তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের অন্তিম পর্ব (২২)

0
2199

তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের অন্তিম পর্ব (২২)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

প্রসন্ন আড্ডায় উপস্থিত মানুষগুলোর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ালো নিশান। মুহূর্ত কয়েকের জন্য পাথুরে মেজাজে বসে, নির্বাক তাকিয়ে রইল সাইফ ও তার পিছে দাঁড়িয়ে থাকা সাইমার দিকে। পাংশুটে হলো তার মুখশ্রী। নিশান ভাবল— এই মুহূর্তে সত্যিটা বলে দেওয়া কখনোই বীরত্বের কাজ হবে না। বরং রাহাত, আদ্রাফ ও আরাভদের মতো সিনিয়রদের সামনে নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ করা হবে। তাই নিশান নিচু স্বরে উত্তর দিল,

“ তোমাকে পরে দেখাবোনি, সাইফ ভাই। আমার জীবনটাই তো সোহাময় হয়ে যাচ্ছে দিন-দিন! নিজের ভাইয়ের বউও সোহা, তোমার বোনও সোহা আর আমার বউ-ও সেই সোহা! কী জ্বালায় পড়লাম রে বাপ! ”

নিশানের কথায় সবাই মৃদু হাসলেও পিহু অট্টহাসিতেই ফেটে পড়ল এবার। আদ্রাফ ধমকালো,

“ একটু কমায় হাসো? ব্যাপারটা সিরিয়াস। দুইটা ভাই সোহার চাপে পিষে যাচ্ছে একদম, আর তুমি এতো সিরিয়াস ব্যাপারেও হাসতাছো? ”

আদ্রাফের কথায় যেন মেয়েটা আরও হেসে কুটিকুটি হলো। বহুত কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলল,

“ সাইফ ভাই? সোহা আজকে আমাদের সাথেই স্টে করতেছে না-কি? ”

রিশান এবার নাটকীয় ভঙ্গিমায় হাত জোড় করে পিহুর দিকে তাকাল। কৃত্রিম শোকে কাতর হয়ে বলল,

“ দোহাই লাগে বোইন আমার, ওরে সাইমা ডাক সাইমা! এইবার আমিও গুলায় ফেলমু কোনটা কার সোহা। ”

পিহু একাই হেসে চোখ দিয়ে পানি ফেলে, আসর মজিয়ে দিল৷ এই সোহা নাম নিয়ে গবেষণা শেষে গানের কলি খেলার আয়োজন করা হলো। হলো আরেক দফা হার-জিতের খেল। সকলে আনন্দে আত্মহারা হতেই সায়ানকে হাই তুলতে দেখা গেল সেখানে। সাইফ তো বলেই ফেলল নির্বিকারে,

“ কী রে বন্ধু, তোর না আজকে বাসর রাত? হাই তুলিস ক্যান? ”

সাইফের কথায় সায়ানের ঘুমে চরচর করে ফাটল ধরল। সকলের উপস্থিতির বিস্মরণে বলে ফেলা কথাটায় এবার সাইফও বোধহয় খানিকটা বিব্রত বোধ করতে লাগল। অস্থির হলো চোখের চাহনি, এলোমেলো হলো নিঃশ্বাসের আওয়াজ। তার কী দোষ? সে তো বন্ধুসুলভ প্রতিক্রিয়াতেই অনুভূতি প্রকাশ করল! তবুও সে সুন্দর করে কথা ঘুরিয়ে বলে উঠল,

“ বাসর রাতে ভোর চারটা পর্যন্ত আড্ডা মারতেও দেখছি। আর তুই কি-না আটটা বাজতেই ঘুমে ঢলে-ঢলে পড়তেছিস? এমনিই কী বলে— যার বিয়ে তার হুঁশ নাই পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই? ”

