সাঁঝক বাতি,২০,২১

0
531

সাঁঝক বাতি,২০,২১
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২০]

-‘আচ্ছা বাবা, আল্লাহ কি আমাকে ভালোবাসে না?’
-‘এমন বলছো কেন সোনা?’
-‘দুষ্টু লোকটা আমার হাত কেটে নিলো। আল্লাহ কিছু করল না তো।’

তনয়ের কথা শুনে শিহাব নিশ্চুপ হয়ে গেল। ওর মনে নানান প্রশ্ন। গতকাল দাদুর সাথে নামাজ পড়েছে। হাদীস শুনেছে। জেনেছে; আল্লাহর খুব দয়াবান। আমাদেরকে খুব ভালোবাসেন। সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। মন্দ কাজের শাস্তিও দেন। এই কথাটা ওর অবুজ মনে টোকা দিয়েছে। তাই তো! মন্দ মানে তো পঁচা কাজ। দুষ্টু লোকেরা ওর হাত কেটে দিয়েছে। সে কষ্ট পাচ্ছে। কাঁদছে। ওরা পঁচা কাজ করেছে। আল্লাহ তো সব দেখেছেও। তাহলে আল্লাহ তাদের কিছু বলল না কেন? শাস্তি দিলো না কেন? তারমানে আল্লাহ ওকে ভালোবাসে না! ছেলের কথার শিহাব উত্তর
খুঁজে পেলো না। অবুজ বাচ্চাটাকে কি বলবে? সে কি অমানুষ চিনবে? বুঝবেও না;পাপ-পূর্ণের পার্থক্য। শিহাব তমার দিকে তাকাল। তমা ভ্রু কুঁচকে ফোনে কিছু দেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল। যেন খুব তাড়ায় আছে। শিহাব জিজ্ঞাসা করলেও সে উত্তর করল না।

তমা হাসিবকে কলে পেলো না। আজকে সকাল থেকে হাসিব নিখোঁজ। প্রশান্তের লোক’ই ওকে মেরেছে। কারণ হাসিবের লাশ ওর বাসার পাশে ফেলে গেছে। শিফার লোক তমাকে ভিডিও করে পাঠিয়েছে। শিফার ফোনও বন্ধ। গতদুইদিন ধরে শিফা ব্যস্ত। মূলত, প্রশান্তর কার্যকলাপের প্রতি নজর রাখছিল। দিগন্তের পেছনে পুনরায় লোক
লাগিয়েছিল। হসপিটালে করা অপকর্মের প্রমান
সংগ্রহ করছিল।সেও বসে নেই। সতর্কতার সাথে একবার দিগন্তের বাসাতেও গিয়েছিল। দিগন্তের মা বর্তমানে পলাতক। উনি দেশ ছেড়েছে। কারণ
শিফা উনার একটা হাত কেটে দিয়েছে। তনয়ের মতো করে। কারণ উনিই প্রশান্তকে তনয়ের হাত কাটার বুদ্ধি’টা দিয়েছিলেন। যেন শিফা নিজেকে সব সময় অপরাধী ভাবতে থাকে। তনয়কে দেখে কষ্ট পায়। মেরে ফেললেই তো সব শেষ। এরচেয়ে
ধীকে ধীকে কষ্ট দেওয়ার আনন্দটা একটু বেশি। দিগন্ত আর প্রশান্ত এসব কিছুই জানে না। তারা উনার ব্যাপারে খোঁজও রাখে না।

