#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা
থাই গ্লাস সরাতেই ঘরে উড়ে উড়ে ডুকে পড়ল রঙবেরঙের একটি প্রজাপতি। হাত বাড়িয়ে দিল কথা। তার ঘরে কেন প্রজাপতির প্রবেশ হঠাৎ। প্রজাপতি উড়ে এসে বসল কথার হাতের উপর আবার উড়ে চলে গেল। প্রজাপতির পেছন পেছন দৌড়াল কথা। তখনি দরজা ঠেলে রুমে ডুকল সজীব। মুখের ভাবভঙ্গি দেখে কিছু বুঝার উপায় নেই। কথা সজীবকে উপেক্ষা করে প্রজাপতিটি ধরার জন্য দৌড়াল। মুখ দিয়ে উঃ উঃ শব্দ বের হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সজীব। প্রজাপতিকে হাতের উপর বসানোর জন্য যেন লড়াই করছে কথা। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দেয়ালে বসা প্রজাপতিটাকে হাতে বসানোর জন্য তুমুল যুদ্ধ। সজীব হাতের শার্টটি খাটে রাখল।
এগিয়ে গেল। লম্বা হওয়ায় পায়ের আঙুলে ভর দিতে হলোনা। দেয়ালে হাত লাগাতেই প্রজাপতিটি উঠে আসল তার হাতে। খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল কথা। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হলো। সজীবের দিকে চোখ পড়তেই হাসি থেমে গেল কথার। সে চোখ নামাল না। সজীব নামাল। হাতটা বাড়িয়ে দিল কথার দিকে। কথা চেয়ে রইল প্রজাপতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে। চট করে মাথায় খেলে গেল খুব সুন্দর একটি দৃশ্য। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল, মগজে ডুকিয়ে নিতে লাগল কিভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলবে সেই দৃশ্য। কথার কোনো নড়াচড়া না দেখে আবার চোখ তুলল সজীব। আশ্চর্য! চোখ বন্ধ কেন এই মেয়ের? কেমন কেমন যেন মেয়েটা! কথা বলতে না পারা মেয়েগুলো আসলেই কি কেমন কেমন হয়!
চোখ খুলল কথা। সজীবের হাতটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। গরম নিঃশ্বাস পড়ল সজীবের হাতের উপর। হাত নাড়তেই প্রজাপতি উড়ে গেল। কথা মুখ নামিয়ে সজীবের হাতের তালু ছুঁতেই আচমকা হাত নামিয়ে ফেলল সজীব। ছলছলে চোখে তাকাল কথা। হাতের তালু শার্টে ঢলে ফেলল সজীব। সোজা বের হয়ে গেল । এক মুহূর্ত ও দাঁড়াল না৷ পিছু পিছু ছুটল কথা। রাগ করে ফেলল? আর আসবেনা?
মোতালেব শেখ বসে রয়েছেন সোফায়। মুখের উপর জার্নাল ধরা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা সজীবকে দেখল আঁড়চোখে।
‘ খেয়েছ?
সজীব কোনো উত্তর দিলনা।
মোতালেব শেখ এবার জোরে আওয়াজ করে বলল,
‘ তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি!
সজীব উত্তর করল,
‘ আমার নাম উচ্চারণ করেননি। তাই বুঝতে পারিনি। খেয়েছি।
‘ এখন কোথায় যাচ্ছ?
‘ বাইরে। বন্ধুদের কাছে। মায়ের কাছে ও যাব।
‘ কথাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে এসো। কোথায় যেতে চাও?
‘ কোথাও না।
মহাবিরক্ত হলো মোতালেব শেখ।
‘ তাহলে বাড়ির বাইরে পা রাখবেনা তুমি। আমি যা বলব তাই হবে।
‘ আপনি আমায় কিনে নেননি? আপনি আমার জন্য কিছুই করছেন না, সব আপনার মেয়ের জন্য করছেন। মায়ের অপারেশনের টাকা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা করছেন সবটা আপনার মেয়ের জন্য। আমি আপনার টাকায় খাচ্ছি ও না, পড়ছি ও না।
মোতালেব শেখ হুংকার ছাড়লেন।
‘ বারবার এক কথা বলে কি প্রমাণ করতে চাও তুমি? যে টাকা দিয়ে কিনে আমি আমার মেয়েকে জামাই দিয়েছি? বিয়ে করার আগে তো তুমি বলোনি, যে আমার মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মানতে তোমার অসুবিধা হবে? বলেছ?
