#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ৫,৬
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৫
আকাশ পরিষ্কার। নীলের মাঝে শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। সূর্যটাও আজ সকাল সকাল তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। দোতলার জানালা দিয়ে বেশ ভাল রকমের বাতাস আসছে ঘরে। বাতাসের দাপটে শুভ্র রঙের পর্দাটা ঝাপটে ঝাপটে ক্লান্ত হয়ে এক সময় দমে যাচ্ছে। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল ঈশা। গায়ে কারো স্পর্শ পেতেই পিছনে ঘুরে দেখল ইলু তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। একটু বিরক্ত হয়েই তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে আশে পাশে তাকাল। ইরা নেই। বাইরে তার কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক আগেই উঠে পড়েছে মনে হয়। চোখটা বন্ধ করে বালিশে মাথাটা ঠেকাতেই বাইরে থেকে একটা মৃদু গলার আওয়াজ কানে আসতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে গেলো ঈশার। চট করে উঠে বসলো। মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে মুহূর্তেই ঘুম ছুটে গেলো তার। আজ ঈশানের জন্মদিন উপলক্ষে ঈশানদের বাড়িতেই সবাই। কিন্তু এতো সকাল সকাল তার মা যে এসে পড়বে সেটা বুঝতে পারেনি। চোখ ডলে ভাল করে তাকাতেই সামনের দেয়ালে চোখ পড়ল। দেয়াল ঘড়ির কাটা ১১ টা ছুঁইছুঁই। আঁতকে উঠে জিভ কেটে ঢোক গিলে ফেলল ঈশা। তার মা যদি কোনভাবে জানতে পারে ঈশা এখন ঘুমাচ্ছে তাহলে আজ সারাদিনটাই মাটি হয়ে যাবে তার। চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে যেয়ে আরেক বিপদ বাধিয়ে ফেলল। না দেখেই নিচে পা দিতেই নিচে শুয়ে থাকা ইরিনার উপরে তার পা পড়ল। এক চিৎকার করে উঠে বসলো ইরিনা। ইলুও চমকে উঠে বসলো। ঈশা অপরাধীর মতো কাচুমাচু হয়ে আবার পা তুলে বসে পড়েছে। ইরিনা শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল
–আমাকে কি পারা দিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস নাকি?
ঈশা দুই হাতে নিজের পা চেপে ধরে অসহায়ের মতো বলল
–সরি। আমি না দেখতে পাইনি।
–অত বড় চোখ গুলা কি আলমারিতে তুলে রেখেছিস যে দেখতে পাস নি। নিচে নামার সময় কি আকাশে দেখে ছিলি? বেয়াদব মেয়ে। এখনি আমার দম বন্ধ করে মেরে দিতিস।
ইলু এতক্ষন কিছুই বুঝতে না পেরে হাবার মতো তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। ইরিনার কথায় কি হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেই অট্টহাসিতে ফেতে পড়ল। ইরিনা কঠিন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে? এভাবে হাসার কি হল?
ইলু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে বলল
–আমি এটা ভেবেই হাসছি যে তোর মতো হাতিকে ঈশার মতো পিঁপড়া কিভাবে পারা দিয়ে মেরে ফেলে। মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।
বলেই আবার হাসতে লাগল। এবার ঈশাও তার সাথে জুক্ত হল। ইরিনা প্রচণ্ড রেগে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইলু আর ঈশা দুজনি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আবার মায়ের আওয়াজ কানে আসতেই ঈশা উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। বাইরে বের হল। বের হতেই সোজা সোফায় বসে থাকা সোনিয়ার উপরে চোখ পড়ল। হঠাৎ করেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু সবার সামনে সেটা প্রকাশ করতে চায়না বলেই নিজেকে সংযত করে এগিয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলের চেয়ার গুলোয় এলোমেলো ভাবে বড়রা বসে খোস গল্পে মশগুল। আর ছোটরা সোফায়। ইরা ইভানের ফোনে গেম খেলছে আর ইভান টিভি দেখছে। ঈশা সেদিকেই ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসলো। সোনিয়ার দিকে তাকাতেই দেখল সে এমন ভাবে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। ঈশার খুব রাগ হল। রাগের মাথায় অনিচ্ছাতেই আশ্চর্য একটা কাজ করে ফেলল। উঠে গিয়ে ইভানের পাশে বসে পড়ল। ইভান সাভাবিক ভাবেই পাশ ফিরে একবার ঈশার দিকে তাকাল। তারপর আবার টিভির দিকে মনোযোগ দিলো। ঈশা ইভান কে দেখে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল
–সোনিয়া আপু কেমন আছ?
