#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ১৭,১৮
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৭
নিরিবিলি সকাল। মস্তিষ্কে অগোছালো ভাবনার বিচরণ। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে দিনের শুরু। কোন কাজ না পেয়ে শেষে টিভির সামনে বসে পড়ল। এলোমেলো ভাবে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে ঈশা। কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না তার। আজ একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। তাই এখন আর সময় কাটছে না। আজ কাল টিভিতেও তেমন ভালো কিছুই হয় না। খুব বিখ্যাত একটা চ্যানেলে এসে থেমে গেলো সে। কোন এক সিরিয়ালে চরম রকমের ঝগড়া চলছে। বউ শাশুড়ির ঝগড়া। বউ নিজের যোগ্যতা প্রমান করতেই ব্যস্ত। আর শাশুড়ি বউকে একের পর এক টাস্ক দিয়েই যাচ্ছে। যাতে সে কোন ভাবেই যোগ্যতা প্রমান করে উঠতে না পারে। আর বেচারা নায়ক দু চোখ দিয়ে সব কিছু শুধু দেখেই যাচ্ছে অসহায়ের মতো। ঈশা ভলিউম টা একটু বাড়িয়ে দিলো। রিমোট হাতে ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। চমর সাসপেন্সের ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ এসে তার নাম ধরে প্রচণ্ড গতিতে কানের কাছে চিৎকার করে উঠল। ঈশা চমকে উঠল। হাত থেকে রিমোট পড়ে গেলো। অতি বিরক্ত নিয়ে পাশে ঘুরে তাকাল। ইভানের মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রচণ্ড রেগে আছে সেটা দেখেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু সকাল সকাল এরকম অগ্নি মূর্তি ধারন করার কারণটা বোধগম্য হল না তার। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে বড় মা?
বলেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে আবার বলল
–এরকম সেজে গুজে কোথাও যাচ্ছ? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছ?
ইভানের মা পাশে বসে পড়ল। ঝাঝাল গলায় বলল
–কখন থেকে ডাকছি। এমন ভাবে ঢুকে গিয়েছিস যে আশে পাশের কোন খেয়াল নেই।
ঈশা মিনমিনে গলায় বলল
–সিরিয়াল দেখছিলাম তো। তাই খেয়াল করিনি।
ইভানের মা ধমক দিয়ে বললেন
–এসব কি সিরিয়াল দেখিস? বউ শাশুড়ির ঝগড়া শিখছিস? আর আমার বাসায় গিয়ে এসব করার পরিকল্পনা করছিস? সংসারে আগুন লাগানোর পরিকল্পনা তাই না?
ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশার মা হেসে ফেলল এসব কথা শুনে। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভানের মা আবার বলল
–ভালো জিনিস দেখবি। কিভাবে শশুর শাশুড়ির খেয়াল রাখতে হয় সেসব শিখবি আর সেবা করবি। আদর্শ বউ হবি বুঝলি?
ইভানের মা থামতেই ঈশা তাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে বলল
–তুমি তো শাশুড়ি না। তুমি তো বড় মা। কেন শুধু শুধু শাশুড়ি সাজতে চাইছ। তোমাকে মোটেই মানাচ্ছে না।
ইভানের মা গম্ভির গলায় বলল
–এসব বলে কোন লাভ হবেনা। এখন ছাড় পাচ্ছ বলে যে পরেও ছাড় পাবে তা কিন্তু না। যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমরা একটু বাইরে যাব।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কই যাব?
–মার্কেটে। তোকে নিয়ে যাব। চল। রেডি হয়ে নে।
ঈশা আর কথা বাড়াল না। কারন আজ একটু বেশী গরম মনে হচ্ছে। সকাল সকাল না গেলে গরম আরও বেড়ে যাবে। উঠে নিজের ঘরে গেলো। বেছে বেছে আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা কামিজ বের করলো। রেডি হয়ে বের হয়ে এলো। বাইরে এসে দেখে ইভানের মা আর ঈশার মা বসে গল্প করছে। ঈশা বের হয়েই বলল
–আমাকে কেমন লাগছে বড় মা?
