সাঁঝক বাতি,২৬

0
1533

সাঁঝক বাতি,২৬
নূরজাহান আক্তার (আলো)

স্বপ্নীলের মুঠোয় শিফার হাত। সে আলতো করে
ধরে আছে। যেন শক্ত করে ধরলে ব্যথা পাবে।
নয়তো গলে যাবে। স্বপ্নীলের চোখে মুখে খুশির ঝলক। মুখভর্তি হাসি সরছেই না। দিগন্ত কথা দিয়েছিল, শিফাকে ফিরিয়ে দিবে। দিগন্ত খারাপ হলেও কথা রেখেছে। বিনা বাঁধায় শিফাকে ছেড়ে
দিয়েছে। এই ঢের। শিফা স্বপ্নীলের মুঠোয় থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল।ওকে উঠতে দেখে স্বপ্নীল সুখুকে বাইরে যাওয়ার ইশারা করল। সুখু নড়লো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। রাগে মুখ থমথমে
হয়ে আছে। যেন, স্বপ্নীলকে পুঁতে দিতে পারলেই ক্ষান্ত হবে। শিফা সুখুর দিকে তাকিয়ে স্বপ্নীলের দিকে তাকাল। দু’জনের মুখে রাগ। এদের এমন করার কারণ অবগত নয়। তবে কিছু আন্দাজ
করছে। মন কু-ডাকছে। অশান্ত লাগছে। অস্থির হয়ে ঘামছেও। হঠাৎ এমন লাগছে কেন? বাসার সবাই ঠিক আছে তো? স্বপ্লীল এখানে কেন? ওর অক্ষত অবস্থায় থাকার কথা না। দিগন্ত ছাড়ার মানুষও না। দিগন্তের মনে কি চলছে? কি করতে চাচ্ছে? শিফা এসব চিন্তায় মগ্ন। তখন স্বপ্নীল সুখুকে ধাক্কিয়ে বলল,

-‘যেতে বলেছি তোকে।’
-‘ম্যাডাম বলুক।’
-‘সুখু ভাই দিগন্ত কোথায়?’
-‘জানি না ম্যাডাম।’
-‘অকারণে মিথ্যা বলা আমার পছন্দ নয়।’
-‘দুঃখিত ম্যাডাম।’
-‘সত্যিটা বলুন।’
-‘বারণ আছে ম্যাডাম।’

কথাটা বলে সুখু মাথা নিচু করে নিলো। অর্থাৎ বলবে না। স্বপ্নীল বেশ বিরক্ত হলো। ওই জঙ্গাল বিদায় হয়েছে। ভালো হয়েছে। ওর খোঁজ নিতে হবে কেন? অযথা সময় নষ্ট। একমাত্র দিগন্তের জন্য সবাই কষ্ট পেয়েছে। বোনকে হারিয়েছে। ওর পরিবারও নেই। একে একে সবাই চলে গেছে। সে এখন একা। শিফাও কম কষ্ট পায় নি। তাহলে?
এদেরকে প্রশ্রয় দেওয়ার মানেই হয় না। নরপশু এরা। স্বপ্নীল সুখুকে ধাক্কিয়ে রুম থেকে বের করে দিলো। স্বজোরে দরজা আটকাল। পিছনে ঘুরে শিফাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে থুতনি রাখল। আলতো স্পর্শে ঠোঁট ছোঁয়াল। শিফার শরীরে জেন্স পারফিউমের সুগন্ধ লেগে আছে।
যেটা দিগন্তের শরীর থেকে পাওয়া যায়। দিগন্তের সবচেয়ে পছন্দের পারফিউম। স্বপ্নীল ভ্রু কুঁচকে নিলো। ওহ,দিগন্ত শিফাকে ব্যবহার করে এখানে পাঠিয়েছে? অমানুষ একটা। স্বপ্নীল নিশ্চুপ হয়ে গেল। শিফা ওকে সরিয়ে চোখে চোখ রেখে ধীর কন্ঠে বলল,

-‘ আমাকে মারতে চেয়েছিলে, মারবে না?’