সাবিনা খালাও উধাও। প্রাণের মায়াতে উনিও গা ঢাকা দিয়েছে। বেঁচে থাকলে কাজের অভাব হবে না। এই সুযোগে’ই শিফা এ’বাসার সবকিছু ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে তল্লাশি করেছে। অজানা অনেক কিছু পেয়েছেও। আর এমনভাবে চলেছে, যেন প্রশান্ত আর দিগন্ত ওকে ঘুরাচ্ছে আর সে ঘুরছে। কিছু না করে হাবার মতো বসেও আছে।
দুইভাই নাচছে নাচুক। সময়মতো লাগাম টানতে পারলেই হলো। তাছাড়া সাফার মায়ের অনেকটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। উনাকে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। শিফা ওর বাবা-মা’কে জানিয়েছে, সে ভালো আছে। কিছু কাজে ব্যস্ত আছে। রাফি বাইকে এক্সিডেন্ট করেছে। দুইমাস ওকে বাসাতে
থাকতে হবে। বেড রেস্ট। শুয়ে বসেই পড়াশোনা করছে। ওর এক্সিডেন্ট করিয়েছে, শিফা। এছাড়া ওকে বাসায় আঁটকে রাখাও যেতো না। সাবধান করলে, নানান প্রশ্ন করত। বাবা-মা এই চিন্তায় অস্থির থাকতেন। আর প্রশান্তের পরবর্তী টোপ ছিল রাফি। তাই ভাইকে এক্সিডেন্ট করিয়ে সেভ করল। তবুও ভাই জানে বেঁচে থাকুক। ওর পায়ে সমস্যা হয় নি। শুধু এক্স-রে রিপোর্ট ভুল তৈরি করা হয়েছে। যাতে বাসাতে থাকে। বাসাটাই ওর জন্য নিরাপদ। নয়তো অঘটন ঘটতেও সময় লাগত না। আর তমা তো আছেই ;ভয় দেখিয়ে বাসার রাখার জন্য।

শিফা যথাসময়ে সুখুর বাড়িতে এসেছে। তবে বাড়িতে ঢুকার দরজা খুঁজে পাচ্ছে না। পুরোটাই ঘুরে দেখল। না, তাও পেলো না। অদ্ভুত বাড়ি। এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়েও কোনো লাভ হলো না।সুখু জানালা দিয়ে শিফাকে দেখে দিগন্তকে ফোন দিলো। দিগন্ত কল রিসিভ করে বলল,

-‘ওকে ভেতরে নিয়ে যা, আসছি।’
-‘ছ্যার এইডা কি ঠিক কাম হইব?’
-‘ঠিক-বেঠিক তুই শিখাবি, সুখু?’
-‘জ্বে না ছ্যার। ম্যাডাম যে রাগী তাই কইতাছি।’
-‘ম্যাডামের আপ্যায়নে যেন ত্রুটি না থাকে।’
-‘জ্বে ছ্যার।’

দিগন্ত কল কাটল। সামনে প্রশান্ত। ঠোঁটে তার কুটিল হাসি। দু’জনে পুনরায় আলোচনা আরম্ভ করল। এতক্ষণ জরুরি আলোচনায় ব্যস্ত ছিল।
ওদিকে, সুখু দৌড়ে বাগানে চলে গেল। ইয়া বড়
বাগান।এই বাড়িতে যাওয়া-আসার রাস্তাও খুব অদ্ভুত। বাইরের ম্যানহল দিয়েই এবাসায় ঢুকতে হয়। সেটা নির্জন রাস্তার পাশে তৈরি। আর ঢুকে পুনরায় ঢাকনা দিতে হয়। যাতে কেউ ক্ষুণাক্ষরে টের না পায়। শিফা ম্যানহলের পাশে’ই দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খুঁজতে ব্যস্ত। সুখুকে দেখে শিফাই জিজ্ঞাসা করল,

-‘এই যে ভাই, আপনি এখানকার স্থানীয়?’
-‘জ্বে ম্যাডাম।’
-‘এই বাসাটা আমার আত্মীয়ের। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার দরজা খুঁজে পাচ্ছি না।’
-‘ওহ, আমার লগে আসেন।’

শিফা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ছেলেটা পাগল নাকি? ওকে ম্যানহলের মধ্যে ঢুকতে বলছে কেন? নাকি এটাও কারো টোপ? দিগন্ত আর প্রশান্ত খুব ধূর্ত।
আর যাই হোক, ওদের বিশ্বাস করা যায় না। সুখু
ওকে পুনরায় ডাকল। শিফা সুখুকে পরখ করল। হেংলা পাতলা ছেলেটা। কথার তালে তালে দাঁত বের করে হাসছে। বড় বড় দাঁত। পরণের শার্টের মধ্যে আরেকজন অনায়াসে ঢুকতে পারবে। এত ঢোলাঢালা। নেশা-টেশাও করে নাকি কে জানে।
শিফা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে দেখছে। না জানি কোন বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুখু পুনরায় দিগন্তকে কল দিলো। শিফা ওকে সন্দেহ করছে। সুখুরও বুঝতে
বাকি নেই। দিগন্ত দুইবারের বেলায় রিসিভ করে সরাসরি বলল,
-‘ ফোনটা ওকে দে।’

