#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_২
#পুষ্পিতা_প্রিমা
সজীব বাইরে চলে যাবে, কথা তাই মাকে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি টেনে তুলল। মারজিয়া ফজরের নামাজটা পড়ে মাত্রই শুয়েছেন। কথার টানাটানিতে থাকতে পারল না। উহ উহ শব্দ বের করে হাত নাড়িয়ে মাকে বুঝাল তার বর বাইরে চলে যাবে। ব্রেকফাস্ট করে দিতে। মারজিয়া বিরক্তি দেখাল।
‘ তোর জামাইয়ের জন্য তুই ব্রেকফাস্ট বানানো শিখ। কোনে কাজ কাম না করে বাদঁড় বানায়ছি দুটাকেই। অকর্মক।
কথা মুখ কালো করে ফেলল। হাই তুলতে তুলতে কলি আসল। মায়ের কথা শুনে বুঝে ফেলল যা বুঝার। ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ তার বরের জন্য তাকে রান্না করতে বলো মা। তুমি কেন করছ? কথা বলতে পারেনা মানে এই না যে রান্না ও করতে পারবেনা।
মারজিয়া রেগে গেল৷ বলল,
‘ তুই কোন রান্না করে উল্টায় দিচ্ছিস যে ওকে কথা শুনাচ্ছিস?
মারজিয়া রান্নার ঘরের দিকে এগোতে এগোতে ছোট মেয়েকে বললেন,
‘ কথা তোর বর কি খাবে? দেখি তাড়াতাড়ি বলে যাহ। তার তো আবার যেমন তেমন খাবার মুখে রোচেনা।
কথা মায়ের পিছু পিছু দৌড়ে গেল।
ব্রেকফাস্ট রেডি করে নিয়ে এল রুমে। মসজিদ থেকে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল সজীব। এই অগোছালো ছেলেটা অগোছালো ভাবেই ঘুমায়। কথা নাশতা টেবিলে রাখল। এখন সজীবকে তুলবে কি করে?
ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সজীবের পিঠে হাত রাখতেই উঠে গেল সজীব। চমকে গেল কথা। ইশারায় দেখিয়ে দিল টেবিলে রাখা ব্রেকফাস্ট। সজীব তার দিকে একবার তাকিয়ে ব্রেকফাস্টের দিকে তাকাল। গায়ের আড়মোড়া ভেঙে বসে থাকল। কথার রাগ লাগল। সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে না?
নাশতার প্লেট নিয়ে গিয়ে সজীবের হাতে ধরিয়ে দিল কথা। ঠেলেঠেলে খাওয়াতে হয় এই ছেলেকে৷ তার মাকে নিশ্চয়ই ভীষণ জ্বালাত। এখন বউকে জ্বালায়।
চুপচাপ খেল সজীব। বোবা বউ খেল কিনা জিজ্ঞেস ও করল না। কথার সামনে এলেই এই লোক কথার মতো বোবা হয়ে যায় কেন? কথার ভীষণ খারাপ লাগল৷ তার সামনে এলেই আনমনা থাকে এই ছেলে। মাথার একঝাঁক চুলগুলো কাটার নামগন্ধ নেই। গালে খোঁচা দাড়িগুলো ও লম্বা হয়ে যাচ্ছে। রোদেরোদে হেঁটে হেঁটে গায়ের উজ্জ্বল রঙটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কথার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়
‘ এই মশাই আপনি এমন কেন? কেন? কেন?
কিন্তু উপরওয়ালা সেই ক্ষমতা দেইনি কথাকে। আর যাকে দিয়েছে সে ইচ্ছে করে কথার সাথে কথা বলেনা। নাকি কথা, কথা বলতে জানেনা তাই সে ও কথার সাথে কথা বলেনা। কথা বোবা বলে কথা বলতে ইচ্ছে হয়না?
নানান রকম ভাবনা এসে জুড়ে বসে কথার ছোট্টমনে। এই ছেলের জন্য রোজ রোজ কত লাল নীল স্বপ্নের জাল বুনে সে। ক্যানভাসে কত রঙিন ছবি আঁকে। ছেলেটা না দেখে, না ছুঁই।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে সোজা নিচে নেমে গেল সজীব। টুং করে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল। তাতে লিখা,
‘ আবার কখন আসবেন আপনি?
