মেঘদিঘির পাড়ে -২৯(বাকি অংশ),৩০

0
784

মেঘদিঘির পাড়ে -২৯(বাকি অংশ),৩০
মালিহা খান
পার্ট-২৯(বাকি অংশ)

৬৩.
তখন দ্বিপ্রহর গড়িয়েছে। একফালি কাঁচের মতোন স্বচ্ছ রোদ সবুজ উঠোনে একপেশে হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের রং কমলাটে। নীরদদেশের পশ্চিমকোঁণে সবে খানিকটা লালাভ রং ধরেছে। বাতাবরণে নিরুত্তাপের অনু ছোঁয়া।
হলুদের গোসল শেষে ঠান্ডায় কাবু হয়ে গেছে হলদে কনে। শাড়ির বদলে তার গায়ে এখন সিঁদুরলাল কামিজ। ছোট্ট পেলব দেহ মুড়িয়ে আছে তুলোনরম লেপের তলায়। বিয়েবাড়ির কোলাহল তার কর্ণ অবধি পৌঁছোচ্ছেনা। গালের নিচে হাত, চোখের পাতা বন্ধ। বিয়ের বধু আড়ম্বর ফেলে গভীর ঘুম। ভেজা এলোকেশ বালিশে ছড়ানো।

ইউসুফকে দরজার বাইরে দেখেই বিভা সচেতন হলো৷ সাবধানে চোখ বাঁচালো। সে ইভার মাথার পাশে বসে আছে। দরজাটা হাল্কা ফাঁক। ফাঁক দিয়েই ইউসুফের মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে। কানে ফোন। কথা বলছে। কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, তবে কি বলছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। জাহানারা চাচি একটু আগে ঢুকে তাড়াহুড়োয় দরজাটা পুরোটা আটকাননি। মনোযোগ দিয়ে আলমারিতে কি যেনো গুছিয়ে রাখছেন তিনি।
বিভা আরেকবার চাইলো। ইউসুফ কথা বলতে বলতে হঠাৎই এদিকে তাকিয়ে ফেললো। দরজার ফাঁক গলিয়ে তার ব্যতিব্যস্ত দৃষ্টিজোড়া হুট করে লাগাম টানলো। অসাবধানে অথচ প্রচন্ড সঠিক সময়ে চারটে চোখ একত্র হলো। বিভা হকচকিয়ে গেল। তাড়াহুড়োয় কি করবে ভেবে না পেয়ে চোখ নামাতেও ভুলে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে চেয়ে রইলো। যখন বুঝলো ততক্ষনে ইউসুফ উল্টো ঘুরে গেছে। এদিকে পিঠ। বিভা ভগ্নহৃদয়ে চোখ নামালো। আলতো করে ইভার কপালে হাত রাখলো। ভেজা চুল আরেকটু ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিলো।
জাহানারা বললেন,”এই ঘরে বাইরের মানুষ ঢুকতে দিবি না। আলমারিতে টাকাপয়সা, গয়নাগাটি রাখা। হাজারটা মানুষ। কখন কি অঘটন হয় বলা যায়না।”
বিভা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো,”জি চাচি।”

তার কথা শেষ না হতেই দরজার ফাঁকে আবার ছায়া পড়লো। পুরুষ ছায়া। ইউসুফ ঢুকলো। দরজার কাছে দাড়িয়ে ইভাকে দেখলো। জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,”নিচে সব ঠিক আছে বাবা?”
ইউসুফ চোখের ইশারায় ‘হ্যাঁ’ বোঝালো। এগিয়ে গিয়ে ইভার কাছে গেলো। ঝুঁকে গালে হাত রাখলো। বিভা কপালে হাত রেখেছিলো। ইউসুফ গালে হাত রাখতে সে চট করে হাত সরিয়ে নিলো।
ইভার তন্দ্রাগত মুখে দৃষ্টি রেখেই ইউসুফ ধীরগলায় বললো,
-“ওকে এখন উঠানোর দরকার নেই আম্মা। ওর অল্পতেই অসুখ করে। সকাল থেকে হুলুস্থুল গেছে। ওর এসবের অভ্যাস নেই তো। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু ঘুমাক।”

কথাটা বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে জাহানারার দিকে তাকালো ইউসুফ। জাহানারা পেছনে তাকিয়ে মৃূদু হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। ঘুরে আলমারি তালা দিতে মনোযোগী হলেন। ইউসুফ হাত সরালো। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে বিভার চোখে চোখ রাখলো। একগুচ্ছ কবোষ্ণ নি:শ্বাস বিভার মুখমন্ডলে আছরে পড়লো। বিভা দ্বিতীয়বার অপ্রতিভ হলো। থতমত খেয়ে মাথা পিছিয়ে নিতেই ইউসুফ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“তুমি কি কখনোই, কোনোদিন আমার কথা শুনবেনা?”