সুখু দাঁত কেলিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিলো। শিফা কানে ধরতেই দিগন্ত বলল,

-‘ওর সঙ্গে যাও। ভয় নেই, সুখু আমার লোক।’
-‘আপনার লোক বলেই তো ভয়।’
-‘ সবকিছুতে নেগেটিভ ভাবাটা অসুস্থ মস্তিষ্কের কাজ। ওর সঙ্গে যাও, আমি আসছি।’

শিফা কল কেটে ফোন ফেরত দিলো। সুখু ওকে নিয়ে ম্যানহল দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করল। মই দিয়ে নামতে হচ্ছে। লোহার প্যাঁচানো মই। সব পরিষ্কার পরিপাটি। বাইরে থেকে যে কেউ দেখে বলবে এটা দো’তলা বিশিষ্ট বাড়ি। অথচ এটা তিনতলা। একটা তলাটা সম্পূর্ণ’ই মাটির নিচে।
কেউ আন্দাজ করতেও পারবে না। সুখু শিফাকে দোতলায় নিয়ে গেল। অভিজাত্যে ভরপুর। তবে দরজা না দেখে শিফা কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করল,

-‘বাড়ির দরজা নেই কেন?’
-‘ছিল, বন্ধ কইরা দিছে।’
-‘কেন?’
-‘ছ্যার কইছে।’
-‘কোন স্যার?’
-‘দিগন্ত ছ্যার।’
-‘ওহ।’
-‘এই বাড়ি ছ্যারের। আমারে দিয়া দিছে। আমি আগে গাঞ্জা বেইচ্চাই, খাইতাম। এহন ছ্যারের লগে’ই থাকি।
-‘আপনি গাঞ্জা বেঁচতেন, খেতেন না?’
-‘জ্বে খাইতামও।’
-‘আপনাকে দেখেই বুঝেছি।’
-‘ধন্যবাদ।’

শিফা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলো। এই চ্যালা’ও দিগন্তের মতোই বেহায়া। ওর’ই লোক বলে কথা।
খারাপ বললে; এরা যেন বেশিই খুশি হয়। হঠাৎ শিফা একটা বুদ্ধি প্রয়োগ করল। দিগন্তের চ্যালা অর্থাৎ দিগন্তের সব খবর ওর জানা। চ্যালাকেই চালে ফাঁসাতে হবে। তাহলে অনেক কিছু জানতে পারবে। শিফা মুচকি হেসে সুখুকে বলল,

-‘সুখু ভাই, আপনার স্যার কি এখানেই থাকে?’
-‘মাঝে মাঝে।’
-‘আর কেউ থাকে না?’
-‘থাকে।’
-‘কে থাকে?’
-‘স্বপ্নীল ভাই, আমি, দিগন্ত স্যার, আরো বেশ কয়েকজন।’
-‘প্রশান্ত স্যার থাকে না?’
-‘না, এটা দিগন্ত স্যারের আস্তানা। এখানকার কথা প্রশান্ত স্যার জানতেনও না। তবে, কিছুদিন আগে লোক লাগিয়ে জেনেছে। আর জেনেই তো
আপনাকে পাঠাল।’

সুখু কথাটা বলে হরেক পদের নাস্তা এনে সামনে রাখল। শিফা চারিপাশে চোখ বুলাচ্ছে। স্বপ্নীল এখানে জেনেও সে ব্যাতিব্যস্ত না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় সামালাতে হবে। শিফা একটা মিষ্টি খেয়ে পানি খেলো। ভালোই খেতে! নাস্তাতে বিষ নেই, নিশ্চিত। শিফা পুনরায় গল্পে মেতে উঠল। সে সুখুর থেকে কথা বের করতে ব্যস্ত। তখন দিগন্ত এসে শিফার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। সুখু
ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। শিফা নিশ্চুপ! এই ছেলে চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্য। লাজ-লজ্জাহীন।
দিগন্ত দুই হাতে জাপটে ধরে শিফার পেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

-‘প্রতিটা ছোঁয়া তখনই আনন্দের হয়। যখন ওই মানুষটা হয় ভালোবাসার।’
-‘ভালোবাসেন আমায়?’
-‘না।’
-‘তুমি হাসবে কবে?’
-‘সেদিন আপনার চোখে অশ্রু ঝরবে।’
-আর খুশি হবে কিসে?’
-‘আপনার বুকে ছুরি বসাতে পারলে।’

