#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দেয়ালে টানানো মায়ের ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে সজীব। পড়নে সাদা ধবধবে পান্জাবী। হাতদুটো পেছনে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। দরজা ঠেলে চুপিচুপি রুমে ডুকে পড়ল কথা। মাথায় ছাইরঙা ওড়না জড়ানো। সজীবকে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভীষণ মনখারাপ হলো কথার। নিচে সায়মা আপু ডাকছেন ওনাকে। কথার এগোতে মন চাইল না। তারপর ও সে এগোলো। কারো আসার শব্দ সজীব হাতের কব্জিতে মুখ ঘষল। কথা খেয়াল করল কব্জির কাছে পান্জাবী ভিজে গিয়েছে। বুক ভার ভার লাগল কথার। এই মানুষটার সব কষ্ট যদি সে দূর করে দিতে পারত?
মন খুলে কথা বলার মানুষটা ও হারিয়ে গেল মানুষটার। কথার সাথে তো কথাই বলেনা। মনের কথা বলবে কিভাবে? কথা যদি কথা বলতে জানত? নিশ্চয়ই বলত?
সজীব ফিরে চাইল কথাকে। গাঢ় চাহনি দিয়ে তাকাল। পরক্ষণে চোখ দিল দরজার দিকে। কথা দেখল চোখের কোণা লাল হয়ে আছে সজীবের। টান টান মুখ।
কথা ইশারায় হাত নেড়ে নিচে যেতে বলল সজীবকে। সজীব চুপচাপ বের হয়ে গেল রুম থেকে। সায়মা সোফায় বসেছিল। মারজিয়ার সাথে কথা বলছে। চোখমুখ ফোলা তার। সজীবকে দেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কলি আর সুমন একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মোতালেব শেখ সজীবকে বললেন,
‘ তোমার আপাকে আর কয়দিন থাকতে বলছি। থাকতে চাইছেনা।
সজীব কিছু বলল না।
সায়মা এসে সজীবকে জড়িয়ে ধরল। সজীব তার একহাত বোনের মাথার উপর রাখল। সাথেসাথে ফুঁপিয়ে উঠল সায়মা।
সায়মার ছেলে সিয়াম মায়ের কান্না দেখে চোখ কচলাতে শুরু করল।
সজীব চোখ পিটপিট করতে করতে বলল,
‘ আপু তোর সিয়াম কাঁদছে। আর না।
সায়মা সজীবের বুকে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ ভাই, আমি বাপের বাড়ি আসতে চাইলে কোথায় আসব? আমার ছেলে নানুর বাড়ি আসতে চাইলে?
সজীব শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমার কাছে আসবি। আমি যেখানে থাকি সেখানে আসবি।
সায়মা অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে ভাইকে ছাড়ল। সজীবের মুখে হাত বুলিয়ে দিল। সজীবের কপাল নামিয়ে চুমু খেয়ে আবার ও ঝরঝরে কেঁদে দিয়ে ডাকল,
‘ ভাই। তুই ভালো থাকিস ভাই।
সজীব উপরে তাকাল। উপরে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে নাড়িয়ে বলল,
‘ চল। গাড়িতে তুলে দিই।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ গাড়ি আমি এনে রেখেছি। একেবারে বাড়ির কাছে দিয়ে আসতে বলেছি।
সায়মার চোখের জল মুছে দিল সজীব। নরম কন্ঠে বলল,
‘ তোর মনে আছে আপু, আমি তোর কাছে এখনো একশ এক টাকা পায়। ভাইয়ার সাথে কথা বলার জন্য লোড করতে নিয়েছিলি।
সায়মা আঁখিজলে হাসল। বলল
‘ এই টাকা দেওয়ার জন্য আমি কিছুদিন পরপর তোর কাছে আসব। কিন্তু না দিয়ে আবার চলে যাব। এই একশ এক টাকা আমি তোকে দেবনা ভাই।
সজীব বোনকে আবার জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ তুই আমার কাছে আসবি। পারলে আর ও একশ এক টাকা ধার নিয়ে যাস।
সায়মা সজীবকে ছেড়ে কথার কাছে এসে দাঁড়াল। মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ কথা আমার ভাইটাকে দেখে রেখো।
কথা সজীবের দিকে তাকাল। সজীব কথা তাকাতেই চোখ মেঝেতে নামিয়ে রাখল।
মারজিয়াকে সালাম করল সায়মা। মারজিয়া তার মাথায় হাত রেখে বলল,
‘ যখন ইচ্ছে হয় তখন এখানে চলে এসো। আর মায়ের জন্য মন খারাপ করোনা। ভালো থেকো।
সায়মা আবার ও কেঁদে দিল। বলল,
‘ আন্টি আমার ভাই, আমার ভাইটাকে একটু দেখে রাখবেন। মা সামলাতো পাগলটাকে। সেই সামলানোর মানুষটা নেই আর। মা ছিল তাই ভাইয়ের জন্য আমার চিন্তা লাগতো না কিন্তু এখন মা তো নেই।
মারজিয়া ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ তোমার ভাইয়ের বউ বরের প্রতি হেব্বি কেয়ারিং। চিন্তা করতে হবেনা।
সজীব ডাকল
‘ আপু ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। আয়।
সায়মা ছেলের হাত ধরল। বলল,
‘ সবার সাথে কথা বলেছ?
