#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ১১,১২
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১১
ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাতটার সময় যেন কিছুতেই এগুচ্ছে না। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল ইভান। নিশব্দে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই এগিয়ে গেলো বেসিনের দিকে। নিকষ অন্ধকারের মাঝে ড্রইং রুমের জানালার পাশে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টটার সাদা আলোটা কাচ ভেদ করেই ঢুকে পড়েছে। তার বদৌলতেই অন্ধকার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পিছনে ঘুরতেই চমকে গেলো। তার মা ঠিক পিছনেই দাড়িয়ে আছে। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু হকচকিয়ে গেলেও আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–এখনও ঘুমাওনি তুমি?
ইভানের মা ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে উলটা প্রশ্ন করে বসলো।
–তুই এতক্ষন কোথায় ছিলি?
ইভান নরম গলায় বলল
–আসিফের সাথে দেখা হয়েছিলো। কথা বলছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেলো।
ইভানের মা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এতো রাত পর্যন্ত তুই তো বাইরে থাকিস না। আজ কেন?
ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বললাম তো। বিশ্বাস হল না কেন তোমার?
ইভানের মা একটু নরম হল। হালকা গলায় বলল
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয় বাবু। তুই খুব জরুরি কাজ ছাড়া এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস না। আর থাকলেও বলেই যাস। আজ না বলেই এতো রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলি। আমি তো মা। চিন্তা হয় নাকি?
ইভান মায়ের হাত ধরল। অপরাধির সরে বলল
–বাড়ির নিচেই ছিলাম। একটু কথা বলতেই দেরি হয়েছে। আর হবে না।
ইভানের মা হালকা হেসে বলল
–খাবি চল। খাবার দেই।
ইভানের মা পা বাড়াতেই ইভান বলল
–ক্ষুধা পায়নি মা। তুমি ঘুমাও। পরে আমি নিজে নিয়ে খাবো।
ইভানের মা কথা বললেন না। ইভান দাঁড়ালো না। ভেজা মুখের পানি চুয়ে চুয়ে পড়ে টি শার্টটা ভিজে যাচ্ছে। সে ঘরের আলো জালিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছে ফেলল। ফোনটা বের করে একবার দেখে নিলো। ইভানের মা পিছন থেকে মৃদু আওয়াজে বলল
–দুধটা খেয়ে নে।
ইভান পিছনে ঘুরে ভ্রু কুচকে বলল
–আমি দুধ খাই?
ইভানের মা বিছানায় বসে পড়লেন। ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন
–জানি খাস না। কিন্তু মাঝে মাঝে খেতে হয়। তুই যে পরে আর কিছু খাবিনা সেটা আমি জানি। তাই খালি পেটে ঘুমালে আমার যে শান্তিতে ঘুম হবে না। এই দুধ টুকু নিজে চোখে খেতে দেখলে তাও একটু শান্তি পাব।
মায়ের কথার বিপরিতে ইভান কিছু বলতে পারল না। আর কথা বাড়ান মানেই মাকে কষ্ট দেয়া। মুচকি হেসে বিছানায় মায়ের পাশে বসে দুধের গ্লাসটা হাতে নিলো। এক নিশ্বাসে সবটা শেষ করে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–এখন শান্তি?
ইভানের মা মৃদু হাসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
–কি হয়েছে? কিছু নিয়ে কি খুব বেশী চিন্তা করছিস?
ইভান মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের ভালবাসা এমনি হয়। না বলতেই বুঝে যায় সব কিছু। ইভানের মা আবারো জিজ্ঞেস করলো
–ঈশার জন্য চিন্তা হচ্ছে?
