#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা
চায়ের ট্রে এনে টেবিলে রাখল কথা। গরমে ঘেমে উঠেছে। শাড়ির আঁচল টেনে ঘাম মুছে নিল। সজীব টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুঁজেছে। কথার আসার শব্দ পেয়ে আঁড়চোখে দেখল কথাকে। শাড়ি পড়েছে কথা। কেন? আশ্চর্য! যা সামলাতে পারেনা তা পড়তে কে বলে?
ভীষণ বিরক্ত হলো সজীব।
চায়ের কাপ এনে সজীবের সামনে রাখল কথা। সজীব জানে সে চায়ের কাপ মুখে না তোলা পর্যন্ত যাবেনা এই মেয়ে। তাই চায়ের কাপ মুখে দিতেই শব্দ করে উঠল। ভীষণ গরম চা।
কথা দুই পা পিছিয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সজীবের দিকে।
সজীব চায়ের কাপ ধপ করে রেখে গটগট পায়ে হেঁটে বের হয়ে যায় রুম থেকে। সাজিয়া বেগম দৌড়েই আসছিলেন। সজীবকে বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে সজীব? কি হয়েছে রে?
সজীব কিচ্ছু বলল না। কথার ছলছলে চোখ দেখে আর কিছু বলতে পারল না। সাজিয়া বেগম কথার দিকে তাকায়। সজীব তার রুমে চলে যায়।
সজীব চলে যেতেই কথা মাথা নামিয়ে রাখে। সাজিয়া বেগম জিজ্ঞেস করে,
‘ শাড়ি কেন পড়েছ আজ? সামলাতে কষ্ট হচ্ছে তো।
কথা মাথা নামিয়ে রাখল।
একটা কাপড় ও তো আনতে দেয়নি সজীব। অতবড় স্যুটকেসে কাপড়চোপড় আর দৈনন্দিন জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে নিয়েছিল কথা। কিন্তু সজীব স্যুটকেস আনতে দেয়নি। শপিং ব্যাগে যে দুইটা কাপড় ছিল সেগুলোই এনেছে কথা।
সাজিয়া বেগম জিজ্ঞেস করল,
‘ আর কাপড় নেই?
কথা মাথা নাড়াল।
সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ আচ্ছা। সজীবকে বলব শপিংয়ে নিয়ে যেতে। কয়েকটা কিনে নিও। কথার অস্বস্তি লাগল। সে সজীবকে নিয়ে যাবেনা। ওনার টাকা আছে কি নেই। তার কাছে যা আছে তার থেকে বাসা ভাড়াটা রেখে কাপড় কিনবে।
সজীব সব শুনল। সাজিয়া বেগমকে এসে বলল,
‘ সন্ধ্যায় রেডি থাকতে বলো।
কথা মাথা নাড়াল।
‘ না সে যাবেনা।
চোয়াল শক্ত করে তাকাল সজীব। সাজিয়া কথাকে রুমে চলে যেতে বললেন। কথা চলে গেল। তিনি সজীবকে বললেন,
‘ ওভাবে তাকাস কেন? কেন যেতে চাইছেনা সেটা জানবি তো আগে।
সজীব বলল,
‘ অসম্মানি হবে নিশ্চয়ই। যেতে হবেনা। থাকুক এককাপড়ে। আর থাকতে কষ্ট হলে চলে যেতে বলো।
সাজিয়া বেগমকে কোনো কথা বলতে দিলনা সজীব। ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কথা আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনল। গাল ভিজে উঠল।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ছিলনা সজীব। কথা সাজিয়া বেগমের পারমিশন নিয়ে চলে গিয়েছে শপিংমলে। সজীব বাসায় ফেরার আগেই ফিরবে বলে। তার পরিচিত এক আন্কেলের দোকান আছে, ওইখানে যাবে।
রিকশায় উঠে বসার সময় দূর থেকে তাকে দেখল সজীব। কপাল কুঞ্চন হলো। সাজিয়া বেগমকে ফোন দিয়ে কথা কোথায় যাচ্ছে তা জানতে চাইল। সাজিয়া বেগম থেমে থেমে বলেন,
‘ ওর একটু শপিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল আব্বা।
সজীব ফোন কাটল। কিছুই বলল না। কথা রিকশা করে চলে গেল।
শপিং শেষে কথা ফিরল বাসায়। দরজা খুলে দিল সজীব। সজীবকে দেখে শুকনো ঢোক গিলল কথা। কিন্তু নীরব চাহনি দেখে ভয়টা কেটে গেল। শান্তশিষ্ট মানুষটাকে ভয় পাওয়ার কি আছে? তারই তো বর।
বরের জন্য আর শ্বাশুড়ির জন্য ও কিনেছে সে। বরের জন্য একটু শার্ট আর ঘড়ি কিনেছে। শ্বাশুড়ির জন্য শাড়ি আর চুড়ি। বাবা আর মাকে ও মাঝেমাঝে শাড়ি পান্জাবী দিত কথা। কলিকে ও কসমেটিক কিনে দিত।
সাজিয়া বেগম হায়হায় করলেন কথাকে শাড়ি চুড়ি আনতে দেখে। বললেন,
‘ এসব কি দরকার ছিল মা?