দিগন্ত মুখ তুলে শিফার দিকে তাকাল। মেয়েটা সত্যিই হৃদয়হীনা, পাষাণ এবং নিষ্ঠুর মানবী।
নয়তো অনায়াসে এসব বলতে পারত না। বুকে না কাঁপলেও, মুখে আটকাতো। যদিও, সেও কম নয়। তবুও মেয়ের মন তো। কঠিন বলে’ই হয়তো পারফেক্ট জুটি। দিগন্ত পুনরায় শিফার পেটে মুখ গুঁজে বলল,

-‘ওহে বিনাশকারিণী তোমাকে এখানেই থাকতে
হবে। তাও আমারই সাথে। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড় দিবোও না, পাবেও না। কথাটা তুমি মিলিয়ে নিও।’
-‘দিবেন না কেন?’
-‘কারণ, তুমি আমার মানসিক সুস্থিরতা।’

To be continue……..!!

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২১]

রুমজুড়ে সুনশান নিরাবতা। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। দিগন্ত শিফার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। প্রায় ঘন্টা খানিক হলো। দুপুরে খায় নি।
শিফার ওড়না হাতে পেঁচিয়ে কোমর ঝাপটে ধরে আছে। খুব শক্ত বাঁধনে। শিফা যেন পালাতে না পারে। অথবা স্বপ্নীলকে খুঁজতে না পারে।এজন্য
এই বুদ্ধির প্রয়োগ। শিফা খাটে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছে।দৃষ্টি ঘূর্ণায়মান সাদা সিলিংয়ের দিকে। গভীর ভাবনায় মগ্ন। দিগন্ত ঘুমের ঘোরে ওর পেটে নাক ঘষে পুনরায় ঘুমে তুলিয়ে গেল। তবে হাতের বাঁধন নরম করল না। শিফার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। এই মানুষটার সঙ্গে সে
বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ। তার স্বামী! এছাড়াও জাত
শত্রু। মামার খুনি। বান্ধবীর খুনির ভাই।পাপী।
অসংখ্য অপকর্মে লিপ্ত। যা মাফেরও অযোগ্য।
এর পরিণতিও ভয়ংকর। শিফা দিগন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নিদারুণ মুখের গড়ন।এই মানুষটা এত জঘন্য বোঝার উপায়ও নেই। যাকে
বাবা বলে ডাকত, তাকেও নিজের হাতে মেরেছে।
তাও নৃশংসভাবে। বুক কাঁপে নি। মায়াও হয়নি।
এত খারাপ হয়েও, সে বাবা হওয়ার স্বপ্নও দেখে।
তাও শিফার গর্ভের বাচ্চার। যে সম্পর্কের ভীত নেই। প্রণয়ের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সেই সম্পর্কের
জোরে নিষ্পাপ প্রাণকে আনা বোকামি। তার তো দোষ নাই। শিফা দিগন্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে দিবে না। সম্ভবও না। কারণ, দিগন্তের যে রাগ, বাচ্চাকে মারতেও দু’বার ভাববে না। স্বার্থে লাগলে ভুলে যাবে তার বাচ্চা।

দিগন্তের কামড়ে শিফার ভাবনার ছেদ ঘটল। সে গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো। দিগন্ত হাসছে! যেন খুব মজা পেয়েছে। শিফা বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে নিলো। হাতে কামড়ের দাগ বসে গেছে। জ্বলছে।
দিগন্ত শিফাকে পুনরায় জাপটে ধরে বলল,

-‘ভাগ্যে কি আছে জানি না। তবে যতক্ষণ বেঁচে আছি, খুব বিরক্ত করব, খুব।’
-‘বাসায় যাব, সরুন।’
-‘উহুম, এখন না।’
-‘অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়।’
-‘সহমত। আমরা এখন গোসল সেরে, খাবো।’
-‘না, আমি বাসায় যাবো।’
-‘দিবো না যেতে। ইমাজেন্সি পিল আর কতবার খাবে? কি, ভেবেছ আমি কিছু জানি না। আমার সঙ্গে চালাকি! যেতেও দিবো না, ইমাজেন্সি পিল খেতেও পারবে না। এটাই ফাইনাল ডিসিশন।’

