শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর_২,সূচনা পর্ব

0
1700

#শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর_২,সূচনা পর্ব
লেখক-এ রহমান

–ঈশা আপু। ইভান ভাইয়া…। ইভান ভাইয়া হাসপাতালে।

হাপাচ্ছে ইফতি। উত্তেজনা আর কণ্ঠের কাঁপুনিতে পুরো কথা শেষ করতে পারল না। ফোনের ওপাশ থেকে ফোঁপানির আওয়াজ শুনেই ঈশা বুঝে গেলো সে কাঁদছে। ‘ইভান হাসপাতালে’ কথাটা মস্তিস্ক ধরতে কিছুটা সময় নিলো। কিন্তু ধরে ফেলতেই ঈশার বুক কেঁপে উঠলো। আঁতকে উঠে বলল
–হাসপাতালে? কি হয়েছে তোর ভাইয়ার?

–এক্সিডেন্ট! তুমি তাড়াতাড়ি আসো। অবস্থা ভালো না।

বলেই হু হু করে কেদে উঠলো ইফতি। ফোনটা কেটে দিলো। টুট টুট আওয়াজ হচ্ছে। তবুও ঈশা ফোনটা কানে ধরে আছে। সেই আওয়াজ কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি কারন ইফতির কথাটা তখনও কানে বাজছে। ইরা পাশেই বসে ছিল। ঈশার কথা শুনেই আন্দাজ করে নিলো ইভানের কোন বিপদ হয়েছে। কিন্তু কি সেটা ধরতে পারল না। কাছে এসে ঈশাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল
–ইভান ভাইয়ার কি হয়েছে আপু?

ঈশার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। তার হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। উদাসীন কণ্ঠে বলল
–এক্সিডেন্ট!

ইরা চমকে উঠলো। হুট করেই শব্দটা শুনেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। গা শিরশির করে উঠলো ভয়ে। কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ঈশার হাত টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল
–আমাদেরকে এখনই যেতে হবে। চলো আপু। দেরি করছ কেন?

ঈশা ইরার দিকে তাকাল। তার কথা মাথায় ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানি টুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। বলল
–চল।

ইরা আর ঈশা বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলো। বাসার কাছেই হাসপাতাল। তাই সময় বেশী লাগলো না। রিক্সা হাসপাতালের সামনে দাড়াতেই দুজন নেমে চলে গেলো ভেতরে। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতেই ইফতিকে দেখতে পেলো। দ্রুত তার কাছে এগিয়ে গিয়ে দাড়াতেই একজন ওয়ার্ড বয় এসে ইভানের কাপড় গুলো ইফতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–এগুলো আপনার ভাইয়ের কাপড়। ওনাকে যখন হাসপাতালে আনা হয়েছিল তখন এগুলই পরে ছিল।

ইফতি কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় গুলো ধরল। সাদা চেক শার্টটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠেছে। সেটা দেখেই আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে যে ইভানের আঘাত কত ভয়াবহ। সেগুলো দেখেই ঈশার ভেতরের আর্তনাদ ভয়াবহ রুপ নিলো। চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ইফতি পাশ ফিরে দেখল ঈশা মেঝেতে পড়ে আছে। ইরা স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি। ইফতির হাত থেকে কাপড় গুলো পড়ে গেলো। সে মেঝেতে বসে ঈশাকে ঝাঁকিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন লাভ হল না। একজন বয়স্ক মহিলা এসে ঈশার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। চোখ হালকা কেঁপে উঠতেই সবাই কিছুটা সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ঈশা চোখ খুলে ফেললো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। কোথায় আছে সেটা বুঝতে পেরেই তড়িৎ গতিতে উঠে বসল। অস্থির হয়ে উঠলো ক্রমশ। ইফতিকে বলল
–তোর ভাইয়া কোথায়?

ইফতি অসহায়ের মতো বলল
–এমারজেন্সিতে।

ঈশা উঠে দাঁড়ালো। এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল
–আমি যাবো। আমি তোর ভাইয়ার কাছে যাবো।

বলেই সামনে পা বাড়াতেই ইফতি বাধা দিলো। টেনে পিছিয়ে এনে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল
–শান্ত হও। তুমি ওখানে যেতে পারবে না। ইলহাম ভাইয়া আছে। ভাইয়ার ব্যান্ডেজ করছে।

ঈশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। হুঙ্কার ছেড়ে বলল
–কেন যেতে পারব না? আমি যাবোই। আমাকে কে আটকাবে?

