#চাদর_জড়ানো_চিরকুট
#পর্বঃ- ১৪
মোবাইলটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে লতা চৌধুরী। রবিউল কখন কল দেবে সেজন্য সে অপেক্ষা করছে বারবার। এদিকে মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বিপদের সময় যেন সকল বিপদ একসঙ্গে এসে হাজির হয়ে যায়।
রবিউলকে জানানো দরকার যে তাকে ধরার জন্য ক্রসফায়ারের হুকুম আসতে পারে। লতাকে মুক্ত করার জন্য সে যেন নিজেকে বড় বিপদে না ফেলে। কিছুক্ষণ আগে যে নাম্বার দিয়ে রবিউল কল দিয়েছে সেটা এখন বন্ধ। রবিউল যে একই নাম্বার দিয়ে বারবার কল করে না এটা লতা বুঝে ফেলেছে আগেই। তাই রবিউলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বেলকনি থেকে বাহিরে তাকিয়ে আছে। পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদের উপর তিনজন মহিলা হাটাহাটি করছে। লতার আফসোস হচ্ছে, এরা সবাই মুক্ত স্বাধীন, কিন্তু লতা নিজের জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
নিজের আপন বাবাকে ছোটবেলা হারিয়েছে। মা যখন এগারো বছর আগে মারা গেছে তখনও সে নিজেকে বেশি অসহায় ভাবেনি। কারণ তার এই বর্তমান বাবা তাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু সেই বাবা এতটা খারাপ কাজ করতে পারে সেটা যেন তাকে কল্পনার বাইরে নিয়ে যায়।
ছয়তলা বাড়িটার পরের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল লতা। ওই বিল্ডিংটা রবিউলকে ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। রবিউল যত তাড়াতাড়ি এটা খুঁজে বের করতে পারবে ততো তাড়াতাড়ি লতা হয়তো মুক্তি পাবে।
কিন্তু সেটা কতক্ষণ?
মোবাইল কেঁপে উঠল। লতা দ্রুত সেই মোবাইল রিসিভ করে বললো,
– রাফসান?
– হ্যাঁ আমি, কি করছেন?
– বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার কলের জন্য অপেক্ষা করছি। খুব খারাপ একটা খবর আছে।
– আমিও একটা খারাপ খবর দিতেই আপনাকে কল করেছি।
– কি খবর? কি হয়েছে? আমাকে বাঁচাতে আসবে না তুমি? খুঁজে বের করবে না আমাকে?
সরি আপনি।
– সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে আমাকে ধরার জন্য পুলিশ মরিয়া হয়ে গেছে। আমার ছবি টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে আর সকল জনগণকে সাবধান করে দিচ্ছে। সুতরাং সারাদেশের মানুষ আমাকে এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে।
– বলেন কি? আমি তো এটাই বলার জন্য কল করেছিলাম আপনাকে। কিন্তু আপনার সেই নাম্বার বন্ধ পাচ্ছি তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছিল।
– ওটা হাবিবের নাম্বার ছিল।
– হাবিব কে?
– দাদাজানের লোক।
– দাদাজান কে? আপনার কল রেকর্ডের মধ্যেও আমি এই নামটা শুনেছি।
– খুব খারাপ একটা মানুষ, একটা সময় আমি তার জন্য যেকোনো কাজ করতাম। আমার এই রবিউল ইসলাম থেকে রাব্বি হবার গল্পটা সম্পুর্ণ দাদাজানের অবদান।
– মুন্নীর সঙ্গে আপনার যখন সম্পর্ক ছিল তখন আপনার নাম ছিল সজীব, তাই না?
– হ্যাঁ। আচ্ছা পুরনো কথা বাদ দেন। আপনাকে যা বলছি সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
– বলেন।
– আমরা দুজন চট্টগ্রাম থেকে আসার সময় যে ওড়নাটা আপনি ব্যবহার করেছেন। সেই ওড়নাটা এখন আপনার কাছে আছে তাই না?
– হ্যাঁ, কিন্তু ওটা তো ভিজিয়ে রেখে দিছি।
– আপনি ওই ওড়নাটা বেলকনিতে গ্রীলের সঙ্গে বেঁধে রাখুন। চার কর্নার শক্ত করে বাঁধবেন, যেন দুর থেকে দেখে আমি আপনার বেলকনি সনাক্ত করতে পারি।
– কীভাবে সনাক্ত করবেন?
– আপনি যে বিল্ডিংয়ের বর্ননা দিয়েছেন সেই বিল্ডিং খুঁজে বের করে তারপর সেখানে ছাদে উঠে আগে আপনার অবস্থান জানতে হবে। তারপর কীভাবে কী করবো সেই পরিকল্পনা করবো।
– রাফসান সাহেব…!