মাথায় ওড়নাটা লম্বা করে টেনে দেয়া। আহামরি কোন সাজ নেই। ইভানের মা উঠে দাড়িয়ে বলল
–খুব সুন্দর লাগছে। একদম আমার বাড়ির বড় বউয়ের মতো।
ঈশা একটু লজ্জা পেল। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনি বের হয়ে গেলো।
—————
আবহাওয়াটা বেশ গরম। মার্কেটে মানুষের ভিড়ে আরও গরম লাগছে। ক্লান্ত শরীরে দুই হাত ভর্তি ব্যগ ধরে ঈশা আর ইভানের মা দাড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। একটা রিকশা সামনে দেখতেই ঈশা হাত উচিয়ে ডাকল। পাশে ঘুরে দেখে ইভানের মা নেই। এদিক সেদিক তাকাতেই খেয়াল করলো তিনি পাশের দোকানে কি যেন কিনছেন। দোকানদার কে টাকা দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে বললেন
–রিকশা পেয়েছিস?
ঈশা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল
–কই গিয়েছিলে তুমি? উঠে পড়।
ইভানের মা উঠে বসলো রিকশায়। ড্রিংকসের বোতলটা ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–এটা আনতে গিয়েছিলাম।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কিন্তু এগুলা তো তোমার পছন্দ না। তাহলে কিনলে কেন?
ইভানের মা মৃদু হেসে বললেন
–তোর তো পছন্দ। তোর জন্য কিনেছি।
ঈশা গভির দৃষ্টিতে তাকাল। ছেলের মতো মাও তার পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখে। মেয়ে নেই বলে ঈশাকে সে একদম নিজের মতো ভালবাসে। ঈশার মা ছোট বেলায় তাকে মারার জন্য ইভানের মায়ের কাছে কত যে বকা খেয়েছে তার হিসাব নেই। খুশি হয়ে একটু জড়িয়ে ধরে বলল
–থ্যাঙ্ক ইউ বড় মা।
দুজনে নিজেদের মতো গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলো বাসায়। ঈশা রিকশা থেকে নেমে কিছু একটা ভেবে বলল
–বড় মা। আমি বাসায় যাই। গিয়ে গোসল করব।
ইভানের মা আপত্তি জানাল। বলল
–এখনি না। আগে আমার সাথে উপরে যাবি তারপর বাসায়।
কিন্তু এতে কোন লাভ হল না। ঈশা জোর করে বলল
–আমি একদম ঘেমে গেছি। এখনি গোসল করে ফ্রেশ না হলে ঠাণ্ডা লাগবে। পরে আবার আসব তো।
আর কিছু বলতে পারলো না। রাজি হয়ে গেলো। তিনি ‘আচ্ছা’ বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অর্ধেক সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতেই ইভানের সাথে দেখা হল। ইভান বাইরে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। মা তাকে দেখে বলল
–কোথাও যাচ্ছিস?
ইভান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–হুম। একটু কাজ আছে।
ইভানের মা আর কথা না বলে উপরে চলে গেলেন। ঈশা তাদের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসল। আসলে সে নিচ থেকে ইভানের বারান্দায় দেখেছিলো তাকে রেডি হয়ে দরজা লাগাতে। বুঝে গিয়েছিলো ইভান এখন বাইরে যাবে। তাই বাসায় যাওয়ার বাহানা করে ইভানের জন্য অপেক্ষা করছে সিঁড়ির নিচে। ইভান শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। হঠাৎ করেই সামনে চোখ পড়ল। ঈশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলো। সাদা মাটা চেহারায় ঈশাকে অদ্ভুত লাগছে। শুভ্র রঙটা যেন তার চেহারার সৌন্দর্য হাজার গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইভানের মনেও ঠিক একি রকম অনুভুতি হচ্ছিল। এই মুহূর্তে ঈশাকে খুব মিস করছিল সে। মনে হচ্ছিল কোনভাবে এক পলক দেখা পেলে তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মন সতেজ হয়ে উঠবে। ইভান ধির পায়ে শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই ঈশা সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোট্ট একটা বক্স তার দিকে এগিয়ে দিলো। ইভান ভ্রু কুচকে বক্সটার দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষন পর হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো। কোন কথা বলার আগেই ইরিনা এসে মাঝখানে দাড়িয়ে বলল
–ওহো! এখানে দেখছি আদান প্রদান হচ্ছে। তো কি আদান প্রদান হচ্ছে শুনি?
ঈশা একটু বিরক্ত হল ইরিনার উপরে। এই সময়েই তাকে আসতে হল। একটু পরে আসলে কি ক্ষতি হতো। তেমন কিছু না হলেও ধন্যবাদটা বলতো সুন্দর করে। এখন হয়তো সেটাও আর বলবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। একটা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়তেই ইভান বলল
–তুই একটু ভুল বলেছিস। সবে আদান হয়েছে। এখনও প্রদান বাকি।
ইরিনা আর ঈশা দুজনেই এমন অদ্ভুত কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভানের কথার মানে যে কেউ বুঝতে পারেনি সেটা বুঝেই সে একটু হাসল। আর একটু এগিয়ে এসে ঈশার কাছাকাছি দাড়িয়ে ইরিনাকে বলল
–তাহলে এখন প্রদানের কাজটা সেরে ফেলি। কি বলিস?