সজীব উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। বের হওয়ার আগেই মোতালেব শেখ আটকালো সজীবকে।
‘ এই ছেলে সোজা বাসায় ফিরবে আজ। আমাকে বারবার ফোন দিতে না হয় মতো। আমার মেয়েকে যতদিন ঘরে তুলতে পারবেনা ততদিন এ বাড়িতে থাকবে তুমি। তোমার মায়ের হসপিটালের ক্লিনিক খরচ আমি এডভান্স পে করে দিয়েছি।
সোজা হয়ে দাঁড়াল সজীব। মোতালেব শেখের পেছনে এসে দাঁড়াল সুমন। সজীব সুমনের দিকে তাকাল। পেছনে দুহাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সোজাসাপটা বলল,
‘ আমার টিউশনি আছে। সকাল, সন্ধ্যা, রাতে। মাকে ও দেখতে যেতে হবে। সব মিলিয়ে অনেক রাত হবে। আমি বাসায় চলে যাব। এখানে আসব না। মাফ করবেন।
মোতালেব শেখ গর্জন করে উঠলেন।
‘ তুমি আবার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করাবে? আবার? এই মোতালেব শেখের মেয়ের জামাই তুমি। ভুলে যেওনা।
‘ আপনাকে বারবার এক কথা বলতে আমার ভালোলাগেনা। টিউশনি আমি আমার হাত খরচ চালানোর জন্য করায়। পড়াতে ভালো লাগে। আপনার মেয়ের জামাই হয়ে টিউশনি করাতে পারব না এটা কোথাও লেখা নেই।
‘ লেখা আছে।
গর্জে বললেন মোতালেব শেখ।
‘ লেখা আছে। চুক্তিপত্রে স্পষ্ট লেখা আছে তোমাকে তোমার স্ত্রীর প্রতি সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে। আর দশটা দম্পতির মতো হতে তোমাদের। কিন্তু তুমি ইচ্ছে হলে আমার মেয়েকে দেখা দাও, ইচ্ছে না হলে দাওনা। ইচ্ছে হলে আসো, ইচ্ছে না হলে আসোনা। আজ পর্যন্ত আমার মেয়েকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছ তুমি? কক্সবাজারের টিকিট কেটে দিয়েছি, তুমি কোথায় নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলে?
ভালো করে দুটো কথা বলতে ও দেখিনি তারসাথে।
‘ আপনার মেয়ে কথা বলতে জানলেই তো কথা বলব।
কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিল যেন সজীব। তেজী গলায় হুংকার ছাড়লেন মোতালেব শেখ।
‘ আমার মেয়ে কথা বলতে জানেনা তাই আমি তোমার মতো গর্দভের সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছি। তোমার মায়ের অপারেশনের টাকা থেকে শুরু সম্পূর্ণ চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি। সব করছি। তারপর ও তুমি আমার মেয়ের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলো কোন সাহসে?
‘ আপনি অযথা কথা পেঁচিয়ে ফেলেন। আমি শুধু বলেছি আপনার মেয়ের সাথে কিসের কথা বলব আমি। সে প্রশ্ন করলেই তো উত্তর দেব আমি। কিংবা আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেবে। আপনি যা বলতে চাইছেন তা হচ্ছে আমি একা একাই বকবক করব আপনার মেয়ের সাথে।
মোতালেব কথায় পারেনা এই ছেলের সাথে। এত ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকেই শেষ পর্যন্ত মেয়ের মনে ধরল? আর ছেলে পেলনা? কিসের কমতি তার মেয়ের?
কথা বলতে না জানা প্রতিবন্ধীদের কথা শেখানো স্কুলে পড়িয়ে ভালো টাকা ইনকাম করে তার মেয়ে। তাছাড়া কত সুন্দর ছবি আঁকে? ছবি বিক্রি করে ও ভালো টাকা কামাই। পুতুলের মতো মেয়েটির রূপের কি কমতি আছে? আল্লাহ কেন যে কথা বলতে পারার গুণটা দিলনা তার মেয়েকে। দিলে এমন একটা ঘাড়ত্যাড়া ছোটলোকের বাচ্চাকে সহ্য করতে হতোনা।
সজীব চলেই যাচ্ছিল। মোতালেব সাহেব আটকালেন,
‘ তুমি টিউশনি করতে যাবেনা।
সজীব আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল,
‘ তাহলে টিউশনি থেকে আমি যত টাকা পায়, ততটাকা আমার একাউন্টে জমা করে দেবেন। সারাদিন আপনার বড় মেয়ের জামাইর মতো সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখব। আর হ্যা সোফা ও খালি রাখতে বলবেন।
সুমন রেগে উঠল।
‘ এই ছোটলোকের বাচ্চা তুই আমার মতো কেন হতে চাসরে?