ইভান চোখ নামিয়ে নিলো। কোন কথা বলল না। তার মা ছেলের মনের কথা বুঝতে পেরে আবারো বলল
–চিন্তা করিস না। মেয়েটা ঠিক হয়ে যাবে। ছোট মানুষ উলটা পাল্টা কিছু খেয়েছে হয়তো। তাই ফুড পয়জনিং হয়েছে। সকালেই দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তোমার কথাই যেন ঠিক হয়।
ইভানের মা আর কিছু বলল না। গ্লাসটা হাতে নিয়ে উঠে চলে গেলো। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার দাড়িয়ে বলল
–সারা রাত এখন মেয়েটার চিন্তায় আবার জেগে বসে থাকিস না। মেয়েটা নিজেও ঘুমাচ্ছে। তুইও শুয়ে পড়। বেশী চিন্তা হলে ঘুম থেকে উঠে একবার দেখে আসিস।
মায়ের এমন খোলামেলা কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। একটু দুষ্টুমি করে বলল
–এতই যখন ছেলের ঘুম নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তাহলে সেই চিন্তার কারণটাকেই এনে দাও। আমিও শান্তিতে ঘুমাই আর তুমিও ঘুমাও।
ইভানের মা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–আমি তোর মা। সেটা কি ভুলে যাচ্ছিস?
ইভান ঠোট চেপে হেসে বলল
–ভুলে যাইনি তো। তুমি মা বলেই তো তোমার টেনশনটা কমাতে চেষ্টা করছি। আমি ছেলে হিসেবে কর্তব্য আছে না?
ইভানের মা কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। গম্ভির গলায় বললেন
–তুই দিন দিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছিস।
ইভান একটু হেসে বলল
–এখন তো সব আমার দোষ। তোমার টেনশন কমাতেই তো ভালো উপায় বলে দিলাম। সেটাও তোমার পছন্দ হলনা। এখন আর কি করার। তোমার বা আমার কারো যদি ঘুম না হয় তাহলে সে জন্য কিন্তু আমি কোনভাবেই দায়ি থাকব না।
ইভানের মা হালকা হেসে বের হয়ে গেলেন। ইভান দরজা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিছানায় বসে কিছুক্ষন ভাবল। এক রাশ চিন্তারা এলোমেলো ভাবে বিচরন করছে তার মস্তিষ্কে। আজ রাতে আর কোন ভাবেই ঘুম আসবে না। তার মা ছেলের মন ঠিকই বুঝেছেন। ইভানের কেন জানি মনে হচ্ছে ঈশা তার কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে। ঈশার আচরন আজ বেশ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তার চোখের সেই অসহায় দৃষ্টি দেখেই ইভান বুঝতে পেরেছে ঈশা এমন কিছু লুকাচ্ছে যা সে কাউকেই জানতে দিতে চায় না। কিন্তু কেন? কি এমন গোপন বিষয় থাকতে পারে? কিছু জিজ্ঞেস করেও তো লাভ নেই। কোন ভাবেই বলবে না। নিজেকেই খুজে নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে লাগল সে। কেন ঈশা তার উপরে ভরসা করতে পারেনা। সে নিজেও জানে ইভান তাকে কতটা ভালবাসে। কিন্তু সেই ভালবাসার মুল্য ঈশা কখনই দেয়না। ঈশা তার প্রতি অনেক অন্যায় করে। সেটা ভাবতেই ইভানের মনে অভিমান বাসা বাধল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঘুম না আসলেও চেষ্টা তো করতে পারে।
—————
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলো সাধারণত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সুচনা করে। কখনও সেটা ভালো হয় আবার কখনও খারাপ। জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলোকে কেউ আঁকড়ে ধরে বেচে থাকার অবলম্বন হিসেবে নেয়। আর কেউ সেগুলোর চাপে পিষ্ট হয়ে জীবন থেমে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অনেকটা দিন কেটে গেছে। বর্ষার মাঝামাঝি সময়। কবি সাহিত্যিকের ভাষায় বর্ষাকাল নাকি প্রেমের ঋতু। বৃষ্টি নাকি মানব মনে প্রেমের জন্ম দেয়। কিন্তু এই প্রেমের ঋতুতেই ঈশার জিবনে ঘটে গেলো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। শুন্য মস্তিষ্কে কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নিকষ কালো অন্ধকারে ঠিক কালো মেঘটা দেখা না গেলেও দূর আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে আন্দাজ করা সম্ভব। মাঝে মাঝেই আবার বেশ শব্দে কেপে উঠছে চারপাশ। কিন্তু ঈশার সেসবের কিছুই মনে ধরছে না। অনুভুতি শুন্য হয়ে পড়ে আছে মন। এলোমেলো ভাবনা। সব কিছুতেই বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সে। আর