কথা হাসল শুধু।
রাতে খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ খেল সজীব। সন্ধ্যার পরে টিউশনি থাকার কথা। কিন্তু সজীব যায়নি কেন? টিউশনিটা কি নেই?
কথা আঁড়চোখে আঁড়চোখে দেখল সজীবকে। কেমন আনমনা এই লোক?
রুমে গিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল সজীব। চোখের উপর হাত রাখা। কথা দরজায় খিল দিল। শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিজের জন্য কেনা ড্রেসগুলো রেখে দিল। সজীবের জন্য কেনা ঘড়ি আর শার্টটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটাকে দেওয়ার সময়টা ও হয়ে উঠেনি। ঘুমিয়ে পড়েছে। কথা ভেবে পেলনা কি করবে?
বাসার ভেতর পড়লেই হবে। বাইরে যাওয়ার সময় পড়তে হবেনা। কথা চুপিসারে গিয়ে সজীবের পাশে বসল। কাঁপাকাঁপা হাতে ছুঁল চোখের উপর রাখা সজীবের হাত। সজীবের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পড়িয়ে দিল হাতে। না বেশ মানিয়েছে ঘড়িটা। সজীবের ঘড়িটার কাঁচ ভেঙে গিয়েছে। তারপরও লোকটা ঘড়িটা পাল্টায়না ৷ ঘড়ি পড়িয়ে মিটিমিটি হাসল কথা। হাতটাতে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।
তারপর শার্টটা সজীবের গায়ের উপর দিয়ে দিল। দেখল কেমন লাগবে এই শার্টে ?
চট করে চোখ খুলল সজীব। কথা চমকে উঠল। সরে পড়ল দ্রুত৷ সজীব নিজের হাতের দিকে তাকাল। ঘড়িটা দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল তার৷
খাট থেকে নেমে পড়ল সে। কথা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটা কি বকবে?
সাজিয়া বেগমের কাছে গেল সজীব। তিনি তখন বিছানার চাদর ঠিক করছিলেন। সজীবকে দেখে অবাক হলেও তা দেখালেন না। ডাকলেন,
‘ আয়।
সজীব মায়ের কাছে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ মিঃ শেখকে ফোন দিয়ে বলো ওনার মেয়েকে যেন এসে নিয়ে যায়। যেদিন আমি সামর্থ্যবান হবো সেদিন এসে দিয়ে যাবে।
সাজিয়া বেগম পাত্তাহীন সুরে বলল,
‘ তোর বউ, তোর শ্বশুর কেন পালবে? কথা আমাদের সাথেই থাকবে, আমরা যা খাব তাই খাবে। যা,
সজীব থামিয়ে দিল সাজিয়া বেগমকে।
‘ আমরা যা খাব তা মোতালেব শেখের মেয়ে খেতে পারবেনা মা। যা পড়াব তা পড়তে পারবেনা। আর কারো টাকায় ভাড়া করা বাসায় আমি থাকতে পারব না।
সাজিয়া বেগমের চোখ কপালে উঠল। হঠাৎ তোর হয়েছেটা কি সজীব? কি হয়েছে?
সজীব বলল,
‘ মোতালেব শেখের বড় মেয়ের জামাইয়ের মন্তব্য আমি বউয়ের টাকায় খাই। বউয়ের টাকায় পড়ি। সবকিছু বউ আর শ্বশুরের টাকায়। কে কি বলল সেটা আমি কানে নিইনা মা। আমি শুধু অবাক হচ্ছি তাদের বলা কথাটা কেন মিলে যাচ্ছে?
সাজিয়া বেগম থতমত খেলেন।
‘ কোথায় মিলছে?