সোনিয়া ইভানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল
–ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
–ভাল আছি।
উত্তর দিয়েই ঈশা ইভানের দিকে আর একটু চেপে গিয়ে তার অপর পাশে বসে থাকা ইরার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–কি করছিস রে ইরু?
ইরার মনোযোগ বিঘ্ন ঘটায় সে একটু বিরক্ত হল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–গেম খেলি গেম।
ঈশা মুচকি হেসে আবার বলল
–কি গেম রে?
ইরা এবার ভ্রু কুচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলল
–ক্যান্ডি ক্রাশ।
ঈশাও মনোযোগ দিয়ে সেদিকে দেখছে। কিন্তু তার আশে পাশে কি হচ্ছে সেটা সে বুঝতেই পারছে না। সে এমন ভাবে ঝুকে আছে তার মাথাটা ইভানের নাকের কাছাকাছি। তার চুলের ঘ্রান নাকে আসতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। মাতাল করা সেই ঘ্রানের নেশায় ইভান নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছে না। কিন্তু ঈশা কিছুতেই সরছে না। ইভানের এবার খুব অসস্তি হচ্ছে। হুট করেই বিস্ময়কর একটা কাজ করে বসলো। আলতো করে এক হাতে ঈশার কোমরে চেপে ধরল। ঈশা মুহূর্তেই কেপে উঠল। বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ শব্দটা বেড়ে গেলো। ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। উঠে তড়িৎ গতিতে সোজা তো হয়ে গেলো। কিন্তু সরতে পারল না। কারন ইভান অনেক জোরে চেপে ধরেছে। নড়াচড়া করা সম্ভব হল না। সামনে সোনিয়াকে বসে থাকতে দেখে ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়েই ধির কণ্ঠে বলল
–আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ।
ইভান কোন কথা বলল না। এমন কি ঘুরেও তাকাল না। এমন ভাব যে ঈশার কথা সে শুনতেই পায়নি। সোনিয়ার দৃষ্টি যদিও বা তখন টিভির দিকে তবুও ঈশা আবার বলল
–প্লিজ ছাড়ো।
এবার ইভান খুব স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–কাপছ কেন? ঠাণ্ডা লাগছে? উষ্ণতা দরকার?
ঈশা কটমট চোখে ইভানের দিকে তাকালেও আবার দমে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইভানের শরীরের উষ্ণতা এমনিতেই তাকে জালিয়ে দিচ্ছে। আরও উষ্ণতা বেড়ে গেলো তো পুড়েই ছাই হয়ে যাবে। ঈশার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো। ইলুকে তাদের দিকে আসতে দেখে ইভান ছেড়ে দিলো। ঈশা যেন সস্তি ফিরে পেল। মুহূর্তেই দুই হাত সরে গিয়ে বসলো। ইলু এসে ইরার পাশে বসে তার গাল টেনে দিয়ে বলল
–কি রে ইরু গেম খেলছিস?
ইরা বিরক্ত নিয়ে মাথা নাড়াল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একটু জোরেই বলল
–কি রে ঈশা তুই তো গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা। ওখানে বাতাস পাচ্ছিস না তো। কাছে এসে বস।
ঈশা কোন কথা বলল না। ইলু ভাল করে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। তারপর বলল
–আমি তো এতদিনে জানতাম আমাদের বাড়িটাই সব থেকে ঠাণ্ডা। ঈশা তো তাই বলতো। ওদের বাড়িতে গরম বলে মাঝে মাঝে দুপুরে আমাদের বাড়িতে ঘুমাতে আসে। তাহলে আজ এভাবে ঘামছিস কেন?
