সাঁঝক বাতি,১৮,১৯
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৮]
দিগন্তকে হাসতে দেখে স্বপ্নীল স্বজোরে এক লাথি বসাল। পা বাঁধা না থাকায় সম্ভব হয়েছে। অদূরে থাকায় দিগন্তেরও লেগেছে; হাঁটু বরাবর। দিগন্তও রেগে স্বপ্নীলের বুক বরাবর লাথি দিলো। স্বপ্নীল
চেয়ারসহ মেঝেতে পড়ে পেল। আর মুখে থেকে বেরিয়ে এলো, ‘মা।’ মধুর এক ডাক। মনে আর মুখে সর্বদা ‘মা’ ডাকের বিচরণ। তাই সামান্য ব্যথা পেলেও আগে ‘মাকেই’ স্মরণে আসে।’মা’ অতি আপন কি না তাই। স্বপ্নীলের দু’হাত বাঁধা চেয়ারের সাথে। শত চেষ্টা করেও বাঁধন খুলতে পারছে না। দিগন্ত সেই অবস্থাতেই লাথি দিয়েই
যাচ্ছে। যেন ফুটবলকে কিক মারছে। রাগে ওর শরীরের রক্ত ফুটছে। এত বড় কলিজা দিগন্তের শরীর স্পর্শ করেছে! যেটা আজ অবধি কারোরই
সাহসে হয় নি। আর চুনো পুটিঁ! এজন্য শাস্তিও প্রাপ্য। দিগন্ত মারতে মারতে বিশ্রীসব গালি দিয়ে বলল,
-‘মা***তোকে পুঁতে ফেলব। জানিস আমি কে? হিরোগিরি দেখাস আমার সাথে! ঝলসে দিবো, শালা হারামজাদা।’
স্বপ্নীলের নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। লাল রক্তে মুখটাও লাল হয়ে আছে। রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে টপটপ করে পড়ছে। দেখতে খুব
ভয়ংকর লাগছে। তবুও দিগন্ত থামছে না। রাগে সে কাঁপছে। স্বপ্নীল তখন অনেক কষ্ট বলল,
-‘এক বাবার ছেলে হয়ে থাকলে তুই বাঁধন খুলে দেখ। কাপুরুষ একটা।’
-‘ খুললে কী করবি, কুত্তার**?’
-‘খুলে তো দেখ।’
-‘ধৈর্য্য ধর, কালকেই তোর সব শখ মিটাবো।’
-‘এখন কি সাহস নেই?’
দিগন্ত সত্যি সত্যি’ই বাঁধন খুলে তাৎক্ষণিক মার শুরু করল। হকিস্টিক দিয়ে। স্বপ্নীল উঠে দাঁড়াতে পারল না। সেই সুযোগটুকুও দেওয়া হলো না।সে মাথা ধরে বসে পড়ল। দিগন্ত প্রচন্ড রেগে বলল,
-‘আমাকে চ্যালেঞ্জ? তোর কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব, ব্লাডি বিচ! অজানা কারণে
বেঁচে যাচ্ছিস। নয়তো বুলেট গিলিয়ে দিতাম।’
-‘মেরে দে। দেখি, তোর বুকে কেমন পাটা।’
স্বপ্নীলের কথায় দিগন্ত চুপ হয়ে গেল। কিছু ভেবে শিফাকে ফোন দিলো। রাত তখন সাড়ে তিনটা।
শিফা কল রিসিভ করল না। হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন। স্বপ্নীল রক্তাক্ত অবস্থায় হাসছে। দিগন্ত ওর হাসির কারণও বুঝেছে। তবে এখন কথা বাড়াল না। কালকেই জবাবটা দিয়ে দিবে। বুঝিয়ে দিবে সে কয় বাবার ছেলে! সে কে? আর ঠিক কেমন ধাঁচের? সুখু এসে দিগন্তকে অনেক কষ্ট সরালো।
নয়তো মেরেই ফেলতো। দিগন্ত ভয়ানক রাগী।
রাগ উঠলে হুশ থাকে না। নিঃশেষ করেই ক্ষান্ত হয়। স্বপ্নীল তবুও হাসছে। দিগন্তকে দেখেই হাসি পাচ্ছে। স্বপ্নীলের চালাকি দিগন্তও ধরে ফেলেছে।
