শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ১৩,১৪

0
888

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ১৩,১৪
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৩

~ “এই মুহূর্তে ‘কেমন আছো’ এই প্রশ্ন করে তোমার মন আরও খারাপ করে দিতে চাচ্ছি না। তোমার হাতে ধরে থাকা রিপোর্টটা তোমাকে ঠিক কতটা ভেঙ্গে দিয়েছে সেটা আমার থেকে ভালো হয়তো তুমি নিজেও জাননা। আমি জানি তুমিও ঠিক আমার মতন এমন অজস্র তিক্ত মূহুর্ত কাটাচ্ছ। তোমার তিক্ততা বাস্তবতাকে ঘিরে। আর আমার তিক্ততা তোমার নিজের মনের বিরুদ্ধে এই জুদ্ধের কারনে। জীবনের প্রতি এই অনিহার কারনে। এতো অধিকার কেন তোমার নিজের উপরে? কে দিয়েছে? আমার মোটেই সহ্য হয়না তোমার উপরে কেউ অধিকার দেখাক। তাই তো এই অধিকার কেড়ে নিলাম।

যেখানে তোমার শরীরে সামান্য আঁচড়ের দাগও আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যায় সেখানে এতো বড় কাটা ছেড়া! কিভাবে সহ্য করেছি বলতে পার? নিজের অজান্তেই কেমন করে যেন দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল আমার চোখ থেকেও। কিন্তু একটা কথা মাথায় ছিল পুরুষ মানুষের কাদতে নেই । তাই নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু মনের মাঝে আজ বড্ড অভিমান। কি ভেবেছিলে? আমি কিছুই জানতে পারবো না? তোমার জিবনে আমার অজানা কোন ঘটনা কি কখনও ছিল আদৌ? তাহলে কেন এই লুকোচুরি?

তোমার অবহেলা যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে প্রতি নিয়ত। তুমি বুঝতে চাওনি। কারন তুমি নিজের কষ্ট নিয়েই ব্যস্ত ছিলে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এভাবে অবহেলা না করে নিজের কষ্টটা তো বলতে পারতে একবার। পারতাম না কি তোমার হাতে হাত রেখে সব কষ্ট ভাগ করে নিতে?

বিধাতার খেলা বড়ই অদ্ভুত তাই না? ‘বিয়ে’ নামক ছোট্ট একটি পবিত্র শব্দ আমাদের দুজনকে কত কাছে টেনে এনেছে। কিন্তু আবার তোমার জীবনের চরম বাস্তবতাকে ঘিরে আজ তুমি এই অনুভুতি থেকে দূরে। প্রতিনিয়ত তোমাকে ভাবাচ্ছে কোন ভুল করনি তো? কেন ভুল করবে? বিশ্বাস নেই আমার উপরে? হয়তো নেই। তাই এমন ভাবনা তোমার। কিন্তু আমি তো জানি তুমি আমাকে ছাড়া কেমন থাকবে। এই প্রশ্নটা তোমাকে করা মানেই নিতান্ত বোকামি।

তুমি নিজেকে তুচ্ছ ভেবে অন্যায় করেছ। নিজের কাছে তুমি একজন সাধারন মানুষ হলেও আমার কাছে কিন্তু আমার জীবন। এটা কিভাবে ভুলে যাও? নিজের জীবনের সাথে এতো বড় অন্যায় আমি কিভাবে মেনে নেই?

মুখ ফুটে ভালবাসার কথা সবসময় হয়ত তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি। কখনো মুগ্ধতা, কখনো নীরবতা, কখনো অপলক দৃষ্টিতে শুধুই চেয়ে থাকা। এসব কি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়?

এই যে আমি এতো অদ্ভুত। ভেতরে ভেঙে চুরে একাকার হয়ে যাই,কিন্তু প্রকাশ করার ক্ষমতা নাই। এটা নিয়ে তোমার অভিযোগের শেষ নেই। তবে কি ধরে নিব মুখে না বলায় তুমি ভালবাসা বুঝে নিতে ব্যর্থ? তবে কি জানো। আমার ভালবাসার মতো আমার অভিমানটাও তীব্র। নিজেকে কষ্ট দেয়া মানে আমাকে কষ্ট দেয়া। তুমি ভুল করেছ জান। এটার শাস্তি যে তোমাকে পেতেই হবে। আমি নিরুপায়। আমি সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারলেও এই ভুলের অপরাধ ক্ষমা করতে পারিনা। দূরে যেতে চেয়েছিলে! তাহলে দূরত্বটাই থাক।“~

