#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ৭,৮
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৭
শরতের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। দিনভর কোথাও নীলের বুকে শুভ্র মেঘের আনাগোনা চোখে পড়েনি। প্রকৃতিও ভীষন বিষণ্ন। থেমে গেছে শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর। এলোমেলো হাওয়ায় জানালার পর্দা ফড়ফড় করে উড়ছে। ঈশা জানালার পাশে বসে বই পড়ছে। বাতাসের দাপটে কালো চুল এলোমেলো ভাবে উড়েই চলেছে তার। হুট করে এক দমকা হাওয়া এসে গায়ে কাপুনি ধরিয়ে দিলো। ঈশা চোখ তুলে তাকাল রাতের তারাবিহীন গুমোট আকাশের দিকে। দূরের আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। রান্না ঘর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। ইরা মনে হয় কিছু একটা করছে। ঈশা গলা তুলে বলল
— ইরা তুই কি চা বানাচ্ছিস? আমার জন্য এক কাপ বানাস।
কোন আওয়াজ এলো না। ঈশা কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অপেক্ষা করলো ইরার উত্তরের। কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার বইয়ের দিকে নিবদ্ধ করলো। ভাবলো হয়তো ইরা একবারেই চা নিয়ে তারপর আসবে। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো তবুও কোনো খবর না পেয়ে ঈশা একটু চিন্তিত হলো। আবারও গলা তুলে বলল
— ইরা তুই কি রান্না ঘরে?
আবারও কোন আওয়াজ না পেয়ে ঈশা এবার বিরক্ত হলো। মেয়েটা কথা বলছে না কেনো? হাতে থাকা বইটা ধপ করে বন্ধ করলো। উঠে গেলো রান্না ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে কাউকেই দেখতে পেলো না। কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো ঈশার। পাশের ঘরে গেলো সেখানেও কেউ নেই। একটু ভেবে একে একে সব ঘরে দেখে নিলো। কিন্তু ইরা কোথাও নেই। বিষয়টা এবার ঈশা কে ভাবতে বাধ্য করলো। কারণ বাসায় ঈশা আর ইরা ছাড়া কেউ নেই।
সেদিন কাজিন সম্প্রদায়ের আড্ডা শেষ হওয়ার পর যে যার মতো বাসায় চলে যায়। এখন আর আগের মতো নিজেদের মধ্যে সময় কাটানো হয়না। সবাই নিজের সংসারে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সময় বের করে আসে একসাথে আড্ডা দিতে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যেতেই ঈশা ইভানদের বাড়ির রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঠিক সেই সময় ঈশার বাবা ফোন করে ইভান কে বলে ঈশাকে বাসায় দিয়ে আসতে। ইভান সেদিন কোন প্রশ্ন না করেই ঈশা কে বাসায় দিয়ে আসে। মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে সে ভীষন কষ্ট পায়। ঈশা বাসায় গিয়ে জানতে পারে তার নানা ভীষন অসুস্থ। তাই খুব জরুরী ভিত্তিতে তার মা আর বাবাকে যেতে হবে গ্রামে। ইরা যেহেতু বাসায় থাকবে তাই ঈশা কে থাকতে হবে তার সাথে। বাবা মা চলে যাওয়ার পর ঈশা ইভান কে সেই রাতে অনেকবার ফোন করে। কিন্তু ইভান তার ফোন ধরেনি। সকালে উঠে ঈশা ওই বাড়িতে ইভানের সাথে দেখা করতে যায়। আর গিয়েই জানতে পারে ইভান অফিসের কাজে কোথাও চলে গেছে। আর কোথায় গেছে কেউ জানে না। শুধু সকালে খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে। কিছু খেয়েও যায়নি। ঈশার ভীষন মন খারাপ হয়। কাউকে কিছু না বললেও অন্তত তাকে তো বলতে পারতো। তীব্র অভিমান জমে যায় মনে। বিষন্ন হয়ে ওঠে পরিবেশ। ইভান এর নাম্বারে ফোন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত ফোনটা বন্ধ। রাগে কষ্টে ঈশার চোখে পানি চলে আসে। সে কেঁদে নিজের বাড়িতে চলে যায়।