সিয়াম মাথা নাড়াল। সায়মা কথাকে দেখিয়ে বলল,
‘ ওটা মামি।
কথা হাত নাড়াল। সিয়াম হাসল। বলল,
‘ মামার বিয়ে খাইনি তো আম্মু।
সিয়ামের কথা শুনে সায়মার হাসি পেয়ে গেলেও হাসিটা আসল না। সে বলল,
‘ সেটা তোমার মামাকে বলিও।
সিয়াম গিয়ে সজীবের সামনে দাঁড়ায়। বলে,
‘ মামা মামি খুব সুন্দর।
সজীব চোখ তুলে সিয়ামকে দেখল তারপর কথাকে। কথার ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। মারজিয়া হাসল। বলল,
‘ তাই নাকি? তুমি সুন্দরও চেনো?
সিয়াম বলল,
‘ হ্যা চিনি। আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে, মানে পুতুল আছে না, মামি ঠিক ওর মতো সুন্দর।
মারজিয়া বলল,
‘ পুতুল? পুতুলকে তোমার পছন্দ?
সিয়াম সায়মার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলল না।
ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আম্মু শুনলে মারবে।
মারজিয়া হেসে ফেলল। সজীব তাড়া দিল। সিয়ামকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
সায়মা বের হতে গিয়ে মোতালেব শেখকে দেখকে আবার থেমে গেল। সালাম করে বলল,
‘ আসি আন্কেল। আমার ভাইটার উপর রাগ পুষে রাখবেন না। একটু বুঝার চেষ্টা করবেন।
মোতালেব সাহেব হাত রাখলেন সায়মার মাথার উপর। বললেন,
‘ তোমার মায়ের মেজবান খেয়ে যেতে ভালো হতো।
সায়মা বলল,
‘ বাড়িতে শ্বাশুড়ি একা আন্কেল তাই চলে যেতে হবে।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ আচ্ছা, সময় হলে এসো ভাইকে দেখতে। আর একটু বুঝাও যাতে এই বাড়িতেই থাকে চাকরি বাকরি না হওয়া পর্যন্ত। আমি বুঝিয়ে কূল পায়না। ঘাড়ত্যাড়া ছেলে। আমার কথা শুনতে বলিও। আমি কি তার খারাপ চাই? ভালোটাই তো চায়। জানিনা তার মা তাকে ছেড়ে গিয়ে শিক্ষা দিতে পেরেছে কিনা। যদি এইবার একটু সোজাপথে আসে আরকি।
সায়মা বলল,
‘ আচ্ছা আমি ফোনে বলব ওকে।
সায়মা গাড়িতে উঠে বসার সাথে সাথে আবার ও কেঁদে দিল। সজীবের হাত ধরে বলল,
‘ ভাই, মায়ের কবর জিয়ারত করাস নিয়মিত। মাকে তো বাবার পাশে দিতে পারিসনি।
সজীব বলল,
‘ আচ্ছা। সাবধানে যাস।
সায়মা চলে গেল। সজীব মোতালেব শেখের কাছে এসে বলল,
‘ আম্মার মেজবান আপনাকে দিতে হবেনা। আপুকে কি বলছিলেন আমি বুঝতে পেরেছি।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ তো? মেজবান না দিলে হবে নাকি? আর আমি তোমার মায়ের মেজবান দিচ্ছি না শুধু। আমার বাবা আর দাদা দাদীদের ও দেব। আর মেজবানের দিন কোথাও যাবেনা। কথার দাদু আর চাচা চাচীরা আসবে। ওরা তোমাকে দেখেনি।
সজীব বলল,
‘ ঠিক আছে। তারপরের দিন চলে যাব।
মোতালেব শেখ চাপাস্বরে বললেন,
‘ কোথায় যাবে? এখন তো তোমার মা ও নেই। কে রেঁধে খাওয়াবে? আর কেনই বা তুমি যাবে। তখন তো তোমার মায়ের কারণে যেতে? তুমি কি কোনো কারণে কলি আর সুমনের কারণে? সুমন ক্ষমা চেয়েছে। তাছাড়া ওর কোনো দোষ ত্রুটি দেখলে আমি নিজেই।
