#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_১০
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,
কনকনে ঠান্ডা পড়ছে। তারমধ্যে মাথার উপর ফ্যান ছেড়ে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানো সজীবকে দেখে ভীষণ আশ্চর্যান্বিত হলেন সাজিয়া বেগম। এটা কেমন ছেলে? এদিকে ফ্যান আবার গায়ে কম্বল ও?
কম্বল টেনে নিয়ে ফেললেন তিনি। বললেন,
‘ কয়টা বাজে খেয়াল আছে সজীব? কোচিং এ কি যাবিনা?
সজীব ঘুমঘুম কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ কয়টা বাজে আম্মা?
সাজিয়া বেগম বলেন,
‘ সাতটা চল্লিশ । এজন্যই বলি নামাজ পড়ে আবার ঘুমাতে যাস না। উঠতে দেরী হয়ে যায়। একটু নদীর পাড়ে গিয়ে হেঁটে আসলে কেমন হয়?
সজীব লাফ দিয়ে নামল। কম্বল ফেলে বলল,
‘ উফ আটটায় ক্লাস নিতে হবে। আর ও আগে বলবেনা?
সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ আয়। কিছু মুখে দে আগে। এখন তো তাড়া লাগাবি।
খেয়ে তাড়াহুড়ো করে পৌঁছালো সজীব। আটটা পার হয়ে গিয়েছে। ক্লাসরুমে ডুকতেই হাই বেঞ্চের উপর বসে পা দুলানো মেয়েটিকে দেখে তার কপাল কুঞ্চন হলো। আশ্চর্য!
পা নাড়াতে নাড়াতে মায়া বলল,
‘ আমি দেরী করে আসায় আমাকে কথা শোনাল স্যার। আজ স্যার দেরী করে আসলে আমরা কথা শোনাব।
সবাই তখনি দাঁড়িয়ে পড়ল সজীবকে দেখে। সজীব হাতের বই আর মার্কার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
‘ সিট।
মায়ার চোখ ততক্ষণে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। মাথাটা একেবারে নিচে। কান দিয়ে গরম গরম হাওয়া বেরোচ্ছে। জিহ্বায় কামড় দিয়ে রাখল মায়া। সবাই সেই কখন বসে পড়েছে মায়া দাঁড়িয়েই আছে মাথা নিচু করে। সজীব চোখ তুলে দেখল মায়াকে। বলল,
‘ আমাদের আজকের ক্লাস টপিক কি?
মায়া চট করে মাথা তুলে থাকাল। সজীবের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ স্যার আমি কি বসব?
সজীব বলল,
‘ না, দাঁড়িয়ে থাকুন।
মায়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ স্যরি স্যার।
সজীব পড়াতে মগ্ন হয়ে গেল।
মায়া দাঁড়িয়েই রইল। কিছুক্ষণ পর নিজে নিজে বসে পড়ল। নীতু চরম অবাক। মায়া বলল,
‘ স্যার বকবেনা। পা ভীষণ ব্যাথা করছে রে।
সজীব আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগী হলো।
পড়াতে পড়াতে আগেপিছে হাঁটল সজীব। চোখের দৃষ্টি বইয়ের মাঝে আংশিক কিন্তু কপাল কুঞ্চিত করে বইয়ে মনোযোগ দেওয়া একজনের কাছে একটু বেশি।
হঠাৎ সজীব মনে করল সে পড়াতে ভুল করে ফেলছে। এলোমেলো লাগছে পড়া। সেনটেন্স উচ্চারণে ভুল হচ্ছে।
সজীব পড়া থামিয়ে দিল। সবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ সবার পড়া রেডি?
মায়া চেঁচিয়ে উঠল।
‘ আমি আজকের পড়া মুখস্থ ফুকস্ত টুডস্ত করে এসেছি।
সবাই হা করে তাকিয়ে রইল মায়ার দিকে। স্টুডেন্টরা সবাই হেসে উঠল উচ্চস্বরে। সজীব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সবাই চুপ হয়ে যায়। মায়া মাথাটা আড়াল করল ব্যাগ দিয়ে। আল্লাহ কি হয়েছে তার? পাগলের মতো কি কি বলে ফেলল?
সজীব মার্কার পেন রেখে মায়ার কাছে আসল। বলল,
‘ আপনি যেহেতু মুখস্থ, ফুকস্ত, টুডস্ত করে ফেলেছেন সেহেতু আপনার কাছ থেকেই পড়া আগে নেই।
মায়া ভীতচোখে তাকাল। মায়ার দিকে মার্কার বাড়িয়ে দিল সজীব। বলল,
‘ যান বোর্ডে গিয়ে লিখে আসুন। যান।
মায়া বলল,
‘ বোর্ডে কেন স্যার?