‘ স্ত্রী মানিনা এটা কখনো বলেছি?
চুপ হয়ে গেলেন মোতালেব শেখ।
মারজিয়া দৌড়ে গেল।
‘ আবার শুরু শ্বশুর জামাইর ঝগড়া?
কলি আর সুমন আসল। মহাবিরক্ত দুজনের চোখেমুখে। কলি মোতালেব শেখকে বলল,
‘ বাবা, তোমার ছোটো মেয়েকে পাঠিয়ে দাও শ্বশুরবাড়ি। রোজ রোজ এসব একদম ভালো লাগেনা।
মোতালেব শেখ ধমক দিলেন মেয়েকে।
‘ একদম চুপ। আগে নিজে গিয়ে দেখাও তারপর ছোট বোনকে বলো।
চোখ ভিজে গেল কলির। বাবা তাকে এভাবে বলল? তা ও আবার একটা ছোটলোকের সামনে? রাগে, দুঃখে ফেটে পড়ল কলি। চলে গেল কেঁদে।
উপর থেকে চেয়ে রইল কথা। পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়ানো সজীব মুখ খুলল।
‘ আর কিছু বলবেন? আমাকে বেরোতে হবে।
‘ কোথাও যাবেনা তুমি। কথাকে গিয়ে স্কুলে দিয়ে এসো।
‘ আমার দ্বারা হবেনা মিঃ শেখ।
‘ কেন হবেনা? লজ্জায় মাথা কাটা যাবে? কেউ দেখে ফেললে বোবা বউয়ের জামাই বলবে?
‘ অযথা কথা বাড়াচ্ছেন আপনি। আমি গাড়ি ড্রাইভ করতে পারিনা, আপনার মেয়েকে ড্রাইভার নিয়ে যাবে।
সুমন বলল,
‘ গাড়ি চালাবি কি করে? গাড়িতে উঠে বসেছিস কখনো?
মারজিয়া ডাক দিল।
‘ সুমন তুই তুকারি করবেনা। ও তোমার মতো এ বাড়ির জামাই। তোমার যতটুকু অধিকার আছে এই বাড়ির উপর, ততটা তার ও। ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।
অপমান বোধ করল সুমন। মাথা নামিয়ে রাখল।
সজীব কিছুই বলল না।
মোতালেব শেখ সজীবকে বলল,
‘ তোমাকে আমি পুলিশে দেব। চুক্তিপত্রের বিপক্ষে কাজ করছ তুমি।
‘ দিতে পারেন সমস্যা নেই।
মোতালেব সাহেব হা করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কথা ও। এমন রুক্ষ, নির্ভয়, কঠোর মানুষকে প্রথম দেখায় এত কোমল মনে হয়েছিল কেন? মনে ধরেছিল কেন?
সজীব চলে গেল। রাগে,আক্রোশে বাড়ি কাঁপিয়ে গর্জন করলেন মোতালেব শেখ।
‘ মেয়ে নিয়ে নেব আমি। রাখব না এই ছেলের কাছে। ডিভোর্স পেপার রেডি করব আমি।
মারজিয়া মুখে আঁচল গুজলেন।
‘ ছিঃ ছিঃ এসব কেমন কথা?