‘ ছোটলোকের বাচ্চা কে, ব্যবহারই তা প্রমাণ করে দিচ্ছে। যাইহোক আপনার মতো হতে কেন চাইব আমি? ফাইলপত্র ঘেঁটে নিজেকে তো আর ম্যানাজার প্রমাণ করতে যাচ্ছিনা।
রাগে,ক্রোধে তেড়ে যেতে চাইল সুমন। মোতালেব শেখ আটকালেন। বললেন,
‘ ঠিক আছে। কত টাকা পাও তুমি টিউশনি করে? কত টাকা?
সুমন আটকাতে চাইল, বসে বসে কেন বেতন খাবে সজীব? সে তো আদরের জামাই, তাকে তো খাওয়ায় না।
সজীব বলল,
‘ বর্তমানে আমার রানিং যতগুলো টিউশনি আছে, সবগুলো মিলে আমি পাই বারো হাজার টাকা। বারো হাজার টাকা আমার একাউন্টে পাঠিয়ে দেবেন। আর টিউশনি করব না আমি।
মোতালেব সাহেব নাক সিটকালো।
‘ সকাল, সন্ধ্যা, রাত মিলিয়ে তুমি টিউশনি করিয়ে মাত্র বারো হাজারটাকা পাও?
সজীব সাথেসাথেই জবাব দিল,
‘ ফাইলপত্রের গন্ধ শুঁকে শুঁকে পাইনা। পরিশ্রম করেই পায়। ফাইলপত্রের গন্ধ শুঁকতে জানলে আপনার বড় মেয়ের জামাইয়ের মতো পয়সাওয়ালা হতে পারতাম।
সুমন আর পারল না। সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। এই বেয়াদব ছেলেটা কথায় কথায় তাকে পঁচায়। কথায় কথায় তাকে হেয়। অথচ নিজে একটা ছোটলোকের বাচ্চা। আর এই বুড়ো শ্বশুর কেন এই বদকে তেল মেখে মেখে রাখে? বুবোনিটা ও আর ছেলে পাইলা না?
সজীব আবার বের হতেই যাচ্ছিল।
মোতালেব শেখ আটকালো।
‘ এখন কোথায় যাচ্ছ?
‘ মায়ের কাছে।
‘ দুপুরে ফিরবে। তোমার মাকে সেখানে ভালো ভালো খেতে দিচ্ছে। মাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। অপারেশনের ডেট সামনের মাসে। আর হ্যা ফোন দিলে, ফোন তুলবে।
সজীব চলে গেল।
হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে ঘরের দিকে দৌড়ে যাওয়া মেয়ের পিছু পিছু মারজিয়া ও দৌড়াই। মেয়েকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখে সান্ত্বনা দেয়।
‘ তোর বর তো কথায় কথায় ওসব বলেছে। এরজন্য কাঁদতে হয়? তোর সাথে কি কখনো খারাপ কথা বলেছে আজ পর্যন্ত?