রাগিয়ে দিয়ে’ই সে বাঁধন খোলার বুদ্ধি এঁটেছে।
তা তো হয় না। সে অন্যকে ঘোল খাইয়েই চলে।
এত সহজ নয় বোকা বানানো। সে সুখুকে ইশারা করল, বাঁধতে। তারপর দিগন্ত জোরে আরেকটা কিক মেরে স্থান ত্যাগ করল। মুখে ফিচেল হাসি। খুব শীঘ্রই ওদের দেখা হবে।স্বপ্নীল জ্ঞান হারাল। দিগন্ত পুনরায় ওর বুকে কিক মেরেছে। একটুপরে
সুখু ভয় পেয়ে দিগন্তকে ফোন করে বলল,
-‘ছ্যার, পোলাডা নড়তাছে না। মইরা গেলে?’
-‘মরলে ভালো, তবে না মরলে আরো ভালো।’
-‘এহন কি করতাম ছ্যার?’
-‘ ফোন রাখ। নয়তো নিজের কবর খুঁড়ে রাখ।’
সুখু তাৎক্ষণিক কল কেটে দিলো। তারমানে ওর রাগ কমে নি। এই রাগ কমাতে না জানি কত কী করবে! দিগন্ত বাসায় ফিরে দেখে ওর বাবা পানি খাচ্ছেন। অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। রুমজুড়ে সিগারেটের গন্ধ। সেন্টার টেবিলে অর্ধেক খাওয়া নাস্তা। হয়তো স্পেশাল কাউকে অাপ্যায়ন করে বিদায় করেছেন। উনি চরম মেয়েবাজ। বলারও অপেক্ষা রাখে না। এই লোককে দেখলে ওর রাগ হয়। মন বলে, পেটভর্তি বুলেট গিলাতে। নয়তো তৃপ্তি করে এসিড খাওয়াতে। উনি ওর বাবা নন।
এজন্যই হয়তো এমনটা মনে হয়। উনি সম্পর্কে ওর খালু আর প্রশান্তর মা আপন খালা। আর প্রশান্ত খালাতো ভাই। একথা এখানকার কেউ’ই জানেন না। জানার সুযোগও দেওয়া হয় নি।এর
কারণও আছে। দিগন্তের নিজের বাবা ওদেরকে
রেখে নিখোঁজ হয়েছিলেন। কোনোভাবে সন্ধান মিলে নি। এই শক ওর মা সহ্য করতে পারেন নি। ব্রেন স্টোক করে মারা গিয়েছিলেন। দিগন্ত তখন চার বছরের। অবুজ একটা বাচ্চা। তখন
থেকে সে প্রশান্তে মায়ের কাছে বড় হয়েছে। বুঝে নি ; দিগন্ত উনার ছেলে নয়। পরে একদিন ওর খালা সব জানিয়েছিল। যাতে হঠাৎ কোনোদিন জেনে কষ্ট না পায়। খালাকে প্রচুর ভালোবাসত;
‘আম্মু’ বলেই ডাকত। খালা জীবিত থাকতে ওর খালু অমানুষই ছিল। তবে চাপা ছিলো। এখন এরুপ উন্মোচন হয়েছে। উনি দিগন্তকে অপছন্দ করেন তবে সেটা প্রকাশ করে না। দিগন্তও বুঝে।
তবে কিছু বলে না। সে নিজের মর্জিমতো চলে।
লোকসম্মুখে বাবা বলে ডাকলেও, অন্য সময়ে ফিরেও দেখে না। ঘৃণা হয়। বাবা ডাকটা উনার সঙ্গে যায় না। কলংকিত করেছে এই ডাকটাকে।
উনি প্রশান্ত ও দিগন্তকে অপকর্মের দিকে ধাবিত করেছেন। টাকার লোভ ধরিয়েছেন। মেয়ের প্রতি আসক্ত করেছেন। আর মাঝে মাঝে নিজে ফেঁসে গেলে, ছেলেদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও দিয়েছেন। ছেলে মরুক। নিজে বাঁচলেই হলো। ঠিক এমন জাতের বাবা উনি। উনি ঘুরে দিগন্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? দূর হও।’
-‘জানোয়ারের মতো ব্যবহার কবে ছাড়বেন?’