সজীব বলল,
‘ যেটা বলেছি।
মায়া চলল বোর্ডের দিকে। পিছু ফিরে বলল
‘ স্যার দেখুন নীতু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সজীবের হাসি পেল। হাসি চেপে রেখে সে বলল,
‘ নীতু একদম হাসবেনা।
মায়া কাঁপা-কাঁপা হাতে লিখল। আবার পিছু ফিরল। মায়া তাকাতেই সজীব ফোনে মনোযোগ দিল। মায়া বলল,
‘ স্যার দেখুন সবাই দেখে আছে। না দেখতে বলুন।
সজীব বলল,
‘ এই কেউ দেখবেনা।
মায়া লিখে ফেলল। লিখা শেষ করে সজীবের কাছে এসে মার্কার বাড়িয়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে মিনমিন করে বলল,
‘ স্যার সবাই মানে সবাইকে বলেছি, আপনাকে ও। কিন্তু আপনি দেখেছেন কেন?
হেসে সজীব আওড়াল।
‘ আমি সবাই নই তাই। আমি টিচার আর বাকিরা স্টুডেন্ট।
মায়া কপালে ভাঁজ ফেলে চলে গেল সিটে।
বোর্ড ক্লিন করতেই একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ স্যার মায়ার দুই নাম্বারটাতে ভুল হয়েছে।
সজীব মুছতে মুছতে বলল,
‘ জানি। বসো।
ছেলেটি বসে পড়ল। মায়া কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ হারামিগুলো ভুল খুঁজে বের করবেই। স্যার কি এখন পানিশমেন্ট দেবে?
নীতু ভেংচি কেটে বলল,
‘ না মাইর দিবেনা আপনাকে, আদর দেবে। তুমি তো এখনো ললিপপ খাও।
বলেই হাসল নীতু।
কান গরম হয়ে গেল মায়ার। ছিঃ এসব কি কথাবার্তা স্যারকে নিয়ে ছিঃছিঃ।
সজীবের দিকে আর তাকাতে মন চাইল না মায়ার। ছিঃ ছিঃ নীতু কিসব বলল।
এভাবে পার হলো দুই তিন সপ্তাহ। কোচিংয়ের টাইম পড়ল সন্ধ্যার দিকে। সজীব নিজের পড়ার জন্য সকালে পড়াতে পারছেনা। সামনে তৃতীর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা তার।
নিত্যদিনের মতো ক্লাস চলছিল। ক্লাসে অনুপস্থিত মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। কলেজ থেকে এসে গোসল নিয়ে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে এসেছে। ভেজা চুল থেকে সামান্য ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে সামনে চলে আসা কয়েক গাছি চুল থেকে। ওড়না মাথায় টেনে ভীতকন্ঠে পাতলা ঠোঁটজোড়া নেড়ে সে শুধালো
‘ আসব স্যার?
সজীব কাশল। বলল,
‘ ইয়াহ।
মায়া এসেই সিটে বসে পড়ল। প্রতিদিনকার মতো পড়া সজীব পড়া নিতে গেল। মায়া ভুলক্রমে পড়া শিখে আসতে পারেনি। কলেজের এত এত হোমওয়ার্ক ছিল। সব শেষ করে কোচিংয়ের পড়া নিতেই ঘুম নেমে আসল। আর শেখা হয়নি। সজীব ভয়াবহ পানিশমেন্ট দিল তাকে। সবার ছুটি হলেও মায়া ছুটি পেলনা।
পরের ক্লাসের সাথে ক্লাস করল। কিন্তু আগামাথা কিছুই বুঝলনা। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হাত পা মোচড়ামুচড়ি করল মায়া। এই স্যারটা ভীষণ রকমের পাজি।
নেক্সট ব্যাচের সাথে ছুটি হলো মায়ার। মাগরিবের আজান পড়বে তখুনি। মায়া একা একা হাঁটা ধরল বাড়ির দিকে। তখুনি কোথাথেকে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে তার পাশে হাজির হলো সজীব। বলল,
‘ যেহেতু আমার জন্যই এত দেরী হলো। তখন আমিই পৌঁছে দিই বাসায়?
মায়া কিছু বলল না। মনে মনে বিড়বিড় করল,
‘ না। স্যারটা ভালো।
মায়া আগে আগেই হাঁটল। তার পিছু পিছু নরম পায়ে হাঁটল সজীব। হঠাৎ করে মনে হলো কানের পেছনে চুল গুঁজে দেওয়ার মতো দৃশ্যর মতো সুন্দর, মনোরম দৃশ্য আর হতেই পারেনা।
আজব লাগল সজীবের, তার মতো ছেলে ওসব কেন দেখছে? স্টুডেন্টকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মতো সামান্য কাজ সে কেন করছে? আসলেই কি সব দায়িত্বের খাতিরে?