তারপর থেকে কেটে গেলো ৫ দিন। ইভান কোথায় গেছে কেউ জানে না। ঈশা বরাবরের মতো ফোন দিয়ে ক্লান্ত। কিন্তু ইভানের কোন খবর নেই। আজ আকাশের মতো ঈশার মনেও কাল মেঘের ঘনঘটা। কোথাও ইরাকে খুঁজে না পেয়ে ঈশা এক দৌড়ে গেলো নিজের ঘরে। ফোনটা হাতে নিতেই হুট করেই চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেলো। ঈশা ভয়ে কেপে ওঠে। এলোমেলো চিন্তা ভাবনা তার মস্তিষ্ক গ্রাস করে ফেলে। অস্থির ভাবে নিশ্বাস ফেলে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট টা জ্বালিয়ে চারিদিকে ঘোরালো। আচমকাই একটা শব্দ কানে আসতেই ঈশা ভয়ে পেছনে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে এক পা এগিয়ে যেতেই আবছা একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেয়ে ভয়ে এক চিৎকার দিতেই হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। বুকের ধুকধুকানি টা বেড়ে গেলো। অসাড় হয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ একজন খুব যত্ন করে বুকে আগলে নিলো ঈশা কে। ঘটনার আকস্মিকতায় ঈশা প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে আকাঙ্খিত মানুষটার স্পর্শ চিনতে কষ্ট হলো না। ইভান ঈশা কে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাড়ালো। লাইটার জ্বালিয়ে ধরতেই অগ্নি শিখার আলোয় ঈশার মুখটা অতি মোহনীয় লাগছে। ইভান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এদিকে লাইটার গরম হয়ে ইভানের হাতে লাগতেই সে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে। হাত থেকে লাইটার পড়ে যায়। ঈশা নিজেকে স্থির করে নিয়ে মোবাইলটা তুলে হাতে নেয়। ইভান এর দিকে তাক করে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ঈশার ওই দৃষ্টি দেখে ইভান মৃদু হেসে বলে
— অভিমানের মাঝে এক রকম অধিকার থাকে। অভিমান শুধু তার উপরেই হয় যার জন্য মনের মাঝে অসীম ভালোবাসা থাকে।
ঈশার চোখ ভরে এলো। বুকের ভেতরের শুন্যতা টা হাহাকার করে উঠলো। ইভান কে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে তার। নিজের আবেগ সামলাতে পারলো না ঈশা। কাপা কাপ কণ্ঠে বললো
— আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে। আমার ভীষন মন খারাপ। তোমার বুকে মাথা রেখে একটু কাদবো।
ঈশার মুখে তীব্র বেদনার ছাপ। ইভান এর এভাবে না বলে চলে যাওয়ায় এই কদিনে ঈশা যে কতটা কষ্ট পেয়েছে সেটা ইভান বুঝতে পারছে। ইভান এর বুকের ভেতরটায় যন্ত্রণা হলো। মৃদু হাসলো। বলল
— জড়িয়ে ধরলে কিন্তু আর কাদতে পারবে না। কারণ তোমাকে বুকে মাথা রেখে কান্না করার সুযোগ দিয়ে তোমার কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা আমার নেই। ভালোবেসে কাছে টেনে কষ্ট নিবারণ করার ক্ষমতা আছে।
ইভান এর কথা শেষ হতেই ঈশা ইভান কে জড়িয়ে ধরলো। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ইভান শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে আবেগী কণ্ঠে বললো
— কেনো এভাবে ইচ্ছা করে কষ্ট দাও আমাকে?