-‘দিগন্ত!’
-‘আমার নাম দিগন্ত, মনে আছে। আপনাকে মনে করাতে হবে না।’
-‘খুব বার বেড়েছে তোর? দাঁড়া কাল সকালেই তোর হচ্ছে, জানোয়ার একটা।’
-‘সকাল পেলে তো।’
কথাটা বলে দিগন্ত উনার গলা চেপে ধরল। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তিও শুরু হয়ে গেল। দিগন্ত উনাকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর প্যান্টের বেল্ট খুলে বেধড়ক মারতে লাগল। ওর রাগ তুলছে। অনেকদিনের জমিয়ে রাখা রাগ।
মাকে অর্থাৎ ওর খালাকে সে খুব ভালোবাসত। এই লোকই খালাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে। দিগন্ত একথা পরে জেনেছে। তাও আবার উনিই মাতাল অবস্থায় এসব বলেছিলেন।আর দিগন্ত চুপ করে শুনেছিল। খালাকে মারার কারণ, উনি সবাইকে পাতালঘরের অপকর্মের কথা জানিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। পাপকর্ম থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। এজন্য উনি খালাকেই সরিয়ে দিয়েছেন। বেল্টের মার খেয়ে উনি ছটফট করতে লাগলেন। অর্ধনগ্ন দেহে কালশিটাও পড়ে গেছে। দিগন্ত উনাকে মারতে মারতেই অবচেতন করে ফেললো। তারপর ধরে ওর রুমে যাওয়ার পথে সাবিনা খালা দেখে নিলেন। দিগন্ত মুচকি হেসে বলল,
-‘খালা আপনার কিডনী দুইটা, তাই না?’
-‘জ্বে ভাইজান।’
-‘আমাকে দিবেন?’
-‘ন ন না ভাইজান।’
-‘তাহলে বলুন, আপনি কিছু দেখেছেন?’
-‘না ভাইজান।’
-‘ভয় পাবেন না খালা। ভয়ে আপনি ভুলভাল
ডাকছেন। অন্যসময়ে বাপজান ডাকেন। এখন ভয়ে ভাই বলে ফেলেছেন। লাগাম ঠিক রাখুন, আপনিও ভালো থাকবেন।’
-‘জ্বে আচ্ছা।’
দিগন্ত কথাগুলো বলে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তারপর গোপনঘরের সিঁড়ি বেয়ে খালুর পাতালঘরে চলে গেল।খালুর পাতালঘরেই কাজ সমাপ্ত। যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। আহা,কত্ত চমৎকার বুদ্ধি। দিগন্ত পানি ছিঁটিয়ে উনার জ্ঞান ফিরালো। নয়তো মেরেও মজা পাবে না। অথচ মজার পাওয়ার জন্যই এতকিছু করা।মরার ভয় চোখে না থাকলে কিভাবে হবে? সব কষ্টই বৃথা।
দিগন্ত উনার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
-‘খালুজান ভালো আছেন? আপনি নিজে তো অমানুষ; আমাকেও বানিয়েছেন অমানুষ। কেন বলুন তো?’