কিড়মিড়িয়ে কথাটা বলেই আলগোছে দৃষ্টি সরিয়ে সোজা হলো সে। বিভা হতবিহ্বল চেয়ে রইলো। কাঠখোট্টা ইউসুফ ততক্ষণে কক্ষ ত্যাগ করেছে।

৬৪.
সায়ন দিঘির পাড়ে এসে গাড়ি থামালো। জানলার কাঁচ নামিয়ে দিঘির জলে চাইলো। স্তুপীকৃত ঝুমঝুমে সফেদ ধোঁয়ার মতোন কুয়াশায় আছন্ন হয়ে আছে পানির উপরটা। সন্ধ্যা হয়েছে। সায়ন ঠোঁটের কোঁণ ছড়ালো। জানলায় হাতের কঁনুই রেখে দু’আঙুলে থুতনি ঘষলো। একধ্যানে চেয়ে বিরবির করে শুধালো,

-“মেঘদিঘির সবচাইতে শুভ্রমেঘটার আজকাল দিঘির পাড়ে সাক্ষাৎ মেলেনা। ভারি অসহ্যকর তো!”

খোলা হাওয়ায় ধুলো উড়িয়ে মেঘদিঘি বোধহয় ভীষণ মন খারাপে সায় দিলো তার কথার। সায়ন হাসলো। জানলার কাঁচ উঠিয়ে দিতে দিতে আলোয় ঝলমলে বাসার দিকে চাইলো। আগের ন্যায় বিরবির করে বললো,”হাহ্! দেখা যাক তুচ্ছ পুরুষ রাজকন্যার সাক্ষাৎ পান কিনা!”

৬৫.
ইভার ধবধবে গায়ে কাঁচারোদের মতো বর্ণ স্বর্ণাভ। লাল জামার আগাগোড়ায় নববধুর প্রলেপ। সে উঠে বসলো। দূর্বলহাতে চোখ ডললো। বড় বড় হাই তুললো। তখন গোসল করে, তন্দ্রা ভাবি ভাত খাইয়ে দেবার পরেই ঘুমে ঢলে পড়েছে সে। আর হুঁশ হয়নি। বিভা তখনো তার পাশে। ইভা তার বাহুতে মাথা ঠেকালো। আদুরে গলায় ডাকলো,”আপা?”

বিভা ফিচলে কন্ঠে বললো,
-“দুলাভাই আসতে না আসতেই ঘুম ভেঙে গেলো তোর। বেশ তো।”

কানের ভেতর যেনো সহসাই একটা বজ্রপাত হলো। ইভা চট করে মাথা তুললো। অবাক হয়ে বললো,”মানে?”

-“বাইরে যেয়ে দেখ।”

৬৬.
তন্দ্রা ঘরের সব জানলার কপাট মেলে বসে আছে। ঠান্ডায় তার শরীর ঘামছে। সরফরাজের সাথে তার কথা হয়নি। যাওয়ার আগে সে রাগের বশে দেখাও করেনি একবার। এখন আফসোস হচ্ছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তার ফোনটা মায়ের ঘরে ফেলে এসেছে। যাবার শক্তি হচ্ছেনা।
ইউসুফ একবার উঁকি দিলো। সরফরাজ খানিক আগেও ফোন করেছিলো তাকে। তন্দ্রাকে দেখে রাখতে বলেছে। সায়ন এসেছে বলে বাড়ির সবাই ওদিকে। তন্দ্রাকে আশেপাশে না পেয়ে সে তড়িঘড়ি উপরে এসেছে।

-“ভাবি? আপনি ঠিক আছেনতো? কিছু লাগবে?”

তন্দ্রা ফিরে তাকালো। মিষ্টি হেসে বললো,

-“না ইউসুফ, কিছু লাগবেনা। আমি ঠিক আছি।”

ইউসুফ চলে যেতে নিলেই সে তাড়াহুড়ো ডাক দিলো,”ইউসুফ?”