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল কথা। মারজিয়া কথাকে দেখে মাথায় হাত দিলেন।
‘ মেয়েটার সামনে আর কোনো কথা বলতে পেলনা লোকটা। প্রচন্ড ভয় পাওয়া বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কথা। গাল ভিজে আছে। চোখের লম্বা পাতা ভিজে ভাগ হয়ে গেছে।
মোতালেব সাহেবের কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে দাঁড়াল কথা। হাতের উপর জোরে চিমটি বসালো ফুঁপিয়ে উঠে। মোতালেব শেখ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকল মেয়ের দিকে। হাতে জ্বলুনি হলেও কিছু বললেন না তিনি। শেষমেশ যখন কথা ছাড়ল না। হাত নেড়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চড় বসালো কান বরাবর। মারজিয়া আঁতকে উঠে এসে ধরল কথাকে। আওয়াজ করে কেঁদে উঠল কথা। মোতালেব শেখ বের হয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
‘ এবার আমার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দেব আমি তোমায়। দরকার হলে এই বাড়ি বেচে দেব।
মারজিয়া মেয়ের মাথায় ঘনঘন হাত বুলায়।
‘ ওগুলো তো রাগ করে বলছে তোর বাবা। কাঁদিসনা মা। ভালো আমার মেয়ে। তোর বর তোরই থাকবে।
কথা শান্ত হলোনা। আওয়াজ করে কাঁদল। মারজিয়া হাত বাড়িয়ে দিল। বলল,
‘ নে চিমটি দে। যত খুশি দে। নে।
কথা জোরে চিমটি বসালো মারজিয়ার হাতে। তারপর দৌড়ে চলে যেতেই সুমন ধরল কথাকে। বলল,
‘ আরেহ কেঁদোনা কথা। বাবা তো ওসব রাগে বলেছে।
মারজিয়া মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসল।
কথা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে হাত ছাড়াতে পারল না। সুমন তার মাথায় বুলালো। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ এত সুন্দর বউয়ের দিকে ওই ছোটলোক তাকায় না কেন ভালো করে?
পিঠে বিশ্রীভাবে বিচরণ টের পেল কথা। দূরে ছিটকে এল কথা। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জাল। মারজিয়া উঠে এল। বলল,
‘ কি হয়েছে? কি হয়েছে মা? চল। সুমন ওর সামনে উল্টাপাল্টা কথা বলিওনা তো সজীবকে নিয়ে। চল মা৷
কথা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সুমনের দিকে।
আপার বর এত অসভ্য কেন? তার বর নিজের বউয়ের দিকেই ভালোভাবে তাকায় না। আর এ নিজের শালিকার দিকে কেমন করে তাকায়।
____________
মায়ের মাথার কাছে চেয়ার টেনে বসল সজীব। নার্স এসে ইনজেকশন পুশ করে গেল সাজিয়া বেগমকে । সাজিয়া বেগম ছেলেকে দেখে বললেন,
‘ চুল না কাটা অব্ধি আমার কাছে না আসতে বলেছি না? রবীন্দ্রনাথ সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে তোর?
সজীব চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,
‘ আজ কেটে ফেলব আম্মা।
‘ মুখের দাঁড়িগুলো ও ছোট ছোট করে নিবি। তোর না বউ আছে। সুন্দর করে গোছগাছ থাকতে পারিস না। কেন এমন হয়ে গেলিরে?
সজীব মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
‘ কেমন ছিলাম মা?
সাজিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে বলেন,
‘ গোছগাছ, ফিটফাট, হাসিখুশি সজীবকে আবার ফিরে আসুক আমার কোলে। যে কথা বলার আগেই হাসত। এমন কেন হয়ে আছিস খোকা? এই অভাব, অনটন একদিন গুছিয়ে যাবে তোর চাকরি হয়ে গেলে। যা হারিয়েছিস তা কি আর ফিরে পাবি? তাহলে এখন যা আছে তা কেন আঁকড়ে ধরছিস না? মেয়েটাকে বউ করলি পর্যন্ত একদিন ও আমার সাথে দেখা করাতে আনলি না। আমার ও যে ছেলের বউ দেখতে ইচ্ছে করে।
সজীব পুরোটা সময় চুপ থাকল। বলল,
‘ তোমার অপারেশন আগামী মাসে মা। আগামী মাসেই আমরা বাসায় উঠব। বাসায় যেতে ইচ্ছে করেনা, তুমি ছাড়া।
‘ আমরা তো বাসায় যাব। কিন্তু তোর বউ? তোর শ্বশুর কি তোর বউকে আমাদের ওই ছোট্ট বাসায় রাখবে? তোকে ছাড়বে?