-‘সোনা আব্বা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আব্বু হই না তোমার? আমার ভুল হয়ে গেছে; আব্বা। ভুলেও আর এমন ব্যবহার করব না।’
দিগন্ত হাসল। আর হাসতে হাসতে বসেও পড়ল।
আজকে দিনটা হাসতে হাসতে গেল। চারপাশে এত শয়তান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের কর্মে না হেসেও পারছে না। খালু ওকে আঘাত করতে
গিয়েও ব্যর্থ হলো। খালু হাল ছাড়লেন না।চেষ্টা করতে থাকলেন বাঁচার। দিগন্ত ওর পকেট থেকে ইনজেকশন বের করে উনার কাঁধে পুশ করল।
উনি আঁকুতি মিনতি করতে লাগলেন। তবে ওর মন গলল না। উনি ধপ করে পড়ে গেলেন। হুশ নেই। দিগন্ত উঠে একটা বক্স আনল। সেখানে সার্জারির যন্ত্রপাতি আছে। চকচক করছে। যেন সদ্য কিনে আনা।দিগন্ত সময় নিয়ে উনার চোখ, কিডনী, লিভার বের করল। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। প্রশান্ত আর দিগন্ত দু’জনেই এসব কাজ পারে। শিখেছে। কালকে সুখুকে দিয়ে একজনের কাছে পাঠাতে হবে। টাকা পরিমানও বেশি পাবে। আপন খালুজানের পার্টস্ বলে কথা। দিগন্ত সব প্রয়োজনীয় পার্টস নিয়ে মৃত বডি এসিডের কূপে ফেলে দিলো। সেকেন্ডেই কঙ্কাল ভাসতে লাগল।
দিগন্ত রড দিয়ে তুলে দেওয়ালেই ঝুলিয়ে রাখল। নিচে নাম ঠিকানাও লিখল। তারপর সুইচ বাটন চেপে হাসল। মেঝেতে পড়ে থাকা সব রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। পাতালঘর এই পদ্ধতিতে বানানো। রক্ত ধোঁয়ার ঝামেলাও নেই। ঘড়িতে তখন চার’টা।
দিগন্ত সব কাজ সেরে রুমে চলে গেল। আজকে ঘুম হলো না। ধ্যাত, কালকে চোখের নিচে কালি না পড়লেই হয়। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই, শিফার কথা মনে হলো। কিছু একটা ভেবে হেসে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।
গভীর স্পর্শে শিফার ঘুম হালকা হলো। প্রথমে না বুঝলেও, পরে বুঝে স্বজোরে ধাক্কা দিলো। তবুও মানুষটাকে সরাতে পারল না। শিফা চোখ খুলে দিগন্তকে দেখে হতভম্ব। দিগন্ত এখানে? সে ঠিকানা জানল কিভাবে? কখনই বা এলো? ওর এখানে আসার কারণ কি? মুহূর্তে শিফার মাথায়
এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘড়িতে কেবল পাঁচটা সাত বাজে। সে পুনরায় দিগন্তকে সরাতে ব্যর্থ হলো। দিগন্ত তখন কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
-‘বাবা হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি খারাপ স্বামী হলেও ;একজন ভালো বাবা হবো।’
To be continue………!!