সোজাসাপটা প্রশ্ন করল।
‘ আজ আটাশ তারিখ। মাস শেষ হতে আরও দুইদিন বাকি। তুমি বাসা ভাড়া কোথা থেকে দিয়েছ?
সাজিয়া বেগম সজীবকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বললেন,
‘ কোথায় দিয়েছি? দেয়নি তো?
‘ তুমি আমাকে মিথ্যে বলা শিখাওনি মা। সেই তুমি মিথ্যে বললে মানায় না।
সাজিয়া বেগম খাটে বসে পড়েন।
‘ এই ছেলে কারো কাছে মাথা নোয়াবেনা। তাহলে হবেটা কি? ঘরের বউ কি বাপের বাড়ি রাখা যায়? তা ও এমন ভালো একটা মেয়ে। কপাল ভালো তার ছেলের, এমন একটা মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী করে পেয়েছে। তারপরও এত কিসের আত্মসম্মান খুঁজে সজীব?
সাজিয়া বেগমকে চুপ দেখে সজীব বলল,
‘ চুপ কেন মা? টিউশনির বেতন আমি এক তারিখ পাব। বাড়িওয়ালার সাথে কথা ও হয়েছে এক তারিখ দেব। তাহলে? তুমি ভাড়া কোথা থেকে দিলে? কথা দিয়েছে? দিয়েছে?
সাজিয়া বেগম আমতাআমতা করে বলে,
‘ তো আমি কি করব? তোর বউ আমার হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। তাছাড়া বউয়ের টাকা কি জামাই খরচ করতে পারেনা?
‘ না খরচ করতে পারেনা। আর পারলে ও আমি তা পারবনা। ছোট্ট বাচ্চার মতো তোমাকে এককথা কতবার বলতে হয় আম্মা?
সাজিয়া বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলের দিকে তাকায়। সজীব মায়ের ছলছলে চোখ উপেক্ষা করে বলে,
‘ আমার টিউশনগুলো কোনো গ্যারান্টি নেই আম্মা। আজ আছে তো কাল নেই। আর যে কয়েকটা ছিল বন্ধুদের দিয়েছি। তাদের থেকে আবার কিভাবে নিয়ে নেব আম্মা?
টিউশনি চলে গেলে আমি এত টাকার বাড়ি ভাড়া কোথা থেকে দেব ভেবেছ?
কথার কাছ থেকে আমি আজ নেব, কাল নেব, পরশু নেব কিন্তু এভাবে কতদিন আম্মা? আমাকে অতটা ছোট করোনা আম্মা। কথাকে তুমি বুঝাও। পরিস্থিতি বুঝতে বলো। আমার কাছে থাকতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে। হয়ত এমন ও সময় থাকবে না খেয়ে থাকতে হবে। সেসব ও পারবেনা। আর আমি ও ওসব দেখতে পারবনা।
‘ তো মেয়েটাকে এখানে এনেছিস কেন?
‘ ভেবেছিলাম মানিয়ে নিতে পারবে, ভুল ধারণা ছিল৷
‘ আচ্ছা? শুধুই এই কারণ? নাকি অন্যকিছু?
মায়ের মুখে এমন অপ্রাসঙ্গিক কিছুর ইঙ্গিত পেয়ে সজীব সাথেসাথে তাকাল। ডাকল,
‘ আম্মা ?
সাজিয়া বেগম কেশে উঠলেন। সজীব ধরতে গেলে হাত দেখিয়ে বারণ করেন। বলেন,
‘ আমি তোকে মানুষ করতে পারলাম না সজীব। কে বলেছে তোকে আমার চিকিৎসা করানোর জন্য মোতালেব শেখের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কথাকে বিয়ে করতে? কে বলেছে?
সজীব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বলল
‘ আমি যাইনি। তিনিই এসেছেন আমার কাছে। আমি তো তোমার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করার জন্য অন্য পথ খুঁজছিলাম আম্মা।
সাজিয়া বেগমের চোখের কোণায় জল।
‘ তো? এখন আমার চিকিৎসা হয়ে গিয়েছে আর তুই কথাকে এখন ফিরিয়ে দিতে চাইছিস না? তোর ভাবসাব বুঝে নিয়েছি তো আমি। বুঝে নিয়েছি। তুই আমার থেকে হয়েছিস সজীব। আমি নই । তোকে আমি বুঝি। পড়তে পারি আমি তোকে। তুই এমনটা কেন করছিস সজীব? মেয়েটা তো তোর কাছেই থাকতে চায়। বেশিকিছু তো চাইছেনা। ওকে ওর মতো থাকতে দেনা। অশিক্ষিত মূর্খদের মতো কেন করছিস এমন?