নতুন জয়ন করা তৃণা ম্যাডাম ও ইংরেজি আর বাংলা পড়ায়। তৃণাকে আনা হয়েছে সজীবের অনুপস্থিতিতে। সজীবের পরীক্ষা। পুরো দেড়মাস সজীবকে কোচিংয়ের আশেপাশে দেখা গেলনা। মায়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। উফ প্যারার দিন শেষ। কিন্তু যে ম্যাডাম এল সে তো আর ও ডেন্জারাস। এত এড বড় স্টুডেন্টদের লোহার স্কেল দিয়ে মারে। মায়া, তৃণা ম্যাডামের পাশে দাঁড়ালে শুধু হাইট মাপে। তারপর হেসে কুটিকুটি হয়। ম্যাডাম তার চাইতে সামান্য খাটো।
ম্যাডামের মাইর খেলে সজীব স্যারকে মিস করে। আহা স্যারটা কতই না ভালো ছিল। মারত না কিন্তু শুধু দাঁড় করিয়ে রাখত। আবার দেরী হলে তাকে বাড়ি ও পৌঁছে দিত। মায়া গিয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করল,
‘ এই নীতু স্যার তোকে কখনো বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে?
নীতু লিখতে লিখতে জবাব দিল,
‘ আমি কি মায়া? স্যার শুধু মায়া নামের মেয়েগুলোকেই বাড়ি পৌঁছে দেয়।
বলেই হো হো করে হাসল নীতু। মায়া খোঁজ নিল আর কোনো মায়া আছে নাকি এই কোচিংয়ে। না নেই। শুধুই সে।
নীতুর বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হেসে কুটিকুটি হলো মায়া। আরও প্রখরভাবে যেন অনুভব করতে লাগল রাগী স্যারের অনুপস্থিতি। পরক্ষনে লজ্জায় মাথা নতজানু হলো তার। ছিঃ স্যারকে নিয়ে কিসব হাবিজাবি ভাবছে। ভাবা ও পাপ। ভীষণ পাপ।
প্রায় দেড়মাস পর কোচিংয়ে দেখা গেল সজীবকে। তৌহিদ স্যারের পরে এল সজীব। সবাই সজীবকে দেখে বলল,
‘ স্যার আপনাকে খুব খুব মিস করেছি।
সজীব হাসল।
‘ তাই?
পুরো ক্লাসরুমে চোখ বুলালো সজীব। কেউ একজন আসেনি। হয়ত এখন কোচিং-এ পড়েনা। সেই আগের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার কাছে এসে থামল মায়া। চোখবন্ধ অবস্থায় বলল,
‘ আসব ম্যাম?
সবাই হেসে উঠল। সজীব তাকালে সবাই চুপ হয়ে গেল। মায়া চোখ খুলে সামনে তাকাল। সজীবকে দেখে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকাল। সজীব স্টুডেন্টকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
‘ আমরা পড়া নিই?
মায়া নরম পায়ে হেঁটে ক্লাসে ডুকল। পড়া বের করে সবার সাথে তাল মিলিয়ে পড়া শিখতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারল পড়া তার মুখস্থ হচ্ছেনা। কিছুতেই হচ্ছেনা। চোখ বইয়ের পাতায় থাকছেনা। একদম উপরে উঠে গিয়ে চলে যাচ্ছে ওই বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দেওয়া মানবটির কাছে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হলো মায়া। সজীবের চোখাচোখি হতেই নিজের পড়া থেমে গেল। সজীবের কথা ও থেমে গেল। সজীব চোখ সরিয়ে আবার ও বলল,
‘ কোথায় ছিলাম আমরা?
মায়া উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ পানি, পানি খাব। স্যার যাই?
সজীবের উত্তর পাওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না মায়া। চলে গেল দৌড়ে। নীতু প্রচন্ড অবাক হলো৷ কি হলো এই মেয়ের?
ক্লাস শেষ না হতেই সজীব বেরিয়ে গেল। আবার আসবে। অফিসে পানির বোতল থেকে পানি ঢেলে খেতেই তৌহিদ স্যার বলল,
‘ কি সমস্যা মায়া? এভাবে পানি তেষ্টা পেয়েছে কেন হঠাৎ।
মায়া পানি গালে রেখে তাকিয়ে থাকল। তৃণা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘ পানি খেয়ে সোজা ক্লাসে যাও মেয়ে। ক্লাস চলছে না?
মায়া পানি ঢোক দিয়ে গিলে ফেলার আগে সজীব অফিসে ডুকে পড়ল। মার্কার ফেলে গেছে। মায়া গাল থেকে পানি ছিটকে পড়ল সজীবের কাছে। হাতের বাহু ভিজে গেল মুহূর্তেই। নিজে নিজেই চিৎকার দিয়ে উঠল মায়া। সজীব পানি ঝাড়তে ঝাড়তে আবার বেরিয়ে গেল। মায়া দৌড় লাগাল তার পিছুপিছু।
‘ স্যার স্যার সরি, সরি। ভীষণ সরি। কি হয়ে গেল এটা?
সজীব জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়ে গেল?