ইরিনা না বুঝেই মাথা নাড়তেই ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে গেলো। ডান গালে আলতো করে একটা হাত রেখে বাম গালে গভির ভাবে একটা চুমু দিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। আচমকাই এমন কিছু হওয়াতে ঈশা হা হয়ে গেলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো সেটাই বুঝতে পারলো না। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম। গরমে ঘেমে পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি শাওয়ার না নিলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
দুই আঙ্গুলে আলতো করে গালে স্পর্শ করে বলল
–বি কেয়ার ফুল। ঠাণ্ডা যেন না লাগে।
বলেই চলে গেলো। ঈশা হা হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। ইরিনা হেসে ফেলল। ঈশার দিকে তাকাতেই ঈশা বলল
–আমাকে একটা চিমটি কাটবে ইরিনা আপু? প্লিজ!
ইরিনা ঈশার কথা শুনে আরও জোরে হেসে ফেলল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–পাগল হওয়ার কথা ছিল আমার আর পাগলামো করছ তুমি। আর আমি এখনও বুঝেই উঠতে পারলাম না বাস্তব না কল্পনা।
ইরিনা ঈশার হাতে জোরে চিমটি কাটতেই সে চিৎকার করে উঠল। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন ইরিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বুঝে উঠতেই মুচকি হেসে তার গালে একটা চুমু দিলো। ইরিনা আবারো হেসে বলল
–তোর উপরে ইভান ভাইয়ার ভুতটা ভর করেছে।
ঈশা হেসে বলল
–এরকম জানলে আরও আগে ভুতকে নিমন্ত্রন জানাতাম। নিমন্ত্রন জানাতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।
দুজন মিলে অট্ট হাসিতে মেতে উঠল। খানিকবাদেই ঈশা বলল
–থাক আমি বাসায় যাই। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?
ইরিনা বলল
–বড় মার কাছে যাচ্ছিলাম।
ঈশা বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছে আর কিছুক্ষন আগের কথা ভাবছে। ভেবেই ঠোট কামড়ে হাসল। বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজাতেই তার মা দরজা খুলে দিয়ে বলল
–কি রে এসেছিস? দেখি কি কি কিনলি?
ঈশা ব্যাগ গুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গালে একটা চুমু দিলো। ঈশার মা তার আচরনে বেশ অবাক হল। ভ্রু কুচকে বলল
–আজ হঠাৎ করে এতো ভালবাসা উতলে পড়ছে যে?
ঈশা ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পিছনে ঘুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–ভালবাসা তো হঠাৎ করেই আসে মা।
বলেই ঘরে চলে গেলো। মেয়ের এরকম উদ্ভট আচরন দেখে তার মা বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। ঈশা ঘরে গিয়ে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে। অনেকটা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। এসেই টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিন অন হতেই চোখে পড়ল ইভানের মেসেজ।
“যাকে এক পলক দেখার মাঝে এক আকাশ সম তৃপ্তি! যার কাজল জড়ানো মায়াবি চোখে হৃদয় হরনের ক্ষমতা। যার মুচকি হাসিতে অনাবিল সুখ! সেই তুমিটা শুধুই যে আমার।”
চলবে…………
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৮
হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকে। কিছু কিছু মুহূর্ত বিশেষ হয়ে জীবনের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। সেসব ঘটনা এক সময় হয়ে যায় সুখময় স্মৃতি। দুইদিন যাবত ভ্যাপসা গরমে জন জীবন বিপর্যস্ত। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে তাল পাকা গরম। দিন ছোট হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে। সেই বিশ্রী গরমে একদল তরুন তরুণী সন্ধ্যে বেলায় ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। নিজেদের মতো ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। কাজিনদের আড্ডার মাঝেই হঠাৎ করেই আকাশে বিজলির ঝলকানি চোখে পড়ল। গরম কেটে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা হিম বাতাস বইতে লাগলো। উপরের দিকে তাকিয়ে ইফতি বলল
–বৃষ্টি হবে মনে হয়।
ইলু আর ইরিনা এক সাথে বলে উঠলো
–বৃষ্টি হলে ভিজব। কতদিন বৃষ্টিতে ভিজিনা।
সবাই সম্মতি দিলো। এমন কি ছোট্ট ইরা ইভানের কোলে বসে ছিল। গলা জড়িয়ে বলল
–ইভান ভাইয়া আমিও ভিজব।
ইভান গাল টেনে বলল
–ঠিক আছে। বৃষ্টি আসুক তখন ভিজব আমরা।
খানিকবাদেই অনেক জোরে মেঘ ডেকে উঠলো। ঈশান ঈশাকে বলল
–তুই এক পাশে গিয়ে দাড়া ঈশা। তোর মাথায় বৃষ্টির পানি পড়লে অসুবিধা হবে।
ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–বৃষ্টি আসুক আমি নিচে চলে যাব।