–তোর শরির খারাপ লাগছে না তো? তুই ঠিক আছিস ঈশা?
ঈশান কথাটা বলতে বলতে সোনিয়ার পাশে বসলো। ঈশা নত দৃষ্টিতেই ওড়নার এক পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলে বলল
–আমি ঠিক আছি। এমনিতেই গরমটা আজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
ইভান ঠোট চেপে হাসল। ঈশান বলল
–তুই ফ্যান থেকে দূরে বসেছিস তাই মনে হচ্ছে। ইভান ভাইয়ার কাছে বস। তাহলে গরম লাগবে না।
ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সামনে তাকিয়ে আছে। তার এসবে কোন যায় আসেনা। চেহারা অতিশয় সাভাবিক। ঈশা কিছুতেই সেখানে বসতে চায়না। কিন্তু সবার কথার জোরে বাধ্য হয়ে ইভানের কাছে এসে বসলো। ইলু উঠে যেতে যেতে বলল
–তুই তো কিছু খাস নি ঈশা। খেয়ে নে।
ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–আমি শুধু চা খাব আপু। এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
ইলু চলে গেলো। ঈশান সোনিয়ার সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ঈশান আর সোনিয়া দুজন এক সাথে পড়াশোনা করে। তাই তার জন্মদিন উপলক্ষে সোনিয়া এসেছে। ঈশা মাথা তুলে টিভির দিকে তাকাল। ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে ধির কণ্ঠে বলল
–সকাল থেকে কিছুই খাস নি। শুধু চা খেলে হবে?
ঈশা আড় চোখে একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। মিনমিন করে বলল
–এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
–ইচ্ছা অনিচ্ছা শুনতে চাইনি। আমার কথা শুনতে বলেছি।
ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–বললাম তো এখন খাব না।
ইভান একটু গম্ভির গলায় বলল
–আমার কথা না শুনলে কিন্তু কিভাবে শোনাতে হয় সেটা আমি জানি। তাই অজথা জেদ না করে চুপচাপ খেয়ে নে।
ঈশা কোন কথা বলল না। বসেই থাকল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এক কথা বারবার বলাটা আমার পছন্দ না। তুই কি আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিচ্ছিস? নিস না। ভুল করবি। আমি বিগড়ে গেলে তোর কপালে শনি নেমে আসবে।
ঈশা কোন কথা না বলে উঠে গেলো। রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে লাগল টেবিলে বসে। বড়রা সবাই ঘরে চলে গেছে। সাংসারিক আলচনায় মত্ত। ইলু চা নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বলল
–কে কে চা খাবে?
সবাই সম্মতি দিল। ইলু চায়ের কাপ নিয়ে সবার হাতে হাতে দিলো। ইভান কাপ নিয়ে উঠে গিয়ে ঈশার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। ইরাও ইভানের পিছে পিছে এসে তার কোলে বসে পড়ল। ঈশা একবার চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। হঠাৎ করেই ইভানের আদুরে কণ্ঠ কানে এলো
–এতো রাগ করে খাস না পাখি। গলায় আটকাবে।
ঈশা চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ইরার দিকে তাকিয়ে তার সাথে গেম খেলছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে দুজনে এখন দুনিয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। কি মনে করে ঈশা হেসে দিলো। হঠাৎ মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হল। ইচ্ছা করে খানিকটা কাশতে লাগল। ইভান ভাবল ঈশার গলায় খাবার আটকে গিয়েছে। পানি এগিয়ে দিলো। বিচলিত হয়ে বলল
–বললাম না গলায় আটকাবে। কথা কানে যায়না না?
