অবাধ্য_মন,পর্ব_৯

0
971

#অবাধ্য_মন,পর্ব_৯
#শোভা_আক্তার(লাভলী)

জানভি মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। তার বরাবরই রঞ্জন ও অর্পিতার বাবা বসে কথা বলছে৷ স্নিগ্ধকে সে সময়ের পর আর দেখেনি জানভি। পূজারীনির কাছ থেকে জানতে পেরেছে স্নিগ্ধ বলেছিল সে স্নান করে ঘুমিয়ে পরবে। হয় তো এতক্ষণে স্নিগ্ধ ঘুমিয়ে পরেছে। এখন রাত ১ টা বেজে ২০ মিনিট। রঞ্জন এত রাত করে কেন আসলো জানভি বুঝতে পারছে না। অর্পিতা ফ্রেশ হয়ে এসে সোফায় বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। রঞ্জন অর্পিতাকে দেখে কিছু বলার আগেই অর্পিতা বলল-
“এত লেইট করে আসার কারণ জানতে পারি?”
রঞ্জন হেসে বলল- “রওয়ানা হয়েছিলাম বিকালে। রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল।”
“হুমম বুঝলাম, কিন্তু তুমি আমার হলুদ মিস করলে। বিষয়টা আমার মোটেও ভালো লাগছে না।”
“আমি কিন্তু এসে তোমাকে হলুদ ছুঁইয়েছি। তো এখন ভালো না লাগার কারণ কোথা থেকে আসলো।”
“জানভি আর তুমি আমার ভার্সিটির সর্বপ্রথম বন্ধু। ভেবেছিলাম তোমরা আমার বিয়েরপ্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাশে থাকবে।”
বলেই অর্পিতা মন খারাপ করে ফেলল। রঞ্জন উঠে এসে অর্পিতার পাশে বসে বলল- “আই এম সরি অর্পা। আমি ছিলাম না তো কী হয়েছে? তোমার বাকি দুই বন্ধু তো পাশে ছিল।”
রঞ্জনের কথা শুনে জানভি তার দিকে তাকাল। রঞ্জন জানভির দিকে তাকাতেই জানভি চোখ সরিয়ে ফেলল। রঞ্জন আবার অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বলল- “এখন প্লিজ মাফ করে উদ্ধার করো আমাকে।”
অর্পিতা রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। পূজারীনি এসে রঞ্জনের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। রঞ্জন পূজারীনিকে দেখে হেসে বলল-
“তুমি কী করে জানলে আমার এখন চা পান করতে ইচ্ছে করছে?”
“বাবার জন্য চা বানিয়েছিলাম। ভাবলাম আপনাকেও দেয়া যাক।”
“খুব ভালো করেছো। আমার খুব ইচ্ছে করছিল এই শীতের রাতে এক কাপ গরম গরম চা পান করতে।”
রঞ্জনের হাতে কাপ দিয়ে পূজারীনি দৌড়ে চলে গেল। জানভির মাথা ব্যাথা করছে। তার মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ আর রঞ্জন তাকে পাগল করে দিবে। জানভির কপালে ঘাম দেখে অর্পিতা ভ্রু কুঁচকে বলল- “কিরে তুই এই শীতে ঘামছিস?”
“আসলে শাড়ি পড়া আমার অভ্যেসের বাহিরে। খুব অস্থির লাগছে। আমি ঘুমাতে যাই। সকালে কথা হবে।”
“ওকে, গুড রাইট।”
জানভি মুচকি হেসে উঠে চলে গেল। রঞ্জন জানভির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে অর্পিতার দিকে তাকাল।