ঈশা থামলো না। নিজের মনের কষ্টটা উজাড় করে দিতেই ব্যস্ত সে। ইভান আবারও বলল
— প্লিজ জান। অনেক হয়েছে। এবার তো থামো।
চারিদিকে আলোকিত হলো। ঈশা থেমে মাথা তুলে তাকাল। ইভান সস্তির নিশ্বাস ফেলতেই ঈশা কঠিন গলায় বলল
— কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
ইভান ক্লান্ত গলায় বলল
— ভীষন ক্লান্ত লাগছে। পরে কথা বলি।
ঈশা নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ইভান পকেট থেকে ফোনটা বের করে ইফতির নাম্বারে ফোন করলো। বলল
— তোরা চলে আয়। ক্ষুধা পেয়েছে। একসাথে খাবো।
বলেই ফোন কেটে বিছানায় বসে পড়লো। ঈশা চুপচাপ দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান এর কাজকর্ম দেখে তার মাথা রাগে ফেটে যাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। ইভান পা ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঈশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— এভাবে দাড়িয়ে থেকে চোখ দিয়ে আমাকে গিলবে নাকি আমার ক্ষুধা নিবারণ করার ব্যবস্থা করবে?
ঈশা উত্তর দিলো না। রাগে গজগজ করতে করতে বাইরে চলে গেলো। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই ইরা আর ইফতি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ইফতির হাত ভর্তি খাবারের ব্যাগ। ঈশা তাদেরকে দেখেই ক্ষিপ্ত গতিতে এগিয়ে গেলো। কোমরে হাত দিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল
— কোথায় থেকে আসলি তোরা?
ইফতি ঈশার রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। ঢোক গিলে এক গাল হেসে বলল
— খাবার আনতে গিয়েছিলাম।
— আর ইরা?
ঈশার কথা শেষ হতেই ইভান বলল
— দুজনই গিয়েছিলো।
ঈশা একবার পেছন ফিরে তাকাল। আবার সামনে ঘুরে ইরার কাছে এসে তার হাত চেপে ধরে বলল
— আমাকে বলে যাস নি কেনো? এতো বড়ো সাহস তোর। আমাকে না বলে গিয়েছিস।
ইরা ভয়ে চুপসে গেল। ইভান এগিয়ে এসে ঈশার হাত ছেড়ে নিয়ে শান্ত সরে বলল
— আমি বলেছি তাই। তোমার যা কিছু জানার আমাকে জিজ্ঞেস করবে। সব কথার উত্তর দেবো। এখন প্রচন্ড ক্ষুদা পেয়েছে। কোন সিন ক্রিয়েট করবানা। নাহলে কিন্তু আমি খাবো না।
ইভান এর ঠান্ডা সরের হুমকি শুনে ঈশা থেমে তো গেলো কিন্তু রাগটা কিছুতেই কমাতে পারলো না। মাথায় এলোমেলো প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এতদিন ইভান কোথায় ছিল আর হুট করে কোথা থেকেই বা আসলো। আর এই নাটকের প্রয়োজন কেন? সবাই যে যার মতো ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ইভান টেবিলে বসে পড়লো। কিন্তু ঈশা অস্থির ভাবে নিশ্বাস ফেলছে। সবটা না জানা পর্যন্ত সে শান্ত হবে না। ইভান ঈশা কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এক ধমক দিল। বলল
— এখানে বসো।
ঈশা ভাবনা থেকে বের হলো। ধীর পায়ে ইভানের পাশে গিয়ে বসলো। ইভান তার মুখের সামনে খাবার ধরলো। ঈশা প্রথমে রাগ দেখাতে গেলেও পারলো না। এভাবে ভালোবেসে মুখে খাবার তুলে দিলে কি তাকে রাগ দেখানো যায়। মুখটা কিঞ্চিৎ হা করতেই ইভান খুব যত্ন করে ঈশার মুখে খাবার তুলে দিলো। ভেতরের কষ্টটা আচমকাই কেমন নাড়া দিয়ে উঠলো। রাগটা উধাও হয়ে গেল। অপরাধবোধ জড়িয়ে নিলো তাকে। ঈশার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইভান যত্ন করে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
— কাদছ কেনো?