কম্পিত হাতে ধরা চিঠিটি দুরুদুরু বুকে নিশ্বাস বন্ধ করে প্রতিটি লাইন পড়েছে ঈশা। সেই ভালোবাসার শব্দমালা। সাথে এক রাশ গাড় অভিমান মেশানো। চিঠিটি পড়ে আবেগি হয়ে কেদে ফেলল সে। চোখ বন্ধ করে ফেলল। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ খুলে সেদিকে তাকাল। দরজার সামনে ইভান দাড়িয়ে হাতে থাকা চিঠিটির দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা নিস্পলক ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। যৌবনের হারান প্রেমিকের সাথে অনেকদিন পর হঠাৎ দেখা হলে মন যেমন আনন্দে নেচে উঠে ঠিক তেমন অনুভুতি হচ্ছে তার। দীর্ঘ ২০ দিন পর ইভানের সাথে তার দেখা। ১০ দিনের মতো হাসপাতালেই থেকেছে। শারীরিক দুর্বলতার কারনে তার সুস্থ হতে একটু বেশী সময় লেগেছে। আর বাকি সময়টা বাসায় এসে পুরো রেস্ট। বিছানা থেকে নামার সুযোগ হয়নি তার। এই ২০ দিনে ইভান যে তার কাছে যায়নি তা নয়। প্রতিদিনই গিয়েছিলো তাকে দেখতে। কিন্তু সে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন। তাই ইভানের সাথে তার দেখাও হয়নি কথাও হয়নি। ইভান অবশ্য ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। কারন ঈশারও একটু বোঝা উচিৎ। প্রিয়জনের অবহেলা আর কষ্ট ঠিক কেমন লাগে। ইভান আগে ঈশার সাথে কখনও এমন করেনি তাই সে বুঝতেও পারেনি। কিন্তু এখন তাকে বুঝতে হবে।

ঈশাকে নিজের ঘরে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইভানের যেমন রিয়াক্ট করার কথা ছিল তেমনটা কিছুই করলো না। ঈশার কেন জানি মনে হল সে যে এখন এখানে আসবে সেটা ইভানের জানা ছিল। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ঈশার দিকে একবার তাকাল না। ধির পায়ে হেটে আলমারির সামনে গেলো। আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে পিছনে হাত বাড়িয়ে ঈশার দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু পেছন ফিরে তাকাল না। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বক্সটা নিয়ে নিলো। ইভান এগিয়ে ওয়াশ রুমের দরজার সামনে যেতেই ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–তুমি সব জানতে?

ইভান থেমে গেলো। ছোট্ট করে ‘হুম’ বলতেই ঈশা আবারো কাপা কাপা গলায় বলল
–কবে জানতে পেরেছ? আমাকে বলনি কেন?

ইভান এবার ঘুরে দাঁড়ালো। ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
–এতো কিছু জেনে কি লাভ? জার জানানো উচিৎ ছিল সে তো জানায়নি কিছু। এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা তাই না?

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–আমি বলতে চেয়েছিলাম অনেকবার। কিন্তু……।

ঈশা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ইভান বলল
–এসব লেইম এক্সকিউজ। বিশ্বাস ছিল না তাই বলা হয়ে উঠেনি। মনে হয়েছিলো আমি সবটা জানার পর ছেড়ে চলে যাব। নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চাইব না। দায়িত্ব নিতে চাইব না।

ঈশা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–যাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশী ভালবাসি। জার জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। জার মুখে হাসি দেখার জন্য আমি গোটা পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি সে আমাকে এক রত্তি পরিমান বিশ্বাস করেনা। অদ্ভুত!

ঈশা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমি এরকম ভাবিনি। বিশ্বাস কর। আমি কখনই এরকম ভাবতে পারবো না। আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে কোন রকম সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি তোমাকে সবটা জানাতে চেয়েছিলাম যে আমি কখনও কনসিভ করতে পারবো না। কিন্তু সেরকম সুযোগ হয়ে উঠেনি। সেদিন আমি তোমাকে বলতে এসেছিলাম কিন্তু তুমি বাসায় ছিলে না। তোমার ঘরে এসে ডাইরিটা চোখে পড়ল। সেটা খুলে পাতা উল্টাতেই তোমার লেখাটা পড়ে জানতে পারলাম তোমার বাচ্চা কত পছন্দ। কিন্তু আমি তো অক্ষম। তাই কিছু ভাবতে পারিনি। মাথায় ঐ সময় একটা কথাই ঘুরছিল তোমার জীবনের সাথে জড়ানো মানে আমি অন্যায় করে ফেলব তোমার সাথে। আমার মাথায় সত্যিই কিছু ছিল না। আমি বুঝতে পারিনি।

ঈশা কেদে ফেলল। ইভান কোন কথা বলল না। দাড়িয়েই থাকল একি ভাবে। ঈশা একটা শ্বাস টেনে আবারো বলল
–তারপর আবার বড় মা আমাকে বলছিল তোমার ছোট বেলার সব খেলনা তোমার বাচ্চার জন্য রেখে দিয়েছে। যখন জানতে পারবে তার এই ইচ্ছাটা অপূর্ণ থেকে যাবে তখন কি হবে? কত কষ্ট পাবে?