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কোন কথা বলল না। কিছুক্ষন পরেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। সবাই খুশি হল। ঈশা নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাতে টান পড়ল। পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান তার হাত ধরে আছে। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইভানের দিকে। ঈশা ততক্ষনে কাক ভেজা হয়ে গেছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–একটু ভিজলে তেমন কিছু হয়না।
হাত ছেড়ে দিয়ে সবার দিকে তাকাল। সবাই ইভানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কারন ঈশার বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে ইভানের সব থেকে আগে আপত্তি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সেই ভিজতে বলছে। ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজলে মন শরীর দুইটাই ভালো থাকে। তাছাড়াও সায়েন্টিফিক্যালি প্রুভড যে বৃষ্টির পানি ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু বেশী সময় নিয়ে ভিজলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–জাস্ট ১০ মিনিট কিন্তু!
ঈশা মাথা নাড়ল। ঠোটের কোনে চাপা হাসি। সবাই নিরবতা ভেঙ্গে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ইরা ইভানের কোল থেকে নেমে গেলো। ইভান রেলিঙ্গে বসে ইরাকে বলল
–টুনটুনি জোরে দৌড়াস না। পড়ে যাবি।
ঈশা ইভানের পাশে গিয়ে বসলো। ইভান হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঠিক করছে। ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকাল। তারপর তার ঘাড়ে মাথা রাখল। ইভান ঈশার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। মাথাটা ঈশার অনেকটা কাছে নিয়ে গেলো। ইভানের চুল বেয়ে ঈশার মুখে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। বেশ কিছুটা সময় ওভাবেই দুজনের নিরব অনুভুতির আদান প্রদান হল। কিছু সময় পরে ইভান মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল
–আর ভিজতে হবে না। নিচে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে নে। ঠাণ্ডা লাগবে পাখি।
ঈশা কোন কথা বলল না। উঠে ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে নিচে চলে গেলো। বাসায় ঢুকতেই ঈশার মা তাকে এভাবে ভিজতে দেখে চেচামেচি শুরু করে দিলো। কিন্তু সেসব কথা ঈশার কানেই গেলনা। তার কানে শুধু ইভানের কথাই বাজছে। সেই সময় ইভান ছাদ নেমে এলো ইরাকে নিয়ে। এভাবে সবাইকে অসময়ে ভিজতে দেখে ঈশার মা আরও রেগে গেলো। ইভান বিচক্ষণতার সাথে পুরো বিষয়টা সামলে নিলো। ঈশার মা আর কিছু বলল না। ইরাকে নিয়ে গেলো ভিতরে। ঈশা দরজার দিকে ঘুরতেই ইভান মৃদু সরে ডাকল।
–ঈশা।
ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভান কাছে এসে দাঁড়ালো। আলতো করে কপালে লেপটে থাকা ভেজা চুলগুলো এক আঙ্গুলে সরিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–এত সুন্দর একটা উপহারের জন্য ধন্যবাদ।
কথা শেষ করে ছেড়ে দিয়ে দূরে গেলো। ঈশা দাড়িয়ে থাকল। ইভান সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। কিছুদুর গিয়ে নামতে নামতেই বলল
–আমাকে দেখা হয়ে গেলে দয়া করে চেঞ্জ করে নেন ম্যাডাম।
ঈশা হেসে ভিতরে চলে গেলো। এটা সত্যিই জীবনের সুখময় স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। জীবনের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখার মতো কিছু ভালবাসার মুহূর্ত।
————
বারান্দার গ্রিলের ফাক দিয়ে মাথা বের করে দেয়া হলুদ অল্কানন্দা ফুলটার গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি লেপটে আছে। কি সতেজ লাগছে। ঈশা চুল গুলো মুছতে মুছতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির তেজটা কমে এসেছে। মেঘ জমে থাকলেও আগের মতো আর তেমন অন্ধকার নেই। তবে এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি থাম বার নয়। একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল ইভান কার সাথে যেন হেসে হেসে গল্প করছে। এখনও ভেজা কাপড়েই আছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ঈশা সেই কখন চেঞ্জ করে বেরিয়েছে। এর মাঝে এক কাপ চাও খেয়েছে। চুলের পানি পড়ছিল তাই শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইভান এখনও এখানে দাড়িয়ে কি করছে? আর কার সাথেই বা কথা বলছে? এতক্ষন ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে জেনেও সে এখানে দাড়িয়ে গল্প করছে। ঈশা দাড়িয়েই দেখছে। জোরে কথা বলতেও পারবে না। নিষেধ আছে। তাই চুপচাপ দেখছে শুধু। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান কথা শেষ করে বাসার ভেতরে চলে গেলো। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়েই অপেক্ষা করছে। দৃষ্টি ইভানের বারান্দায় স্থির। ইভান তোয়ালে মেলে দিতে বারান্দায় আসল। ঈশার বারান্দার দিকে খেয়াল করেনি। ঈশা এগিয়ে গিয়ে ক্ষুব্ধ সরে বলল
–কার সাথে এতো গল্প করছিলে?