সহ্য করতে পারছে না। এলোমেলো ভাবনার মাঝেই আচমকা কান ফাটানো আওয়াজে নামলো বৃষ্টির ধারা। কিন্তু সেই বৃষ্টি মনে আনন্দ দেয়ার বদলে জমে থাকা সমস্ত কষ্ট যেন বাধ ভেঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। এক রাশ অভিমান। কিন্তু কার প্রতি এই অভিমান? ভাগ্যের? সে কি ভাগ্যের চরম নির্মমতার স্বীকার? বাধ ভাঙ্গা কান্না থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো ওয়াশ রুমে। প্রকৃতির কান্না সে পৃথিবীর বুকে বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে পারে কিন্তু ঈশা তার কান্না কাউকে দেখাতে পারেনা। এই কষ্ট তার একান্ত। ঝর্নার নিচে বসে হাঁটু দুই হাতে ধরে অসহায়ের মতো কেদে চলেছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই কান্নার বেগ বেড়ে যাচ্ছে। সাথে আর্তনাদও। সেটাকে আটকাতেই মুখে হাত চেপে ধরছে। মাঝ রাত হওয়ায় রুমে এখন কেউ আসবে না। তাই কোন চিন্তাও নেই। নিশ্চিন্তে ঝর্নার নিচে বসে কাদছে সে।
অনেকটা সময় পর বের হয়ে এলো ওয়াশ রুম থেকে। ঠিক কতটা সেটা হিসাব করে বলতে পারবে না সে। এতটা সময় ভেজার ফলে চোখ নাক লাল হয়ে গেছে। মাথাটাও ভারি হয়ে আসছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ভেজা কাপড় পরেই সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শুকনা কাপড় বের করে নিলো আলমারি থেকে। চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই টেবিলের উপরে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। এতো রাতে কেউ ফোন দিবে ভেবে একটু অবাক হয়েই সেদিকে তাকাল। ইভানের নামটা দেখে চোখ ছলছল করে উঠল তার। পাতা জোড়া বন্ধ করতেই গাল বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ফোনটা হাতে নিলো ঠিকই। কিন্তু রিসিভ করতে নয়। কেটে বন্ধ করে দিতে। কিছুদিন ধরেই ঈশা ইভান কে ইগনোর করছে। ইভান বিষয়টা বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। আবার হার মানতেও নারাজ সে। নিজের মতো করেই ঈশার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু ঈশা চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। ঈশা ফোনটা কেটে বন্ধ করতে চাইলেও সেটা সম্ভব হল না। কারন ঐ যে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তেমনি কিছু ঘটে গেলো। প্রচণ্ড রকমের শ্বাস কষ্ট শুরু হতেই হাত পা কাপতে লাগল তার। কথায় আছে বিপদের সময় মানুষ নাকি তাকেই মনে করে যাকে সব থেকে আপন মনে হয়। ঈশার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। প্রবল বাচার আকুতি নিয়ে মনের সাথে যুদ্ধ করে ফোনটা ধরে অস্পষ্ট সরে বলল
–আমার খারাপ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে।
কথাটা ইভানের কান পর্যন্ত পৌছালো কিনা সেটা বোঝার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো ফোনটা। ওপাশের মানুষটা আদৌ কিছু শুনতে পেয়েছে কিনা বা বিপদটা ঠিক ঠাক আন্দাজ করতে পেরেছে কিনা সেটা বোঝা সম্ভব হল না।
চলবে………
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১২
ইভানের কথাটা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু ঈশা গম্ভির হয়ে গেলো। তার চোখে মুখে হতাশার ছাপ। সে ইভানের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। ঈশার বাবা সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমি তো না করিনি বাবা। আমি তোর হাতে তুলে দিলেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। সময় হলেই আমি তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা ইভানের দৃষ্টি দেখে আঁতকে উঠল। ইভানের চোখ ছলছল করছে। হারানোর ভয়। সাথে ধরে রাখার আকুলতা। ঈশা করুন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান ছলছল চোখে ঈশার দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি এখনি এই মুহূর্তে ঈশাকে বিয়ে করতে চাই।
পুরো ঘর নিরবতায় ভরে গেলো। ঈশার বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন
–এখনি?