– জ্বি।
– না থাক, পরে বলবো।
– এখনই বলেন, চারিদিকে যেভাবে আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কখন কিভাবে মারা যাবো জানি না, তখন আপনার না বলা কথাটা কিন্তু আর শোনা হবে না।
লতা চুপ হয়ে গেল। রবিউল নিজেও বুঝতে পেরেছে এভাবে কথা বালাট ঠিক হয়নি। লতাকে এই মুহূর্তে মন খারাপ করে দেবার মতো কথা বলা একদমই ঠিক হয়নি।
রবিউল বললো,
– চিন্তা করবেন না, আমি আমার জীবন থাকতে আপনার কিছু হতে দেবো না। আর যদি মারা যাই তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
রবিউল আবারও জিব কামড়ে ধরলো। বারবার শুধু নিজের মৃত্যুর কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সত্যি সত্যি সে মারা যাবে? এরকম তো কখনো মনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজগুলো করার মধ্যে কখনো মৃত্যু নিয়ে ভয় ছিল না। তবে আজ কেন যেন ভয় হচ্ছে, বড্ড অদ্ভুত ব্যাপার।
সে বললো,
– আর বলবো না, কথা দিলাম।
– আমি একটা কথা বলি?
– বলেন।
– আপনি যদি সত্যি সত্যি মারা যান তাহলে অন্তত আমাকে একটু জানাবেন। কারণ তখন আমার আর বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে না। আমি ওদের হাতে মরার আগেই রুমের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেচিয়ে মরবো।
– এসব কথা বলতে হয় না। সাজু ভাই এতক্ষণে ঢাকায় পৌঁছে যাবার কথা। আপনাকে কল করার আগে আমি তাকে করেছিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ। তবে আপনার নাম্বারটা আমি সাজু ভাইকে মেসেজ করে দিয়েছি।
– হুম বুঝলাম।
– সাজু ভাই যদি মেসেজ দেখতে পারে তাহলে সে আপনার নাম্বার ট্রাকিং করে আপনাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার নাম্বার বন্ধ, কখন যে চালু করবে জানি না।
– আমার কাছে এই মোবাইলেও চার্জ নেই, এটা যদি বন্ধ হয়ে যায় তখন কি করবো?
– তাহলে তো বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে। আপনি বেশি চাপাচাপি করবেন না, কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
– আপনি একটু সাবধানে থাকবেন।
– আপনিও সাবধানে থাকবেন।
কল কেটে গেল। লতার মুখটা অন্ধকারে এখনো ছেয়ে আছে। রবিউল বারবার মৃত্যুর কথা বলাতে তার খারাপ লেগেছে, কিন্তু এমনটা হবার নয়। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে নিজের স্বামী ফিরোজের কথা মনে পড়তেই তার রাগ উঠে যায়। কি কুৎসিত এক মানুষকে সে ভালোবেসে।
লতা মোবাইল রেখে তাড়াতাড়ি ওড়না আনতে গেল। রবিউলের কথামতো তাড়াতাড়ি টাঙানো দরকার। রবিউলের এই বুদ্ধিটাও লতার মনে ধরেছে, কি চমৎকার চিন্তা লোকটার।
লতা কিংবা রবিউল কেউই জানে না লতার বাবার এসিস্ট্যান্টের মনের মধ্যে কি চলছে। তারা যে আজ মাঝরাতের মধ্যে লতাকে মেরে ফেলতে চায় সেটা এরা জানে না। লতাকে মারার আগে তাকে নিয়ে যেসব চিন্তা বৃদ্ধ এসিস্টেন্ট করেছে সেকথা রবিউলের বা লতার জানার কথা নয়। রবিউল যদি জানতো তাহলে অবশ্যই আরও দ্রুত কিছু করার চেষ্টা করতো।
★★★
পুরাতন এসিস্ট্যান্টের বাসা থেকে বের হয়ে সাজু ভাই ও রামিশা এখন আজিমপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাজুর মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে গেছে তাই কখন বন্ধ হয়ে গেছে।
গতকাল রাতে কিছু সময় চার্জ দিয়েছে, তারপর সেই রাত তিনটা থেকে এই পর্যন্ত চলছিল। এখন সরাসরি মিরপুরে ডিবি হাসান ভাইয়ের বাসায় যাবে কিনা সেই চিন্তা করতে লাগলো সাজু।
রামিশার আপুর বাসা শ্যামলী। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই রামিশাকে তার আপুর বাসায় রেখে হাসানের বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সাজু একটা সিএনজি ঠিক করে দুজনেই উঠে বসলো।
রামিশা বললো,
– এখন কী করবেন সাজু ভাই?
– আপাতত হাসান ভাইয়ের বাসায় যাবো তারপর রাতে তার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
– রবিউলের যদি কিছু হয়ে যায়?
– হলে তো কিছু করার নেই, তাছাড়া এ লাইনে যারা থাকে তাদের মৃত্যু এভাবেই হয়।
– কিন্তু লতাকে যদি তার বাবা সত্যি সত্যি মারতে চাইতো তাহলে তো লতার খুব বিপদ।
– আমার সব প্রশ্নের জটিলতা এখানেই রামু।
– কিরকম?