মায়া চুপ হয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
‘ কিছুনা।
সজীব চলে গেল। অধরে ছড়ালো হাসির ছিঁটে।
মায়া তার পিছু পিছু ক্লাসে ডুকে পড়ল। সেদিন ক্লাসে মনোযোগ বসল না আর। এ’র জায়গায় বি লিখল, বি এর জায়গায় সি লিখল। কি একটা বাজে অবস্থা!
নীতু হাসল মায়ার কান্ড দেখে। সর্বনাশ সর্বনাশ মায়া তোর পড়ালেখা তো লাটে উঠবে রে বান্ধবী। কি হবে?
মায়া নিজেই অবাক হলো। যাহ নীতু আজেবাজে কথা বলে।
সেবার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করল মায়া। ইংরেজিতে থাকা ভয়টা তার ধীরেধীরে দূরীভূত হলো। সজীবকে জানাল পরীক্ষার রেজাল্ট। সজীব শুধু হাসল একটুখানি। মায়ার ভীষণ রাগ। তার রেজাল্ট ভালো হয়েছে অথচ স্যার কিছু বলেনি?
ভীষণ মন খারাপ হলো মায়ার। সে রেগে সজীবকে বলে আসল
‘ শুনুন আমি আজ থেকে আপনাকে আর স্যার ডাকব না।
মায়ার কথায় সজীব নিঃশব্দে হেসে বলল,
‘ তো কি ডাকবে?
পাল্টা প্রশ্ন আসায় শক্ত হয়ে গেল মায়া। তা ও আবার যেমন তেমন প্রশ্ন নয়। কি ডাকবে মানে? যা ইচ্ছে তাই ডাকবে।
সজীব হেসে চলে গেল। মায়ার আরও রাগ লাগল। স্যার তাকে এভয়ড করল মনে হলো।
তার কিছুদিন পরে,
সায়মার শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরছিল সজীব আর সাজিয়া বেগম। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল বাসস্টপ থেকে কিছুটা দূরে। মায়াকে দেখা গেল তার মায়ের সাথে। সজীবকে দেখে এগিয়ে এল মায়া। ঠোঁটের কোণায় হাসি,চোখের কোণায় লজ্জাভাব। সাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে লম্বা সালাম দিল। সাজিয়া বেগম সালাম নিয়ে বললেন,
” স্যারকে দিয়েছ না আমাকে?
সজীব নিজের হাত মোচড়াল।
মায়া হেসে বলল,
‘ স্যারকে ও।
সাজিয়া বেগম হাসলেন। বললেন,
‘ নাম কি তোমার?
মায়া হেসে বলল,
‘ মায়া।
সাজিয়া বেগম কিছুক্ষণের জন্য কথা বলা বন্ধ রেখে সজীবের দিকে তাকাল। সজীব কানে হাত দিল। কান ঢলতে ঢলতে বলল,
‘ ওভাবে কি দেখ আম্মা? চলো যাই।
আবার মায়াকে দেখে থেমে গেল সজীব। সাজিয়া বেগম হেসে ফেললেন আওয়াজ করে। মায়ার মুখে হাত বুলিয়ে বললেন
‘ ওহ তুমি মায়া?
মায়া বলল, মানে?
সাজিয়া বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন’ তুমি ও। ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তোমার নাম ও মায়া তাহলে?
মায়ার মা মাজেদা বলল,
‘ মুমতাহিনা জান্নাত মায়া আপা।
মায়া সজীবের দিকে তাকাল। হাসিমুখে সাজিয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করল
‘ আর কেউ মায়া নামের আছে নাকি?
সাজিয়া বেগম সজীবের দিকে তাকালেন। বললেন,
‘ হ্যা হ্যা আছে তো। আছে। আমার ছেলের মানে তোমাদের স্যারের হবু বউ। আমার হবু বৌমার নাম ও মায়া।
মায়ার ঠোঁটে হাসি, চোখে বিষণ্নতা। সজীব হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভয় পেয়ে গিয়েছিল মা কি বলতে কি বলে ফেলে।
মায়া বলল,
‘ ওহ। আমি জানিনা তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা।
মায়া আর দাঁড়াল না তার মাকে নিয়ে। চলে গেল৷ নিমেষেই।
মায়া চলে যেতেই সাজিয়া বেগম হো হো করে হেসে ফেললেন। সজীব কান ঢলতে ঢলতে বলল,
‘ আম্মা এভাবে হেসোনা তো।
সাজিয়া বেগম ছেলের লাল মুখ দেখে আরও জোরে হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
‘ আব্বা শেষমেশ একটা পিচ্চি তোর মাথা খেল। হায় হায় এটা করলি?
সজীব বলল,
‘ আম্মা?
সাজিয়া হাসি রোধ করতে চাইলেন। তারপর ঠোঁটের ফাঁক গলে বের হয়ে দুর্বোধ্য হাসি। এই পিচ্চিটাকে সে ছেলের বউ করবেই। তিনি কান টেনে ধরলেন ছেলের। বললেন,
‘ যাহ তাড়াতাড়ি চাকরি যোগাড় কর। নইলে দেখবি পাখি অন্য খাঁচায় ডুকে পড়েছে।
সজীব রাগ করে ডাকল,
‘ আম্মা?