সজীব আর দাঁড়াল না।
চলে গেল। রুমে নয় একেবারে বাসা থেকে। কথা দৌড়াল তার পিছুপিছু। কিন্তু সজীব ততক্ষণে চলে গিয়েছে। কথা গেল শ্বাশুড়ির ঘরে। সাজিয়া বেগম জড়িয়ে ধরলেন কথাকে। নাক টেনে ফুপিয়ে উঠে বলেন,
‘ আর কাউকে ভালোবাসতে পেলিনা কপালপুড়ী। ওই হাঁদারামকেই ভালোবাসতে হলো? যার কোথাও তুই নেই।
কথার বোবাকান্নার নোনাজল গড়াল গন্ডদেশ বেয়ে।
‘ সে কেন কপালপুড়ী? কথা বলতে জানেনা বলে?
সাজিয়া বেগম কথার মুখ আগলে ধরেন। বলে,
‘ তুই তোর বাপের বাড়ি চলে যাহ। এ বাসাটায় আর থাকা সম্ভব নয়। এক তারিখ আমরা আগের বাসায় চলে যাব। তোর ওখানে থাকতে কষ্ট হবে। তাছাড়া আমরা মা ছেলে একটা ডিমকে দুভাগ করে খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারি কিন্তু তুই সেটা পারবিনা। যেদিন তোর বর সাবলম্বী হবে সেদিন তোকে সে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আসবে। ভয় পাস না। ও নিয়ে আসবে তোকে।
কথা কান্নার করছে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে। সাজিয়া বেগম বলল,
‘ কাঁদবিনা খবরদার। একদম কাঁদবিনা। আমি জানি তুই আমাদের সাথে ওই বাড়িতে থাকতে পারবি বলবি। কিন্তু কয়েকদিন পার হলে তোর থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে। আমি খোলা রুমে ছেলের বউ রাখতে পারব না। সজীব কখনোই তোর কাছ থেকে একটা কানাকড়ি ও নেবেনা। না পারতে, না পারতে বাধ্য হয়ে সে তোর বাবার কাছ থেকে আমার অপারেশনের টাকাটা নিয়েছে। সেজন্যই তো তোর বাবার কোম্পানিতে আর চাকরি নিচ্ছেনা। মায়ের জন্য সে অনেক মহান কাজ করে ফেলেছে। ঋণী তার মা তার কাছে। ছেলের কাছে ঋণী। অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছি আমি তার।
কথা বলতে চাইল,
‘ সে এক কাপড়ে থাকতে পারবে। একবেলা খেয়ে থাকতে পারবে। মানিয়ে নিতে পারবে।
সাজিয়া বেগম বুঝলেন না। বললেন,
‘ তোর বাবা যদি রেগে এখন ওর দিকে ডিভোর্স পেপার ছুড়ে ও মারে তাহলে ও ওর মধ্যে কোনো বিকার দেখা যাবেনা। সই করে দেবে। তোকে ছেড়ে দেবে। চলে যাবে তোর জীবন থেকে। তুই কি সেটা চাস? চাস?