এবার ইভান শান্ত সরে বলল
–সবার অনুভুতির এতো খেয়াল! এতো চিন্তা! আমার টা কই? এই জিবনে আমার কি আদৌ কোন জায়গা আছে?

ঈশা কেদে ফেলল। ইভান আর কোন কথা না বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশা বুঝতে পারল সব কিছু নিয়ে তার ইভানের সাথে কথা বলা উচিৎ ছিল। তাকে বুঝিয়ে বলা উচিৎ ছিল। সে বড় অন্যায় করে ফেলেছে তার সাথে। ইভানের অভিমান তার দিক থেকে একদম ঠিক। সব দোষ তার নিজের। সে বেশী বুঝতে গিয়েই সবটা এলোমেলো করে ফেলেছে।

ঈশা এলোমেলো পা ফেলে ইভানের বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের বাড়িতে এলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। কাগজটা আবার খুলে চোখের সামনে ধরল। ঈশার সামনে এবার সবটা পরিষ্কার হল। ইভানের এভাবে হুট করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা কোন ছেলে মানুষী ছিলনা। সবটা জেনে বুঝে সে এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভিতরে জমে থাকা কষ্টটা দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলো বদ্ধ ঘরে। চোখ বন্ধ করতেই পানি গড়িয়ে পড়ল।

ভাবতে লাগল সেদিনের কথা যেদিন সে প্রথম জানতে পেরেছিল কোনদিন মা হতে পারবে না। ঈশা যখন প্রথম তার এই অক্ষমতার কথা জানতে পেরেছিল তখন অনেক ভেঙ্গে পড়েছিল। চেয়েছিল ইভান কে সবটা জানাতে। সাহস সুযোগ কোনটাই হয়ে উঠেনি। কিন্তু ইভানের মতো একটা মানুষ কোন কিছু না জেনেই তাকে ঠিক সামলে নিয়েছিল তার অসীম ভালবাসা দিয়ে। আর ঈশাও তার এই ভালবাসা পাবার লোভে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ইভান তাকে জীবনের নেতিবাচক দিক থেকে সরিয়ে এনে সৌন্দর্য টা দেখাতে চেষ্টা করে। আর এতে সে সফল হয়ে উঠে। ইভানের তীব্র ভালবাসার জোরেই ঈশা আবারো নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু ঈশার মতো সাধারন পরিবারের মেয়েরা সাধারন জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখে। একজনকে ভালবেসে তার সাথে সাধারন ভাবে বাঁচতে চায়। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখি পরিবারের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এই শারীরিক অক্ষমতা ঈশার জিবনে অভিশাপের মতো মনে হয়েছে। সন্তান বিহীন দাম্পত্য জীবন ভয়ানক কষ্টের। ইভানের ডাইরি পড়ে সেদিন ঈশা বুঝতে পেরেছিল তার বাচ্চা কত পছন্দ। যদিও বা এসবের জন্য ঈশা কোনভাবেই দায়ী না। তবুও সেদিন নিজেকে অপরাধি মনে হয়েছিলো তার। মনে হয়েছিলো এই অপূর্ণতা তার একার। নিজের ভালবাসা আর অনুভুতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সে এতো গুলো মানুষের অনুভুতির সাথে অন্যায় করছে। তাই সেদিন থেকে ইচ্ছা করে ইভান কে ইগ্নর করতে শুরু করে। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিল যে ইভান কে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ। সে কোন ভাবেই বাঁচতে পারবে না। তাই নিজের বাচার ইচ্ছাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।

ইভান যে এতো সহজভাবে নেবে বিষয়টা ঈশা সেটাই ভাবতে পারেনি। আবারো ইভানের ভালবাসার কাছে বাস্তবতা হেরে গেলো। ভাবনার মাঝেই হাতে থাকা বক্সটার দিকে চোখ গেলো। সেটা খুলতেই একটা চিরকুট বেরিয়ে এলো। মেলে ধরতেই দেখল শুভ্র রঙের একটা কাগজে নীল কালিতে লেখা

“ওয়েডিং নাইটে নাকি বউকে ওয়েডিং গিফট দিতে হয়। বিয়েটা যেভাবেই হোক বউ তো তুমি আমার। তাই সেই দায়িত্বটাই পালন করতে চেষ্টা করেছি। জানিনা তোমার ভালো লাগবে কি না। তবে আমার এই ছোট্ট গিফট নিজের সাথে পরম আলিঙ্গনে রাখলে আমার ভালো লাগবে। জানিনা তুমি এমন কিছু করবে কিনা। কারন আজ কাল আমার ভালো লাগার প্রতি তোমার বড্ড অনিহা! ”