-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৯]
-‘বাবা হওয়ার সুযোগ দাও। আমি খারাপ স্বামী হলেও ;একজন ভালো বাবা হবো।’
শিফা নিষ্পলকভাবে দিগন্তের দিকে চেয়ে রইল।
কত চমৎকার আবদার! প্রত্যেকটা স্বামী যেমন আবদার করে। ওরও ঠিক তেমন’ই আবদার।
অথচ পরিস্থিতি ভিন্ন। বেঠিক সময়। মানুষটাও ভুল। দিগন্ত ভালো হলে ওদের গল্পটা অন্যরকম হতো পারত। সুখ দিয়ে সংসার সাজাতে পারত। দু’জন একসঙ্গে পথ চলার প্রতিজ্ঞা করত।একে অন্যের বিশ্বাস হয়ে থাকত। অন্তস্থল থেকে গাঢ় প্রনয়ের রচনা তৈরি করত। এই রচনায় দু’জন
মানব- মানবীর উন্মাদিত প্রনয়ের কাহিনী লিখা থাকত। কতই না সুন্দর হতো ওদের দিনগুলো।
শিফার স্থানে সাফাও থাকতে পারত। যেই থাক, জীবনটা অন্তত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ থাকত।
এখন যেভাবে দিন কাটছে; এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। বেঁচে থেকেও যেন জীবন্ত লাশ। এখন মুখে হাসি ফোঁটে না। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতেও পারে না। প্রায় সময় দুঃচিন্তায় ডুবে থাকে। এই জীবনে সুখের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সুখ নিখোঁজ।
ভালো নেই। একটুও ভালো নেই। খুব ক্লান্ত সে।
এসব ভেবে শিফা দিগন্তের দিকে তাকিয়েই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। প্রত্যেকটা মেয়ের মনে ভালোবাসা, স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে নানান ভাবনা থাকে। নিজস্ব কল্পনার জগৎ থাকে।ওর
ও ছিল। সেও স্বামীর ভালোবাসা আশা করত।
ফুটফুটে একটা বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্নও দেখত।
স্বামী সোহাগী হতে চেয়েছিল। অথচ! সে বাবার প্রাণ ভোমরা। তেমনি স্বামীরও প্রাণ ভোমরা হতে চাইত। আকাঙ্খা ছিল; স্বামী নামক মানুষটা ওর আসক্তিতে ডুবে থাকুক। ভালোবাসুক! আগলে ওকে রাখুক। ওর রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে দিক প্রণয়ের ব্যাধি।
তবে পরিস্থিতি আজ ভিন্ন। স্বপ্ন ধূলিসাৎ।জীবন
অনিশ্চিত! সুদর্শন স্বামী, সংসার, সেও, আছে। শুধু সুখ নেই। তবে ইচ্ছেগুলো রয়ে গেছে। মনে হানাও দেয়। একমুঠো সুখের বাসনা সেও করে। সুখপূর্ণ জীবনের স্বাদ পেতে শখও জাগে। তবে সেটা আর সম্ভব নয়! জীবনের মোড় বাজেভাবে
ঘুরে গেছে। পূর্বের মতো হওয়ার সম্ভবনাও নেই। হয়’ও না। দিগন্ত শিফাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। সময় নিয়ে, গভীরভাবে। স্বযত্নে আদুরে স্পর্শ। শিফা দু’চোখ বন্ধ করে নিলো। টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। ওর হাতজোড়া দিগন্তের আঙ্গুলের ভাঁজে বাঁধা। বেশ শক্তভাবে। সে নড়লে’ই দিগন্ত বেশি ভর দিচ্ছে।
তাই নড়তেও পারছে না। এটা দেখে; এই বেহায়া পুরুষটা হাসছে। দিগন্ত হঠাৎ শিফার অশ্রু শুষে নিয়ে বলল,
-‘আমার জীবনটা ঠিক শুকনো বকুলের মতো।
না আছে সৌন্দর্য ;না সুগন্ধ।’
শিফা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। সাফা বলত;
দিগন্তের চোখ কথা বলে। আসলেই কি তাই? সে কি এই চোখের ভাষা পড়তে পারবে? চোখ দু’টো
কি ওকে কিছু বোঝাতে চায়; বলতে চায়? বুঝছে না তো! তবে দিগন্ত অদ্ভুত এক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। সত্যিই অদ্ভুত! দিগন্তের চোখের ভাষা সে পড়তে চায় না। আসক্ত হতেও চায় না। ডুবতেও চায় না; মোহপ্রাপ্ত চোখজোড়ায়। সেই চোখে ওর সর্বনাশ নিশ্চিত। তাই ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
-‘ফুল পবিত্র। আর আপনি..!’