বান্দা কথা ঘুরালেও তেমন একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হলো না। বহুত কষ্টে যেখানে সকলেই হাসি চেপে রাখল, সেখানে পিহু আর আদ্রাফ হো হো করে হেসে উঠল। এরপর? এরপর আবার কী! ছোঁয়াচে রোগের মতোই সেই অট্টহাসি ছড়িয়ে গেল সকলের মাঝে৷ লাজ বৃদ্ধি পেলেও খেলায় দারুণ পারদর্শীতা দেখিয়ে, জিতিয়ে দিতে লাগল বরপক্ষকে। খেলার চঞ্চলতা বজায় রাখতে রাখতেই যখন মিশমিও হাই তুলে নিজের ক্লান্তি প্রকাশ করল, তখন বিয়ে বাড়ির আনন্দ ভুলে সকলেই যেন বেশ ক্লান্ত হয়ে উঠল চোখের পলকেই। একে-একে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সকলে। এইতো দু’মাস আগের কথা… মিশমির বিয়ের পাকা কথা হতেই বিয়ে নিয়ে সকলের নানান পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুমহলে এই প্রথম কারো উৎসবের রমরমা আয়োজনে বিয়ের অনুষ্ঠান সারা হবে বলে কতই না অধীরতা তারকাদের! তীব্র অভিলাষের তরঙ্গে যৌবনোচ্ছল তারকাগুলো এমন কর্মঠ হলো যেন পিতা-মাতা না, বরং তারা-ই নিজ দায়িত্বে বান্ধবীর বিয়ে দিতে যাচ্ছে। দুই মাসে শত শত জমানো পরিকল্পনাগুলো মাত্র তিনটে দিনেই শেষ হয়ে গেল। বাহাত্তর ঘন্টা; শুনতে দীর্ঘ মনে হলেও চেতনার আঁখিতে তা খুব হ্রস্ব। সেই হৈচৈ, আনন্দ, উল্লাসগুলো মনের কোনো এক কোণেই জমা রইল এক টুকরো স্মৃতি হিসেবে। জীবনের যান্ত্রিকতায় আবারও বদ্ধ হলো দুটো ভাই। মিশমি সংসার সামলালো, দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে লাগল আরও তীক্ষ্ণভাবে। বর্ষের সাত মাস তো সে নিজের দোষেই হারিয়ে ফেলেছে! এবার একটু কর্মঠ না হলেই নয়। ঝুমুর বেগম তাকে বলে দিয়েছেন— সংসারও তার, পড়াশোনাও তার। কীভাবে সবটা এক তালে সামলাতে হবে তার খেয়াল রাখাটাও মিশমির-ই দায়িত্ব। নীলাশাও সেই আগের বন্ধুপ্রিয় মনেই জমে রইল নিজের মাঝে। দুটো বাড়ির সদস্যদের প্রতি নিজ ভালোবাসাকে অপ্রকাশিত রেখে, বন্ধুদের এক সুতোয় বেঁধেই আজীবন বেঁচে থাকার দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকল সে। সেই সাথে ভালোবাসার পুরু চাদরে মুড়িয়ে রাখল তার প্রিয়তমকে। এদিকে সানাম তো বরাবরই ছন্নছাড়া! সে যেমন কখন কী করে তা অগ্রীম ধারণা করা দায়, তেমন তার জীবনেও কখন কী হয় তা অগ্রীম ধারণা করা দায়। এই ভালো তো এই খারাপ। অন্যদিকে পিহুর যেমন দিন কেটেছে ভীষণ উল্লাসে ঠোঁটে ঝিলিক দেওয়া হাসির রেখা ফুটিয়ে, ঠিক এখনও তার দিন কাটতে লাগল ঠোঁটের হাসির রেখাকে ফুটিয়ে রেখেই। যারা প্রচুর হাসে তাদের না-কি বুকে বিঁধে থাকে অজস্র বেদনার সূঁচ। অথচ আজ অবধি এই মেয়েটার কোনো ভীষণ কষ্টের কথা শুনেছে বলে মনে পড়ে না তার বন্ধুদের। কী অদ্ভুত প্রজাতির মেয়ে এটা, হে বিধাতা!