ইফতি বেশ বিরক্ত হল। ঈশার এরকম আচরন সহ্য করার মতো মন মানসিকতা নেই। কে জানে ইভানের অবস্থা এখন কেমন? ইরা ঈশাকে ধমকের সুরে বলল
–এভাবে জেদ করে তুমি সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল করে ফেলছ। ইভান ভাইয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। অজথা সিনক্রিয়েট করছ কেন? তুমি এরকম করলে কি ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে?

ঈশা চুপ হয়ে গেলো। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি একবার শুধু দেখবো। প্লিজ। আমি কাউকে বিরক্ত করবো না। কোন কথাও বলবো না। শুধু একবার দেখতে দে।

ইরা এবার নিজের রাগটা দমিয়ে রাখতে পারল না। মন মানসিকতা কোনটাই ভালো নেই। অস্থির লাগছে ভীষণ। তাই বাঘিনির মতো শক্ত কণ্ঠে বলল
–আপুউউ! তুমি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছ। আমরা সবাই ইভান ভাইয়ার জন্য চিন্তা করছি। সবাই অস্থির হয়ে আছি। তাই বলে এরকম আচরন করছি না। তোমার বোঝা উচিৎ।

ইফতি হাত বাড়িয়ে ইরাকে ইশারা করলো থেমে যেতে। কারন ঈশা যে এখন সজ্ঞানে নেই সেটা তার আচরনেই বোঝা যাচ্ছে। সে কি করছে সেটা বুঝতে পারলে আর এরকম করত না। ইরা আরও কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। ইফতি খুব নরম কণ্ঠে বলল
–একটু শান্ত হয়ে বসো। ইলহাম ভাইয়া আসলেই সব জানা যাবে। ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।

ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল
–তুই দেখেছিস তোর ভাইয়াকে?

–নাহ!

ইফতির কণ্ঠ কেঁপে উঠলো। ঈশা চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। পানি টলমল করছে। তার ভেতরের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরেই ঈশা চুপ হয়ে গেলো। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলো নীরবতায়। কিছুক্ষন পর ইলহাম হন্তদন্ত করে এলো। তাদের সামনে দাঁড়াতেই তিনজনই উঠে দাঁড়ালো। তিনজনের চোখে মুখে তীব্র ভয় আর এক রাশ কৌতূহল। ইলহাম বুঝতে পেরেই একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। খুব ভয়াবহ অবস্থায় আনা হয়েছিলো। আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ডক্টর না হলে বোধহয় সহ্য করতে পারতাম না। প্রচুর রক্ত ক্ষরন হয়েছে। আর একটু দেরি হলে…।

কথাটা শেষ না করেই ইলহাম চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছাড়ল। এতেই সবাই বুঝে গেলো অবস্থা ঠিক কতটা ভয়াবহ। ইফতি অস্থির হয়ে বলল
–এখন কি অবস্থা?

ইলহাম নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–একবার জ্ঞান ফিরলেই নিশ্চিন্ত।

সবাই ভয় পেয়ে গেলো। ঈশা মৃদু স্বরে বলল
–মানে?

ইলহাম ঠোট ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কিছুক্ষন ওভাবে থেকেই বলল
–মাথায় আঘাতটা বেশী। তাই রিস্কটাও। জ্ঞান ফিরবে না এমন না। তবে…।

ঈশা এবার আর ধৈর্য ধরতে পারল না। চেচিয়ে উঠে বলল
–স্পষ্ট করে বল ভাইয়া। আমি এখন সত্যি অবস্থাটা জানতে চাই। কেমন আছে ইভান?

ইলহাম অসহায়ের মতো তাকাল। বলল
–লাইফ সাপোর্টে আছে।

কেঁপে উঠলো ঈশা। তার সমস্ত কথা বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি দুজনেরও একই অবস্থা। অবস্থার ভয়াবহতা এবার তারা ভালোভাবেই ধরতে পারল। ইরার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। নাক টেনে বলল
–কখন জ্ঞান ফিরবে?