-“জি।”

তন্দ্রা খানিক চুপ থেকে বললো,

-“তোমার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে?”

-“হয়েছে ভাবি। একটু আগেই হয়েছে।”ইউসুফ আস্বস্ত করলো। তন্দ্রা আমতাআমতা করলো। তার ইতস্ততা দেখে ইউসুফ নিজ থেকেই বললো,”কিছু বলবেন ভাবি?”

তন্দ্রা জড়তা পাশ করে নিচু সুরে বললো,
-“তোমার ভাইকে একটু ফোন করে দিবে ইউসুফ? আমি কথা বলবো। আমার মোবাইলটা মায়ের ঘরে।”

ইউসুফ সম্মতি দিয়ে এগিয়ে এলো। ফোন করে তন্দ্রার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো। তন্দ্রা প্রচন্ড খুশিমনে হাতে নিলো ঠিক তবে ওপাশ থেকে ফোন উঠালোনা মানুষটা। রিং হতে হতে লাইন কেটে গেলো। মুখটা কালো হয়ে গেলো তন্দ্রার। মন খারাপ করে বললো,”ধরলোনাতো।”

ইউসুফ আরো ক’বার ফোন করলো। সরফরাজ উঠালোনা। তন্দ্রার কথা বলা হলোনা। মন হলো দ্বিগুণ খারাপ। অভিমানে জবুথবু।

বাতাসে প্রণয়াভাস। লালরঙা লেবাস, কনুই অবধি মেহেদীর রং, বিয়ের হলুদ মেখে স্নান করা উজ্জ্বল বেশভূষা নিয়ে ইভা বাইরে এসে দাড়ালো।

চলবে

মেঘদিঘির পাড়ে – ৩০
মালিহা খান

৬৭.
মেঘদিঘির ঝোঁপের আড়ালে একটা বড় বাঁশঝাড় আছে। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বাঁশঘুঘুর ডাক আসে। এখনো আসছে। ঊষাকালে যখন শীতের নরম রোদ পৃথিবীর গা ছোঁয়, বাঁশঘুঘু গুলো নিশ্চুপ হয়ে সেই রোদে গা পোঁড়ায়।
ইভা দাড়িয়ে আছে ঠাওর করতে পেরেও সায়ন তাকাতে পারলোনা। তার সামনে নেওয়াজ সাহেব বসে আছেন। আর সবার সামনে হলেও বাপের সামনে অন্তত মেয়ের দিকে বেহায়ায় মতোন তাকিয়ে থাকা যায়না। অতটুকু শোভনীয় ভদ্রতা তার মধ্য আছে। সায়ন মনে মনে খুব করে কপাল চাপড়ালো।
কপাল চাপড়ানোর ঠাস ঠাস আওয়াজগুলো সে কান অবধি শুনতেও পেলো।

কারো পায়ের পদচারণে ইভা দ্রুত পেছন ফিরলো। চোখ ডলার ভঙ্গি করে ভারী নির্বিকার গোছে একটা মিথ্যে হাই তুললো। ইউসুফ তন্দ্রার ঘর থেকে ফিরছিলো। ইভাকে সিঁড়ির কাছে দাড়িয়ে থাকতে
দেখে থেমে গেলো। কাছে যেয়ে মাথায় হাত রাখলো। ভারী আদর করে জিজ্ঞাসা করলো,

-“ঘুম হলো?”

মিথ্যে হাইটায় একটা মিথ্যে শব্দ হলো। ইভা মুখ থেকো হাত সরিয়ে দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,

-“হলো ইউসুফ ভাই।”

-“এখনো হাই তুলছিস যে? কেও তোকে জাগিয়ে দিয়েছে নাকি? আমি মানা করেছিলাম তো..”ইউসুফের কন্ঠে রোষ প্রকাশ পায়। ইভা দ্রুত ধাতস্থ করলো তাকে।

-“না না কেউ জাগায়নি। ওই এমনি একটু…”তার কথা সম্পূর্ণ হলোনা। ভয়ার্ত নারীকণ্ঠের চিৎকারে কথা আটকে গেলো। তন্দ্রা ভাবীর কন্ঠ। ইউসুফের রুহ কেঁপে উঠলো। তন্দ্রার হাবভাব সে স্বাভাবিক দেখে আসেনি। ভাবি অনবরত ঘামছিলো। সরফরাজ বলেছিলো শরীর খারাপ একটু তাই সে তেমন ঘাটায়নি।