কথা কেঁদেই গেল। সে কথা বলতে পারেনা তাই ওনি ও কথা বলেনা। কথা কেন ভাষাহীন? কেন বাকহীন? নিজেকে অসহায় মনে হয় মাঝেমাঝে। তার সব থেকে ও যেন সব নেই।
কথার কান্নার আওয়াজ শুনে মোতালেব শেখ হাঁক ছাড়লেন দরজা বাইরে দাঁড়িয়ে।
‘ এইসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে তোমার মেয়েকে কাঁদতে বারন করো মারজিয়া। ছোটলোকদের কথা কানে নিতে নেই।
আর ও জোরে কেঁদে উঠল কথা। তার বরকে ছোটলোক বলে বাবা কথায় কথায়। কথার আর ও জোরে কান্না দেখে মারজিয়া রুম থেকে বের হয়। মোতালেব শেখকে বলে,
‘ ছোটলোক হলে বিয়ে দিয়েছেন কেন সেই ছেলের সাথে? সব দোষ তো আপনার। মেয়ের পছন্দের ছেলের সাথেই তো বিয়ে দিলেন। আবার ছোটলোক ডাকেন কেন? সে কি যেচে আপনার কাছে এসেছিল? আপনি নিজেই গিয়েছেন তার কাছে। তার দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে আপনিই তাকে মেয়ের জামাই করেছেন।
মোতালেব শেখ বলেন,
‘ তো? কি হয়েছে? তাকে তো বলেছি আমার কোম্পানিতে চাকরি করো। ভালো পয়সা পাবে। মেয়ের জামাই হওয়ায় সে আর ও সুবিধা পাবে। কিন্তু না সে করবে না চাকরি। আমার কোম্পানি বলে। আমার পয়সায় খাবেনা। আমি ও বলে দিয়েছি আমার মেয়েকে এমন বাড়িতেই রাখতে হবে নইলে এখানেই থাকতে হবে তাকে। দেখি কোথায় চাকরি পায় সে? আমার কোম্পানিতে চাকরি না করে যায় কোথায় সে?
মারজিয়া আর কিছু বলল না। জানেনা সে এর শেষটা কোথায় হবে।
__________________
সজীবকে জোর করে সিগারেট ধরিয়ে দিল তার বন্ধুরা। বলল,
‘ তোর টিউশনিগুলো আমাদের দিয়ে মহান কাজ করলিরে মামা। নে আমাদের পক্ষ থেকে ট্রিট।
সজীব নিতে চাইল না।
‘ এসব আমার দ্বারা হবেনা দোস্ত। আম্মা এসব থেকে দূরে থাকতে বলছে আমায়। আম্মার মতে আব্বার অকাল মৃত্যুর কারণ এই সিগারেট।
হো হো করে হেসে উঠল সজীবের বন্ধুরা। শওকত বলল,
‘ তুই একটা জিনিস মামা। তোর মতো শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার জন্য আমরা কি করতে পারি সেটা বল। বউ পাইলি, ভালো শ্বশুরবাড়ি পাইলি, আবার মাসে মাসে বেতন ও পাবি। মায়ের চিকিৎসা ও ফ্রি ফ্রি।
সজীব কানেই নিল না সেসব কথা। শওকতের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে তুলে বলল,’ ঠোঁট পুড়ালে কি নিজেকে বিচ্ছিরি দেখায়?
যদি দেখায় তাহলে খেতে হবে। আম্মার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেব।
বন্ধুরা হা করে তাকিয়ে থাকল।
‘ বিচ্ছিরি দেখানোর জন্য সিগারেট খাচ্ছিস? ঠোঁট পুড়লে কি তোকে বিচ্ছিরি দেখাবে? আশ্চর্য কথা বলছিস মামা।
তানিমের কথায় কোনো ভাবান্তর দেখা গেলনা সজীবের মধ্যে। নিজেকে বিচ্ছিরি ভাবে উপস্থাপন করতে পারলেই তার শান্তি। সে জানে দূরে পার্ক করা গাড়িটা থেকে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটি তার বিচ্ছিরি রূপ আর স্বভাবের মাঝে ও মুগ্ধতা খুঁজে বেড়ায়। তার এই বিচ্ছিরি সেজে থাকার কারণটা ভালোভাবে উপলব্ধি করে। তারপর ও নিজেকে মেয়েটার সামনে বিচ্ছিরি ভাবে উপস্থাপন করতে ভালোলাগে সজীবের। হয়ত কোনো একদিন বিরক্তিতে তিথিয়ে উঠে বলবে,
‘ দূরে যান। দূরে যান।
ফোঁপানি উঠল কথার। গাড়ির ড্রাইভার বলল,
‘ ম্যাডাম স্কুলে কি যাবেন না?