সজীব বলল,
‘ কালো আঙুর পছন্দ করো তাই এনেছি। খেয়ে বলোতো কেমন হয়েছে। দাঁড়াও আমি ধুঁয়ে দিচ্ছি।
সজীব বোতলের পানি দিয়ে ধুয়ে নিল আঙুর। মায়ের কাছে দিতেই চোখ নিচে নামিয়ে ফেলল।
‘ কথা ঘুরাবি না সজীব। আমি তোর মা হই। কথাকে নিয়ে আসবি কাল। নইলে দেখতে আসবি না আর আমাকে।
সজীব কিছু বলল না।
অনেক্ক্ষণ পর বলল,
‘ গ্রামের বাড়ি ফিরব মা। তুমি আর আমি।
না না করে উঠলেন সাজিয়া বেগম।
‘ আমি যাব না ওখানে। তুই ও যাবিনা। তুই যাবিনা সজীব।
মাথা তুলে তাকাল সজীব।
‘ কেন মা?
‘ তোর বউ এখানে সজীব। তোর বউ। বিয়ে করা বউ। কালেমা স্বাক্ষী রেখে বিয়ে করেছিস তাকে। এক সুঁতোয় বাঁধা পড়েছিস। বিয়ে পবিত্র বন্ধন। এই বন্ধনকে অসম্মান করলে পস্তাবি তুই সজীব। কথার প্রতি একটু যত্নশীল হ আব্বা।
সজীব আঙুর মুখে পুড়ল।
‘ তোমার অপারেশন হয়ে যাক আম্মা। আমরা এসব নিয়ে পরে কথা বলব।
সজীব চলে যাওয়ার আগে সাজিয়া বেগম ছেলের কপালে চুমু আঁকলেন। জড়িয়ে ধরে রাখলেন অনেকক্ষণ।
সজীব বলে গেল,
‘ আসি আম্মা। নার্সদের কথামতো চলবে। ঠিকমতো ওষুধ খাবে।
কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন দেবে।
সাজিয়া বেগম বলেন,
‘ কথাকে নিয়ে আসবি কাল।
সজীব কিছুই বলল না।
______
স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো দৌড়ে এল কথার কাছে। সবাই কথার পা ধরে লাফাতে লাফাতে মুখ দিয়ে আঃ উঃ শব্দ করল। কথা তাদের ভাষা বুঝে হাসল। ইশারায় বলল,
‘ ক্লাসে যেতে। সে কাল আবার আসবে।
বাচ্চাগুলো ইশারায় বিদায় জানাল কথাকে।
ড্রাইভার আকমল কথাকে দেখল। তার ও কথার সমবয়সী একটা মেয়ে আছে। এই মেয়েটাকে দেখলে বুঝার সাধ্যি নেই এই মেয়ে কথা বলতে জানেনা। গাড়িতে উঠে বসল কথা ৷ ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল। শপিং কমপ্লেক্সের পাশে বন্ধুদের সাথে সজীবকে দেখা গেল। চুল কেটেছে, গায়ে অন্য একটি সাদা শার্ট। হাতে কাগজপত্র।
কথা ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। ড্রাইভার গাড়ি থামাল। গাড়ির কাচ নামালো কথা। সজীবের চোখ সোজা এল গাড়ির কাচে। কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিল সজীব। বন্ধুদের নিয়ে উল্টোপথে হেঁটে চলে গেল। কথার মন খারাপ হলো? এখন বেলা দুইটা। লোকটা কি বাড়ি ফিরবেনা? খাবে না?