ইভান ঈশার বাবার দিকে তাকাল। করুন সরে বলল
–তোমার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়ে যদি তুমি নিশ্চিন্তেই থাক তাহলে আজ হলে সমস্যা কোথায়? মানুষটা তো আমিই বাবা। তোমার সেই ভরসার মানুষ। আমি আজ এখন থেকেই ঈশার দায়িত্ব নিতে চাই। প্লিজ তুমি রাজি হয়ে জাও বাবা।
ঈশার বাবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। একদিকে মেয়ের অসুস্থতা। অন্যদিকে ইভানের যুক্তি। তিনি একটু ভেবে বললেন
–ঈশা সুস্থ হওয়া পর্যন্ত না হয়……।
ইভান থামিয়ে দিলো। কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি তো তোমার মেয়েকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি না। শুধু রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করবে। এটাই কি খুব বেশী চাওয়া? তোমার আর তোমার মেয়ের কাছে আমি এই মুহূর্তে এটাই চাই। আমি কোনদিন কিছুই চাইনি বাবা। আমাকে নিরাশ করোনা। আপাতত শুধু ঈশার সাইনটাই দরকার। বাকিটা নাহয় সুস্থ হলে দেখা যাবে।
ঈশার বাবা মাথা নিচু করে ভাবলেন কিছুক্ষন। চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাতেই দেখল সে ঈশার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। চোখের পানি গড়ে পড়ছে। ঈশার বাবা তার কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিতেই ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন পর মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো সে এই বিয়ে করতে চায় না। তার বাবা মেয়ের কথা বুঝলেও এটা বুঝতে পারলেন না যে এখনি বিয়ে করতে তার আপত্তি নাকি ইভান কে বিয়ে করতে আপত্তি। তিনি আরও কিছু বলার আগেই ইভান গম্ভির গলায় বলল
–আমি ঈশার সাথে কথা বলতে চাই। একা।
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ইভান টুলে বসে পড়ল। সাদা পর্দায় মোড়ানো নিস্তব্ধ ঘরটার নিরবতা ভয়ংকর লাগছে ঈশার কাছে। এক হাতে স্যালাইন ঝুলছে। আর এক হাতে নিজের গায়ে জড়ান শুভ্র চাদরটা খামচে ধরে আছে। শ্বাস অনবরত চলছে। চোখে মুখে ভয়ের আভাষ। সামনের টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা হাত নিলো ইভান। ফাকা গ্লাস। পানি নেই। হাত ধরে ঈশার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নরম গলায় বলল
–তুই কি ভাবছিস আমি সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছি। আর কি বলতে চাইছিস সেটাও জানি। তুই কথা না বললেও তোকে বুঝতে আমার কষ্ট হয়না জান।
কথাটা ঈশার বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু করে দিলো। অবাক চোখে কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ইভান মৃদু হেসে বলল
–খুব অধিকার বোধ নিজের উপরে তাই না?