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
— ভীষন কষ্ট হচ্ছে। আমি না ভালোবাসাটা আগের মতো অনুভব করতে পারছি না। কোথাও একটা অনুভূতির কমতি আছে।
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
— মৃত্যুর আগ মুহূর্তে জানতে চাইলেও বলবো শুধু তোমাকেই ভালবাসি। কিন্তু তোমার উপরে আমার আকাশসম অভিমান।
ঈশা কেঁদে ফেললো। বলল
— এই তীব্র অভিমানের দেয়াল কি ভাঙবে না কখনো? তোমার এই অভিমান আমার জীবনে আফসোস। আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।
ইভান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর মিনমিনে কণ্ঠে বললো
— অভিমান করে আর কি লাভ সেই তো দিনশেষে আবার ক্ষমা করেই দেই।
চলবে…..
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৮
চমৎকার ঝলমলে একটা দিনের সূচনা হল। সকালের প্রথম রোদটা এসে পড়েছে ঈশার বারান্দার সেই অলকানন্দা ফুলটার উপরে। সোনালী রোদ্দুরের উষ্ণ স্পর্শে লজ্জায় মিইয়ে গেছে ফুলটা। তার পাশেই একটা প্রজাপতি বসে সেই লাজুকতার মহনীয় দৃশ্য উপভোগ করছে। আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। কাল সারাদিনের কালো মেঘের উপস্থিতি রাতে প্রেম বর্ষণ ঘটিয়ে কেটে গিয়েছে। আজ শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর এর সূচনা হয়েছে দিনের শুরুতেই। ঝলমলে রোদ্দুরের উষ্ণ আলিঙ্গনে শুভ্র মেঘ তার বুকের মাঝে লুটিয়ে পড়েছে। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিয়েই নিজের ভেজা চুল ঝেড়ে নিলো ঈশা। চুলের পানির ঝাপটা ইভানের মুখে গিয়ে পড়তেই ঘুমের মাঝেই চোখ মুখ কুচকে এলো তার। ঈশা সেদিকে খেয়াল না করেই আবার ঝাড়া দিলো চূলগুলো। ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ভীষণ বিরক্ত নিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–ঈশা জানালাটা বন্ধ করো। আমি ঘুমাচ্ছি।
ঈশা ঘাড় বেকিয়ে তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–আর ঘুমাতে হবে না। ওঠো।
ইভান উত্তর দিলো না। ঈশা এবার পুরো জানালা খুলে দিয়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো। সম্পূর্ণ রোদটা ইভানের মুখে এসে পড়লো। চোখ খুলে ফেললো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল
–ননসেন্স! আমি ঘুমাচ্ছি দেখতে পাচ্ছ না? বিরক্ত করছ কেন? বন্ধ করো জানালা।
ঈশা ইভানের পাশে এসে বসল। মুচকি হেসে বলল
–৮ টা বাজে।
–তো কি হয়েছে?
ইভান ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করতেই ঈশা বলল
–অফিসে যাবে না? এখন না উঠলে দেরি হয়ে যাবে তো।
ইভান নীরব দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। কপালের চূলগুলো জত্ন করে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আবেগি কণ্ঠে বলল
–তুমি কি জানো ঈশা পাখি তুমি ভয়ঙ্কর সুন্দর! আর তোমার এই ভয়ঙ্কর রুপের মতো যদি বুদ্ধিটা ভয়ঙ্কর হতো তাহলে আমার এই জীবনে আমার আর কোন আফসোস থাকতো না। আমি এটা ভেবে শান্তি পেতাম যে একজন ভয়ঙ্কর সুন্দরীর পাশাপাশি ভয়ঙ্কর বুদ্ধি সম্পন্ন নারীকে আমি বিয়ে করেছি।
ইভানের কথা শেষ হলে ঈশা কিছুক্ষন ভাবল। এতক্ষন তার আবেগি কণ্ঠের মায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল ঈশা। কিন্তু শব্দগুচ্ছ মস্তিস্কে ঢুকতেই সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল
–আমার মাথায় কি বুদ্ধি নেই?