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভাবে বলল
–বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম। কেন?
ঈশা ঝাঝাল গলায় বলল
–এতক্ষন ধরে কি কথা বলছিলে?
ইভান বিস্ময়কর চোখে তাকাল। ঈশার এভাবে কথা বলার কারণটা বুঝতে পারলো না। নরম কণ্ঠে বলল
–এভাবে রিয়াক্ট করার কিছু নাই। ছেলে বন্ধু ছিল মেয়ে নয়। নাকি ছেলে বন্ধুর সাথেও কথা বলা যাবে না?
ইভানের কথা শুনে ঈশা প্রচণ্ড রেগে গেলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–ছেলে ছিল না মেয়ে সেটা কি আমি জানতে চেয়েছি? আমার চোখ নাই? আমি দেখিনি?
ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–তাহলে? সমস্যাটা কোথায়?
ঈশা ঝাঝাল গলায় একটু জোরেই বলল
–ভেজা কাপড়ে এতক্ষন বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে গল্প করার কি দরকার ছিল? বন্ধু কি হারিয়ে যাচ্ছিলো। পরে কথা বলা জেতনা? বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসতে। চেঞ্জ করে তারপর কথা বলতে।
ইভান কোন কথা বলল না। নিরব দৃষ্টিতে ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–এরকম ভেজা খোলা চুলে আবেদনময়ী রুপ নিয়ে বারান্দায় আসার কি দরকার ছিল? এরকম হুটহাট বারান্দায় আসা যাওয়া চলতে থাকলে কিন্তু একদিন বারান্দায় আসা বন্ধ করে দেবো। মাথায় থাকে যেন।
ইভানের এরকম ত্যাড়া কথায় চরম রাগ নিয়ে তাকাল ঈশা। সে যা বলতে চেয়েছিল সেটা তো শুনলই না উলটা তাকেই জব্দ করার চেষ্টা করছে। কারন ইভান ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ঈশা এখন অযথাই বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে যাবে আর ঝগড়া করবে। কিন্তু ইভানের এখন কোনভাবেই ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না। তাই যাতে আর কথা না বাড়ায় সেই জন্যই তাকে একটু রাগিয়ে দিলো। রাগে ফুসতে ফুসতে উলটা দিকে ঘুরে বলল
–অসহ্য একটা!
কথাটা স্পষ্ট রুপে ইভানের কান পর্যন্ত পৌছালো। মুচকি হেসে গলা তুলে বলল
–আমি অসহ্য হই বা অসভ্য! সবটা কিন্তু একজনের জন্যই। আর এই সব কিছু সহ্য করতে সে বাধ্য।
ঈশা থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভানের ঠোটে সেই জ্বালাময়ী হাসি। রাগটা কমার বদলে বেড়ে আরো দিগুন হয়ে গেলো। দ্রুত পায়ে হেটে ঘরে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগ কমানর জন্য যা যা করার দরকার সব করলো ঈশা। কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। এক সময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কোন এক গল্পের বইয়ে পড়েছিল যে রাগ হলে নাকি রবিন্দ্র সঙ্গীত শুনতে হয়। তাহলে রাগটা কমে যায়। তাই ফোনে রবিন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে দিলো। বসে বসে মনোযোগ দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করছে। রাগটা কতটুকু কমলো সেটা বোঝার আগেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। এতোটুকু ভালো করে বুঝতে পারলো গান শুনলে রাগ না কমলেও ঘুমটা বেশ হয়। উপায় না দেখে বালিশটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশা। কতক্ষন ঘুমিয়েছে সেটা বুঝতে পারলো না। কানের কাছে চাপা আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ফেলল। ইলু ইরিনা আর ইফতিকে দেখে হুরমুরিয়ে উঠে বসলো। অবাক হল না মোটেই। কারন এরা কখন আসে আর কখন যায় সেটার কোন ঠিক নেই। ক্লান্ত সরে বলল
–তোমরা কখন এলে?