শিফা রেগে দিগন্তকে সরাতে চাইলেও পারল না।
বরং উঠে বসে শিফাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।খুব শক্ত করে। ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি। দিগন্ত
চোখজোড়া বন্ধ করে কিছু বলল। খুব’ই আস্তে।
শিফা ওর কথা বুঝল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। ফোনে কল আসায় দিগন্ত সেভাবে জড়িয়ে ধরেই কথা বলল।শিফাকে সরালোও না, যেতেও দিলো না। বরং খুব যতনে আগলে রাখল, ওর
বক্ষপিঞ্জারায়। যেখানে হৃদপিন্ডের অবস্থান। সে শিফাকে হৃদপিন্ডের কাছে স্থান দিয়েছে।স্বজ্ঞানে!
স্ব-যতনে! তখন সুখু দরজা নক করল। দিগন্ত সাড়া দিলো না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ঘড়ির কাঁটাকে স্থির করার সাধ জাগছে। এ আলিঙ্গনে শতযুগ পেরিয়ে যাক। জীবনও থমকে যাক। এই অবস্থায় মৃত্যু আসুক। নিয়ে যাক ওর প্রাণপাখি। অাফসোস থাকবে না। অনুশোচনাও হবে না।চারদিকে অফুরন্ত সুখ আর সুখ। এতবছর পর, জীবনে যেন সুখের সন্ধান মিলেছে।স্বস্তি পাচ্ছে।
শিফা নিশ্চুপ! এ প্রথম কোনো ছেলের বক্ষঃস্থলে
মাথা রেখেছে। হৃদপিন্ডের শব্দ শুনছে। খুব দ্রুত হার্টবিট চলাচল করছে। অদ্ভুত শব্দ।যেন ছিঁটকে
বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিঃশ্বাসের গতিবিধি’ও অনুসরণ করছে।তবুও শরীরে শিহরণ বইছে না। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। মন অকেজো,
অনুভূতিশূন্য। শিফাকে চুপ থাকতে দেখে দিগন্ত ওর কপালে আদর দিয়ে বলল,

-‘ভালোবাসি না। একটুও না, একফোঁটাও না।’
-‘আচ্ছা।’
-‘যেতেও দিবো না।’
-‘আপনার চোখ অন্য কথা বলছে।’
-‘এ চোখের মায়ায় অনেকেই পড়েছে। তবে কেউ চোখের ভাষা পড়তে সক্ষম হয় নি। এমনকি সে, তুমিও না।’
-‘আপনার চোখ প্রণয়ের স্বপ্ন বুনছে। বিনাশকে আহ্বান করছে। সাবধান, পরে সামলানো দুষ্কর হয়ে যাবে।’

দিগন্ত শিফার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সরে গেল। সুখু
ডাকছে। হয়তো বিশেষ কাজে। নয়তো এতবার
ডাকত না। তাও শিফার সঙ্গে থাকাকালীন। ওর এত সাহসও নেই। দিগন্তকে প্রচুর ভয় করে। যেন
ওকেই গিলে খাবে। দিগন্ত শার্ট ঠিক করে সামনে
পা বাড়াল। শিফাও বের হচ্ছে। এই তো সুযোগ।
দিগন্ত ব্যস্ত হলে সেও বেরিয়ে যাবে। কিন্তু, দিগন্ত বাইরে থেকে দরজা আঁটকে চলে গেল। তাও খুব দ্রুত। শিফা দৌড়ে গিয়েও বের হতে পারল না।
চেঁচিয়ে দরজা ধাক্কালো। লাভ হলো না। শিফার ডাক দিগন্ত শুনেও শুনল না। যেন বধির! বরং
মুখে শীষ বাজাতে বাজাতেই দো’তলায় নামল।
ফোনে কথা বলতে বলতে কর্ণারের একটা রুমে প্রবেশ করল। এখানেই স্বপ্নীলকে রাখা হয়েছে।অদূরে বসে সুখু গাঞ্জার পুরিয়া বানাচ্ছে।আজই
কাস্টমারকে সাপ্লাই দিতে হবে। দিগন্তকে ঢুকতে দেখে সুখু গাঞ্জার পুরিয়া লুকিয়ে ফেলল। দিগন্ত গাঞ্জা দেখতে পারে না। সবচেয়ে সস্তা নেশাদ্রব্য এটা। সুখুকে নিষেধ করে এসব না করতে। তবুও এতদিনের ব্যবসা সুখু ছাড়তে রাজি না।ব্যবসায়
নাকি মায়া পড়ে গেছে। তাই সে বিশেষ অনুরোধ করেছে, কাজটা যেন করতে দেওয়া হয়। এজন্য
দিগন্তও আর কিছু বলে না। স্বপ্নীলের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। জ্ঞান নেই। মার খেয়ে জ্বরে ভুগছে।ওর শরীরে কালশিটে দাগ স্পষ্ট। দিগন্ত ওকে একটা ইনজেকশন পুশ করল। একটুপরেই, শরীর ঘেমে জ্বর ছাড়বে। জ্ঞানও ফিরবে। বেচারা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। মুক্তি দিতে হবে। চির-মুক্তি। ওর সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। বেশিদিন অপেক্ষা করাবে না।
সুখুকে খেয়াল রাখতে বলে দিগন্ত বেরিয়ে গেল।
এখন ওর বউকে সামলাতে হবে। আদরের বউটা খুব রেগে আছে।