সজীব বলল,
‘ না। ওরা সমস্যা না। সমস্যা আমি নিজেই। আমি আপনার বাড়িতে থাকতে পারব না।
‘ তাহলে কথাকে নিয়ে যাবে।
‘ না পারব না। আমি বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকিনা। আপনার মেয়ের একা থাকতে অসুবিধা হবে। আপনি কি রাখবেন?
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ না। ও একা কিভাবে থাকবে? জায়গাটা ভালো না। বিপদ আপদ হতে পারে। বস্তির মতো জায়গা। আমার ভালো লাগেনা। ওখানকার মানুষ গুলো ভালো না।
সজীব বলল,
‘ বুঝতে পেরেছেন তাই খুশি হলাম।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ তো তুমি আমার মেয়েকে রেখে ওখানে পড়ে থাকবে? তুমি ঠিক কি চাইছ?
‘ কিছুই চাইছিনা আপাতত।
মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে মোতালেব শেখের। তিনি এবার গর্জে উঠলেন,
‘ তোমার কথা আমি শুনব কেন? তুমি এখানেই থাকবে, এখানেই। নইলে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেব একদম। আমি যা বলব সেটাই করবে। বেয়াদব ছেলে। ভাগ্যিস আমার ছেলে হওনি। পিঠিয়ে সোজা করে ফেলতাম।
সজীব পেছনে হাত দেওয়া অবস্থায় দাঁড়ানো। মাথা সামান্য নাড়িয়ে বলল,
‘ আচ্ছা বুঝেছি।
‘ কি বুঝেছ?
কড়া কন্ঠে বললেন মোতালেব শেখ।
‘ বুঝলাম। আপনার ছেলে হলে তাকে আপনি এভাবে ধমকের উপর রাখতেন।
মোতালেব ভেতরে চলে গেল। মারজিয়া বেগমকে বলল,
‘ মারজিয়া ওই ছেলেকে একটু বুঝাও। বুঝাও। পারিনা আমি আর।
কথা দাঁড়িয়ে থাকল। ভাবল,
‘ আবার কি হয়েছে?
সজীব এসে সোজা রুমে চলে গেল।
কারো দিকে তাকাল না।
মেজবানের দিন ঘনিয়ে এল। কথার দাদু আর চাচা চাচীরা ও এসেছে মেজবানে। সজীবকে খুব মনে ধরেছে কথার দাদু হালিমা বেগমের। বৃদ্ধা হলে কন্ঠে তেজী ভাব। কিছুক্ষণ পরপর সজীবকে ডেকে ডেকে আনছেন। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেন। সজীব ভীষণ বিরক্ত হালিমা বেগমের প্রতি। চুপচাপ সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় ও নেই। সজীবকে তো পিঠে লাঠির বাড়ি ও বসিয়ে দিল। বলল,
‘ এত ত্যাড়া ত্যাড়া জবাব দাও কেন ছেলে? তুমি জানো আমি স্কুলের মাস্টারনী ছিলাম। কত ঘাড় ত্যাড়া ছেলেকে পিঠিয়ে সোজা করেছি। আমার সামনে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলবে। তোমাকে ভালো লাগলে ও তোমার একটা অভ্যাস ও আমার ভালোলাগেনি।
সজীব বলল,
‘ পিঠিয়ে অভ্যাস পাল্টানো যায়না এটা আপনার শেখা উচিত। আপনার মাস্টারি তখনকার যুগে চলত, এখন চলেনা।
হালিমা বেগম ভীষণ অবাক। কথাকে ডাকলেন চেঁচিয়ে
‘ কথামনি তোমার বরকে বলো শুধরে যেতে। নইলে তাকে পিঠিয়ে সোজা কিভাবে করতে হয় তা আমি ভালো করে জানি।
কথা মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
‘ তার বরকে পেটাবে কেন?