– লতার বাবা কেন লতাকে মারতে চাইবে? তার তো আর কেউ নেই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে লতার সব সম্পত্তি ভোগদখল করতে পারবে। লতা তো তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।
– এমনতো হতে পারে যে লতা বিয়ে করে বাচ্চা হবে শুনে তিনি ভয় পাচ্ছেন। কারণ লতার স্বামী তো খুব খারাপ মানুষ ছিল, সে যদি কিছুদিন পরে তার কাছ থেকে কেঁড়ে নেয়।
– তাহলে তো তিনি ফিরোজকে হত্যা করার প্ল্যান করতেন। কিন্তু লতাকে কেন? লতাকে মেরে যদি ফিরোজকে বাঁচিয়ে রাখে তাহলে তো আরও বিপদ ছিল।
– রবিউল বলেছিল যে ফিরোজকে মারার প্ল্যান ও করেছিল তারা। সেই হিসেবে বোঝা যাচ্ছে লতাকে খুন করানোর পরে তার স্বামীকেও ওরা খুন করে দিত। নাহলে একটা খুনের জন্য তিন কোটি টাকা কেউ বাজেট করে?
– সেটাই ভাবছিলাম আমি।
– তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, এই খুনাখুনির মধ্যে দাদাজান নামের লোকটা সরাসরি জড়িত। এমন হতে পারে যে তিনিই লতার বাবাকে দিয়ে বাধ্য করিয়ে এসব করাচ্ছেন।
– এজন্যই কী আপনি লতার বাবার পিছনে তদন্ত শুরু করেছেন?
– হ্যাঁ। আমাকে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আরো কিছু পয়েন্ট বের করতে হবে।
– আমি কী আগামীকাল সকালে হাসান ভাইয়ের বাসায় আসবো?
– না তোমাকে আসতে হবে না, আমি তোমার আপুর বাসার কাছে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো।
– ঠিক আছে।
সাতটার দিকে সাজু ভাই হাসান সাহেবের বাসায় আসলো। রামিশাকে তার আপুর বাসায় রেখে এসেছে। হাসান সাহেব বাসায় নেই, সাজু তার মোবাইল চার্জে লাগিয়ে গোসল করতে গেল। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে সবার আগে মোবাইল চালু করলো।
হাসানের স্ত্রী এসে খাবারের জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলো। সাজু খাবার জন্য উঠতে যাবে ঠিক তখনই মেসেজটা দেখতে পেল। অপরিচিত সেই নাম্বার দিয়ে মেসেজ।
019—– এই নাম্বারটা লতার কাছে রয়েছে। লতার খুব বিপদ, আপনি দ্রুত নাম্বার ট্রাকিং করে ওকে বের করার ব্যবস্থা করবেন। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, কিন্তু কতটুকু পারবো জানি না। কারণ আমার সম্পর্কে তো এতক্ষণে জানেন সবকিছুই।
R.I.R
আর আই আর, রবিউল ইসলাম রাব্বি। সাজু তাড়াতাড়ি লতার সেই নাম্বারে কল দিল। অপর প্রান্ত থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে বলছে,
” আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে, একটু পরে আবার চেষ্টা করুন। ”
★★★
একটা বিদেশি মদের বোতল আর ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো লতার বাবার পুরাতন এসিস্ট্যান্ট। পাহারায় নিযুক্ত দুজনের কাছে জিজ্ঞেস করে সবকিছু ঠিকঠাক আছে জেনে নিশ্চিত হয়ে বসে আছেন। যেকোনো সময় রবিউলের মৃত্যুর খবর পাবেন বলে মনটা বেশ ফুরফুরে।
এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে দাদাজান কল করেছে৷ বৃদ্ধ এসিস্টেন্ট তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলেন।
– বলেন দাদাজান।
– রবিউল সত্যি সত্যি পালিয়েছে।
– বলেন কী?
– হ্যাঁ, দুজনকে মেরে পালিয়েছে। আমরা মিথ্যা মিথ্যা প্রচার করতে গিয়ে সে সত্যি সত্যি কীভাবে পালিয়ে গেল।
– সমস্যা নেই দাদাজান, আরো তিন ঘন্টা আগেই যেহেতু পুলিশ নেমে পরেছে। তখন রাত পার হবার আগেই ও ধরা পরবে।
– ওকে কিছুতেই বিশ্বাস নেই। তুমি এক কাজ করো।
– কী কাজ?
– লতা কোথায়?
– রুমের মধ্যে।
– মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। রাব্বি যতক্ষণ পর্যন্ত পালিয়ে আছে সে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবে। তুমি লতাকে মেরে ফেল।
– এখনই?
– হ্যাঁ এখনই, নাহলে লতা আবার হাতছাড়া হবে।
এই সুযোগে লতাকে মারতে পারলে সম্পুর্ন দোষ রাব্বির ঘাড়ে পরবে৷ সবাইকে বলা যাবে যে রবিউল পালিয়ে গিয়ে সবার আগে লতাকে খুন করেছে। সম্পুর্ন দোষ রবিউলের হয়ে যাবে।
চলবে…
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।