আবার চলে এল সজীব। রিকশা ডেকে উঠে পড়ল রিকশায়। রিকশা চলতে লাগল আপন গতিতে।
কথা ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়তে বলল। রিকশার পিছু পিছু গাড়ি এসে থামল শেখ বাড়ির গেইটের কাছে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো সজীব।
দাড়োয়ান গেইট খুলল গাড়ি ডুকার জন্য। সজীবকে গাড়ি পেছন পেছন ডুকতে দেখে বলল,
‘ ম্যাডাম গাড়ি করে, আপনি রিকশায় কেন স্যার?
সজীব কোনো উত্তর দিলনা। এসব আজব প্রশ্ন করে কেন মানুষজন?
গাড়ি থেকে কথা বাড়িতে ডুকল। তার পেছন পেছন সজীব। মোতালেব শেখ দেখে খুশি হলেন। সজীব কথাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসেছে? মুখে হাসি ফুটল মোতালেব শেখের। মাঝেমাঝে প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া মনে হয় সজীবকে। এজন্যই বিরক্ত লাগে। কিন্তু ছেলেটা মন্দ না।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ খাচ্ছে সজীব। সুমন মোতালেব শেখের পাশে এসে বসল। সজীবকে চুপচাপ খেতে দেখে গা জ্বলল। চরম বিরক্ত লাগে এই ছেলেকে। কলি এসে খাবার বেড়ে দিল সুমনকে। এদের এত ঢং দেখলে গা জ্বলে সজীবের। কথা এসে দূর থেকে আড়চোঁখে দেখল সজীবের খাওয়া। সামনে যাওয়ার সাহস ও করে উঠতে পারেনা। অথচ তার বরকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে করে খাওয়ায়। বরটা ভালো না।
মারজিয়া গিয়ে সজীবের পাতে ভাত তুলে দিল।
‘ এত কম খেতে নেই সজীব।
সজীব হা হু কিছুই বলল না। মারজিয়া ডাক দিল কথাকে।
‘ কথা ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছেলেটার কি লাগছে দেখ। সবকিছু বলে বলে করাতে হয়।
কথা দৌড়ে এল। মারজিয়া চলে গেল।
চামচ হাতে নিয়ে এটা ওটা তুলে দিতে গিয়ে আটকে গেল কথা। সজীব হাত দিয়ে রাখল। কথা আর দিলনা। ত্যাড়া লোক। মোতালেব শেখ আঁড়চোখে দেখলেন কান্ড। বেয়াদব ছেলে আমার মেয়ের সাথে কথা বলেনা।
কলি বলল,
‘ কথা তোর ভাইয়ার জন্য পায়েস রেখেছি। ওটা নিয়ে আয় তো।
কথা গেলনা। মারজিয়া পায়েসের বাটি এনে টেবিলে রেখে বলল,
‘ সজীব তোমাকে একটু পায়েস দিই?
সজীব ঘনঘন মাথা নাড়াল।
মারজিয়ার খারাপ লাগল।
‘ এই ছেলের এত বাছা কেন? পায়েস ও মানুষ খাইনা?
কলি বাটি কেড়ে নিল।
‘ এগুলা খেতে জানতে হয় আম্মা। সবাই খেতে জানেনা। জানলে ও হজম করতে পারেনা।
কথার রাগ লাগল। সজীব খেয়ে সোজা উপরে উঠে লাগল। কলি বোকাবনে গেল। ‘ এই ছেলের রাগ, ঘৃণা বলতে কিছুই নেই। কিভাবে এড়িয়ে যায়?
কথা কলির হাতে জোরে চিমটি মারল। দৌড়ে সজীবের পিছু পিছু চলে গেল। কলি হাত ঢলতে ঢলতে চিল্লিয়ে পুরো ঘর মাথায় তুলল। মোতালেব শেখ বলল,
‘ বড় বোন বড় বোনের মত থাকো কলি। সবসময় ওকে, ওর বরকে খোঁচা দিয়ে কথা বলবেনা।
কলি রেগে ডাকল
‘ বুবোনি। কথা বলতে জানলে আল্লায় জানত কি করত? বেয়াদব।
মারজিয়া বলল,
‘ ভাল হয়েছে কথা বলতে জানেনা। অন্তত খারাপ কথা বলতে হচ্ছেনা ওকে।
কলি রাগে দুঃখে কেঁদে দিল।
সজীবের পিছু পিছু ঘরে ডুকে গেল কথা। দরজা বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে নিজে নিজে আওয়াজ করে হাসল। চিমটিটা জোরে দিয়েছে। ভালো হয়েছে একদম। তার বরকে পঁচায়?