ঈশা পানি একটু মুখে দিয়ে গ্লাসটা পাশে রেখে দিলো। দুষ্টুমি করে বলল
–আমাকে বলেছিলে? কই শুনলাম না তো।
ইভান সবটা বুঝতে পেরে বাকা হেসে ইরাকে বলল
–ইলু আপুর কাছ থেকে বিস্কিট নিয়ে আয় তো টুনটুনি।
ইরা কোল থেকে নেমে এক দৌড় দিলো। ইভান উঠে ঈশার পাশের চেয়ারটা একটু টেনে কাছে নিয়ে বসলো। প্লেট থেকে খাবার তুলে ঈশার মুখে দিয়ে বলল
–এখন শুনতে পাবি নাকি আরও কাছে আসতে হবে? তুই চাইলেই আমি আসতে পারি। আমার কিন্তু কোন সমস্যা নেই।
এবার সত্যি সত্যি ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। ইভান পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ঠোটে হাসি রেখেই বলল
–ততটুকুই টর্চার করা উচিৎ যতটা নিজের সহন ক্ষমতা। বেশী হয়ে গেলে কিন্তু সেটা নিজের উপরে ভারি পড়তে পারে। ভাবা উচিৎ ছিল।
চলবে………
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৬
শুক্রবার মানেই ব্যস্ততম দিন। সবাই বাড়িতে থাকে আর অনেকটা সময় অব্দি ঘুমায়। সকালে নাস্তা খেতেও দেরি করে। তাই রান্না বান্নার দেরি হয়ে যায়। আর এই দিনে ইভানের মা একটু আয়োজন করে সবার পছন্দের রান্না করতে খুব ভালবাসেন। এক সাথে খেতেও। রান্নার হাতটা তার বরাবর খুব ভাল। এই কাজটা তিনি খুব ভালবাসেন বিধায় যত্ন সহকারে করেন। প্রতি বৃহস্পতি বার সন্ধ্যা থেকে ইউটিউব ঘেঁটে নতুন নতুন রেসিপি শিখে ফেলেন। আর শুক্রবার সেগুলো রান্না করেন। আজও তার ব্যতিক্রম না। তিনি বহু মনোযোগ দিয়ে আজ ভাপে ইলিশ রান্না করছেন। সকাল থেকে প্রস্তুতি চলছে তার। একজন সাহায্যকারী আছে তবুও তাকে একাই এসব কাজ করতে হয়। কারন তার কোন মেয়ে নেই। দুই ছেলে। ছেলেদের বিয়ে হলে তারপর বউ আসলে নাহয় এসবের দায়িত্ত নিবে। কিন্তু ততদিন তো তাকেই সামলাতে হবে। ইভান রান্না ঘরের দরজায় দাড়িয়ে কিছুক্ষন বুঝতে চেষ্টা করল কি চলছে। বুঝতে না পেরে অবশেষে জিজ্ঞেস করলো তার মাকে।
–কি রান্না হচ্ছে?
ইভানের মা এক গাল হেসে বললেন
–ভাপে ইলিশ। নতুন শিখেছি কাল।
ইভান ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলেই আবার বলল
–ইফতি এখনও ঘুম থেকে উঠেনি? আজ তো শুক্রবার। নামাজে যাবেনা?
ইভানের মা হতাশ হয়ে বলল
–এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি আর পারিনা। অতিস্ট হয়ে যাচ্ছি। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় জানিস। এই ছেলেটাকে আমি জন্ম দিয়েছিলাম নাকি হসপিটালে আমি যখন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম তখন তোর বাবা বাচ্চা পালটে এনেছিল।
ইভান হেসে ফেলল মায়ের কথা শুনে। ইভানের মা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। এর মাঝেই ইফতি এসে ইভানের পিঠে নিজের মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করেই ঘুম জড়ান কণ্ঠে বলল
–মা এক কাপ স্ট্রং কফি দাওনা। ঘুমটাকে তাড়াই। কিছুতেই যাচ্ছে না জানো।
ইভান হালকা ঘুরে একটু জোরেই কান টেনে দিলো। ইফতি ‘আহ’ শব্দে কান চেপে ধরে বলল
–ঘুম থেকে উঠেই এভাবে কেন অত্যাচার করছ ভাইয়া। মায়া হয়না তোমার। অসহায় বাচ্চাটার উপর এভাবে অত্যাচার কর।