–জানি না।

ভয়াবহ রকমের কেঁপে উঠলো তার কণ্ঠ। কথা বলেই ইলহাম আর দাঁড়ালো না। তার কাছে আর দেবার মতো কোন উত্তর নেই। এখন সবটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। ইফতি চোখের পাতা অনবরত ঝাপটে পানি আটকাতে চেষ্টা করছে। ইরা তার ভেতরের কষ্টটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে দিয়ে প্রকাশ করছে। ঈশা তেমন কিছুই করছে না। সে একদম চুপ। স্থির হয়ে বসে পড়লো চেয়ারে। দুজনই তার দিকে ঘুরে তাকাল। এর ফাঁকে চোখের পানিটাও মুছে ফেলেছে সে। কথায় আছে অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। সেরকম কিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।

————
ধরণীর বুকে রাত নেমেছে। আবহাওয়া আজ প্রচণ্ড উগ্র। কোন কারনে তার ভীষণ রাগ। মাঝে মাঝেই পৃথিবী কাঁপিয়ে তীব্র আর্তনাদ করে উঠছে। বাইরের ঝড় হাওয়ায় জানালার শুভ্র রঙের পর্দা গুলো ফড়ফড়িয়ে উড়ছে। এখনো বৃষ্টি শুরু হয়নি। কিন্তু শীঘ্রই হবে। হাসপাতালের করিডোরে বিভিন্ন মানুষের ভিড়। কেউ প্রিয়জনের অপেক্ষায় সারাদিনে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে। আবার কেউ সদ্য অসুস্থতার খবর পেয়ে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে ছুটে এসেছে। সেসব দৃশ্যই দেখছে ঈশা। সেই তখন বসেছে। এখনো কারো সাথে একটা কথাও বলেনি। খাবারও খায়নি। ইভানের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে বাড়ি থেকে সবাই চলে এসেছে। যে যার মতো কথা বলছে। অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঈশার কিছুই ভাললাগছে না। শান্ত থাকার চেষ্টা করছে যথেষ্ট। কিন্তু মাঝে মাঝেই ভেতরের কষ্টটা বুক চিরে বাইরে বেরনোর জন্য হাসফাস করে উঠছে। ইফতি অনেক্ষন পর ঈশার কাছে এসে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই ঈশা সামনে তাকিয়েই বলল
–বড় মার কাছে কে আছে?

ইফতি শুনতে পেলেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না যে ঈশা কথা বলছে। তার দিকে গভির দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা আবারো জিজ্ঞেস করলো
–বড় মা জানে?

ইফতি নিচে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। সে তার মাকে এই বিষয়ে কিছুই জানায় নি। এমনিতেই তার মা অসুস্থ। আর ইভানের এই অবস্থার কথা জানলে কি হবে কে জানে? ঈশা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তুই বাসায় যা ইফতি। বড় মা রাতে তোকে না দেখলে চিন্তা করবে। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে। এখানে সবাই আছে। আমি তোকে কিছুক্ষন পর পর ফোন করে জানাবো।

ইফতি নিচের দিকে তাকিয়েই ভাবল কিছুক্ষন। ইচ্ছা না থাকলেও তাকে যেতেই হবে। কারন ঈশা ঠিক বলেছে। রাতে দুই ছেলের একজনকেও না দেখলে তার মা চিন্তা করবে। ছোট বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করবে আর জেদ করে ঔষধ খাবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সবার দিকে একবার তাকাল। সবাই আশে পাশেই আছে। ইফতি পা বাড়াতেই ঈশা উঠে দাঁড়ালো। মিহি স্বরে বলল
–ইফতি।

ইফতি পিছন ফিরে তাকাল। বলল
–কিছু বলবে?

–ভাবিস না তোর ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে। আমি কষ্ট পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু তার অচেতন দেহটা আমার থেকেও বেশী অনুভব করতে পারছে সেটা। আমার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। তাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।

ঈশার চেহারার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ইফতি চমকাল। ঈশা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি? ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। ইফতিরও ইচ্ছা করলো ঈশার কথা বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত হতে। তার মতো উতফুল্য চেহারায় হেসে উঠতে। নিজেকে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রস্তুত করে নিতেই কানে এলো ক্ষীণ স্বর।
–আমরা এখনো কিছুই বলতে পারছি না। সবটা সৃষ্টিকর্তার হাতে। আপনারা দোয়া করুন। কোন মিরাকেল ঘটতেও পারে। আপনাদের ছেলে ফিরলেও ফিরতে পারে।

কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে ইফতি সেদিকে তাকাল। ঈশার বাবা ডক্টরের সাথে কথা বলছিলেন। ইভান এখন কেমন আছে সেটা জানতে চাইলেই তার উত্তরে ডক্টর এমন কথা বলেন। ইফতির পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। নিশ্বাসটাও আটকে আসছে তার। ঈশার দিকে তাকাল। সে এখনো আগের মতই হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here