বিভা মাত্র ইভার ঘর থেকে বেরোচ্ছিলো।
তন্দ্রার চিৎকারে সে প্রায় দৌড়ে ঘরের দুয়ারে হাজির হলো। তন্দ্রা দাড়ানো, বসার মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। দাঁড়াতে গিয়ে সে পুরোপুরি দাড়াতে পারছেনা। বিভা দ্রুত যেয়ে ধরলো। পায়ের নিচে অকস্মাৎ কিছু দেখতে পেয়ে ভীত হয়ে উঠলো মন। ইভাকে দরজার কাছে আসতে দেখে ত্রস্ত গলায় বললো,

-“ইভা! আম্মা, চাচীকে আসতে বল গিয়ে, ভাবীর পানি ভাঙছে।”

বিয়ে বাড়ির হাসিঠাট্টাপূর্ণ কোলাহল মূহুর্তেই থমকে গেলো। তন্দ্রা অল্পতেই ভয় পায়। সরফরাজ সাথে না থাকায় সে আরো ঘাবড়ে গেলো। হু হু করে কেঁদে ফেললো। বিভা শত বুঝিয়েও শান্ত করতে পারলোনা তাকে। জাহানারারা এলেন। তন্দ্রার প্রসব বেদনা উঠছে। ব্যাথার চেয়ে দূর্নিবার ভয়েই তার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ইউসুফ আরো বারকয়েক ফোন করার চেষ্টা করলো সরফরাজকে। মরার উপর খরার ঘা হিসেবে সরফরাজের ফোন এবার বন্ধ পাওয়া গেলো।
ইউসুফ বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। নিচে নেমে গাড়ি বের করতেই আবার মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। ফুয়েল মিটারের কাঁটা মাঝামাঝি অবস্থানে। অভিজ্ঞতা বলছে এতোটুকুতে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। মাঝে অবশ্য ফুয়েল পাম্প আছে। কিন্তু ভাবির অবস্থার অবনতি হলে মাঝপথে গাড়ি থামানো যাবে নাকি তাও সমস্যা। সায়ন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো। ইউসুফ এসে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“সায়ন? তুমি গাড়ি নিয়ে এসেছো?”

-“জি ভাইয়া।”

-“কোথায়? উঠোন তো খালি।”

-“গেটের বাইরে পার্ক করা। উঠোনের ওখানে তখন ফুলের ঝাঁকি টাকি রাখা ছিলো।”

সায়নকে গাড়ি বের করতে বলে একদৌড়ে উপরে গেলো ইউসুফ। তন্দ্রা ভয়ে জবুথবু হয়ে গেছে। ব্যাথায় চাদর খামছে ধরেছে। জাহানারা ইউসুফকে দেখেই বললেন,”কই ছিলি তুই? গাড়ি বের করেছিস? বৌমাকে হাসপাতালে নিতে হবে তো।”

ইউসুফ মাথা দোলালো।

সায়ন ড্রাইভিং সিটে। পেছনে তন্দ্রা, বিভা আর জাহানারা। ইভা নেওয়াজ সাহেবের সাথে ওই গাড়িতে আসছে। তারা মাঝপথে তেল নিয়ে বাকিটা যেতে পারবে। ইকবাল বাড়িতেই থাকবেন৷ বিয়ের বাড়ি। একেবারে খালি করে যাওয়া যাবেনা। কারো তো থাকতে ই হবে। ইভার মা ভীষণ অসুস্থ মানুষ। তিনিও চলাফেরা বেশি একটা করতে পারেন না৷ তিনি সামলাতে পারবেননা সব। বাহাদুর ছোট। সেও বাসায়ই রইলো।

ইউসুফ ফ্রন্ট সিটে যেয়ে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। তন্দ্রা তখনো দূর্বল স্বরে সরফরাজের নাম আওড়াচ্ছে। ইউসুফ ফোন বের করলো। তুখর গরম মেজাজ নিয়ে অনবরত সরফরাজের ফোনে ডায়াল করতে লাগলো।

গাড়ি তখন মাঝামাঝি পথে। লাউডস্পিকারে রাখা ফোনটা রিং করলো। প্রথম রিংয়েই ফোন তুললো সরফরাজ। খানিক কেটে কেটে ভেসে এলো তার ভারি কন্ঠ,”হ্যালো? ইউসুফ? এদিকে নেটওয়ার্কের এতো সমস্যা। হ্যালো?”