ইভান কঠিন গলায় বলল
–তোমার বুদ্ধির নমুনা এই জীবনে অনেকবার দেখেছি। সেসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। এখন আমাকে ঘুমাতে দাও।
ইভান শুয়ে পড়লো আবার। ঈশা একটু ভেবে আবারো তাকে ডেকে তুলল। ইভান এবার রেগে গেলো। উঠে বসে বলল
–এই মেয়ে! কেন বারবার এভাবে ডাকছ? কি সমস্যা তোমার?
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–অফিসে যাবে না? এখন না উঠলে দেরি হয়ে যাবে।
–তোঁতা পাখির মতো সেই তখন থেকে একই কথা বলছ। আমার বুদ্ধিমতী বউ আজ কি বার সেটা জানো? ক্যালেন্ডার টা চেক করে দেখো।
ঈশা দেয়ালে টাঙ্গান ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকাল। আজ শুক্রবার! ঈশা সেটা খেয়াল করেনি। তাই তো ইভান এতো রাগ করছিলো। সে দাঁত কেলিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। বলল
–আমি আসলে খেয়াল করিনি। তুমি ঘুমাও।
বলেই উঠে যেতে নিলে ইভান হাত ধরে টান দিলো। ঈশা তার বুকের মধ্যে গিয়ে পড়লো। ইভান দুষ্টুমির সুরে বলল
–আমি মনে হয় কাল রাতে তোমাকে একটু বেশীই বিরক্ত করে ফেলেছি। তাই এখন আর সহ্য করতে পারছ না।
ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইভানের দিকে। বলল
–অসভ্যের মতো কথা বলবে না একদম। যা মুখে আসে তাই বল।
ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। বলল
–বউয়ের কাছে এখন আমাকে সভ্য হয়ে কথা বলতে হবে। ঠিক আছে তাহলে বাইরে গিয়ে অসভ্যতামি করবো।
ঈশার শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। সে জোরে জোরে শ্বাস টানছে। ইভান তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি যা বললে আমিও তাই বললাম। তাহলে রাগ করছ কেন?
ঈশা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। অভিমানী কণ্ঠে বলল
–কেন এভাবে না বলে চলে গিয়েছিলে? আর ফোন কেন ধরনি? বন্ধ করে রেখেছিলে। কথাও বলনি আমার সাথে। কত টেনশন হয়েছিলো জানো।
ইভান ঈশাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–কিছুদিন একটু নিজের মতো থাকতে চেয়েছিলাম। এই মান অভিমানের মাঝে আমি ভীষণ এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। সব কিছু কেমন অসহ্য লাগছিল। তাই কিছুদিন নিজেকে সময় দিতে চেয়েছিলাম। তোমাকেও সময় দিলাম নিজেকে গুছিয়ে নিতে। আবার আমাকেও গুছিয়ে নিলাম। আর পারছিলাম না তোমাকে ছাড়া থাকতে। এই সবকিছুর অবসান হওয়ার দরকার ছিল।
ঈশা অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল
–তোমাকে না ইলহাম ভাইয়া এখনই অফিসে যেতে নিষেধ করেছিল। তুমি তবুও কেন গেলে?
ইভান ঈশার চুলের ভাজে হাত গলিয়ে দিয়ে বলল
–আমি ঠিক আছি। আমার যা প্রয়োজন সেটা পেয়ে গেছি। এখন আর সমস্যা নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–এটা দরকার ছিল ঈশা। খুব বেশী দরকার ছিল।
———–
টেবিলে চায়ের আড্ডা চলছে। ইফতি আর ইশান এসেছে সকাল সকাল। ঈশা মাত্র চা বানিয়ে এনে বসেছে চেয়ারে ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা উঠে বলল
–সিয়া এসেছে মনে হয়।
ইশানের চোখ চকচক করে উঠলো। পুরোটা ঘুরে তাকাল সে দরজার দিকে। ইরা দরজা খুলতেই সিয়া ভেতরে ঢুকল। ইশান কিছু বলার আগেই ইভানের কণ্ঠ কানে এলো।
–আরে সিয়া কেমন আছো?