ঈশা চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান হাতের গ্লাসটা চাপ দিয়ে ভেঙ্গে দিলো। এতে কাচের টুকরো গুলো তার হাতে ঢুকে গেলো। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঈশা সেদিকে তাকাল। ইভানের হাতে রক্ত দেখে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। এক হাত উঠিয়ে ইভানের দিকে বাড়াতেই সে হাত সরিয়ে নিলো। হালকা হেসে বলল
–এতো সহজ? আমার কষ্টের কোন দাম নেই না? এখন থেকে থাকবে। তুই এবার থেকে আমার সব কষ্টের দাম দিবি। আমি সব হিসাব তোর কাছ থেকে নিব।
দাতে দাত চেপে বলল
–তোর সব অধিকার আমি কেড়ে নিব। তোর উপরে এখন থেকে শুধু আমার অধিকার থাকবে। আমার এই অধিকার এতটাই কষ্টের হবে তোর জন্য যা তুই ভাবতেও পারবি না। আমি আর কোন ভাবেই কষ্ট পেতে রাজি না। কোন ভাবেই না।
রেজিস্ট্রি পেপারটা ঈশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–সাইন কর। আমি হেল্প করছি। দেরি করিস না।
ঈশা কি করবে বুঝতে পারছে না। ইভানের দিকে তাকিয়ে অনবরত চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছে। ইভান এক হাতে ঈশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–তুই যত দেরি করবি আমার শরির থেকে ততই রক্ত ঝরবে। তাই তাড়াতাড়ি কর। হাতে বেশী সময় নেই।
ঈশা করুন চোখে তাকাল। ইভান তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলল
–আমি তোর উপরে জোর করতে চাইনা। আমাকে এসব করতে বাধ্য করিস না। এই মুহূর্তে নাহলে আমি যে কোন কিছু করতে দুই বার ভাবব না। আমাকে তো তুই চিনিস জান।
কথা শেষ করেই ইভান তার হাত থেকে কাচের টুকরো টান দিয়ে বের করলো। হাত থেকে গল গল করে রক্ত পড়তে লাগল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো ভাবার সময় নাই তো। তোর কাছে কোন অপশন নাই।
ঈশা বুঝতে পারল ইভানের কথা শোনা ছাড়া তার কাছে কোন উপায় নাই। ইভান আর কিছুতেই কোন কথা শুনবেনা। তাই কিছু না ভেবেই কাপা কাপা হাতে সাইন করে দিলো। ইভান সস্তির নিশ্বাস ফেলে কাগজটা ঈশার হাত থেকে নিয়ে নিলো। ঈশার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল
–সরি জান। তোর জন্য কোন অপশন রাখিনি। বাধ্য করার জন্য সরি। পারলে মাফ করে দিস।
ঈশার কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো। ঈশা নিজের চোখের পানি আটকাতে পারল না। সে বুঝতে পারছে না তার জীবনের কাঙ্খিত প্রাপ্তিটাকে সে গ্রহন করবে নাকি বাস্তবতার কাছে হার মেনে দূরে ঠেলে দিবে। কিন্তু সে তো ইভান কে ভালবাসে। তাহলে কেন এতো বাধা।
ইভান কাগজ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ঈশার বাবার হাতে কাগজটা দিয়ে বলল
–ঈশা সাইন করে দিয়েছে মেজ বাবা। সব ঠিক আছে।
ঈশার বাবার চোখ থেকে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এটা তার খুশির কান্না। সবাই এগিয়ে এলেন। তখনি ইফতি চিৎকার করে বলল
–ভাইয়া তোমার হাত কাটল কিভাবে?
ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কাচ লেগে। তেমন কিছু না।
ইলহাম কাছে এসে ইভান কে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। তার রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে কাচ গুলো সাবধানে বের করতে করতে বলল
–ইচ্ছা করে করেছিস তাই না? ঈশা সাইন করতে রাজি হচ্ছিল না? কিন্তু কেন?
ইভান হাতের দিকে তাকিয়েই বলল
–ঈশার অসুস্থ হয়ে যাওয়াটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না সেটা তুমি জানো। যা করেছে সবটা ইচ্ছাকৃত। ওর মধ্যে বাচার কোন ইচ্ছাই নাই। কিন্তু আমি যে ঈশাকে ছাড়া বাচব না। আমার জন্য হলেও ওকে বাচতে হবে।
ইলহাম একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–কিন্তু ঈশার এরকম আচরন করার মানে কি? কেন এমন করছে?