সজীব পিছু ফিরে চোখ বন্ধ করে হাসতে দেখল কথাকে। আশ্চর্য!
কথা হাসতে হাসতে বিছানায় ঢলে পড়ল। হাসার কারণে চোখে জল চলে এল। সজীবকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতে দেখে হাসি থেমে গেল কথার। হাসি থামিয়ে গালে আঙুল দিল কথা। তাকিয়ে রইল সজীবের দিকে।
চোখ সরিয়ে পকেটে হাত দিল সজীব। ফোনে মেসেজ লিখল হেঁটেহেঁটে।
টুংটাং আওয়াজ করে মেসেজ এল কথার ফোনে।
‘ মায়ের কাছে নিয়ে যাব। রেডি হয়ে থাকতে হবে।
সম্বোধনহীন এই মেসেজটা কথা কয়বার পড়ল হিসাব নেই। তাকে কি বলে সম্বোধন করবে? তুমি নাকি আপনি? কোনটাতে বেশি ভালো লাগবে? তুমিতে বেশি ভালো লাগবে।
কথা মেসেজ পাঠাল।
‘ বুঝলাম না।
‘ মায়ের কাছে নিয়ে যাব রাতে। আবার নিয়ে আসব। মা দেখতে চেয়েছে?
কথা চালাকি করে মেসেজ পাঠাল।
‘ কাকে?
আর মেসেজ এলনা। কথা রেগে তাকাল সজীবের দিকে। অসভ্য লোক মুখে বললে কি হয়? কথা, কথা বলতে জানেনা। কিন্তু শুনতে পায়। বুঝেনা কেন এই লোক।
কিন্তু কথা খুশি হলো ভীষণ। তাকে সাথে করে নিয়ে যাবে সজীব। রিকশায় একপাশে বসবে। চুপিচুপি কথা হাতটা শক্ত করে ধরে নেবে। কাঁধে মাথা রাখবে। চোখে চোখ রাখবে।
কিন্তু তা হলোনা। সজীব গেল যে গেল আর এলনা। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ল কথা। মারজিয়াকে ধরে আনল শাড়ি পড়িয়ে দেবার জন্য। মারজিয়া মেয়েকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে চেয়ে রইলেন অনেক্ক্ষণ। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ তোকে কত মিষ্টি লাগছে মা?
কথার ঠোঁট থেকে হাসি সরলনা। যদি এমনটা বরটা বলতো?
কিন্তু এ তো অসম্ভব। অমন দামী কথা কখনো বলবে সজীব? তার চোখে কথা তো সুন্দর না।
মারজিয়া মেয়েকে হাতে চুড়ি পড়ালেন। বললেন,
‘ তোর বর যখন থাকে তখন তো শাড়ি পড়তে পারিস। কত সুন্দর দেখায়। আমি মা হয়ে তোকে ওসব বলতাম?
কথা হাসল। লজ্জা পেল।
কিন্তু সজীব এলনা। কথার মন খারাপ হলো। কান্না পেল। বাড়ির ড্রাইভার রাত আটটার দিকে এসে বলল,
‘ ছোট ম্যাডামকে হসপিটালে দিয়ে আসতে বলেছেন জামাই।
কথা আবার দৌড়ে উপরে উঠল। তাড়াহুড়ো করে আবার শাড়ি পড়ল।
অভিমানে ভারী হলো বুক। রিকশা করে যেতে চেয়েছিল সে। লোকটা এমন কেন? খালি কষ্ট দেয়। মন খারাপ করে দেয়। কান্না করায়।
গাড়িতে বসে চোখের জল ফেলল কথা। সজীব হসপিটালের সামনে দাঁড়ানো। কথা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে সামনে এল। কথা মাথা তুলে তাকালো না। মুখের কি অবস্থা করেছে কে জানে? শুধু কান্না পায় কেন?