চিঠিটা পড়ে এতক্ষনের কষ্টটা আচমকাই দূর হয়ে গেলো। আশ্চর্য জনক ভাবে হেসে ফেলল সে। ভালবাসার অনুভুতি গুলো বড়ই এলোমেলো। কখন কাদায় কখন হাসায় কেউ বলতে পারেনা। বক্সের ভিতরের প্যাকেটটা খুলতেই বেরিয়ে এলো অসম্ভব সুন্দর একটা পায়েল। তার মানে এটাই সেই ওয়েডিং গিফট! হাতে ধরে ঠোট টিপে হাসল সে। কোনভাবেই এটা পরবে না সে। ইভান জতক্ষন না নিজে হাতে তাকে পরিয়ে দিবে ততক্ষন সে কিছুতেই এটাকে নিজের সাথে জড়াবে না। কারন বিশেষ উপহার তো বিশেষ মানুষের হাতেই পরতে হয়। সেও দেখতে চায় ইভানের অভিমান টা ঠিক কতটা। ঈশা যে ভুল করেছে সেটা সে বুঝতে পেরেছে। নিজের বোকামির ফল যে ইভান কে এতো কষ্ট দিবে সেটা হয়তো আন্দাজ করাও তার পক্ষে সম্ভব হতনা যদি না ইভানের আবেগময় চিঠিটা পড়তো। এটা এখন তার কাছে স্পষ্ট যে ইভানের সাথে অন্যায় করেছে। তার উচিত ছিল ইভানের ভালবাসাটা বোঝা। কিন্তু সে সেটা না করে তার ভালবাসাকে অসম্মান করেছে। ঈশা ভেবেছিল সে ইভানের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। বাস্তবতা জতই কঠিন হোক না কেন যে তার জন্যই বাচে এমন প্রেমিক কে কি কষ্ট দেয়া সম্ভব? এটা যে বড় অন্যায় হবে।

চলবে………

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৪

শরৎ মানেই শুভ্র নীলের সমাহার। রোদ্রজ্জল ঝলমলে সকাল। এলোমেলো দখিনা হাওয়া। দোলনচাঁপা, শিউলি, বেলি আর কাশফুলের স্নিগ্ধতা। ঝকঝকে নীল আকাশে ঝাকে ঝাকে শুভ্র মেঘ। যেন কয়েক গুচ্ছ তুলোর পেঁজা। রোদ্র ছায়ার খেলার মাঝেই ছাদে ব্যস্ত ভাবে হাঁটছে ঈশা। গভির ভাবনায় নিমগ্ন। ভ্রু কুচকে নিচের দিকে তাকিয়েই হেটেই যাচ্ছে। অবাধ চিন্তা ধারা মস্তিষ্কে নানান রকম ভাবে হানা দিচ্ছে। এতো চেষ্টা করছে কিন্তু ইভান কে কিছুতেই মানাতে পারছে না। এতো কঠিন মানুষ হয়? এরকম অনেক কারনেই অনেক বার ইভান তার উপরে রাগ করেছে। সময়ের সাথে সেসব ঠিকও হয়ে গেছে। কিন্তু এবার তো পুরোটাই ভিন্ন। না সে ঈশার সামনে আসছে আর না তার সাথে কথা বলছে। কথা না বলুক। সামনে আসলে তাও তো মানানো যায়। সামনে আসছে কিন্তু সেই সময় কথা বলার মতো সুযোগ থাকছে না। কারন পুরো পরিবার তখন উপস্থিত থাকছে। আর সেটারই সুযোগ নিচ্ছে ইভান। অসহায় মুখ করে বিড়বিড় করে বলল
–সবার সামনে আদর্শ সামির দায়িত্ব পালন করছে কিন্তু পরে ঠিকই খারাপ ব্যবহার করছে। খারাপ আর কই ব্যবহারি তো করছে না।

–কিসব একা একা বিড়বিড় করছিস?

চমকে পিছনে ঘুরতেই দেখল ইরিনা দাড়িয়ে আছে। নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–কিছু না। তুমি কখন এলে?

ঈশার কথার উত্তর দেয়ার আগেই পাশের ছাদে চোখ গেলো তার। ইফতি আর ঈশান কি নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছে। ইরিনার দৃষ্টি তাক করেই ঈশা সেদিকে তাকাল। তাদের কথার মাঝেই ইলু চায়ের কাপ নিয়ে ছাদে এলো। ঈশা একটু এগিয়ে গিয়ে গলা তুলে বলল
–তোমরা ওখানে কি করছ?

ঈশার কথা শেষ হতেই ইভান ছাদে এসে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। ঝাঝাল গলায় বলল
–আসতে কথা বলা যায়না?