স্বপ্নীল বিস্মিত! শিফা ছলছল চোখে হাসল। সে সব জানে। জানে বিধায় এতদিন পর ওকে দেখে ব্যাকুল হয় নি। হাসেও নি।বরং যথেষ্ট স্বাভাবিক আছে। স্বপ্নীল কানাডায় যায় নি।দিগন্তের লোক ওকে শুটও করে নি। শিফার দেহরক্ষীর ব্যাপারে
স্বপ্নীল জানত। এতটা বোকা সে নয়! কেউ ওকে নজরে রাখবে আর সে বুঝতেই পারবে না। এটা ভাবাও নেহাৎ বোকামি। উল্টে সেই, দেহরক্ষীকে তিনগুন টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। এবং নিজের হাতে শুট করে নিখোঁজও হয়ে দিয়েছিল।
যাতে শিফা দিগন্তকে দোষী ভাবে। হয়েছেও তাই।
এসব করার বিশেষ কারণও ছিলো। প্রশান্ত ওকে ডেকে তার পাপকর্ম শিফা আর দিগন্তের ঘাড়ে চাপিয়েছিল। সাফাকে দিগন্ত মেরেছে আর শিফা সব জেনেও কিছু বলে নি। দিগন্তকে শিফা প্রশ্রয় দিয়েছে। আর দিগন্ত সুযোগ বুঝে মজা লুটেছে।
অসংখ্যবার সাফার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্তও হয়েছে।
ফেইক আইডির চ্যাটও সে স্বপ্নীলকে দেখিয়েছে।
এসবের মধ্যে শিফা সাফার ময়নাতদন্তে মিথ্যা রিপোর্টও বানিয়েছিল। কেউ যেন ধরতে না পারে তাই চটজলদি বিয়েও করে নিয়েছিল। প্রশান্ত এসব বলে ভুল বুঝিয়েছিল। স্বপ্নীল প্রমাণ পেয়ে মেনে নিয়েছিল। একটা ভাইয়ের পক্ষে বোনের এ কথা শোনা কতটা কষ্টকর। স্বপ্নীলও বুঝেছিল।
তখন থেকে শিফার পেছনে লোক লাগিয়েছিল। বেইমানীর শাস্তি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।কিন্তু
দিগন্তের জন্য সফল হয় নি। দিগন্ত শিফাকে সব সময় বাঁচিয়েছে। সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আর প্রশান্ত বহুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল।

হ্যাঁ, এটাও সত্যি স্বপ্নীল শিফাকে ভালোবাসাত।
তা এখন অতীত। পছন্দের মানুষকে চাইত।তবে
বোনের খুনিকে নয়। শিফা খুনি। একজন খুনি তার প্রিয় হতেই পারে না। শিফা ওর পরিবারকে, বোনকে, ভালোবাসা, সুখ, মন, সবকিছুকে খুন করেছে। কষ্টের অনলে দগ্ধ করেছে। ছাড় নেই ওর। কিছুতেই না! এর মধ্যে হাসিব কিভাবে যেন সত্যটা জেনে গিয়েছিল। এজন্য স্বপ্নীল’ই ওকে সরিয়ে দিয়েছে। হাসিব গোপনে শিফাকে রেকর্ড পাঠিয়েছিল। শিফা তাতেও চমকায় নি। কারণ কঙ্কালের পার্সেল পাওয়ার পর, শিফা স্বপ্নীলকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। একজন দেহরক্ষীর মাধ্যমে সব সত্যিটা জেনেছিল। সেদিন থেকে সে মানুষকে বিশ্বাস করা ভুলে গেছে।আপনজনদের
প্রতিও না। এই পৃথিবীতে কেউ স্বার্থহীন না,কেউ
না। নিজ স্বার্থে ঘা লাগলে কেউ আপন পরের পরোয়া করে না। স্বপ্নীলও তাই। ওর মনে প্রণয় নয়। বর্তমানে ঘৃণা আর প্রতিশোধের জেদ কাজ করছে।শিফার মামার মৃত্যুর পর কষ্ট পেতে পেতে কষ্টসওয়া হয়ে গেছে। কষ্ট না পেলে অস্বাভাবিক লাগে। স্বপ্নীল ওর ভালোলাগার মানুষ ছিলো। ভালোবাসার কেউ হলে এত সহজে ঘৃণা করতে পারত না। এটাও টের পেয়েছে। যাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করেছিল, সেই প্রাণে আঘাত করেছে।
বেশ তো! শিফার ক্ষতি করার জন্য দিগন্ত ওকে এখানে তুলে এনেছিলো। প্রচন্ড মেরেও ছিলো।
এত মার খেয়ে দিগন্ত ওখানে বসে ওর লোকদের
শিফার পিছু নেওয়ার আদেশ দিতো। দিগন্ত তা ধরে ফেলাতে ওকে এই রুমে আঁটকে রেখেছিল।
বার্তা পাঠানোর গোপন ফোন ভেঙ্গে ফেলেছিল।
এসব কিছু শিফা অবগত। শিফার চোখে পানি দেখে স্বপ্নীল হাসতে লাগল। সে এখনো বিশ্বাস করে; শিফা খুনি।

স্বপ্নীল হাসতে হাসতে শিফার গালে স্বজোরে এক থাপ্পর বসিয়ে দিলো। শিফা গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষনিকের জন্যও অবাক হচ্ছে না। স্বপ্নীলের এরুপটা এতদিন চাপা পড়ে ছিলো। আজ স্বচক্ষে দেখছে। স্বপ্নীল গর্জে উঠে আবার শিফাকে থাপ্পর দিতে গেলে শিফা ধরে ফেলল। ওর আঙ্গুলে ভাঁজে আঙ্গুল রেখে মুচড়ে দিয়ে বলল,