ওইদিকে, শিফার পুরো পরিবার দিগন্তের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। সবার মাথায় যেন মস্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। দিগন্ত আর শিফা নিখোঁজ। ওরা কই? গতকাল, কেউ মাথা কাটা লাশ দিগন্তদের বাসার সামনে ফেলে গেছে। লাশের মাথা নেই। শুধু রক্তাক্ত দেহ। প্রতিবেশীরা দেখে পুলিশকে খবর দিয়েছে। পুলিশ এসে, প্রশান্ত বা দিগন্তের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে নি। এমনকি অন্য সদস্যেদেরও না। যেহেতু ওদের’ই বাসার সামনে।
তাই ওদের প্রয়োজন ছিল। যদি লাশটা শনাক্ত করতে পারে। পরে, প্রতিবেশীদের তথ্যানুসারে দিগন্তের বাবা-মা, প্রশান্ত-নিহা, দিগন্ত-শিফা ও সাবিনা খালার সম্পর্কে জানা গেছে। এরা সবাই উধাও। কাউকেই খুঁজে পায় নি। তারপর বাড়িটা তল্লাসি করে পাতালঘরের সন্ধান মিলেছে।এত
কঙ্কাল এবং তাদের ঠিকানাও। টিভিতে এটাই ব্রেকিং নিউজ। প্রতিটা চ্যানেলে ওই পাতালঘর, কঙ্কালের স্তুপ আর এসিডের কূপটাকেই বার বার দেখানো হচ্ছে। সব জেনে শিফার পুরো পরিবার হতবাক। পাড়া-প্রতিবেশি ,আত্মীয়-স্বজন এসে নানান কথা বলছেন। স্বান্ত্বণা দিচ্ছেন। কেউ বা খোঁচা মারছেন। শিফার বাবা-মা, ভাই, শিফার
চিন্তায় কাঁদছে। শিফা উনাদের প্রাণ।তমার এসব অজানা নয়। তাই শক’ও খায় নি। শুধু শিফার জন্য চিন্তিত। লাশটা কার? আর কে বা মারল?
মারল তো দিগন্তের বাসার সামনে রাখল কেন?
শিফা নয় তো! কিন্তু সে কোথায়? হাসিবও নেই।
কোনো খবরও পাচ্ছে না। দিগন্তের সঙ্গে শিফা নেই তো? তমা এসব চিন্তায় অস্থির।