সজীব তার আগে আগে হাঁটল। কথা পেছনে। হাতটা ধরলে কি হয়? হাত ধরে কি হাঁটা যায় না? বউই তো।
সজীব পিছু ফিরে ফিরে দেখল কথাকে।
কথা পিছু পিছু হাঁটল। শাড়ি পড়েছে তা ও ভালো করে দেখল না। এই হৃদয়হীন লোকটার হৃদয়টা কোথায়? চুরি করার জন্য তো তার ঠিকানা জানা দরকার? কোথায় গেলে সে হৃদয়ের ঠিকানা পাবে সে?
সাজিয়া বেগমের চোখ জুড়াল কথাকে দেখে। জিজ্ঞেস করে বসল,
‘ কেমন আছ মা?
কথাকে, কথা বলতে না দেখে জিভে কামড় বসালেন। তিনি ভুলে গিয়েছেন কথা কথা বলতে পারেনা।
মিষ্টি করে হাসল কথা। পা ছুঁয়ে সালাম করল। সজীব বের হয়ে গেল মায়ের ইশারায়।। সাজিয়া বেগম কথার মুখে ছুঁয়ে বলল,
‘ অনেক মিষ্টি বৌমা আমার। বর কথা বলে?
কথার মন খারাপ হয়ে যায়। সে মাথা নাড়িয়ে না বলে।
সাজিয়া বেগম হাসে।
‘ বর একটু, একটু না একটু বেশিই খারাপ। আবার একটু বেশিই ভালো।
কথা মাথা নামিয়ে ফেলল।
‘ ছলছলে চোখদুটো লুকোতে চাইল সাজিয়ার কাছ থেকে। গলার চেইনটা খুলে কথার গলায় পড়িয়ে দিল সাজিয়া। বলল,
‘ আমার ছেলে তো তোমাকে কিছুই দেয়নি। আমিই দিলাম। আজ দেয়নি, কাল নিশ্চয়ই দেবে। সেদিন আমাকে এটি ফেরত দিও। আমার বৌমা চিহ্ন দিলাম। এটা তোমার শ্বশুর আমাকে দিয়েছিলেন। তখনকার। অনেক ভারী দেখেছ? সজীব কোনোমতেই সেটা আমাকে বেঁচতে দেয়নি। এত অভাব অনটন গেল, সে তারপর ও সেটা বেঁচার নাম নেয়নি। বলে, এটা নাকি তার বাবার স্মৃতি।
কথার কত কথা বলতে ইচ্ছে হলো কিন্তু বলতে পারল না। কত কথা, কত আলাপ করতে ইচ্ছে হলো। একপক্ষ যখন নীরব শ্রোতা হয় তখন অপর পক্ষ কথা বলে সুবিধা পায়না।
মন খারাপে চেয়ে গেল মুখখানি। সাজিয়া বুকে জড়ালেন কথাকে। কথার গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়াল।
সজীব তখনি কেবিনে ডুকে এল। মায়ের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আম্মা আপা কল দিয়েছে। কি বলতে চাই শোনো।
সাজিয়া বেগম কথার সাথে হাসল। বলল,
‘ ও আমার বড় মেয়ে। সায়মা। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। একটা বাচ্চা ও আছে ছয়বছরের ।
সজীব বলল,
‘ কথা বলো মা।
সাজিয়া ফোন কানে দিয়ে কথা বললেন মেয়ের সাথে। সজীবের বউ এসেছে বললে আবদার করল,আমার সাথে কথা বলতে বলো মা। ওকে দাও। আমি কথা বলব ভাইয়ের বউয়ের সাথে।
কথা শুনল সেই কথা। সাজিয়া বেগম হেসে বলল,
‘ বলিস। পরে। এখন তোর ভাইয়ের ফোনে ব্যালেন্স নেই। বুঝলি।
সায়মা ওপাশ থেকে বলল,
‘ আমার আছে। দাঁড়াও কল দিই।
ফোন নিয়ে নিল সজীব। বাইরে চলে গেল। কথা মাথা নামিয়ে বসে রইল। সাজিয়া বেগম তার মুখ আগলে ধরল। বলল,
‘ কথা বলতে পারোনা এটা লজ্জার কিছু নয়। এটা তোমার দুর্বলতা নয়৷ কথা বলতে না জানলে ও তুমি কি সজীবের কথা বলতে না তোমার বাবাকে?