ইভান মৃদু হেসে বলল
–বাস্তবতা! বাস্তবতার কাছে হার মেনে ঈশা এরকমটা করছে। কিন্তু লাভ নেই। ও হয়তো ভুলে গেছে যে ওর জীবনে এমন কিছু নেই যা এই ইভান জানেনা। আমি এতো সহজে ঈশাকে হেরে যেতে দিবনা। কোনভাবেই না। আমি এই নাটকটা না করলে ঈশা কোনদিনও সাইন করত না। আপাতত ঈশাকে বেচে রাখতে এটাই যথেষ্ট। বাকিটা সুস্থ হলেই নাহয় ভাবা যাবে।
ইলহাম ইভানের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল
–তুই অনেক ভালো বুঝিস ইভান। আমি আশা করব তোদের মধ্যে সব ঠিক থাকবে।
ইভান হেসে বলল
–ভেবনা ভাইয়া। ঈশাকে আমি সামলাতে পারি। এখন শুধু ওর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা।
কথা শেষ করে ইভান বের হয়ে এলো। সবাই একসাথে দাড়িয়ে তাদের বিয়ে নিয়েই জল্পনা কল্পনা করছে। ভিতরে কি হয়েছে কেউ জানে না। কিন্তু বাইরে সবাই বেশ খুশি। ইভান কে এগিয়ে আসতে দেখে তার মা হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো
–কিভাবে কাটল?
ভিতরে কি হয়েছে। কিভাবে ঈশার কাছ থেকে সাইন নিয়েছে এসব কিছুই সে কাউকে জানতে দিতে চায়না। কারন সেসব নিয়ে কথা বলতে গেলে যে অনেক কিছুই সামনে আসবে। আর ইভান কোন ভাবেই সেসব নিয়ে কথা বলতে চায়না। তাই ইভান চায় তাদের সম্পর্ক দুনিয়ার সামনে স্বাভাবিক থাকবে। তাদের মাঝে কি হচ্ছে সেটা কেউ জানবে না। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–অসাবধানতায় গ্লাস ভেঙ্গে হাতে লেগে গেছে। তেমন কিছু না মা। সব ঠিক আছে।
ইভানের মা একটু হেসে বলল
–সব ঠিক থাকবে এখন।
ইভান একটু হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। ঈশার মা এগিয়ে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। ইভান চোখ তুলে তার দিকে তাকালেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আজ ইভান না থাকলে তার মেয়ের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–এভাবে কান্না কাটি করার কি আছে? তোমার মেয়ে একদম ঠিক আছে। পুরপুরি সুস্থ হতে একটু তো সময় লাগবেই। সেই সময়টাও কি দিতে চাওনা?
ঈশার মা নিজের চোখ মুছে ফেললেন। ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–সারাদিন কোথায় ছিলি? ফোন কেন বন্ধ তোর?
ইভান নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল
–একটু কাজ ছিল। আর ফোনে চার্জ নেই তাই বন্ধ হয়ে গেছে।
ইলুর বাবা এগিয়ে এসে বললেন
–তুই কিভাবে ঈশার অসুস্থতার কথা জানলি?
–ঈশার ঘরে লাইট জালানো ছিল। আর এতো রাতে ঘরে লাইট জালিয়ে রাখা একটু অস্বাভাবিক। কারন ঈশা আলোর মধ্যে একদম ঘুমাতে পারেনা। তাই ভেবেই নিয়েছিলাম যে সে জেগে আছে। আমি ফোন দিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করতে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। কিন্তু আমার সাথে কোন কথা হয়নি। ফোনটা রিসিভ করার কিছুক্ষন পরেই আমি কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পাই। তারপর কিছুক্ষন পর ঈশার রেসপন্স না পেয়ে মেজ বাবাকে ফোন করি। মেজ বাবাই ঈশার রুমে দেখে আমাকে ফোন করে সবটা জানায়।
ইভানের কথা শুনে সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ইভানের কারনে হয়তো আজ খারাপ কিছু হওয়া থেকে বেচে গেলো।
চলবে………