ঈশা ভয় পেয়ে চুপ করে গেলো। কারন অপারেশন হওয়ার পর থেকে ঈশার জোরে কথা বলা শুনলেই ইভান রেগে যায়। আগেও কয়েকবার বলেছে। কিন্তু ঈশা ভুলে যায়। আর রাগ করার কি আছে সেটাই বুঝতে পারেনা। জোরে কথা বলতে তার তো কোন প্রব্লেম হয় না। তাহলে ইভানের সমস্যা কি। ইরিনা সিঁড়ির দিকে ঘুরে ঈশার উদ্দেশ্যে বলল
–চল। ঐ বাড়িতে যাই।

ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরিনার সাথে চলে গেলো। ছাদে উঠতেই ইলু বলল
–তোদের জন্য চা আনিনি। ঈশা তুই নিচে গিয়ে একটু কষ্ট করে চা নিয়ে আয় না।

ঈশা কোন কথা বলল না। সোজা নিচে চলে গেলো। ইভানের মা রান্না ঘরেই ছিল। পিছন থেকে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তিনি একটু চমকে উঠে বলল
–আরে তুই কখন আসলি?

ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
–এই তো। উপরে চা নিয়ে যেতে বলল।

ইভানের মা আঙ্গুল তাক করে বলল
–ঐ যে গরম করে নে।

ঈশা চুপচাপ চা গরম করে কাপে ঢেলে নিলো। ইভানের মা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে? মন খারাপ নাকি তোর?

ঈশা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–না বড় মা। এমনিতেই।

ইভানের মা আর কথা বাড়ালেন না। ঈশা চা নিয়ে চলে গেলো ছাদে। ছাদে গিয়ে দেখে সবার হাতে চায়ের কাপ শুধু ইভানের হাতে নেই। ঈশা এগিয়ে গিয়ে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। ইভান রেলিঙ্গের উপরে এক পা তুলে বসে আছে। তার মুখের এক পাশে রোদ পড়েছে। ঈশা ইভানের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে পিছনে এসে দাঁড়ালো। ইভান ঈশার দিকে তাকাল না। ঈশা পিছনে রেলিঙ্গে হেলানি দিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি রে ঈশা তুই এরকম বিধবাদের মতো সাদা কামিজ পরেছিস কেন? মনে হচ্ছে তোর জামাই মরে টরে গেছে।

ইভান চায়ের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে কেবল মুখে দিয়েছে। ইরিনার কথা শুনেই গলায় আটকে গেলো। কাশতে লাগল। ঈশা ঈশানের হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে এগিয়ে দিলো ইভানের দিকে। ইভান সেটা নিয়ে পানি খেয়ে ইরিনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ইরিনা বুঝতে পারল সে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। একটু হকচকিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুচকে একটু ভাবল। ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–আমি জলজ্যান্ত মানুষটা তোর সামনেই বসে আছি। আর তুই আমাকে মেরে ফেললি?

ইরিনা এবার বুঝতে পারল সে কি বলেছে। অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বলল
–না মানে ভুলে বলে ফেলেছি। ভুলে গিয়েছিলাম যে তুমিই ওর বর।

সবাই ঠোট চেপে হেসে ফেলল। ইভান তীক্ষ্ণ চোখে সবার দিকে একবার তাকাল। ইফতি এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলল
–ইভান ভাইয়া তুমি ব্যচেলর থেকে ম্যারিড হয়ে গেলে। সেই হিসেবে অন্তত একটা ট্রিট দেয়া উচিৎ ছিল। কি বল ভাবি আপু?

কথা বলে ঈশার দিকে তাকাতেই সে ভ্রু কুচকে বলল
–এটা কি ধরনের ডাক?

ইফতি দাত কেলিয়ে বলল
–ছোট বেলা থেকেই তোমাকে আপু বলে এসেছি। এখন বড় বেলায় ভাবি হয়ে গেলে। এখন আপু টা কিছুতেই ছাড়তে পারছিনা। তাই আর কি। আর বড় বেলায় যে ভাবি হয়ে যাবে সেটা তো বুঝতে পারিনি। তুমি ছোট বেলায় বলে দিলেই তখন থেকেই ভাবি বলে ডাকতাম। তাহলে আর আমার অসুবিধা হতনা।

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। সবাই শব্দ করে হেসে ফেলল। ইভান ঠোট চেপে হাসল। কিন্তু ঈশা পিছনে থাকায় সেটা দেখতে পেলনা। ইফতির কথায় সে বেশ বিরক্ত হল। কিন্তু ঈশান তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল
–একদম ঠিক। তুই এভাবেই ডাকবি। শুনতে ভালই লাগছে। আন কমন নাম।

ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোর এক মাত্র দেবর শখ করেছে। তুই বাধা দিস না।

বলে আবারো সবাই হাসতে লাগল। ঈশা সবার উপরে বেশ বিরক্ত হল। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই ইলু বলল
–তবে ইভান ভাইয়া ইফতি কিন্তু ভুল কিছু বলে নি। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো। কি হল সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না। অন্তত বোঝার সুযোগটা তো দাও।