ইভান একটু ধমক দিয়ে বলল
–রাতে সেই কখন ঘুমিয়েছিস। এখনও তোর ঘুম ভাঙ্গেনা কেন? আজ শুক্রবার সেটা কি ভুলে গেছিস? নামাজে যেতে হবে না।
ইফতি পাশে চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল
–হবে না আবার কেন? যেতে হবে যাব। এখনও তো আজান দেয়নি। দিক আগে।
ইভান একটু বিরক্ত হয়ে বলল
–তোমার ছেলে মানুষ হবে না মা।
বলেই সোফায় গিয়ে বসলো। পেপারটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ইভানের মার সাহায্যকারী কলি নামের মেয়েটা এসে ইভানের সামনের টেবিলে চায়ের কাপ রাখল। সাথে কয়েকটা বিস্কিট। পেপারে মুখ ডুবিয়েই ইভান চায়ে একবার চুমুক দিয়ে আবার কাপটা সামনে রেখে দিলো।
–বড় মা।
পেপার থেকে মুখটা তুলে ইভান দরজার দিকে তাকাল। হালকা রঙের একটা কামিজ পরেছে ঈশা। ওড়নাটা মাথায় অরধেক টেনে দেয়া। সামনের ছোট চুলগুলো বের হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। ঈশা দরজায় দাড়িয়েই আছে। ইফতি ভ্রু কুচকে বলল
–কারো অনুমতির অপেক্ষা করছ ঈশা আপু?
ঈশা ভিতরে ঢুকে হাতের বাটিটা ইফতির সামনে রেখে বলল
–অনুমতির অপেক্ষা করছিলাম না। অনুমতি ছাড়াই আমি এই বাড়িতে আসতে পারি যখন তখন। আর আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
ইফতি দাত বের করে বলল
–ওহ! তাহলে ওখানে দাড়িয়ে দেখছিলে বুঝি? তো কাকে দেখছিলে? তোমার ওখান থেকে তো…।
থেমে আবার বলল
–বুঝেছি। ভাইয়াকে দেখছিলে।
ঈশা থতমত খেয়ে দাড়িয়ে থাকল। ইভান পেপারে মুখ ডুবিয়েই হাসল। ইভানের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে বাটিটা দেখে বলল
–এটাতে কি রে?
–মিষ্টি বড় মা। আমি বানিয়েছি। তাই নিয়ে আসলাম।
ইভানের মা হেসে ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুই বস আমি রান্না শেষ করে আসি।
ঈশা মাথা দুলিয়ে ইফতির সামনে থেকে একটা বিস্কিট নিয়ে মুখে দিলো। ইভানের মা রান্না ঘরে গেলো। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে পেপার নিয়েই ব্যস্ত। ধির পায়ে সেদিকে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ল। ইভান পেপারের দিকে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সেটা আবার সামনে রেখে দিলো। ঈশা আড় চোখে একবার ইভানের দিকে তাকাল। তারপর হুট করেই চায়ের কাপটা তুলে নিলো। তখনি রান্না ঘর থেকে ইভানের মায়ের আওয়াজ আসলো।
–ঈশা চা খাবি?
ঈশা চায়ের কাপটা মুখের কাছে ধরেই বলল
–না বড় মা। খেয়েছি একবার।
ইভান আড় চোখে ঈশার দিকেই তাকিয়ে আছে। বুঝতে চেষ্টা করছে তার মাথায় কি চলছে। ঈশা চায়ে পরপর দুই বার চুমুক দিয়ে কাপটা সামনে রেখে গলা তুলে অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি বাসায় যাচ্ছি বড় মা। কাজ আছে। পরে আসব।
উঠে কিছুদুর যেতেই ইভানের মৃদু কণ্ঠ কানে এলো।
–মিষ্টিটা যে এতো কড়া হবে ধারনা ছিলনা। ধন্যবাদ ম্যাডাম। মিষ্টি মুখ করানোর জন্য।
–কিন্তু আমি তো চায়ে চিনি দিতেই ভুলে গেছি। তাহলে কড়া মিষ্টি হল কিভাবে?