সময়কে না-কি স্থির হতে নেই! জগদ্বাসীর বিস্তীর্ণ বুক জুড়ে মানুষের বসবাস থাকুক কী ভিনগ্রহের জীব অথবা থাকুক জন-মানবহীন সমাধিক্ষেত্রের প্রতিচ্ছবি, সর্বশক্তিমানের আদেশ ছাড়া কখনোই স্থির হবে না সময়। তার বয়স আরও সহস্রাধিক বাড়লেও হয়তো পঙ্গু হবে না সে এবং এটিই চিরন্তন সত্য কথা। তাইতো তার যাত্রার সাথে-সাথে পেরিয়ে গেল নীলাশাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের আরও একটি বারমাস। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হয়েও নব কৈশোরের উন্মীলিত ব্যাকুলতাতেই আঁটকে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক বয়স। সময়ের সাথে-সাথে দায়িত্ব বাড়লেই কি মনের বয়স বাড়ে? মন যে কেবলই তার নীতিতে চলতেই ইচ্ছুক! তাইতো আজকের এই চৈতালি বিকেলে মিত্রাঙ্গনে এসে, নিজেদের পুরনো স্বভাবটাকে পুনরায় জীবন্ত করে তুলল তারকারাজির তারকাগুলো।

বিকেলের সুবর্ণ রৌদ্রে মিত্রাঙ্গনের হরিৎ তৃণের চাদরে আড্ডা বিছানো ছয়টি তারকাদের ভীষণ গম্ভীরমুখে বসে থাকতে দেখা গেল এখন। এতক্ষণের জমজমাট আড্ডাটায় হঠাৎ চিড় ধরল কী-করে তা খুঁজেও খোঁজ পাচ্ছে না কেউ। গালে হাত দিয়ে বসে থাকা নিশান এবার বাঘতার সাথে ধমকে উঠল,

“ ধুরু! হুদাই-হুদাই এখানে শোক দিবস পালন করতে আইছি। ”

হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠায় বেজায় ভয় পেল পিহু। আর যতটা না ভয় পেল তার থেকেও বেশি ভীতি প্রকাশ করল সে। বরাবর তো তা-ই করে এসেছে! সেই সাথে মিশমিকেও প্রচুর বিরক্তিতে বলতে শোনা গেল,

“ দোস্ত? আজকে সতেরোই মার্চ, আমাদের বন্ধবন্ধুর জন্মদিন৷ তার মৃত্যুর দিনকে শোক দিবস বলা হয় আর তুই জন্মদিনকে শোক দিবস বলতাছিস? এই কথা শুনলে মানুষ তো তোকে রাতারাতি ভাইরাল করে দিত! এর জন্যই বলি নীলুরে খোঁচা মারিস না। দেখ, এখন নিজের-ই কী অবস্থা নিজের দেশ নিয়ে। ”

মিশমির বলা শেষ হতেই নীলাশা তার চোখ দুটো এমন টান-টান করে তাকাল যেন মারাত্মক কিছু শুনে ফেলেছে সে! সে ছাড়াও বাকি চারবন্ধু মিশমির দিকে বিস্ময়াভিভূত নয়নে তাকিয়ে রইল বেশ কিছু মুহূর্ত। মিশমি স্তব্ধতার সাথে ভাবল যে, তাদের এহেন ভাবভঙ্গির কারণ কী। সে কি কিছু ভুল বলল? সতেরোই মার্চ-ই কি তবে তাদের জাতীয় শোক দিবস? না, তার তেইশ বছরের অর্জিত জ্ঞানটা এমন মারাত্মকভাবে ভুল হতে পারে না। সে গাম্ভীর্যের সাথে তাদের বিদ্রুপাত্মক চেহারার কারণ জানতে চাইতেই সানাম বলল,