হালিমা বেগম কথার চেহারা দেখে বললেন,
‘ ওরেবাপ মুলেব তো ঠিকই বলছে। এই মেয়ের জন্য তার জামাইকে কিছু বলা যায়না।
সজীব চট করে কথার দিকে তাকাল। মুখটা কালো করে রেখেছে কথা। সজীব উঠে পড়ল।
হালিমা কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
‘ কোথায় যাচ্ছ?
সজীব বলল,
‘ জ্বি, এক্ষুণি আসছি।
‘ এক্ষুণি মানে এক্ষুণি আসো।
সজীব চলে যেতেই কথা দৌড়ে আসল হালিমা বেগমের কাছে। কুঁচকে আসা হাতের চামড়ার উপর চিমটি বসালো। উঃ উঃ করে মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করল। ধমক দিতে গিয়েও হেসে ফেলল হালিমা বেগম। সত্যিই তো বর পাগলা মেয়ে দেখছি।
সজীব তখন জগ থেকে ঢেলে পানি খাচ্ছিল। হালিমা বেগম মোতালেব শেখকে গিয়ে বললেন
‘ তোর কপালটা পোড়া মুলেব । তোর বেটি দুইটাই অন্ধ। জামাই পাগল। বড়টা তো অন্ধ হয়েই গেছে, আর ছোটোটা ও। কিভাবে চিমটি বসালো আমার হাতে।
জগ থেকে ঢেলে পানি খাওয়া সজীবের কাশি উঠে গেল তা শুনে। মারজিয়া দৌড়ে গেল।
কি হয়েছে কি হয়েছে বলতেই হালিমা বেগম বলল,
” কি আর হবে? খুশিতে কাশি উঠছে। না নাতজামাই?
সজীব একপলক তাকিয়ে সোজা উপরে উঠে গেল। এ মহিলা কেন তার পিছু লেগেছে আবার?
কথার চাচীরা আঁড়চোখে দেখল সজীবকে। কিছুই নাই এই ছেলের। তা ও কেন বড়দা এই ছেলেকে এত পাম্পের উপর রাখে কে জানে?
তার উপর ছেলেটার ইগো বেশি। কলির বর সুমনের মতো অত কথাবার্তা বলেনা। কেমন ভাবসাব নিয়ে থাকে সারাক্ষণ। সবাই সুমনের সাথে মিলেমিশে গেল কিন্তু সজীবের সাথে কথা বলতে গিয়েও গেলনা। মারজিয়া সজীবকে গিয়ে বলল
‘ ওরা কথার চাচী বাবা। সালাম দিয়ে কথাবার্তা বলিও। সবার সাথে মিশলে ভালো লাগবে।
সজীব মাথা নামানো অবস্থায় বলল,
‘ জ্বি বুঝতে পেরেছি।
কথার মেঝ চাচী নাসমিন বেগম সংকোচ রেখে কথা বলতে আসল সজীবের সাথে। সজীব হা হু ছাড়া বাড়তি কোনো কথা বলল না। কথার ছোট চাচী নুসরাত বেগম বললেন,
‘ কথার বর কি কথার মতোই বোবা নাকি?
সজীব মাথা তুলল। বলল,
‘ জ্বি।
নুসরাত বেগম হা করে থাকলেন। কি বলে জ্বি? এ কেমন ছেলে?