ইভান একটু চুপ থেকে বলল
–কোথায় যাবি? আজ রাতে চল।

সবাই খুশি হয়ে গেলো। জার জার পছন্দ মতো বলতে লাগল। সেটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষন ঝগড়া চলল। অবশেষে একটা রেস্টুরেন্ট ঠিক করলো সবাই মিলে। ইভান সম্মতি দিতেই ঈশা ভ্রু কুচকে একটু ভাবল। তারপর মুখ বাকিয়ে বলল
–আমি যাব না। তোমরা যাও।

ঈশার কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকাল। ঈশান বলল
–তুই যাবি না মানে?

ঈশা মলিন কণ্ঠে বলল
–আমি যাবনা এটার আবার কি মানে হয়?

ইরিনা বিরক্তিকর গলায় বলল
–ঈশা এমন করিস না।

ঈশা কিছুতেই রাজি হল না। সবাই ঈশার উপরে বেশ বিরক্ত হল। সহজেই ইভান রাজি হয়ে গেলো। আর ঈশার নাটক শুরু হল। এখন যদি কোনভাবেই ইভান প্ল্যান ক্যান্সেল করে দেয়? সবার কথার মাঝেই ইভান সামনে ঘুরে বলল
–ঈশা যেতে না চাইলে জোর করিস না। ও তো এখনও পুরপুরি সুস্থ না। রেস্ট নিক।

ইভানের কথা শুনে সবাই থেমে গেলেও ঈশার মনে হল কেউ তার গায়ে ফুটন্ত গরম তেল ঢেলে দিলো। কারন সে ভেবেছিল যেতে না চাইলে সবার সামনে হয়তো ইভান তাকে জোর করবে। কারন সে তো সবার সামনে ভালো সাজে। কিন্তু এখানে তো পুরই উলটা ব্যাপার ঘটে গেলো। এখন কি হবে? কিভাবে বলবে সে যাবে? বিরক্ত হয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। ঈশা নেমে যেতেই ইভান মুচকি হাসল। কারন সে বুঝতে পেরেছে ঈশার এমন নাটকের কারন। সবাই ঈশার এমন আচরন দেখে একটু অবাক হল। ইলু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল
–ঈশার কি কিছু হয়েছে?

ইভান শান্ত গলায় বলল
–তেমন কিছু না। মেডিসিনের কোর্স এখনও চলছে তো। পাওয়ার ফুল মেডিসিন নেয়ার ফলেই একটু মুড সুইং হচ্ছে।

————–
ভর সন্ধ্যা বেলা। রাস্তায় অনেক লোকজন। ল্যাম্পপোস্টের সাথে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে ইভান। ঈশান হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল
–মেয়েদেরকে নিয়ে কোন জায়গায় যাওয়া খুব প্রব্লেম। কখনই সময় মতো বের হতে পারেনা।

ইভান মুচকি হাসল। কোন কথা বলল না। ঈশান বিরক্তিকর শব্দ করে বলল
–ইফতি কোথায়?

ইভান ফোন থেকে মুখ তুলে ঈশার বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলল
–ঈশাকে আনতে গেছে।

ঈশান ইভানের দিকে ঘুরে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল
–ঈশা নাকি যাবে না?

ইভান ঠোট কামড়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–যাবে।

ঈশান সামনে ফিরতেই ইভান হাসল। ঈশা ইভানের উপরে রাগ করে বাসায় চলে গিয়েছিলো। কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে যাবেই না। কিন্তু যখন জানতে পারল যে শুধু তার কাজিনরা না ইভানের দুই জন মেয়ে বন্ধুও আসছে তখন থেকেই ঈশার মাথা আরও গরম হয়ে গেলো। সে কিছুতেই আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। কারন ওর মধ্যে একজন মেয়ে ইভানের গায়ে পড়ে সেটা ঈশার জানা আছে। এভাবে নিজের জেদ আর আত্মসম্মান ধরে রাখতে গিয়ে নিজের বরকে বিসর্জন দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। তাই সব কিছু ভুলে রেডি হয়ে নিলো। ইভানও জানতো এটা শোনার পর ঈশা কিছুতেই আর বাসায় থাকতে পারবে না। তাই তো ইফতিকে সেভাবে বলেই পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ইফতি সিঁড়ি দিয়ে নামলো। আর তার পিছনে ঈশা নিজের চুল ঠিক করতে করতে আসছে। এপাশে ইরিনা আর ইলুও এসে পড়েছে। ঈশান সামনে দাড়িয়ে রিক্সা দেখছে। সে রিক্সা থামাল। ঈশান ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি তোমার বউকে নিয়ে যাও আমরা আসছি।

ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার দিকে তাকিয়ে রিক্সায় উঠতে ইশারা করলো চোখ দিয়ে। ঈশা কোন কথা না বলে উঠে বসলো। ইভান তার পাশে বসে পিছনে ঘুরে বলল
–তোরা আয়।

বলেই চলে গেলো। এলোমেলো হাওয়া বইছে শিরশির করে। ঈশার আধ খোলা চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে। ওড়না এক পাশে উড়ে চলে যাচ্ছে। যে কোন সময় চাকায় ঢুকে যেতে পারে। ঈশা খেয়াল করেনি। ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে গেলো। হঠাৎ এমন হওয়ায় ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সেদিকে না তাকিয়েই ওড়নাটা ধরে কোলে তুলে দিলো। ইটের টুকরোর উপরে রিক্সার চাকা উঠতেই ঈশার দিকে হেলে গেলো। ঈশা ভয় পেয়ে ইভানের হাত চেপে ধরল। ইভান আর এক হাতে ঈশাকে ধরল। তাকে ধরে নিয়েই নিজে সোজা হয়ে বসলো। রিক্সা ওয়ালা মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আসতে চালাও মামা।

রিক্সার গতি কমে গেলো। সাথে ঈশার হাত আলগা হল। ছেড়ে দিলো ইভানের ধরে থাকা হাত। কোলে রাখা ওড়নাটা চেপে ধরল। ইভানের হাত আলগা হল না। সে আগের মতো করেই ধরে রাখল। সারা রাস্তা কেউ কোন কথা বলল না। মান অভিমানের মাঝেই শেষ হয়ে গেলো পথ। চলে এলো গন্তব্য। রিক্সা থামতেই ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা নেমে গেলো। পর পর সব রিক্সা এসে থামল। ঈশা ইলুর কাছে এসে দাঁড়ালো। ইভানের বান্ধবীরাও এসে পড়েছে। দুইজনই ইভানের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। একজন বলল
–কিরে কতক্ষন থেকে ওয়েট করছি। এতো দেরি করলি যে?

ইভান কিছু বলার আগেই আর একজন বলে উঠল
–এখন আর ও কি আগের মতো সময়ে আসতে পারে? এখন তো অনেক কিছু মেইনটেইন করতে হয়। বিবাহিত বলে কথা।

বলেই দুজন হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল
–তোর বউ কই?

ইভান ঈশার দিকে তাকাতেই দুজনি সেদিকে এগিয়ে গেলো। একটু হেসে বলল
–তুমি ঈশা রাইট?

ঈশা হেসে মাথা নাড়াল। তাদের মধ্যে একজন বলল
–তোমার বর কিন্তু বিয়ের আগে আমার ক্রাশ ছিল।

কথাটা শুনেই ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছু বলল না। অপরজন বলল
–এখন এসব ভুলে যা। তোর ক্রাশ কিন্তু এখন বিবাহিত। এসব বলে ওদের সংসারে আগুন জালানর কোন মানেই হয়না।

ইভান পিছন থেকে বলল
–আমার বউ সেরকম না। অনেক ব্রড মাইন্ডের। আমি মেয়েদের নিয়ে ঘুরাফেরা করলেও কিছুই ভাববে না।

ইভানের কথা শেষ হতেই ঈশা তার দিকে তাকাল। ভীষণ অভিমান হল তার। চোখ ছলছল করে উঠল। ইভান বুঝতে পেরেও সেদিকে পাত্তা দিলো না। সামনে এগিয়ে গেলো। এবার লিফটে উঠার পালা। ঈশা সবার পিছনে দাড়িয়ে আছে। ইভান মেয়ে দুইটার সাথে লিফটের দরজার সামনে। ঈশা ভাবছে আগের বারের মতো ইভান তার ধরবে না। তাহলে উঠবে কিভাবে। এগিয়ে গিয়ে ইলুর পাশে দাঁড়ালো। লিফট এসে থামতেই ঈশার অসস্তি হল। ইলুর হাত চেপে ধরার আগেই ইভান বলল
–সবার এক সাথে লিফটে জায়গা হবে না। তোরা যা আমরা পরে আসছি।