“ ঝাণ্ডুবাম? তুই তিনতলা থেকে পইড়ে মরতে গেলি, তিহামরে ঠাসঠাসি মাইরা আমাদের বেক্কল বানায় দিলি, বিয়ে করে মহিলা হয়ে গেলি আর তারপরও তোর বুদ্ধি খুলে নাই? তুই আসলেই ক্যাবলা না-কি চালাকি করোস আমাদের সঙ্গে, একটু ক্লিয়ার করে বল তো? ”

মিশমি নাকে হাজার টন বিরক্তি ঝুলিয়ে সানামের কথা বোঝার চেষ্টা চালালো। তৎক্ষনাৎ জানা গেল যে, নিশান তাদের মহলের এহেন মরমর নীরবতা দেখে, বিরক্তিপ্রকাশক ভাব হিসেবেই ‘শোক দিবস’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করেছে। কিন্তু বেখেয়ালি মিশমি সেই কথার ঠিকঠাক ভাবানুবাদ করে উঠতে পারেনি। তাই সে ভেবেছিল যে, নিশান সত্যিই দিবসটা গুলিয়ে ফেলেছে। নিজের কর্মে মিশমি নিজেও যে অত্যন্ত বিরক্ত হলো তা আর অপ্রকাশিত রইল না। এমন ভুল তো বাচ্চারাও করে না ভাই! মিশমিকে নিয়ে তাদের হাসাহাসি করার এক পর্যায় এসে সানাম হঠাৎই তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,

“ দোস্তস্? চল একটা কাম করি। ”

সানাম চাতুরিপূর্ণ হাসি প্রকাশ করতেই পাঁচ জোড়া প্রশ্নবিদ্ধ আঁখি অধীর হয়ে উঠল যেন! মেয়েটি তার পরিকল্পনা জানাতেই মিশমি তা বাস্তবায়ন করবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিল। এই বয়সে এসে এইসব ছেলেমানুষী করবে না-কি? কিন্তু বন্ধুদের সাথে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকা হলো না তার। তারকারাজির তারকাগুলো একবুক প্রাণোচ্ছলতা নিয়ে এগিয়ে গেল এক যুবকের কাছে। যুবকটি একাকী দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রোল করছে। শরীরটা মেদবহুল বলেই হয়তো এই যুবককে সানাম বাছাই করেছে৷ দৌড়াতে যে পারবে না!
মিনিট দশেকের মাঝে নিশান আটা ও ডিম নিয়ে চলে আসতেই শুরু হলো তাদের খেল। অপরিচিত ছেলেটির গায়ে হুট করেই সেগুলো মাখিয়ে দিতে দিতে ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে হৈচৈ করতে লাগল সানামরা। অতর্কিতে এমনটা হওয়ায় সেই ছেলেটিও বোধহয় বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তাদের এই কর্মকাণ্ডেই কোথা থেকে যেন আরও তিনজন ছেলে এসে সানামদের সাথে তর্কে লিপ্ত হলো। তারা ভেবেছিল ছেলেটি একা এসেছে এখানে। কিন্তু ছেলেটির সাঙ্গপাঙ্গ দেখে ভরকে গেল সানাম। খানিকটা অপ্রস্তুত হতেই চুপসে গেল তাদের মুখ। ভয়ও পেল বেশ। তবে হ্যাঁ, ঠিক এইখানটায় বেশ কাজে লাগল পিহুর স্বভাবসুলভ আচরণ অর্থাৎ নাটকীয়তা। সে অভিনয় করল দারুণ,

“ অ্যাই তনয় ভাই? আপনি আপনার বন্ধুদের বলতে পারতেছেন না যে, আপনি আমাদের চেনেন, আমরা আপনার ছোট ভাই-বোন? আপনার জন্মদিন দেখেই তো একটু মজা করতে আসলাম আর আপনি আমাদের এইভাবে কেস খাওয়ায় দিচ্ছেন? দারুণ ধাপ্পাবাজ তো আপনি! ”