শিফা রেগে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন
চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দিবে। দিগন্ত হাসছে। তাও উচ্চশব্দে। দিগন্ত গোসল সেরে খাবার এনেছে।
শিফা খাবে না। সে এই মুহূর্তেই বাসায় যাবে।ওর কথা দিগন্ত পাত্তা না দিয়ে দুই হাত ওড়না দিয়ে বেঁধে দিলো। শিফার দুই পায়ের পাতার উপর পা রাখল। জোরে চাপ দিচ্ছে। তবুও সে খাচ্ছে না। দিগন্ত শিফার গাল চেপে খাবার ঢুকিয়ে দিলো।
তারপর নাক চেপে ধরল। শিফা শ্বাস আটকে
যাচ্ছে। অর্থাৎ নিঃশ্বাস নিতে গেলে খেতে হবে।
নয়তো খাবার ফেলতে হবে। দিগন্ত মুখও চেপে ধরেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে শিফা দ্রুত খাবার গিলে নিলো। দিগন্তও নাক, মুখ, ছেড়ে দিলো। শিফা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছে। সে রেগে দিগন্তকে থাপ্পড় দিতে গেল। অমানুষ একটা। দিগন্ত ওর হাতটা ধরে হাতের উল্টো পিঠে আদর দিলো। বেহায়া পুরুষ! শিফার জেদ, ওর হাতে খাবেই না। আর দিগন্তের জেদ, খেতেই হবে। এই নিয়েও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলল। দিগন্ত নিজে খেয়ে আরাম করে শুয়ে টিভিতে সংবাদ দেখছে। রুমের দরজায় তালা।
শিফা সোফায় বসে গজগজ করছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে। তখন দিগন্ত শীষ বাজিয়ে ওকে টিভি দেখার ইশারা করল। শিফা একবার দেখে
স্তম্ভিত হয়ে গেল। সবাই এসবকিছু জেনে গেছে!
নিউজে পাতালঘরটা দেখাচ্ছে। কঙ্কালগুলোও।
তাহলে ওর বাব-মা, ভাইরাও জেনে গেছে। ওদের কি অবস্থা? শিফা অবাক দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকাল। ওর কোনো হেলদোল নেই। এসব যেন স্বাভাবিক। হওয়ারই কথা ছিল। দিগন্ত শিফাকে পানি এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-‘ টেনশনের কিছু নেই। আমি আছি, পাগলি।’
-‘এসবের মানে কী? ওই মৃত লোকটা কে?’
-‘তোমারই খুব চেনা কেউ।’
-‘আমাকে মারছেন না কেন? আপনার পায়ে পড়ি আমাকে মারুন, প্লিজ।’
-‘নিজের হৃদপিন্ডকে কেউ মারে? ব্যথা যে নিজে পাবো।’

শিফা অবাক চাহনি তাকিয়ে আছে। দিগন্ত ওকে ভালোবাসে! ওর ধারণায় সঠিক। বিপরীত মেরু আকষর্ণ করা চুম্বুকের কাজ। তেমনি বিপরীত লিঙ্গের মানুষ খুব দ্রুত আকৃষ্ট হয় একে-অন্যের প্রতি। কিন্তু এমন হওয়া কথা ছিলো না। দিগন্ত! যে কি না ওকে সহ্য’ই করতে পারত না। সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল শত্রুতার জোরে। যাকে মারতে সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে নাকি তাকে ভালোবাসে!
ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও হাসতে পারছে না।সব ওর কাছে ধোঁয়াশা লাগছে। দিগন্ত ওকে উঠিয়ে বিছানায় বসাল। তারপর দুই গালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলল,

-‘দেশের বাইরে চলে যাবো। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করব। শুধু তোমাতে বিলীন হতে দাও।’

কথাটা বলে দিগন্ত উঠে চলে গেল। শিফা হাঁটু মুড়ে মুখ গুঁজে বসে রইল। সে সমীকরণ মিলাতে
ব্যস্ত। দিগন্ত আর রুমে আসল না। সন্ধ্যার পর, শিফা উঠে বাইরে বের হলো। কেউ নেই। নিচে নেমে হঠাৎ সুখুকে দেখে ডায়নিং টেবিলে বসল। আপেল তুলে খেতে লাগল।যেন আপেল খেতেই এসেছে। সুখু কিছু না বলে হেসে চলে গেল। ওর কাস্টমারকে গাঞ্জা দিতে। শিফা উঠে আশেপাশে কাউকে না দেখে ম্যানহলের দিকে গেল। প্রথম
সিঁড়িতে পা দেওয়ার দিতেই কেউ পেছন থেকে বলল,

-‘জান, পালাচ্ছো? যেতে না নিষেধ করলাম।’

দিগন্তের কন্ঠে রাগ স্পষ্ট। শিফা নির্বাক।আবার ধরা পড়ে গেল। তবুও স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে রইল। অথচ দিগন্তকে দেখে ভয়ে বুকটা কাঁপছে।
দিগন্ত এগিয়ে এসে শিফার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

-‘বেইমানীর জন্য ভাইকেও ছাড়ি নি। দেহ থেকে গলাটা আলাদা করে দিয়েছে। এখন তুইও একই পথেই হাঁটছিস!’

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here