সবাই এক এক করে লিফটে উঠে গেলো। শুধু ঈশা আর ইভান থেকে গেলো। লিফট চলে যেতেই ঈশা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে নিলো। এখনও তার শারীরিক দুর্বলতাটা কেটে উঠেনি। একটু আগের ভয়ে মাথা ঘুরে উঠেছিল। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে চোখ খুলে দেখল ইভান লিফটের দরজার সামনে দাড়িয়ে ভ্রু কুচকে ঠোট কামড়ে নিজের চুল ঠিক করছে হাত দিয়ে। ঈশা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ছেলে মানুষ কি এতো সুন্দর হতে পারে? পারে তো! নাহলে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে দেখে সে বারবার এভাবে মুগ্ধ হতোনা। তার সৌন্দর্য দেখে লজ্জার শেষ সীমাটুকু অতিক্রম করে তাকিয়ে থাকত না। ঈশার ভাবনার মাঝেই টুং আওয়াজ করে লিফট নেমে এলো। তার ঘোর কেটে গেলো। একটু নড়েচড়ে ইভানের পাশে এসে দাঁড়ালো। লিফটের দরজা খুলতেই ইভান ভিতরে ঢুকে গেলো। ঈশা দাড়িয়ে থাকল। ঢোক গিলে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল ইভান অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাত ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাত ধরে ফেলল। ঈশা ভিতরে ঢুকতেই ইভান হাত ছেড়ে দিলো। ঈশার হার্ট বিট বেড়ে গেলো। জোরে জোরে শ্বাস নিতেই দুর্বলতার কারনে মাথা ঘুরে গেলো। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই খেয়াল করলো নিজের কোমরে হাতের স্পর্শ। কিছু বুঝে উঠার আগেই ইভান তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ইভানের চোখের দিকে তাকাতেই ঈশার পুরো শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। ইভানের হাত আরও গভির ভাবে কোমরে স্পর্শ করলো। ঈশা ঠোট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান আরও কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ঈশাকে। ঈশা লিফটের কথা ভুলেই গেলো। সে এখন চরম অসস্তির মাঝে ডুবে আছে। ইভান ঈশার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। আবারো টুং আওয়াজ হতেই লিফট থেমে গেলো। ঈশা চোখ খুলে ফেলল। দরজা খোলার আগেই ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। দরজা খুলতেই দেখল সবাই সামনে দাড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশা লিফট থেকে নেমে শুকনো ঢোক গিলে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। এতক্ষন যা হল সবটা ঈশার মাথার উপর দিয়ে গেলো। তার অবস্থা দেখে যে কেউ ভাববে এতক্ষন দম বন্ধ হয়ে ছিল। গলায় জমে থাকা ঘাম ওড়নার মাথা দিয়ে মুছে ফেলল। ইরিনা এগিয়ে এসে বলল
—কি রে ঈশা তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?

ঈশা মাথা নাড়িয়ে না বলল। ইভান পাশে দাড়িয়ে বলল
–শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মাত্র ছাড়া পেল তো। ঘোর কাটতে একটু সময় লাগবে।

ইফতি এগিয়ে এসে ভ্রু কুচকে বলল
–মানে?

ইভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঈশা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–আমার লিফটে ফোবিয়া আছে তুই জানিস না?

ইফতি মাথা নাড়িয়ে বলল
–ওহ! হ্যা। জানতাম। ভুলে গেছিলাম।

ইভান ঠোট টিপে হাসল। ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। তারা রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকল। নিজেদের মতো পাশা পাশি দুইটা টেবিলে বসে পড়ল।

———-
পরিষ্কার আকাশে এক ফালি চাঁদ। তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে। ঈশা মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ রাত হওয়ায় রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। রিক্সা চলছে প্রচণ্ড গতিতে। মাঝে মাঝে টুং টাং আওয়াজ কানে আসছে। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষন। পাশ ফিরতেই ঈশাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও তাকাল। বেশ ভালো লাগছে। কি মনে করে হঠাৎ পিছনে ঘুরে দেখল। ইলু আর ইফতি এক রিক্সায়। তারা কি একটা কথা নিয়ে বেশ গম্ভির ভাবে আলোচনা করছে। যেন এই মুহূর্তে এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইভান একটু গলা তুলে বলল
–ঐ ইলু। নতুন ব্রিজের ঐ দিকটায় ঘুরতে যাবি?
ইভানের কথা কানে আসতেই ঈশার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মাথা নামিয়ে ইভানের দিকে ঘুরে তাকাল। সে ইলুর দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছে। আর ইলু এমন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন ভুত দেখছে। ঈশা সাথে সাথেই মাথা বেকিয়ে ইলুর দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ দিতেই ইলু হেসে ফেলল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ইভান সামনে ঘুরে দেখল ঈশা পিছনে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। ঈশা সামনে ঘুরে ভদ্র মেয়ের মতো ঠিক হয়ে বসলো। দুজনের ঠোটের কোনেই চাপা হাসি। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ঈশা হঠাৎ করেই পায়েলটা সামনে ধরল। ইভান সেটার দিকে একবার তাকাতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে ঈশা পায়েলটা পরেনি। মুখ ফিরিয়ে নিলো আর একদিকে। ঈশা ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বলল
–নিজে হাতে পরিয়ে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো?

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার হাত থেকে পায়েলটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলো। আবার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ঈশার চোখে পানি টলমল করে উঠল। সে কি আবারো না বুঝে ইভান কে কষ্ট দিয়ে ফেলল?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here