কথা ঘনঘন মাথা নাড়াল।
সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ আমি জানি সেটা তুই চাসনা। কারণ তুই ওই হাঁদারামকে ভালোবাসিস। এই তোর ভালোবাসাটাকে ভয় পায় ও। কারণ ভালোবাসার কথা যখন আসে তখন তার সাথে আর ও একটা কথা ও চলে আসে,
‘ অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। তোর এই ভালোবাসা তাকে নিঃস্ব করে আবার পালিয়ে যাবেনা তো কখনো? এই ভয়টাই পায় সে। নিঃস্ব হতে যে কেউ চায়না। তুই ও চাসনা। আমিও চাইনা। সজীব ও চায়না।
কথা কাঁদল নীরবে। সাজিয়া বেগমের কথা অনুযায়ী সে চলে যাবে কাল। সজীব ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত আর আসবেনা। আসবেনা।
রাত দুইটার দিকে বাসায় ফিরল সজীব। মায়ের রুমে গিয়ে দেখে আসল মাকে। তারপর রুমে এসে ঘুমন্ত কথার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। গড়াগড়ি করে মেয়েটা চলে আসল তার বুকের উপর। ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে যখন ঠাঁই খুঁজে পেল শান্তিতে ঘুমালো কথা। সজীব কথার মাথার উপর হাত দিয়ে গিয়ে ও দিলনা। ঘুমিয়ে পড়ল।
কিছু না খেয়েই টিউশনির উদ্দেশ্যে সজীব বের হলো সকাল সকাল। কথা বের হলো তার পিছু পিছু। বেরোনোর আগে সাজিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে রাখল অনেক্ক্ষণ। কাঁদল।
কারো কাছে টাকা না থাকাটাই সুখ, আবার কারো কারো কাছে অতিরিক্ত টাকা থাকাটাই অসুখ। কথা ভেবে পায়না তাকে একটিবার সুযোগ দিলে মন্দ হতোনা। সজীব তাকে একটিবার সুযোগ দিতে পারত। তাকে নিঃস্ব করত না কথা। রোজ রোজ একটু একটু ভালোবাসা জমিয়ে প্রাসাদ গড়ে দিত। নিঃস্ব করত না। কথা নিঃস্ব করতে জানেনা। ভালোবাসতে জানে। কথাদের ভালোবাসতে জানতে হয়। ভালোবেসে যেতে হয়।
অবশ্য পেতে ও হয়। তবে তা কজনে বুঝে? কজনে এমন ভাষাহীন কথাদের খুঁজে?
ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে ফ্যান ছেড়ে অনেক্ক্ষণ বসে থাকল সজীব। ঘামে ভিজে উঠা শার্ট শুকিয়ে গেছে আবার। শরবতের গ্লাস নিয়ে আসল মা। কথার কোনো টুঁশব্দ না দেখে রুম থেকে বের হলো সজীব। সবখানে দেখে ও কথাকে খুঁজে পেলনা। কথা চলে গিয়েছে মনে হলেও কোনো বিস্ময় দেখা গেলনা তার চোখেমুখে। শুধু ফোনে টেক্সট পাঠাল,
‘ আমাকে জানানো উচিত ছিল।
পাল্টা মেসেজ সাথে সাথে আসার কথা থাকলে ও আজ তার ব্যাতিক্রম হলো।
সাজিয়া বেগমকে অসুস্থ মনে হলো সজীবের। কাশতে কাশতে রান্না করছেন। সজীবের উপর অভিমান জমেছে। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারসময় গুলো কথার সাথেই কাটত। বাকহীন মেয়েটার সাথে বকবক করতে তার ভালো লাগত। মেয়েটির ইশারায় ইশারায় বলা কথাগুলো দেখে হাসতে ভালো লাগত। আজ থেকে আবার ও নিঃসঙ্গ তিনি।
খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় সাজিয়া বেগমের শ্বাস নেওয়ার শব্দটা ভালো ঠেকলনা সজীবের। বলে উঠল,
‘ আম্মা তোমার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে । চলো হসপিটালে নিয়ে যায়।
সাজিয়া বেগম তেঁতো গলায় বললেন,
‘ অনেক করেছিস আমার জন্য। একটা বোবা মেয়েকে বিয়ে পর্যন্ত করলি আর কত করবি?
সজীব খাওয়া বন্ধ করে রাখল। বলল,
‘ আম্মা তোমার শরীর খারাপ করবে। বেশি কথা বলছ তুমি।
সাজিয়া বেগম কোনোমতে দুটো করে খেয়ে রুমে চলে যান। সজীব খেয়ে উঠে থালাবাসন রেখে আসে রান্নাঘরে। সাবান মেঝে বেসিনে ধুঁয়ে ও ফেলে। আম্মার কষ্ট হবে।
সাজিয়া বেগমকে দেখতে গেল সজীব। ঘুম এসেছে। নিঃশ্বাস ফেলার বিকট বিকট শব্দ হচ্ছে। সজীব বুঝে নিল আম্মা ভালো নেই। এক তারিখ টিউশনির টাকা পেলে সবার আগে মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। অপারেশন হলো টিউমারের। কিন্তু এই শ্বাসকষ্ট পিছু ছাড়েনা। মা ছাড়া সজীবের পৃথিবীতে আর কেউ আপন নেই। বড়বোন আছে, সে ব্যস্ত তার স্বামী সংসার নিয়ে। অতিষ্ঠ শ্বাশুড়ির জ্বালাতনে। মায়ের এতবড় অপারেশন গেল, একবার ও দেখতে আসার সুযোগ দেয়নি। তার বরটা ও বিদেশে বসবাসরত। সজীবের তার আম্মা আছে। তার আম্মার ও সজীব আছে। আর কেউ নেই।
কথাকে একা একা ফিরতে দেখে মোতালেব শেখ চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে তোলেন।
‘ কেমন বেয়াদবের বাচ্চা সে? আমার মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে, তা ও একা একা? তার সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের সাথে অন্যায় করতে? তাকে পুলিশে দেব আমি।
কথার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলনা মোতালেব শেখ। কলি ও ভীষণ অবাক। সুমন বাঁকা হাসল। আবার ও পাখি আবার ও তার নীড়ে ফিরেছে। বেশিদিন থাকবে কই?