পিহুর তালে তাল মিলালো নীলাশাও। কিন্তু যুবকরা তা শুনতে নারাজ! তারা যেন বুঝেই ফেলেছে যে, এটা প্র‍্যাঙ্ক ছিল। নিশান আর রিশানকে মারবে বলে শার্টের আস্তিনও গুটিয়ে ফেলেছে তারা। তারপর নিশানরা যখন তনয়ের সাথে তাদের একটা ছবি বের করে সেই ছেলেটির বন্ধুদেরকে দেখালো; তখন সেই ঝঞ্জাটটা মিটমাট হওয়ার পথে এলো নিমিষেই। তারউপর সেখানে মিশমিও কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিমায় নাক টেনে অনুরোধ করতেই তারকাদের সাথে এই বিতণ্ডা টিকিয়ে রাখার যেন কোনো ভাষাই রইল না ওই যুবকদের! এই নিয়ে অবশ্য দারুণ মজার একখানা বাণী শোনালো নিশান। নিজেদের হাত পরিষ্কার করার সময় নিশানকে বলতে শোনা গেল,

“ এর জন্যই একটা করে বিশ্বসুন্দরী মাইয়া সাথে রাখা লাগে। শালার ব্যাটাগুলা মিশুর কথায় কী-রকম গলে গেল, দেখছিস? নাহলে আজকে আমার আর রিশানের খবর আছিল। তোরা তো মাইয়া মানুষ, তোদের তো কিছুই করত না। মাঝখান থেকে আমরা পঙ্গু হইতাম। ”

তখন নয়া গোধূলির ঝিমঝিমানোটা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে চারিদিক। সূর্যটার কেবল এক চিমটি অংশই দেখা যাচ্ছে পশ্চিমাকাশে। ঠিক সেই দিকে তাকিয়ে যখন নিশানের কথাটা শ্রবণেন্দ্রিয় হলো মিশমির, তখন সে ঘোর প্রতিবাদ জানালো। ঝামেলাটা তনয়ের ছবি দেখানোতেই মিটে গিয়েছে, তার কথায় নয়। আর মিশমির এই অভিব্যক্তির পর সানাম ফুঁসে উঠল নিশানের উচ্চারিত ‘মাইয়া মানুষ’ শব্দ দুটোকে কেন্দ্র করে। নিশানের বলা কথাটা সঠিক হলেও সানামের তা মোটেও পছন্দ হলো না। সে তো সুন্দর করেও বলতে পারতো যে, তারা মেয়ে বলে তাদের কিছুই করত না। ‘মাইয়া মানুষ’ আবার কী-রকম কথা? পিহু যদি তনয়ের কথা না আনতো তবে কি তারা রেহাই পেতো? পেতো না৷ মিশমি যদি ভয়ে কেঁদে না ফেলে ছেলেগুলোকে অনুরোধ না করতো, তো তারা কি এখনও হাসাহাসি করার মতো স্বাভাবিক থাকতে পারতো? না, পারতো না। এই সমাধান দুটো যারা করল সেই পিহু আর মিশমি কি মেয়ে না? ঠিক এই কথাটি শুনেই মিশমি ফের তেতে উঠল। সে তো রীতিমতো ঝগড়া-ই শুরু করে দিল যে, তার জন্য নয় বরং তনয়ের ছবি দেখানোতেই সবটা মিটে গিয়েছে। নয়তো সানামের এহেন মজা নেওয়ার জন্য করা কাজটিতে তারা বেশ বিপদে পড়ত।

তাদের এই নিয়ে কথা হলো অনেক। বলে না— কথায় কথা বাড়ে? সেই এক ঝঞ্জাট নিয়ে কথা বেড়েই চলল। এমন সময় নীলাশা তার ফোন নিয়ে এগিয়ে এলো তাদের বিতণ্ডায়। ধমকের সুরে বলল,

“ গাইজ, তোরা একটু চুপ করবি? দেখ নিউজে কী লিখছে— ছাব্বিশে মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট এমনকি নৌযান ও আকাশযান চলাচলও বন্ধ থাকবে। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না৷ এইটাও লিখছে যে, প্রয়োজনে এই লকডাউন বাড়ানোর সম্ভাবনা অত্যধিক বেশি। ”