সাজিয়া বেগম হেসে বললেন,
‘ ভুল কিছু বলিনি,গ্রামের মানুষ। মেয়ে বড় হলেই রাখতে চায়না। কথাটা মাথায় রাখিস।
সজীব মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা।
মায়াকে কোচিং-এ দেখা গেল তিনদিন পর। কোচিং-এ আসল মনমরা হয়ে। মাথায় জবজবে তেল দেওয়া। কপালের একপাশে ও লেপ্টে আছে তেল। সজীব তাকে ডেকে নিল অফিসে। বলল,
‘ মিস.মায়া আপনি রুলস ব্রেক করেছেন। এখন কি করা যায়?
মায়ার মাঝে কোনো উত্তেজনা,ভয় কিংবা বিকার দেখা গেলনা। নরম কন্ঠ তারপর ও কড়া মনে হলো সজীবের।
‘ কি করা যায় মানে কি? চলে যাব। কোচিং-এর কি অভাব হয়েছে?
সজীবের অক্ষি কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁপাতে থাকল মায়া। চোখের কোণা আংশিক লাল। তবে নাকের মাথা জ্বলন্ত। উজ্জ্বল শামবর্ণের মেয়েটির সেই অগ্নিমূর্তি ও দেখার মতো। সজীব দেখল, খসখস করে খাতায় সাইন দেওয়ার আড়ালে।
সজীবকে কোনোরূপ উত্তর দিতে না দেখে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না মায়া। পায়ের আওয়াজ ও শোনার মতো। অফিস থেকে বের হয়ে এলোমেলো ভাবে আওয়াজ করে কেঁদে ফেলল মায়া। নীতু ঠিকই বলে,
‘ আর ও একটা মায়া ফায়া আছে।
নীতুর পাশে এসে ধপ করে বসল। তার চোখমুখের বেহাল অবস্থা দেখে ভড়কে গেল নীতু
‘ ওমা? তোর বিয়ে কখন ঠিক হলো আবার?
জোরে কিল বসালো মায়া নীতুর পিঠে। কড়া কন্ঠে বলল,
‘ আমি ইয়ার্কির মুডে নেই নীতু। আমার কেন বিয়ে ঠিক হবে? তোর প্রিয় স্যারের বিয়ে ঠিক হয়ছে। যাহ খুশিতে এবার নাচ। যত্তসব।
ব্যাগের উপর মাথা রেখে অন্যদিকে মুখ করে পড়ে থাকল মায়া। ক্লাসে সজীব এল। কিন্তু মায়ার হেলদোল নেই। নীতু ডাকল কিন্তু মায়া উঠল না। সজীব ও কিছুই বলল না। মায়া অনেক্ক্ষণ পর উঠে এদিকওদিক তাকাল না। বই খুলে মুখে দুহাত দিয়ে পড়া শিখতে লাগল। যদিও পড়া না ছাই। ঝুঁকে তাকায় চোখ থেকে টপ করে একফোঁটা নোনাজল পড়ল বইয়ের উপর। ভিজে গেল। মায়া সেই জল পড়া জায়গায় চিমটি দিয়ে ফুঁটো করে ফেলল। নীতু হায়হায় করে উঠল
‘ এভাবে বই ছিঁড়ছিস কেন পাগল?
মায়া ছিঁড়ল। সজীব আঁড়চোখে তাকিয়ে মায়াকে দেখে বলল,
‘ মেয়েটা কি অসুস্থ নাকি?
মায়া বই খাতা গুছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
‘ স্যার আমি চলে যাব। আজকে ক্লাস করব না। শরীর খারাপ লাগছে।
সজীব কিছু বলতে চাইল মায়া বলতে না দিয়ে বলল,
‘ হসপিটালে যাব। যাব?
সজীব কি বলবে খুঁজে পেলনা।
‘ তারমানে মেয়েটা অসুস্থ ছিল এতদিন।
মায়ার কড়া কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘ যাব?
সজীব মাথা নাড়ল।
‘ হুহ যাও।
মায়া চোখ নামিয়ে ব্যাগ পিঠে তুলে নিল। মোটা বইটা বুকের সাথে জড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ জীবনে ও আর এই কোচিং-এ আসব না। বেয়াদব স্যার। হবু বউ রেখে আবার মেয়েপাগল করে। বেয়াদব, অসভ্য, লম্পট।
সজীবের পড়ার ফাঁকে মায়া বের হয়ে গেল ক্লাসরুম থেকে। সজীব তার যাওয়া আঁড়চোখে দেখে আবার ও পড়াতে শুরু করল। নিজের উপর বিরক্তি উঠল।
কেন যে স্যার হতে গেল কে জানে? স্যার হয়ে এই এক জ্বালা। ছাত্রীর প্রেমে ও কেউ পড়ে নাকি। না পারছে বলতে, না পারছে না বলে সইতে। আর এই পিচ্চিটার নাকের ডগায় এত রাগ, সজীব না পারে হাসতে,না পারে কাঁদতে। মহাজ্বালায় আছে।
ইয়ারচেন্জ পরীক্ষায় একেবারে ভীষণ খারাপ রেজাল্ট আসল মায়ার। বাসায় বকুনি তো আছেই। পাশাপাশি সজীবের ধমকাধমকি ও কম শোনেনি। সজীব বকতে না বকতেই বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদা শুরু করে দিল মায়া। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ স্যার এই বয়সটাতে পড়ালেখা একটু কম হয়। সেটা আপনারা কেউ বুঝতে চাননা কেন? এই বয়সে ছেলেমেয়েরা প্রেমেটেমে পড়ে। আবার ছ্যাকাট্যাকা ও খায় । ওসবে মন দিতে দিতে পড়ালেখা লাটে উঠে। এটা বুঝতে হয়। বোঝা উচিত। কেন যে বোঝেন না?
আর কেউ হাসল কিনা জানেনা, সজীব নিজের হাসি আটকাতে পারল না। পেন,বই নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ল ক্লাসরুম থেকে। ক্লাসটা করালো না আর। তার হাসি দেখে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বাসায় পৌঁছে ও একি দশা সজীবের। হাসি থামল না তার। সাজিয়া বেগম ছেলের এই অবস্থা দেখে বিড়বিড় করলেন
‘ মেয়েটা শেষপর্যন্ত আমার এত ভালো ছেলেটাকে পাগল করে ছাড়ল?
_____
কোচিং-এ মায়াকে অনিয়মিত দেখে ভীষণ চিন্তিত হলো সজীব। মেয়েটার কি সত্যি সত্যি শরীর খারাপ নাকি? নীতুকে জিজ্ঞেস করল। নীতু জানাল
‘ ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তাই ওর আব্বা বলেছে লেখাপড়া নাকি আর করাবে না।
সজীব অবাকসুরে বলল,
‘ আশ্চর্য! ওটা কি ফাইনাল পরীক্ষা। মায়াকে সুযোগ দেওয়া উচিত।
তারউপর অজান্তেই রাগ লাগল সজীবের। রাগ দেখাল প্রত্যেকটা স্টুডেন্টের উপর। নীতু ও বাদ যায়নি।
আফজাল সাহেবের যে নাম্বারটা দেওয়া ছিল ওই নাম্বারে ফোন দিল সজীব। তিনি জানালেন,
‘ মায়ার গায়ে জ্বর। তাই কোচিং-এ যায়নি। আগামী কাল থেকে আবার আসবে।
সজীব হাঁফ ছাড়ল। নীতুকে এসে বলল,
‘ মিথ্যে বলেছ কেন নীতু?
নীতু ভড়কে গেল। আমতাআমতা করে বলল,
‘ মায়া আমাকে এমনটা বলেছে।
সজীব আর কিছু বলল না। মায়ার প্রতি এত পজেসিভনেস চোখে পড়ল সবার। তৃণা কথায় কথায় সজীবকে বলে,
‘ আজকাল তুমি স্টুডেন্টদের বেশি কেয়ার করছ বোধহয় সজীব।
সজীব খাতায় খাতায় লিখতে লিখতে জবাব দিল,
‘ কোচিং-এর নামটা ভুলে যাও কেন তৃণা? কোচিং-এর নামই তো স্টুডেন্ট কেয়ার।
তৃণা মুখ ফিরিয়ে নিল।
‘ এই ছেলের সাথে কথা বলে লাভ নেই।
তারপরের দিন কোচিং-এ হাজির হলো মায়া। সজীবকে উপেক্ষা করল। পড়া দেওয়ার সময় নাকটা খাম্বার মতো উঁচু করে ফুলিয়ে রাখে। সজীব আঁড়চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। মিনমিন করে বলে,
‘ একদম রিনা খানের কার্বন কপি মনে হচ্ছে।
বলেই চট করে সরে পড়ল সজীব। স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ আমাদের পড়া কোথায় ছিল?
মায়া নিজের নাকে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমাকে রিনা খানের মতো লাগে?
মায়া হাত নেড়ে তেজীকন্ঠে সজীবকে ডাকল। বলল,
‘ স্যার?
সজীব ফিরে চাইল।
‘ আপনাকে রিনা খানের জামাইর মতো লাগে।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সজীব বিড়বিড় করে বলল,
‘ এই যাহ, আমার দেওয়া গোল আমাকেই খাইয়ে দিল?
সজীব মায়ার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘ তাই নাকি?
মায়া হেসে হেসে বলল,
‘ হ্যা।
সজীব আর কিছু বলল না।
_____________
একটু হাসি, একটু অভিমান, একটু রাগ, একটু অনুরাগের পালা চলতে চলতে পার হলো অনেকগুলো দিন। ঈদের সময় মায়া বেড়াতে গেল নীতুদের ঘরে। আর ও অনেকে ছিল। নীতু মায়াকে টেনে নিয়ে গেল হালকা গোলাপি রঙের একটি পাকা ঘরে। মোট পাঁচটা রুম আছে। অনেক পুরোনো হয়েছে ঘরটা। কিন্তু কি সুন্দর গোছানো! ঘরের বারান্দায় বসে রইল মায়া। কিছুক্ষণ পর ভেতর রুম থেকে আসলেন সাজিয়া বেগম। মায়া হতচকিত। সাজিয়া বেগম এসেই মায়াকে জড়িয়ে ধরল।
‘ ওমা? তুমি কখন এসেছ মা?
মায়া হেসে বলল,
‘ এখন। এটা স্যারের বাড়ি?
সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ হ্যা। ভালো লেগেছে।
উত্তেজনার বশে মায়া বলেই ফেলল।
‘ হ্যা খুব।
নীতু হাসল মিটিমিটি। মায়া তাকে চিমটি মেরে বলল,
‘ এই তুই আমাকে আগে বলিস নি কেন তোর বাড়ির পাশেই স্যারের বাড়ি? এজন্যই তোর সাথে স্যারের এত কানাঘুঁষা। ওহ আচ্ছা আচ্ছা।
নীতু হাসল। সাজিয়া বেগমকে বলল,
‘ কাকি সজীব ভাই কি এখন ঘরে আসবে?
সাজিয়া বেগম হাসলেন
‘ আমার ছেলে কি যম। এত ভয় পাওয়ার কি আছে।
নীতু বলল,
‘ ভয় তো আর ও বেশি পাওয়ার কথা কাকি। এই বাঘিনীকে এনেছি তাই।
মায়া মুখ কালো করে ফেলল।
‘ আমাকে এনেছিস তাই তোকে বকবে?
সাজিয়া বেগম নীতুকে বলল,
‘ এই যাহ। আর কথা পাসনা। তুই যাহ নীতু।
আমি একটু কথা বলি মায়ার সাথে।
নীতু হাসল। যেতে যেতে মায়াকে বলল,
‘ ইন্টারভিউ ভালো করে দিস। চলি। টা টা।
মায়া কিছু বুঝল না। পুরো ঘরে চোখ বুলাতে বুলাতে সাজিয়া বেগমের সাথে রান্নাঘরে পৌঁছাল মায়া। সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ এভাবে কি দেখছ?
মায়া বলল,
‘ না দেখছি। আপনি একা হাতে এই পুরো ঘরটা গুছিয়ে রাখেন কিভাবে?
সাজিয়া বেগম হেসে বললেন,
‘ পারি। ঘর গোছাতে ভালোলাগে। আর এখন তো ছেলের বউ আনব। সে আর আমি করব।
মায়ার মুখ কালো হয়ে গেল নিমেষেই। সাজিয়া বেগম বলল,
‘ ধরো তোমার শ্বশুরবাড়ি এমন। খুশি হবে নাকি বেজার হবে?
মায়া থেমে গেল। বলে ফেলল,
‘ খুব খুশি হবো। সাজিয়া বেগম হেসে বললেন
‘ তাহলে সেই ব্যবস্থা করি?
মায়া কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। তার শ্বাস নেওয়া যেন বন্ধ হয়ে গেল। সে ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল,
‘ নীতু কই গেল?
সাজিয়া বেগম বলেন,
‘ আরেহ দাঁড়াও, ঈদের বখশিশ নিয়ে যাও। সেমাই চিনি খেয়ে যাও। এই মেয়ে?
মায়ের চিল্লাচিল্লি শুনে রুম থেকে বের হলো সজীব। ঘুরেফিরে ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুমের আয়োজন করেছিল। মা আর হতে দিল কই?
পড়নে ঢিলেঢালা শার্ট। প্যান্টের পকেটে ফোন গুঁজে গুঁজে আসতেই তার সামনে পড়ল একটি মেয়ে। ভয়ার্ত চকচকে দুটো চোখ। খাড়া নাক। মসৃণ তৈলাক্ত চেহারা। কাজলওয়ালী।
সজীব বিরক্ত হলো।
‘ উফ এই মেয়েটা যেখানে সেখানে হাজির হয়। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এমন হলে কি চলে? ঘুমঘুম চোখে ও না দেখলে কি নয়?
সাজিয়া বেগম ছুটে এলেন। মায়ার দিকে সজীবকে বিরক্তি নিয়ে তাকাতে দেখে বলল,
‘ আব্বা দেখেছিস, একটু বকে দে তো এই মেয়েকে। আমার কোনো কথায় শুনছেনা।
মায়ার বুকে ধড়ফড়ানি আর ও বাড়ল। সাথে সজীবের। সজীব বুঝতে পারল
‘ এই মেয়ে সত্যি সত্যি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্বপ্ন নয়। কিন্তু কি করে সম্ভব?
