথা নেই। সময় কোথায় ? সে আছে নিজের ভুবনে। বাকি সবাই
ওর কাছে ফিঁকে। শিফা মরুক, বাঁচুক, তাতে ওর কী! উটকো ঝামেলা একটা!

এভাবেই সময়গুলো কাটল লাগল। রাত পেরিয়ে দিন। আর এক একটা দিন পেরিয়ে মাস গড়াতে লাগল। দিগন্ত অপমান করলে শিফা মাথা নিচু করে থাকে। অশ্রু ঝরায়! তবে ভুলেও প্রত্যুত্তর করে না। সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়াতে বললে তাই’ই করবে। ওর কোনো কথার হেড়ফের করবে না। তাই দিগন্ত আর কিছু বলে না। এসব নখরা ওর বরাবরই অপছন্দ। তাছাড়া, অহেতুক সময় ব্যয়ের মানেই হয় না। সময়ের মূল্য বোঝে সে। এভাবেই কেটে গেছে আরো তিনটা মাস।

সময় অতিবাহিত হচ্ছে সাথে জীবনের মোড়ও।
এই তিনমাস ধরে স্বপ্নীল নিখোঁজ। তাও আহত অবস্থায়। কোনোভাবেই সন্ধান মিলে নি। শিফা কানাডায় গিয়ে হন্ন হয়ে খুঁজেছে। কিন্তু পায় নি।
সাফা নেই আর স্বপ্নীলও নিঁখোজ। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে সাফার বাবার হার্ট এ্যার্টাক হয়।
হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথে উনি মারা যান।
সাফার আম্মু এখন শয্যাশায়ী! কিছু বললে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। যেন উনার সব কথা ফুরিয়ে গেছে। কিছু বলার শব্দ খুঁজে পান না। সুখ-দুঃখ আর হারানোর শোকে বাকশক্তি হারিয়েছেন। সাজানো সংসারটাকে নিঃশেষ হতে দেখেছেন। মেয়ে এবং স্বামীর লাশ দেখে বাঁচার ইচ্ছেটুকুও শেষ। কলিজার টুকরো ছেলেও পাশে নেই। সেও হয়তো…..! ছেলে, মেয়ে, স্বামী, সুখ, আর কিছুই তো নেই। উনি থেকেই বা কি করবে?
তাই দিন-রাত নিজের মৃত্যু কামনা করেন। উনি মৃত্যুকে গ্রহন করতে প্রস্তত!
বর্তমানে উনি হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। উনার অবস্থাও যায় যায়। মনোবল না থাকলে যা হয় আর কি! শিফা রোজ দু’বার করে দেখে যায়।

এসবের মধ্যেই তনয়কে অপহরণ করা হয়েছিল।
তিন দিন আটকে রেখেছিল। টাকা বা অন্যকিছু
দাবিও করে নি। শুধু তনয়ের বাম হাতটা কবজি অবধি কেটে দিয়েছে। ছোট্ট বাচ্চাটা নিজের হাত দেখে কাঁদে। কেউ নাকি ওর সঙ্গে খেলে না।ওকে দেখে হাসে! চঞ্চল, প্রানবন্ত, তনয়ও এখন শান্ত হয়ে থাকে। এই ঘটনায় ছোট্ট বাচ্চাটার জীবনের রং বদলে গেছে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অাহত তনয়ের পকেটে শিহাব কালো কাগজের চিরকুট পেয়েছিল। তাতে
সাদা কালিতে লিখা ছিল,’শিফার উড়নচণ্ডীর উপহার।’

তখন থেকে শিফা জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছে।
জীবনের খৈই হারিয়ে ফেলেছে। সাহস ও জোর বিসর্জন দিয়েছে। শিফা সেদিন দিগন্তের পায়ের কাছে মাথা নিচু করেও বলেছে,
-‘আমার সবকিছু ফিরিয়ে দেন। আর লড়াইয়ের কথা মুখেও আনব না। সারাজীবনের জন্য হার স্বীকার করব।’