ইভান ঈশা দুজনেই ঘুরে তাকাল। তার মা চিনির বয়াম হাতে দাড়িয়ে আছে। ইভান পেপারটা রেখে উঠে যেতে যেতে বলল
–মিষ্টি তো ঈশার কাছে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস কর।
কথা শেষ করে ইভান ঘরে চলে গেলো। ইভানের মা ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা আমতা আমতা করে মিষ্টির বাটির দিকে ইশারা করে বলল
–ঐ যে মিষ্টি। ওটাই অনেক কড়া। চিনি বেশী দিয়ে ফেলেছি মনে হয়।
ইভানের মা একটু হেসে রান্না ঘরে চলে গেলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলে ইভানের ঘরের দিকে একবার তাকাল। ইভান দরজায় হেলানি দিয়ে হাত গুজে মুখে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা কঠিন চোখে তাকিয়ে ঘুরে বের হতে যাবে তখনি ইফতি বলল
–কিন্তু ভাইয়া তো মিষ্টিই খেলনা। তাহলে বুঝল কিভাবে কড়া না হালকা?
ঈশা পিছনে ঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। এগিয়ে এসে ইফতির সামনে মাথা ঝুকে গাল টেনে বলল
–তোকে কি ইনভেস্টিগেশনের জন্য মেডেল দেয়া হবে?
ইফতি না সুচক মাথা নাড়ল। ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–তাহলে নিজের কাজে মনোযোগ দে। আশে পাশে এতো মনোযোগী হওয়ার দরকার নেই তো। নাহলে আমি তোর প্রতি মনোযোগী হয়ে গেলে কিন্তু দুঃখ আছে কপালে।
ইফতি কি বুঝল কে জানে। কিন্তু ভয় পেয়ে শুকন ঢোক গিলে ফেলল। ঈশা চোখ তুলে আবারো ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো।
—————
শেষ বিকেলে চায়ের সাথে মুড়ি মাখার সংমিশ্রণটা বেশ। ইরিনাদের বাড়ির ছাদে ঈশা আর ইরিনা ছোট একটা বাটিতে মুড়ি আর হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। ইরিনাদের বাড়িটা একদম মাঝে। বাম পাশে ইভানদের বাড়ি আর ডান পাশে ইলুদের বাড়ি। ইরিনা একাই। তার কোন ভাই বোন নেই। ঈশার ছোট চাচার মেয়ে সে। সেজো চাচার দুই ছেলে মেয়ে হচ্ছে ঈশান আর ইলু। ইরিনা হতাশ হয়ে বলল
–কতদিন বিয়ে খাইনা। আমাদের বাড়িতে কেউ বিয়ে করেনা কেন? সেদিন একটা বিয়ে হইল তাও আবার খাওয়ার মতো না। কি যে হইল বুঝতেই পারলাম না।
ঈশা সামনে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–আসলেই। আমার মনে হয় সেজো মা সেজো বাবাকে বুঝিয়ে বললে তারা ঠিক রাজি হত। ইলু আপুর এভাবে বিয়ে করার প্রয়োজন ছিলনা। সায়ান ভাইয়া খুব ভাল একজন মানুষ। আর ইভান ভাইয়ার খুব ভাল বন্ধু হিসেবে বাসায় মোটামুটি সবাই জানে তার সম্পর্কে। কারো আপত্তি থাকার কথা না।
–ইভান ভাইয়ার বুদ্ধি ছিল সবটা। যদিও বা আমার ভাল লাগেনি কিন্তু ইভান ভাইয়া কিছু তো একটা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যে কোন ভুল করতে পারেনা সেটা সবাই জানে ঈশা। কিছু তো ভেবেছে সে। আর সব কথাও যে সে সবাইকে বলবে তাও তো না। আমরা তো জানি ইভান ভাইয়া সবার কাছে তার মনের সব কথা প্রকাশ করতে পছন্দ করেনা। কেউ বুঝলে তবেই সেটা জানতে পারে।
ইরিনার কথা গুলো চুপচাপ শুনলেও ঈশার দৃষ্টি ইভানদের ছাদে স্থির। হালকা গোলাপি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে ইভান। ওটা পরেই হয়ত নামাজ পড়তে গিয়েছিলো। এখনও খুলেনি। ছাদে রেলিঙ্গে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। বেশ হাসি খুশি। ঈশা একটু হেসে ইভানের দিকে তাকিয়েই ইরিনাকে বলল
–তুমি ঠিক বলেছ আপু। মানুষটা একদম অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। জাকে বলে এক কথায় পারফেক্ট!