ঘনঘন মাথা নাড়াল কথা।
সাজিয়া বেগম হাসল। বলল,
‘ তোমার বর তোমার সাথে কি একবার ও কথা বলেনি?
কথা ইশারায় মোবাইল দেখিয়ে বুঝাল।
‘ বলে, মেসেজে। কিন্তু মুখে বলেনা।
সাজিয়া বেগম হেসে ফেলল।
‘ বলবে, আমি বলব বলার জন্য। তোমার বর ভালো তো।
কথা ইশারায় বুঝালো।
‘ আমি জানি তো। বর ভালো। শুধু আমার সামনে এলেই খারাপ হয়ে যায়।
_________
২ দিন পর,,,
ইজেল থেকে ক্যানভাস নিয়ে দেয়ালে টাঙালো কথা। সাদা কালো সজীবের ছবি। হাসিমুখের ছবি আঁকতে পারল না কথা লোকটাকে কখনো হাসতে দেখেনি বলে। কেমন গম্ভীর ভাবমূর্তি। ছবিটা দেখেই হাসল কথা।
ঘরে ঠেলে ঘরে ডুকে পড়া ব্যক্তিকে দেখল না। দেখার কি আছে? ছবিটাকে দেখুক বরঞ্চ। তারপাশে এসে দাঁড়ালো লোকটি। কথা অবাক। লোকটা এতকাছে এসে কখনো দাঁড়ায় না। পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে গেল কথা। সুমন?
চেহারা কুঁচকে ফেলল কথা। সুমন হাসল তার সাথে। একাহাতে কথার গাল গলিয়ে কানের পাশে হাত রেখে বলল,
‘ বরের জন্য অপেক্ষা করছিলে?
হাতটা ছুড়ে ফেলল কথা। ঘর থেকে বের হওয়ার ইশারা করল। চিৎকার করলে ও সে আওয়াজ ঘরের বাইরে যায়না। গলা ধরে যায়। সুমন হেসে বলল,
‘ এরকম করছ কেন? আমি কি কিছু করেছি? এখনো তো কিছুই করলাম না।
কথা ঘর থেকে বের হয়ে যেতে গেল। সুমন আটকালো। দরজা বন্ধ করেছি আমি। পালাতে চাইছ কেন? কথা বলতে এসেছি তোমার সাথে। বসো। কথা বলি। তোমার বর তো তোমার সাথে কথা বলেনা। আমি বলি। আসো।
দরজার খিল খুলল কথা। সুমনকে টেনে বের করল দরজার বাইরে। সুমনের জুতো দরজার কাছে। আঙুল দেখিয়ে শাঁসাল কথা। বাবাকে বলে দেব আমি। হাসল সুমন। তার পেছনে এসে দাঁড়াল সজীব। ফোন থেকে মাথা তুলতেই রুমের বাইরে দেখল সুমনকে। খালি পায়ে।
জুতোজোড়া পড়তে পড়তে সুমন বলল,
‘ তোমার বর বোধহয় আজ আসবেনা। আর কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম।
কথা তাকাল সজীবের দিকে। গাল বেয়ে টুপটাপ জল পড়ল। সজীব নিঃশব্দে এল, আবার ও নিঃশব্দে চলে গেল। একদম বাড়ি থেকে। সুমন ও চলে গেল। কথা দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। মাকে আঁচড় কাটতে কাটতে কাঁদল। মারজিয়া কিছু বুঝতে পারল না।
চলবে,