কথা সজীবের কথা শুনে মিটিমিটি হাসল পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে।
সবার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে সজীব ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। বুক ভরে শ্বাস নিল। চারপাশে এত এত মানুষ, অথচ কি একা সজীব। খাওয়া দাওয়া চলছে মেজবানের। কিছু ছুঁয়ে ও দেখতে ইচ্ছে করছেনা সজীবের। সবকিছু কেমন যেন বিরক্ত বিরক্ত লাগছে।
সবকিছু ছেড়েছুড়ে একা বাঁচতে ইচ্ছে করছে। নিজের সাথে কাউকে জড়াতে ইচ্ছে করছেনা। তার কাছে কেউ ভালো থাকবেনা।
কথা তো একদম না। সজীব চায়না কারো পিছুটান হতে, কারো প্রিয়জন হতে। সে খুব করে চায় তার প্রতি কথার বিরক্ত চলে আসুক। কথা নিজ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিক। চলে যেতে বলুক। কিন্তু আশ্চর্য মেয়েটা এমন কিছুই বলেনা। কখন বলবে? কি করলে বলবে? সজীবের চলে যাওয়া উচিত। বহু বহুদূরে। কিন্তু কথা?
সজীবের বন্ধুরা এল ছাদে। অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলল তারা। সান্ত্বনা বাণী শোনাল সজীবকে। চিরন্তন সত্যটা আমাদের মেনে নিতে হয়,মানতে হয়। সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সজীবকে খুঁজতে গিয়ে ছাদের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কথা। লুকিয়ে দেখল সজীবকে। সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে লোকটা। দুচোখ টলমলে করে উঠল কথার। এই লোকটা আবার সিগারেট খাচ্ছে কেন? সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সজীব আওড়াল
‘ সিগারেটখোররা কি সহজেই কারো অপ্রিয় হয়ে যেতে পারে দোস্ত?
তানিম হেসে বলল,
‘ সিগারেট খোরদের পোড়া ঠোঁটে ঠোঁটে প্রেম লেপ্টানো থাকে মামা।
বলেই হেসে উঠল বন্ধুমহল। বাঁকা হাসল সজীব।
‘ বাজে বাজে অভ্যাসের একটা রুটিন করে দিস তো। কারো প্রিয় হয়ে থাকতে ইচ্ছে করেনা। অপ্রিয় হতে ইচ্ছে করছে। এই মায়া জিনিসটা বড্ড খারাপ। ভীষণ জ্বালার। জড়াতে ইচ্ছে করেনা আর।
কথা কেঁদে উঠে চলে গেল। সজীব সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘ দ্বিতীয়বার একই ভুল করতে ইচ্ছে করেনা।
কথা রুমে গিয়ে দরজা আটকালো। মাথায় দুহাত দিয়ে এলোমেলো সুরে কাঁদল। সজীবের বলা কথাগুলো ভীষণভাবে আঘাত করেছে। কি আশ্চর্য পৃথিবী!
কেউ প্রিয় হয়ে উঠার জন্য করছে লড়াই, আর কেউ প্রিয় হয়েছে তা নিয়ে করে বড়াই। অপ্রিয় হওয়ার লড়াই। এমন হয় কেন?
দরজা ঠেলে ডুকল সজীব। কথা তাড়াতাড়ি চোখ মুছল। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। সজীব কথার দিকে তাকাল। ঘনঘন নিজের ঠোঁটজোড়া মুছল।
আশ্চর্য এই মেয়ে কাঁদছে কেন? সে কি বলেছে? কি করেছে? তার কি নিজের মতো করে বাঁচতে ইচ্ছে হয়না?
সজীব বের হয়েই যাচ্ছিল। কথা দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরল তাকে। শ্বাশুড়ি মাকে সে কথা দিয়েছে, সজীবকে সে আগলে রাখবে। ভালো রাখবে। ভালোবাসবে। তার ভালোবাসা আদায় করে নেবে। কথা ছাড়বে না তাকে। ছাড়বেনা।
সজীব শক্ত হয়ে দাঁড়ানো। শক্ত বুকটাতে মাথা রেখে অঝোর ধারায় কাঁদল কথা। সজীবের ভাবান্তর হলোনা। বুকে পড়ে থাকা মেয়েটাকে তুলে চোখের জল মুছে দিতেও দিরুক্তি। সান্ত্বনা বাণী শোনাতে ও আলস্য। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেও বারণ।
সজীব তার মতোই দাঁড়িয়ে থাকল। তাকে যেকোনো দুইটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হয়ত এই মেয়ের সাথেই নিজেকে জড়িয়ে নেবে নয়ত একদিন হুট করে হারিয়ে যাবে। একদম সবকিছু ভুলে। এভাবে চলতে পারেনা।
চলবে