মায়া সামনে তাকাল একদম। ঢিলেঢালা শার্ট,আর এলোমেলো চুলে স্যারটাকে কি ভালো লাগছে মাইরি!
সজীব তাড়াতাড়ি রুমে ডুকে পড়ল। ছিঃ মায়া তাকে এই অবস্থায় দেখে কি ভাবল কে জানে?
সাজিয়া বেগম মায়াকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,
‘ এটা তোর স্যারের দেওয়া বখশিশ। নে। আর হ্যা আমার ছেলের বউ হতে গেলে আমার তুই তুকারি সইতে হবে। আমার পাগল ছেলেটাকে সামলাতে পারবি তো। নাকি কিছু হলেই রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবি? কোন মায়ার কথা বলেছি সেদিন বুঝিসনি বোকা মেয়ে?
মায়ার দুচোখে টলমলে জল দেখা দিল। এত সুখ সুখ কেন চারপাশে? কেন?
সাজিয়া বেগম তার গালে হাত রেখে বলল,
‘ শেষমেশ আমার ছেলেটাকে পাগল বানিয়ে ছাড়লি?
মায়া গালভরে হাসল। বলল,
‘ আমি?
সাজিয়া বেগম মাথা নাড়াল। মায়া উত্তেজনায় তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
‘ আমি একটু যাই?
সাজিয়া বেগম হেসে বলল,
‘ কার কাছে?
মায়া লজ্জা পেল। সাজিয়া বেগম সায় জানাল।
মায়া গিয়ে আবার ফিরে আসল।
‘ আন্টি এখন গেলে গুনাহ হবেনা তো?
সাজিয়া বেগম আওয়াজ করে হেসে ফেললেন। ওনাকে কিছু বলতে না দিয়ে মায়া দৌড় লাগাল। সজীবের রুমে ডুকে পড়ে ঝাপটে পড়ল তার বুকে।
আকস্মিক হামলায় দুই তিন পা পিছু হাঁটল সজীব। নিজের বুকের এতকাছের রমণীকে দেখে কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটি পালালো মুহূর্তেই। দেখা আর পাওয়া গেল না। সজীব বসে পড়ল কাউচে। মস্তিষ্ক ফাঁকা, শূন্য মনে হচ্ছে।
সাজিয়া বেগম আফজাল সাহেবের সাথে কথা বললেন। আফজাল সাহেব ভীষণ বিস্মিত। তা কি করে হয়?
সাজিয়া বেগম বলে আসলেন,
‘ মায়া ও পড়ুক। কিন্তু সময় হলে আমাদের দিয়ে দেবেন। আমার ছেলে ও চাকরি বাকরি করুক।
আফজাল সাহেবের রাতের ঘুম হারাম হলো। পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে তিনি সজীবের পরিবার নিয়ে খোঁজখবর নিলেন। দুই একজন ছাড়া বেশিরভাগই নাম করলেন সজীবের। তাছাড়া ওনার ও দেখার মুখে সজীবকে ভালো লাগে। ছেলেটা সবদিক দিয়েই ভালো। কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে।
ছেলেটার বাবার ও নাম রয়েছে। ভালো পরিবারের সন্তান।
আফজাল সাহেব ফোন দিয়ে জানালেন সাজিয়া বেগমকে।
‘ ঠিক আছে আপা। দেখছি ব্যাপারটা। মায়ার ও মত লাগবে। তার চাচা, মামাদের সাথেও কথা বলে দেখতে হবে।
সাজিয়া বেগম হেসে বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ।
কোচিং-এ শুরু হলো কানাঘুঁষা। কার কথায় কান দেয় সজীব? তাকে দেখে বোঝার জোঁ নেই কিছুর। মায়ার ও। সে তো সজীবের সামনে পড়লে পারেনা মাটির নিচে ডুকে যেতে।
অফিসে সব টিচার যখন একসাথে বসল। তৌহিদ স্যার বলে উঠল।
‘ চাকরি পাওয়ার দুই বছর পর, বউয়ের খোঁজ লাগায়ছি। তার দুই বছর পর বউ খুঁজে পাইছি। তারপর বিয়ে করছি। আর আমাদের সজীব চাকরি বাকরি হওয়ার আগেই লাইন ফিট।
সজীব খসখস করে সাইন বসালো ক্লাস নাইনের পরীক্ষার খাতায়। পাশের গ্লাস থেকে পানি খেয়ে বলল,
‘ সাড়ে আটটা বেজেছে? এইচএসসি ব্যাচের ক্লাস আছে।
মনির আর তৌহিদ স্যার হেসে উঠল। বলল,
‘ হ্যা। হ্যা। সাড়ে আটটার আগে যাও। ক্লাস যখন তখন করাতে পারো সজীব। সমস্যা নেই।
সজীব খাতা গুছিয়ে রেখে উঠে পড়ে বলল,
‘ জ্বি আচ্ছা।
চলবে,