কথা মাথা নাড়াল। ইশারায় বুঝিয়ে দিল সোজা ঘরে ফিরবে। কোথাও যাবেনা আর।
‘ ছেলেটা ইচ্ছে করেই তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে। ইচ্ছে করেই। ইচ্ছে করেই সিগারেটে ঠোঁট পুড়াই। ইচ্ছে করেই কথাকে দূরে ঠেলে। ইচ্ছে করেই নিজেকে কথার অযোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। ইচ্ছে করেই৷
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরালো আবার। কথা চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিল গাড়ির সিটে। ভাবে।
আড্ডামহলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া ছেলেটার পোড়া ঠোঁটে ও নেশা থাকে। মুগ্ধতা থাকে। এলোমেলো চুলেই দেখতে তাকে ভীষণ ভালোলাগে। জোড়াতালি দেওয়া স্যান্ডেলেই সবচাইতে স্মার্ট দেখায় ছেলেটাকে। বোতাম ছেড়া শার্ট পড়া ছেলেটার বুকের দিকে চোখ যেতেই যেন এলোমেলো হয় কথার মনমস্তিষ্ক। আনমনা চাহনিটাই ভীষণ মনকাড়ে। খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করার শব্দটা কানে এলেও বুকে তোলপাড় শুরু হয়। মাঝরাতে ছেলেটার নিঃশ্বাসের শব্দ তার নির্ঘুম রাতের কারণ হয়।
তার এই চুপকথার গল্প ইশারায় ইশারায় শোনানোর জন্য সে বসে থাকে কিন্তু গল্প শোনার মানুষটা সুনিপুণভাবে বাকিদের মতো তাকে এড়িয়ে চলে। কেন? কথা বাকপ্রতিবন্দ্বী বলে? কথা বলতে জানেনা বলে? নাকি সজীব তার ইশারা বুঝেনা বলে।
_________
নতুন একজোড়া কালো বেল্টের দু ফিতার স্যান্ডেল কিনেছে কথা। দুটি শার্ট। দুটোয় কালো। তারমতে কালো শার্টেই তার বরকে বেশি সুন্দর দেখায়। অনেক আগের কেনা। ভয়ে ভয়ে দেইনি। কিন্তু এখন লোকটার স্যান্ডেলের বাজে অবস্থা। অনেক পুরোনো হয়ে গিয়েছে। গায়ের শার্ট তিনটা উলটপালট করে পড়ে।
দরজার বাইরে জুতো খুলে রাখার জায়গায় জুতোজোড়া রাখল কথা। বিছানার উপর মেলে রাখল শার্ট দুটো। এসেই দেখলে পড়বে।
দুপুরে খেতে আসেনি। রাতে আবার বাবার সাথে ঝগড়া লাগবে।
মাগরিবের আগে ফিরল সজীব। বাড়ির কাজের মহিলা সুজাতা দরজা খুলে দিল।
‘ ভাইজান গোসল করলেন কই? দুপুরে খাইলেন?
সজীব উত্তর দিল।
‘ আমার বাসায়।
সোজা উপরে চলে গেল। মোতালেব শেখ দেখে ও কিছু বলল না।
দরজার কাছে নতুন জুতো দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল সজীব। ঘরে আবার কে ডুকল? দরজা হালকা করে লাগানো। দরজা ঠেলে ডুকল না সজীব। কে ঘরে ডুকল, বের হচ্ছেনা কেন? মেজাজ বিগড়ে উঠতে লাগল সজীবের। তারপরে ও ঘরে ডুকল না সে। গলা খাঁকারি দিল।
দৌড়ে এসে দরজাটা একেবারে খুলে দিল কথা। নিচে জুতোজোড়া দেখিয়ে দিল ইশারায়। সজীব সোজা রুমে ডুকে পড়ল। বিছানার উপর রাখা কালো শার্ট দেখে ভুরু কুঞ্চন হলো। মুখ ধুয়ে এসে পড়নের শার্ট বদলে অন্য শার্ট পড়ে নিল। বিছানার উপর শার্ট দুটো পড়ে থাকল।
আড়ালে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠল কথা। সে কত পছন্দ করে শার্টদুটো কিনেছে, পড়বেনা?
রাতের খাবার না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কথা। সজীব খেল কি খেল না দেখল না। মা খাওয়াবে।
সজীব এসে বিছানায় ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখল। একবার তাকিয়ে আর তাকাল না। না দেখার জন্য ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল। শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙল কথার। খিদে পেয়েছে।
ঘরের লাইট জ্বালাতেই বালিশের নিচে হাত রেখে ঘুমানো ছেলেটাকে দেখে হাসি ফুটল মুখে। গায়ে সেই কালো শার্ট। তার কেনা। তার টাকায় কিনেছে সে। কি সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে!
কথা ঠোঁট দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল ছেলেটার কান। ছেলেটার অজান্তে।
চলবে,