ইলু বলল
–অনেকক্ষণ এসেছি। তুই ঘুমাচ্ছিস তাই ডাকি নি।
ঈশা উঠে ওয়াশ রুমে গেলো। মুখে চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে বের হয়ে এলো। বিছানায় বসে বলল
–কয়টা বাজে?
ইফতি ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল
–৮.৩০ বাজে।
ঈশা চমকে উঠলো। সেই সন্ধ্যা বেলা ঘুমিয়েছে। এখন অব্দি ঘুমাচ্ছিল? আজ নির্ঘাত সারা রাত জেগে থাকতে হবে। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–চা খাবে তো? বানাবো?
ইরিনা বলল
–চা পরে খাবো। আগে ফুচকা, চটপটি এসব খাই।
ঈশা অবাক হয়ে বলল
–এসব কই পেলে?
এর মাঝেই ইলু সব কিছু প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। ঈশা খুব খুশি হল এসব দেখে। সবার সাথে মেঝেতে বসে পড়ল। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে আর খাচ্ছে। খাওয়ার এক পর্যায়ে ঈশা বলল
–কে এনেছে এগুলা?
ইলু একটা ফুচকা মুখে পুরে অস্পষ্ট সরে বলল
–ইফতি এনেছে।
ঈশা ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অনেক ধন্যবাদ ভাই। খুব মিস করছিলাম। কতদিন খাইনা এসব।
ইফতি মুখের ফুচকাটা শেষ করে বলল
–আমি আনিনি তো। ইভান ভাইয়া এনেছে। আমাকে দিয়ে বলল এখানে নিয়ে আসতে। আর সাথে ইলু আপু আর ইরিনা আপুকেও ডাকতে। তাই আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসলাম।
ঈশা ফুচকা টা মুখে ঢুকাতে গিয়েও থেমে গেলো। একটু সময় ভাবল। তার মানে তখনের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এই ব্যবস্থা। একটু হেসে বলল
–তোর ভাইয়া কোথায়?
ইফতি খেতে খেতে বলল
–জানিনা তো। আমাকে দিয়েই চলে গেলো।
ঈশা খাবারটা মুখে পুরে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ইভানকে একটা এস এম এস পাঠিয়ে দিলো।
“প্রিয় জিনিস গুলোর জন্য পছন্দের মানুষটাকে অনেক ধন্যবাদ। যদি এসব রাগ ভাঙ্গানোর জন্য হয়ে থাকে তাহলে ‘আই এম ইম্প্রেসড’ ! এখন আর রাগ নেই।”
মেসেজটা ডেলিভারড হতেই একটু হেসে আবার নিজের খাবারে মনোযোগ দিলো। খানিকবাদেই আবার ফোন বেজে উঠলো। ইভানের মেসেজ দেখেই মনটা খুশি হয়ে গেলো। ওপেন করে দেখল
“এতো প্রিয় জিনিস গুলোর জন্য শুধু শুকনো মুখে ধন্যবাদ? পছন্দের মানুষ আমাকে কোন উপহার দিলে আমি ধন্যবাদের সাথে যে আরও বিশেষ কিছু দেই। সেই বিশেষ কিছুর অপেক্ষায় থাকলাম। আর হ্যা কেউ দিতে না চাইলেও কোন সমস্যা নেই। আমার যা দরকার সেটা আমি সময় মতো নিজে থেকে নিয়ে নেই। সো! গেট রেডি টু গিভ সাম্থিং স্পেশাল।”
মেসেজটা পড়ে ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। সবাই তার দিকে তাকাল। ইফতি পানি এগিয়ে দিলো। পানি খেয়ে ঈশা বোতলটা চেপে ধরে ভাবতে লাগলো। ইভান ঠিক কি বোঝাতে চাইল?
চলবে…………।