এটা শুনে উপস্থিত ছয়জনের মুখে নামলো আষাঢ়ী আঁধার। গণমাধ্যমের নাম দেখে বলাও মুশকিল হচ্ছে যে, এটি ভুয়া খবর। নিশান বিরক্তি প্রকাশ করল খুব করে। গালি-গালাজও করল এই নতুন শনাক্ত হওয়া করোনা ভাইরাসকে। অতঃপর খুবই জড়ীভূত কণ্ঠে পিহুকে বলতে শোনা গেল,

“ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ মানে তো হোস্টেলও বন্ধ করা হবে। আমাকে বোধহয় ময়মনসিংহেই চলে যাওয়া লাগবে, বুঝছিস? ”

নীলাশার ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে উঠল। সে পিহুকে কোনোমতেই যেতে দিবে না। প্রয়োজনে তার বাড়িতে থাকবে তাও ঢাকার বাহিরে যেতে দেওয়া হবে না তাকে। তার এহেন ছেলেমানুষীর সাথে তাল মিলালো মিশমিও। তাদের বাসায় তো সে এবং সায়ান-ই খালি থাকে। তার মাঝে সায়ান সারাটাদিন অফিসেই কাটায়। তাহলে পিহুর তো তার বাসায় থাকতে কোনো অসুবিধা-ই হবে না! কিন্তু পিহু তা মানতে নারাজ। রিশানও বেশ সুন্দর করে কথা ভাঙিয়ে দিল সেখানে,

“ দেখ মিশা, তোরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ থাকিস ওই বাসায়। সেখানে বান্ধবীকে রাখাটা কিন্তু কোনো যুক্তির কথা না। তোর বন্ধুই হোক আর সায়ান ভাইয়ের বন্ধু, তারে বাসায় থাকতে দেওয়ার মতো কোনো কাজ করবি না কখনো। এটা সমাজে দৃষ্টিকটু ব্যাপার! আর নীলের বাসায় অলরেডি ঈশা আছেই। এইভাবে বাসাটারে হোটেল বানায়ে কি আমাদের ইমেজটা খুব ভালো হচ্ছে নিজেদের কাছে? আবার আরাভ ভাইয়ের ওখানেও পিহুর থাকাটা মানায় না। হাজার হোক ওইটা তো বন্ধুর শ্বশুরবাড়ি, না-কি? আরেকদিকে সানাম; ও নিজেই তো সেখানে টিকে আছে শুধুমাত্র রাহাত ভাইয়ের জন্যে। সেখানে পিহু কেমনে যায়? আর আমরাও ওরে রাখতে পারব না আমাদের কাছে। ঈশারেই তো রাখতে পারলাম না! এর থেকে ও ওর বাড়িত যাক। এক সপ্তাহের-ই তো ব্যাপার! সেখানে গেলেই ভালো হবে। আত্মীয়-স্বজনের সাথেও একটু দেখা করে আসলো ও! ”

সানামকেও মিইয়ে আসা কণ্ঠে বলতে শোনা গেল,

“ হু, ঠিক বলছিস। কিন্তু আমার মনে হইতাছে না যে, এক সপ্তাহেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বাইরের দেশগুলার অবস্থা দেখোস নাই? নিশ্চিত লকডাউন বাড়বে আর কাকার বাসার অশান্তি। ওইখানে থাকা মানে নিজের মন-মেজাজ সব নষ্ট করা। ”

মিশমি বলল, “ এতো দিন যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে তাহলে আমাদের লেখা পড়ার কী হবে, দোস্ত? এইবারের পরীক্ষায় তো টেনেটুনে ভালো করতে হইছে। লেকচার না পেলে আর কতটুকুই নিজের থেকে বুঝব, বল তো? পরে যখন এগুলা সব স্বাভাবিক হবে তখন পড়াশোনা নিয়ে কী একটা বাড়তি প্রেশার পড়বে, ভাবতে পারতাছিস? আমি এতকিছু ক্যামনে সামলাবো তখন? ”