ইরিনা কিছু না বুঝেই মাথা নাড়াল। ঈশা একটু এগিয়ে গেলো ছাদের কিনারে। এপাশ থেকে গলা তুলে বলল
–ইভান ভাইয়া।
হঠাৎ এমন ডাকে ইভান চমকে পাশ ফিরে তাকাল। ঈশাকে হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনটা কানে ধরেই তার দিকে তাকিয়ে বলল
–পরে কথা বলছি।
ফোনটা রেখে ঈশার দিকে ভ্রু নাচিয়ে বলল
–কি চাই?
ঈশা মুচকি হেসে হাতের চায়ের কাপটা দেখিয়ে বলল
–চা খাবে?
ইভান ভ্রু কুচকে নিলো। কিছুক্ষন পর সাভাবিক ভাবেই বলল
–খেয়েছি। এখন খাবনা।
–আমি বানাই? তবুও খাবেনা?
ইভান এবার এগিয়ে আসলো। রেলিঙ্গে দুই হাত রেখে বলল
–আমার জন্য এতো কষ্ট আপনাকে করতে হবে না ম্যাডাম। আমার ইচ্ছা করলে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসব। এমনিতেও আমি এখন বাইরেই যাব।
–তা তো যাবেই। আমি কি তোমাকে আটকে রাখব নাকি? শুধু এক কাপ চা খাওয়াতে চেয়েছি। খুব বেশী কিছু না তো।
ইভান বেশ অবাক হল তার কথা শুনে। ঈশা পিছনে ঘুরে ইরিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–ইরিনা আপু আমি নিচে যাচ্ছি চা বানাতে। তুমি কি আরও এক কাপ খাবে?
–কিন্তু ইভান ভাইয়া তো খাবেনা। আর আমরা তো চা খেলাম। এখন থাক বানাতে হবে না। তুই বস। একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। তখন নিচে গিয়ে আবার খাবো।
ঈশা প্রশস্ত হাসি হেসে মৃদু সরে বলল
–খাবে।
ইরিনা বধ হয় কোন রকমে শুনতে পেল। কিন্তু ঐ ছাদে ইভানের কান পর্যন্ত গেলই না। ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেলো। ঈশার এমন আচরনে ইভান বেশ অবাক হল।
বেশ কিছুক্ষন পর ঈশা চা বানিয়ে এনে দেখল ইভান ইরিনার সাথে বসে গল্প করছে। খুব সাভাবিক ভাবেই এগিয়ে গিয়ে একটা কাপ তুলে ইভানের দিকে এগিয়ে দিলো। যেন সে জানত ইভান আসবে। ইভান শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে কাপটা হাতে নিলো। ইরিনার ফোন বেজে উঠল। সে ফোন ধরতে চলে গেলো। ইভান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–কিছু বলবি?
ঈশা একটু ভেবে বলল
–কেন তোমার মনে হল আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই?
ইভান সোজা হয়ে বসলো। ঈশার দিকে তাকাল গভির ভাবে। বেশ কিছুক্ষন পর শান্ত সরে বলল
–আমি হয়ত তোকে খুব ভাল মতো চিনি। তুই যে শুধু চা খেতে আমাকে ডাকিস নি সেটাও জানি। যা বলতে চাস বলতে পারিস। একদম নিশ্চিন্তে।
ঈশা করুন দৃষ্টিতে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ঈশার দৃষ্টির মানে বুঝতে পারল না। কিন্তু এটা খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে কিছু একটা বলতে চায়। ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা ওভাবে তাকিয়েই বলল
–যদি কখনও চরম সত্যের মুখোমুখি হতে হয় তখন কি করবে?
ইভানের কপালের ভাজ সোজা হয়ে গেলো। অবাক চোখে তাকাল। মৃদু সরে বলল
–কেমন সত্য?
চলবে……।