-‘তুইও অমানুষ। তোকেও প্রচুর ঘৃণা করি।’
-‘তো?’
-‘অপেক্ষা কর বুঝে যাবি।’

স্বপ্নীল হাত ছাড়িয়ে শব্দ করে হাসতে লাগল। এ মেয়ের তেজ এখনো কমে নি। সে কমিয়ে দিবে।
এই দিনেরই অপেক্ষায় ছিলো। এজন্য দিগন্তের
কাছে ভালোও সেজেছে। যেন শিফার জন প্রাণ দিয়ে দিবে। দিগন্ত ওর কথা বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছে।শিফাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা রেখেছে।
বোকা দিগন্ত। যদিও সে বর্তমানে দেবদাস। উফ, ছেলেটা ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে আছে। তার সব জারুজুরি শেষ। স্বপ্নীল শিফার থুতনী চেপে ধরে বলল,

-‘দিগন্ত খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ভেবেছিলি, আমার কাছে আসবি। আর আমি গ্রহন করব?’
-‘এরচেয়ে মৃত্যু ভালো।’
-‘মেরে তোর শখ পূরণ করছি।’
-‘তাই কর।’

স্বপ্নীল সত্যি সত্যি শিফার গলা চেপে ধরল।যেন
মেরে’ই ফেলবে। শিফা বাঁধা দিচ্ছে না। মরলেই শান্তি। আপনজনকে জঘন্য দেখলে এমনিতেই মরে যেতে ইচ্ছে করে। চেনা কেউ’রা অচেনা হলে কষ্ট হয়। যন্ত্রণা’রা ঘিরে ধরে। শিফার অঝরে
অশ্রু ঝরছে। হঠাৎ একটা বুলেট এসে স্বপ্নীলের হাতে লাগল। নিঃশব্দে। খোলা জানালা দিয়ে দিগন্ত শুট করেছে। ওর টার্গেট মিস যায় না। ওর রাগান্বিত দৃষ্টি। স্বপ্নীল হাত ঝাড়া দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ করে উঠল। লাল রক্ত ঝরছে। বুলেট গেঁথে গেছে। তখন সুখু রুমের ভেতরে প্রবেশ করল।
দিগন্ত রুমে ঢুকে স্বপ্নীলকে লাথি দিলো। রাগে ওর শরীর কাঁপছে। শিফার জন্য ভাইকেও ছাড়ে নি। র্নিদয়ের মতো মুন্ডুচ্ছেদ করেছে। বাবাকেও মাফ করে নি। যার হাসি দেখতে এতকিছু করছে,
আর স্বপ্নীল কি না তার শরীরে’ই হাত দিয়েছে। এটা মানা যায়? মানা সম্ভব কি? সে তো মানবে না। তাছাড়া দিগন্ত স্বপ্নীলকে বুঝিয়েছেও ; শিফা র্নিদোষ। স্বপ্নীল মানতে নারাজ। এখানে দিগন্ত বা করবে? আর ওকে এত তেল মারবে কেন? সে কে? ওকে পরীক্ষা করতেই শিফাকে পাঠিয়েছিল।
আর সে না ভেবেই খোলস থেকে বেরিয়ে এলো।
যাকে মনে প্রাণে নিজের করে চাচ্ছে। তাকে নাকি অন্যের হাতে তুলে দিবে, হাস্যকর। সে এতটা দয়াবান না ছিলো; আর না এখন আছে। তখন
স্বপ্নীল ঝট করে উঠে সুখুর থেকে পিস্তল কেড়ে শুট করল। ওর টার্গেট মিস হওয়াতে দিগন্ত বেঁচে গেল। ততক্ষণে সেও শুট করে দিয়েছে। স্বপ্নীলের বুক বরাবর। শিফা হতভম্ব! স্বপ্নীল মুখ থুবকে নিচে পড়ে গেল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে
মৃদু হেসে বলল,

-‘তোকে আমি মাফ করবো না শিফা। কখনোই না। তুই আমার হৃদয় ভেঙ্গেছিস।’

দিগন্ত পরপর আরো দু’টো শুট করে হাসল।যাক
এবার শান্তি লাগছে। স্বপ্নীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। চোখে তার ঘৃণা। দিগন্ত তখন শিফাকে বলল,

-‘তোর শহরের আমি নগন্য ধূলিকণা মাত্র।তবুও আমার তোকেই চাই।’

শিফা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। একে সুযোগ দিতে চেয়েছিল। যার হৃদয়ে মায়া কিচ্ছু নেই।এর মধ্যে পরিবর্তন এসেছে ভেবেছিল। আচ্ছ সে কি আদৌ মানুষ? কোনো মানুষ এতটা জঘন্য হয়?
তখন দিগন্ত এগিয়ে এসে ধীর কন্ঠে বলল,

-‘আমার অতীতটাকে কত খন্ড করলে তোমায় পাবো, বললে না তো?

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here