পিহু সান্ত্বনা দিল মিশমিকে— আগেই এতোকিছু অনুমান করে হতাশ হওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু দেশান্তরের খবর কি তা সোজাভাবে ভাবাচ্ছে তাদের? অন্যান্য দেশে তো লকডাউনের উপর লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। নিশান তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কেই ধরে নিল যে, বাংলাদেশের লকডাউন বাড়বে। তাহলে তাদের দুই ভাইয়ের কী অবস্থা হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেই কী বেতন নিতে পিছুপা হবে তারা? না, হবে না। যদি তারা টিউশনিই না করতে পারে তো টাকা আসবে কোথা থেকে? বেতন, বাসা ভাড়া, খাওয়ার খরচ… এগুলোই-বা পাবে কোথা থেকে? চিন্তার স্পন্দনে নিশান আর রিশানকে বেশ ছটফট করতে দেখা গেল। লকডাউন যদি সত্যিই বাড়ানো হয় তো তাদের যা সর্বনাশ হবে তা তো কাউকে বলে বোঝানো-ও সম্ভব হচ্ছে না! এই অধীরতাতেই রিশানের চোখ পড়ল নীলাশার উপর। মেয়েটা কেমন কাঁদোকাঁদো মুখে জমিনে তাকিয়ে রয়েছে। গোধূলির রক্তিমে তার মুখটাও লাগছে বেশ বিষণ্ণ। এই বুঝি কেঁদে ভাসাবে! রিশান প্রশ্ন করল তাকে,

“ কী রে নীল? তুই মুখরে কালা করে দাঁড়ায় আছিস ক্যান? তোর তো কোনো সমস্যা নাই। খাবি-দাবি, চিল করবি… আর তুই কি-না মুখরে ডাস্টবিনের মতো বানায় রাখছোস? তোর কী সমস্যা আছে এই লকডাউন নিয়ে, শুনি? ”

একটু আহ্লাদ পেয়েই যেন ঠোঁট ভেঙে, চোখের পানি ছেড়ে দিল মেয়েটি। তার চোখের পানি দেখে তাজ্জব বনে গেল বাকি পাঁচজন। আরেহ্, এভাবে কাঁদে কেন তাদের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীটি? তার জীবনে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না এই লকডাউন নিয়ে। অবশ্য নীলাশাও কথাটা ভেবেছে অনেক। খুঁজেছে কোনো সমস্যার সন্ধান। কিন্তু না, মেয়েটি নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে যে— তার জানা মতে লকডাউন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তার জীবনে। আর যদি থেকেও থাকে তবে তা সর্বজ্ঞানী-ই জানেন ভালো। ভবিষ্যত কি আর মানুষ বলতে পারে? তবুও মেয়েটার চোখে কান্না। অন্তরের কম্পনে তিরতির করে কেঁপে উঠছে ঠোঁট জোড়াও। চেষ্টা করেও কান্নাটা থামানো সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। তাকে থামানোর চেষ্টা করা হলো, বোঝানো হলো এবং কারণও জিজ্ঞাসা করা হলো। কিন্তু নীলাশা সেই কারণ কীভাবে প্রকাশ করবে? বন্ধুদের এতো যৌক্তিক কারণের কাছে তার কারণ শুধুমাত্রই ফেলনা, এক চিলতে অনুভূতি। তবুও অনেকক্ষণ ধরে তাকে জিজ্ঞাসা করার পর সে ক্রন্দন রুদ্ধের ভাঙা কণ্ঠেই বলে ফেলে অন্তরের কথা,

“ সবেমাত্রই তো সব ঝামেলা ছাড়িয়ে এক হলাম আমরা! এখনই আবার দূরে সরতে হবে আমাদের ছয়জনকে? ”

———- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের সমাপ্তি ———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here