আরাধ্য কন্ঠটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র ডুঁকরে উঠলো তন্দ্রা। ফোন অবধি পৌঁছালো আওয়াজটা। ওপাশে সঙ্গে সঙ্গে উৎকন্ঠা ছেঁয়ে গেলো,

-“হ্যালো? ইউসুফ? তোর ভাবী কাঁদছে? কি হয়েছে? হ্যালো?”

ফোনটা ধরে রেখে ইউসুফ থমথমে গলায় বললো,”ভাবির পেইন উঠেছে। হাসপাতালে যাচ্ছি।”

-“কিহ্?”সরফরাজ স্তম্ভিত।

ইউসুফ অবিচল গলায় বললো,
-“ভাবির সাথে কথা বল। ধর।”

তন্দ্রার কাছে ধরা হলো ফোন। সে কিচ্ছুটি বলতে পারলোনা। কেঁদে গেলো কেবল। সরফরাজ মৃদুক্ষণ তার কান্নাই শুনলো। তারপর নরম গলায় ডাকলো,”ইউসুফ? লাউডস্পিকার টা বন্ধ করে দে।”

ইউসুফ লাউডস্পিকার বন্ধ করে আবার তন্দ্রার কাছে দিলো ফোন। তন্দ্রা এপাশ থেকে বললোনা কিছু৷ ওপাশ থেকে পুরুষকন্ঠটি অনর্গল বিরতিহীন কি যেনো বলে গেলো। যার উদ্দেশ্য বলা হলো সে এপাশ থেকে চুপটি করে শুনলো। কিছুক্ষন পর লাইনটা কেটে গেলো। তন্দ্রা ফোন এগিয়ে দিয়ে মিনমিন করে বললো,

-“রেখে দিয়েছে, নাও।”

এরপর আর ভেঙে পড়তে দেখা গেলোনা প্রসববেদনা সহ্য করে যাওয়া ভয়ে জর্জরিত রমনীটিকে। সে চুপচাপ শান্ত হয়ে গেলো। ভয় যেনো কোথায় উবে গেছে।
সেই নিঝঝুম রাতে সায়ন আশ্চর্য হয়ে দেখলো নিরব অনূভুতির জোয়ার। ঠিক কতটা শক্তি থাকলে মাত্র কিছু সময়ের আলাপে নিজের সঙ্গীনীকে এত দূর থেকেও এতটা সাহস দেয়া যায়।
তার আর ইভারও কি এমন শক্তি হবে? এতোটা?

৬৮.
তন্দ্রার সিজার শেষ হলো রাত আড়াইটার দিকে। বেশ ভুগেছে মেয়েটা। জ্ঞান আসেনি এখনো। হাতে স্যালাইন চলছে। রক্ত দেয়া লেগেছে। অবশ্য রক্ত খুঁজতে অসুবিধা হয়নি। সায়নের সাথে মিলে যাওয়ায় সায়ন দিয়েছে।

নেওয়াজ সাহেব হাসপাতালে টাকা জমা করে ফিরে এলেন। সাদা টাওয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটা জাহানারার কোলে আছে। তিনি তন্দ্রার বেডের পাশে বসে আছেন। বাড়ির সবাই ক্লান্ত।

ইভা ঘুমিয়ে পড়েছে সায়নের উপর। নার্স একজন কয়েকবার এসে বলে গিয়েছে সায়নকে একটু বিশ্রাম নিতে। সে রক্ত দিয়েছে। সায়ন শোনেনি। আলতো করে ঘুমন্ত ইভাকে ধরে কড়িডোরের চেয়ারে বসে বসেই চোখ বুজে রেখেছে। নেওয়াজ সাহেব দেখে চাপা হাসলেন। সে এসেছে ছেলেটা বুঝেনি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।

নেওয়াজ সাহেব খানিক দুরত্ব রেখে পাশে বসলেন। সে পাশে বসতেই সায়ন আস্তে করে চোখ মেললো। পাশে উনাকে দেখে হঠাৎই কিছুটা বিচলিত বোধ করলো। ইভার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে পেটের দিকের শার্ট মুচরে ধরে আলুথালু হয়ে ঘুমাচ্ছে। সায়ন নড়লোনা। নিজ থেকেই বললো,

-“আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা, নড়লে উঠে যাবে।”
নেওয়াজ সাহেব হাসলেন। সম্মতির ইঙ্গিত দিয়ে ছোট্ট করে বললেন,

-“নড়োনা তবে।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here