পুরোনো বাসায় উঠে সজীব আর সাজিয়া বেগম। শরীর বেশি খারাপ দেখে সজীব জোর করে সাজিয়া বেগমকে নিয়ে যায় হসপিটালে। ডাক্তার উনাকে হসপিটালে এডমিট করানোর তাড়া দেন। অক্সিজেন কমে গিয়েছে ওনার শরীর থেকে। ঠোঁটে আংশিক নীলাভ রং। বাসায় এজন্যই অক্সিমিটার রাখা উচিত।
চিকিৎসার টাকা হাতে যা ছিল তাই খরচ করে ফেলল সজীব। দিশেহারা হয়ে পড়ল। বাকি টাকা পাবে কই? মোতালেব শেখের কাছে কখনোই যেতে পারবেনা। বন্ধুদের বললে তারা টাকা যোগাড় করে দেয় কোনোমতে। সজীব হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
শুক্রবার ছিল সেদিন। সকাল আটটার দিকে শ্বাশুড়িকে লুকিয়ে দেখতে এসেছিল কথা। অনেক কষ্টে সাজিয়া বেগম তার সাথে দুটো কথা বলেন। সজীবকে ফিরতে দেখে কথা আবার ও লুকিয়ে চলে যায়। একদম আসতে ইচ্ছে হয়নি।
হসপিটালের বিল পে করল সজীব। মায়ের জন্য আনা ফ্রুটসগুলো নিয়ে মায়ের কেবিনের দিকে ছুটে যেতেই নার্স দৌড়ে আসল।
‘ স্যার আপনার মা আপনাকে খুঁজছে। তাড়াতাড়ি আসুন।
সজীব কেবিনে ডুকে পড়ে। মায়ের মুখ আগলে ধরে জিজ্ঞেস করে,
‘ মা, তোমার কিচ্ছু হবেনা। আমি আছি তো। কিচ্ছু হবেনা তোমার। একদম সুস্থ হয়ে যাবে তুমি।
সাজিয়া বেগম ছেলের হাত শক্ত করে ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নেন। বহুকষ্টে বলেন,
‘ কথাকে ছাড়িস না আব্বা। ওকে আগলে রাখিস। মেয়েটাকে ভালো রাখিস। ওর সাথে অন্যায় করিস না আব্বা। তোর আম্মার শেষ ইচ্ছা।
সাজিয়া বেগম আর কোনো কথা বলল না সজীবকে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে চিরনিদ্রায় শায়িত হয় সাজিয়া বেগম। অন্ধকার হয়ে আসে সজীবের পৃথিবী। মনে হলো রঙিন পৃথিবীর রঙিন রঙটা হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেছে। যার জন্য এত লড়াই, এত সংগ্রাম, এত ত্যাগ তিতিক্ষা শেষপর্যন্ত সে একা করে চলে গেছে। নিঃস্ব করে চলে গেছে।
সজীবের প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ কার কাছে আমাকে রেখে গিয়েছ আম্মা? কার কাছে? কেন ভাবোনি তুমি ছাড়া আমি অসহায়,নিঃস্ব, বড়ই একা আম্মা। কার কোলে আমি মাথা রেখে ঘুমোবো? কার হাতে খাব? আমাকে আব্বা বলে কে ডাকবে আম্মা? আমাকে ও কেন নিয়ে যাওনি আম্মা?
সজীবের মনে হলো সাজিয়া বেগম উঠে বসলেন। তারমুখে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ যার কেউ নেই তার উপরওয়ালা আছে আব্বা। তোকে উপরওয়ালার ভরসায় রেখে গেলাম। ভালো থাকিস। ভালো রাখিস। তোকে যারা ভালোবাসে তাদের ভালোবাসিস। আগলে রাখিস।
চলবে
সকলের মন্তব্য আশা করছি।