দিগন্ত হাসল। পুনরায় শিফার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে
কানের কাছে মুখ নিয়ে আদুরে সুরে বলল,
-‘ভূমিকায় না থাকলেও উপসংহারে তোমাকেই থাকতে হবে। হোক, আমার জীবিত অথবা মৃত
অবস্থায়।’
শিফা দিগন্তকে সরাতে ধাক্কা দিতে থাকল। ব্যর্থ হলো। ওর কাব্যিক কথায়, শিফা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলো। প্রণয়বাক্য ওর মুখে শ্রীহীন। ওর জন্য খুন, রক্ত, বেইমানী, হিংস্রতা, কঠোরতরা,
এসবই পারফেক্ট। দিগন্ত ছড়ালোও না, নড়লোও না। বরং আদুরে স্পর্শে মগ্ন হলো। ওর পুরুষালি শক্তির কাছে শিফাকে হার মানতে হলো। আজও ব্যর্থ হলো। তবে খেয়াল করলে বুঝত; দিগন্তের
স্পর্শে হিংস্রতা নেই। খুবলে খাওয়ার তাড়া নেই।
শিফাকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
-‘ জানো, সাকা চৌধুরী বলেছিলেন; ধর্ষণ যখন নিশ্চিত, তখন তা উপভোগ করাই শ্রেয়। আমি ধর্ষক নই! আমি বৈধপ্রাপ্ত তোমার পতি।’
শিফা হারল। মেনেও নিলো। নিশ্চুপ হয়ে ছোঁয়া সহ্য করল। সময়ও গড়াতে থাকল। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘড়িতে এখন সাতটা ছাব্বিশ। শিফা উঠতেও পারছে না। দিগন্ত ওকে আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।
নিশ্চিন্তের ঘুম। শিফা ওকে সরাতে গেলে দিগন্ত বলল,
-‘ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিও না। নয়তো স্কিণে সমস্যা দেখা দিবে। ঘুমাও, ঘুমাতেও দাও।’
কথাটা বলে পুনরায় ঘুমে তলিয়ে গেল। শিফাকে আরো শক্ত করে ধরে। যেন বাহুডোরে ঢুকিয়েই ফেলবে। শিফা প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ওর লাগছে।
এভাবে কেউ ঘুমায়? অসভ্য একটা! এটা কোনো কথা! শিফা বুদ্ধি খাঁটিয়ে দিগন্তের কানের কাছে চিৎকার করে বলল; ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খাব’ও।
শিফাকে থামাতে দিগন্ত স্বজোরে’ই ঠোঁট কামড় ধরল। শিফা ছটফট করলে ওকে ছেড়ে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। যেন কিচ্ছু করেই নি। শিফা ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখে রক্ত। কেটে গেছে। শিফাও
দিগন্তের গলায় কামড়ে দৌড়ে চলে গেল। নয়তো শান্তি পেতো না। দিগন্ত শব্দটুকুও করল না।বরং
হাসল। শিফা দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেল। খাওয়ার সময় নেই। দিগন্ত ঘুমাচ্ছে। শিফা কাল প্রশান্তের গোপন আস্তানার সন্ধান পেয়েছে। তাই
সেখানেই যাচ্ছে। খবর পেয়েছে; প্রশান্ত’ও নেই।
হাসিব যেতে চাইলে নিষেধ করে দিলো। শিফা
সতর্কতার সাথে সেখানে প্রবেশ করল। ভয়ংকর জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েকজন বসে তাশ খেলছে। শিফা বিপরীত দিকে শব্দ করে লুকিয়ে গেল। দু’জন লোক উঠে দেখতে গেল।হেলা করা যাবে না। প্রশান্ত জানলে জীবন্ত কবর দিবে। বড় এক থামের পিছনে শিফা লুকিয়ে আছে। বাইরে দিন। অথচ ভেতরটা রাতের মতো’ই অন্ধকার।