দিগন্ত প্রত্যুত্তরে কিছু বলে নি। শুধু শিফার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। মুখে তার বাঁকা হাসির রেশ।
তারপর থেকে’ই দিনগুলো এমন যাচ্ছে। শিফাও
আর লাগতে যায় নি। কমকিছু তো হারালো না।
আর কত? ওর আপনজনগুলোই নাহয় ভালো থাকুক।

দিগন্ত কেবল বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। রাত তখন দুইটা সতেরো। অনেক রাতেই ফিরে। শিফা এগিয়ে দিগন্তের চুল মুছিয়ে কফির মগটা হাতে দিলো। বেলকনিতে তেয়ালে মেলে দিগন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
-‘আর কিছু লাগবে?’
-‘হুম! উষ্ণ আদর কলঙ্কের ন্যায় ছড়িয়ে দিতে চাই; তোমার সর্বাঙ্গে।’
-‘এমন তো কথা ছিল না, ঘুমান।’
-‘উহুম, আমার সুখময় আদরে আজ ঝলসে যাক তোমার হৃদয়। আমি যত্ন করে রেখে দিবো, আমার বক্ষপিঞ্জিরায়।’

শিফা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। কিছু বলার নেই ওর। দিগন্ত হেসে ওকে কাছে টানছে। গাল দু’টো ধরে দিগন্ত ওর চোখে চোখ রাখল। শিফাও চুপ করে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। এই দু’চোখেতে অসীম মায়া। অথচ মনটা এত কঠিন কেন? এত পাষাণ কেন এই মানুষটা? এর
হৃদয়ের আনাচে-কানাচে কী একটুও মায়া নেই? কেন নেই? থাকলে তো গল্পটাও অন্যরকম হতে
পারত! দিগন্ত একদৃষ্টিতে শিফার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দু’টো দিগন্তকে খুব আকৃষ্ট করে। লোভও হয়! ওর বৈধ অধিকার আদায়ের লোভ। তখন শিফা বলল,
-‘এত পাষাণ কেন আপনি?’
-‘জানি না। বাঁধা দিবে না নয়তো রেগে যাবো।’
-‘মনের টান নেই। সেখানে শরীর …!’
-‘আগে শরীরের হিসাবটা চুকায় তারপরে নাহয় মনেরটা।’

দিগন্ত ওর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করতেই শিফা ডুকরে কেঁদে দিলো। মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে, মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। বুকে ধাক্কা দিয়েও সরানোর বৃথা চেষ্টা করল। তবে পারল না। কারণ দিগন্ত পুরো ভরটুকু ওর উপরে ছেড়ে দিয়েছে। শিফার নড়ার ক্ষমতা নেই। চেষ্টাও বৃথা। দিগন্ত শুধু মিটিমিটি হাসছে। একপর্যায়ে শিফা হাল ছেড়ে নিশ্চুপ হয়ে রইল। পুরুষের শক্তির কাছে নারীর শক্তি বৃথা! এটা মানতে বাধ্য! সেও পারল না। সত্যি বলতে, মন ও শরীর আর জোরও নেই। বেঁচে আছে এই ঢের! এখন সহ্য করা আর অশ্রু ঝারানো ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। শিফাকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত শব্দ করে হেসে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। খুব
শক্ত বাঁধনে! যেন শরীরের মধ্যেই ঢুকিয়ে নিবে। শিফা খুব ব্যথা পেলেও প্রকাশ করল না। লাভও হতো না। শিফা শেষ চেষ্টাটুকু করেও ব্যর্থ হলো।
দিগন্ত শিফাকে আর সুযোগ দিলো না। নিজের কাজে মগ্ন হলো। পুরুষালি শক্তির কাছে শিফাও হার মানল। অশ্রু ঝরিয়ে গ্রহন করল ভাগ্যকে!
দিগন্ত ততক্ষণে তলিয়ে গেছে এক অনিন্দ্য সুখ রাজ্যে। বদ্ধ উন্মাদের মতো! একপর্যায়ে শিফাকে দিগন্তের আদর নামক কলঙ্ক’ই মাখতে হলো; ওর পুরো সর্বাঙ্গে।

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here