সিয়া প্রশস্ত হেসে বলল
–ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?
–সকাল সকাল তোমাকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো।
সিয়া ইভানের কথা শুনে হাসল। ইভান এসে ঈশার পাশের চেয়ারে বসল। ইশান তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান নিজের ভেজা চূলগুলো আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করতে করতে বলল
–বস। চা খাবে তো।
সিয়া মিষ্টি হেসে বলল
–এখন খাব না ভাইয়া। ইরার সাথে একটু কাজ ছিল।
বলেই ইরা আর সিয়া ঘরে চলে গেলো। ইভান সামনে তাকাতেই ইশানের সূচাল দৃষ্টি চোখে পড়লো তার। ভ্রু কুচকে বলল
–কিছু বলবি?
ইশান তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এখনো সময় আছে ঈশা। নিজের ঘর বাঁচাতে চেষ্টা কর। নাহলে কান্না ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
ঈশা ঠোট চেপে হাসল। ইশান তার কাজে বেশ আশ্চর্য হল। ভ্রু কুচকে বলল
–তুই আমার কথা এখন বুঝতে পারছিস না কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারবি।
ইফতি ইশানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–সবই বুঝলাম ভাইয়া। কিন্তু তোমার সমস্যাটা ঠিক বুঝলাম না। একটু খুলে বলবে?
ইশান চটে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–আমার আবার কি সমস্যা? কি বলতে চাইছিস তুই?
ইভান মুচকি হেসে বলল
–কিছু বলতে চায় না শুনতে চায়। বলে ফেল তোর মনের কথাটা।
ইশান সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–কি শুনতে চায়?
ঈশা শব্দ করে হেসে ফেললো। বলল
–ভাইয়া অযথা কেন কথা বাড়াচ্ছ। বলে ফেল। সুযোগ সব সময় আসে না কিন্তু।
ইশান দমে গেলো। একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। ওভাবেই কিছুক্ষণ থেকে বলল
–মেয়েটা অনেক ছোট। কি ভাববে কে জানে?
ইভান নিজের চুলের ভাজে হাত চালাতে চালাতে বলল
–ছোট বড় হিসেব করতে বসলে যদি পাখি উড়ে চলে যায় তখন কি করবি? তার আগেই খাচার দরজা বন্ধ করে ফেল। উড়ে যেতে যেন না পারে।
ঈশা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। ইশান কে নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেক সময় পেরিয়ে গেলো তাদের। এর মাঝেই তারা সকালের নাস্তা সেরে ফেলেছে। ঈশা টেবিল থেকে উঠে বলল
–তোমরা দুপুরে কি খাবে? আমি রান্না করবো।
ইফতি বলল
–তুমি যা রান্না করবে আমরা তাই খাবো। শুধু মনোযোগ দিয়ে একটু রান্না করো প্লিজ। কয়েকদিন একটু রান্নায় অমনোযোগী ছিলে সেটা আমরা বুঝতে পেরেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এই মেনে নেয়াটা আর বেশীদিন হয়তো চলবে না। তাই বললাম আর কি।
ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইফতির দিকে। ইভান আর ইশান শব্দ করে হেসে ফেললো। ঈশা আরও বেশী রেগে গেলো। রাগী চোখে একবার সবার দিকে তাকিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল ঈশা। ইভান পেছন থেকে বলল
–মেজ বাবারা কবে আসবে?
ঈশা তাকাল। বলল
–জানি না। জিজ্ঞেস করিনি।
–এবার ফোন দিলে শুনে নেবে।
ইভানের কথা শেষ হতেই ঈশা বলল
–আচ্ছা। কিন্তু কেন?
ইভান সরু চোখে তাকাল। অবাক হয়ে বলল
–আমাকে কি ঘর জামাই রেখে দেয়ার প্ল্যান করেছো নাকি?
চলবে……