ভয়ে বুক কাঁপছে। হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেয়ে শিফা চমকে উঠল। ধীরে ধীরে পেছনে তাকাল। কেউ নেই। ওর মনের ভুল। শিফা আর একটু সামনে এগোতেই কেউ বলল,
-‘হেই, হটি গার্ল লুক এট মি।’
শিফা পেছনে ঘুরে দেখে প্রশান্ত দাঁড়িয়ে আছে।
মুখে কুটিল হাসি। পরণে ফোর কোয়াটার প্যার্ট আর সবুজ র্টি-শার্ট। পোশাকও কুঁচকে আছে।
কেবল ঘুম থেকে উঠেছে, বেশভূষায় সেটা স্পষ্ট।
শিফাও ধরা পড়ে গেছে। তবুও বিচলিত না হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ওর লকেটে থাকা ক্যামেরায় সব রেকর্ড হচ্ছে। এত কঙ্কাল দেখে সে হতভম্ব।
প্রশান্ত একটা সুইচ চেপে দরজা বন্ধ করে দিলো। এখানে আসতে শিফাকে আঠারোটা দরজা পার হতে হয়েছিল। আর আঠারো’টা দরজায় প্রশান্ত একেবারে বন্ধ করে দিলো। মাত্র একটা সুইচে।
প্রশান্ত আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল,
-‘ আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইউ।’
-‘কেন?’
-‘ জানতাম তুমি আসবে। এজন্য আসার পথে বাঁধাও রাখিনি। এখানে একটা বিশেষত্ব আছে। অচেনা কেউ প্রবেশ করলে টিউন বেজে উঠে। সেটা কেবল আমারই কাছে।’
শিফা নিশ্চুপ। পাশের রুম থেকে কেউ চিৎকার
করছে। ছেড়ে দেওয়ার আঁকুতিও ভেসে আসছে।
প্রশান্ত শিফাকে টেনে একটা রুমে নিয়ে গেল।
কারো বেডরুম। বিছানায় অর্ধনগ্ন একটা মেয়ে শুয়ে আছে। শিফা খেয়াল করল, মেয়েটার গলা কাটা। রক্তে বেডশীট ভিজে গেছে। প্রশান্ত হেসে জানাল, মেয়েটা সাংবাদিক ছিল। গোপনে তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছিল। তাই ধর্ষণ করে মেরে ফেলছে। শিফা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল। অবাকও হচ্ছে প্রশান্তকে শান্ত থাকতে দেখে। এতক্ষণ ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। নয়তো মারার পন্থা অবলম্বন করা। প্রশান্ত লোকদের ডেকে মেয়েটার লাশ সরিয়ে ফেলার হুকুম দিলো। লোকগুলোও তাই করল। তারপর প্রশান্ত সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলল,
-‘তোমায় কেউ ভালোবাসে তাও পাগলের মতো।
জানো সে কে?’
-‘না।’
-‘আমার কথা বিশ্বাস করবে?’
-‘না।’
-‘স্বপ্নীলের খোঁজ জানো?’
-‘না।’
-‘দিগন্ত জানে। এই ঠিকানায় চলে যাও পেয়ে যাবে।’
শিফার সোজাসুজি উত্তরে প্রশান্ত হাসল। এরপর
একটা চিরকুট ওর দিকে এগিয়ে দিলো। কালো চিরকুটে সাদা কলম দিয়ে লিখা। শিফা নিজেকে সামলে নিলো। তনয়ের অপহরণকারী কে? সেও জানে। সাফাকে মারার পরিকল্পনা কার? তাও জেনেছে। প্রশান্ত তখন সুইচ চেপে ওকে যাওয়ার ইশারা করল। ওর ব্যবহারে শিফা হতবাক। সে
ভাবল কী? আর এসে ঘটল কি! শিফা চিরকুট নিয়ে সত্যিই বেরিয়ে গেল। ওর উদ্দেশ্যে এখন সুখুর বাসা। আর শিফা বেরিয়ে যেতেই ওখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো।
To be continue……….!!