পরেরদিন…..
আজ রাতে বিয়ে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। খুব চেচামেচি হচ্ছে। জানভি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। সে সবসময় তারাতাড়ি উঠে কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেল। উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১১ টা বাজে। বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমে চলে গেল। সে যত দ্রুত সম্ভব বাসায় যেতে চায়। রঞ্জন আর স্নিগ্ধ একই ছাদের নিচে। কখন আবার গন্ডগোল হয়ে যায় কে জানে। অর্পিতার বাড়িতে কোনো ঝামেলা চায় না জানভি। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলো। মণ্ডপ সাজানোর আয়োজন চলছে। জানভি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ডাইনিং রুমে আসলো। পূজারীনি আর বিজয় নাস্তা করছে। জানভি গিয়ে তাদের সাথে বসলো। পূজারীনি জানভিকে নাস্তা বেড়ে দিতে দিতে বলল-
“জানভিদি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ করো”
“রঞ্জনদা আর স্নিগ্ধদার মধ্যে কী ঝগড়া হয়েছে?”
“কেন?”
“না মানে, স্নিগ্ধদাকে বললাম রঞ্জনদার সাথে বসে নাস্তা করে নিতে। কিন্তু রাজি হলো না। আর রঞ্জনদাও বলল সে একা বসেই নাস্তা করতে চায়।”
জানভি কী জবাব দিবে এখন বুঝতে পারছে না। তার মন বলছে আজই কোনো অঘটন ঘটাবে তারা। একে অপরকে তো একদমই সহ্য করতে পারে না। জানভির কাছ থেকে জবাব না পেয়ে পূজারীনি আর প্রশ্ন করলো না। হয়তো তাদের বন্ধুদের মাঝের ব্যাপার এটা। তার দূরে থাকাই শ্রেয়। তখনই স্নিগ্ধ আসলো। জানভি স্নিগ্ধকে দেখে তাকিয়ে রইলো। চোখদুটো লাল হয়ে আছে তার। যেন রাগ মনে পুষে রেখেছে কিন্তু বের করতে পারছে না। জানভি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। স্নিগ্ধ বিজয়ের পাশে বসে পূজারীনিকে বলল- “পূজা আমি তৈলাক্ত খাবার খাই না এ্যাসিডেটি হয়ে যায়।পাউরুটি হবে?”
“জি দাদা আমি এখনই আনছি।”
পূজারীনি রান্নাঘরে গেল। জানভি চোখ তুলে বার বার স্নিগ্ধকে দেখছে। তার ইচ্ছে করছে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলতে। কিন্তু স্নিগ্ধকে দেখে মনে হচ্ছে সে জানভির দিকে তাকিয়েও দেখতে চায় না। তখনই রঞ্জন আসলো। জানভি রঞ্জনকে দেখে ঢোক গিলল। রঞ্জন জানভির পাশে বসে মুচকি হেসে বলল- “গুড মর্নিং ম্যাম, এখানে এসে আমাকে ভুলেই গিয়েছেন দেখছি।”
স্নিগ্ধ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল রঞ্জনের দিকে। রঞ্জন জানভির দিকে তাকিয়ে আছে। জানভি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল- “ভুলবো কেন? তুমি কী ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ?”
“না ভুললে একটা কল পর্যন্ত দিতে।”
“এখানে আসার পর সময় যেন খুব তারাতাড়ি কেটে যায়। কিছুদিন আগেই তো আসলাম। আগামীকাল চলে যেতে হবে।”
“হ্যাঁ ঠিক বললে।”
পূজারীনি আসলো স্নিগ্ধর জন্য পাউরুটি নিয়ে। রঞ্জনকে দেখে পূজারীনি মুখ ভর্তি হাসি দিলো। স্নিগ্ধকে পাউরুটি দিয়ে পূজারীনি রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলো- “রঞ্জনদা আপনার কিছু লাগবে?”
“না, আমি তো নাস্তা করেছি। দেবজানি আছে বসে তার পাশে বসলাম।”
“চা নিয়ে আসি?”
“রাতে চা তুমি বানিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ”
“খুব মজা হয়েছিল। দ্রুত এক কাপ চা নিয়ে আসো।”
“এখনই আনছি আপনি বসুন।”
পূজারীনি দ্রুত চলে গেল। জানভি চুপচাপ বসে আছে। তার মনে হচ্ছে ভয়ংকর প্রকৃতি দুর্যোগের মাঝে সে আটকা পড়েছে। যেমন ঝড় ও জোয়ারভাটা একসাথে। স্নিগ্ধ ঝড় হলে রঞ্জন জোয়ারভাটা। দুজনই পরিবেশ বরবাদ করে দেয়। জানভিকে চুপচাপ দেখে রঞ্জন বলল-
“দেবজানি কী হয়েছে তোমার?”
“কই কিছু না।”
“যদি আমাকে কিছু বলতে চাও নিশ্চিন্তে বলতে পারো৷ তুমি ভালো মতো জানো তোমার কথা আমাকে কখনো কষ্ট দেয় না।”
স্নিগ্ধ এক ভ্রু উঁচু করে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে এসব ঢং ছাড়া কিছুই না। জানভি মাথা নিচু করে বলল- “বলবো, এখন না আগামীকাল বাসায় ফিরে তারপর।”
“ঠিক আছে”
জানভি চোখ ঘুরিয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ এখনো রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটা সত্যি পাগল। জানভি লম্বা নিশ্বাস ফেলে নাস্তা করায় মনোযোগ দিলো।

পূজারীনি আর জানভি অর্পিতার বিয়ের জামা ও গহনা ব্যাগে রাখছে। অর্পিতা খাটে বসে তার হবু বরের সাথে ফোনালাপ করছে৷ পূজারীনি অর্পিতাকে দেখে আফসোসের স্বরে বলল- “আমার বিয়ে কবে হবে? আমিও এভাবে রোমান্টিক ফোনালাপ করতে চাই আমার বরের সাথে।” জানভি তার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল- “খুব শীগগিরই। শুনেছি তোমার কলেজের পড়া শেষ হলে তোমার জন্য বর খোঁজা শুরু হবে।”
“সত্যি বলছো?”
“একদম, আমি শুনেছি এমনটা।”
“আউচ আমার লজ্জা লাগছে খুব।”
জানভি শব্দ করে হেসে উঠল। অর্পিতা কল কেটে পূজারীনির দিকে তাকিয়ে বলল- “তুই বলেছিলি লাভ ম্যারিজ করবি। তো বল তোর বয়ফ্রেন্ডের নাম কি?”
“দিদি, তুই ভালো মতো জানিস আমার শত শত ক্রাশ আছে কিন্তু বয়ফ্রেন্ড নেই৷”
জানভি বলল- “এটা খুবই ভালো। পূজারীনি একটা এডভাইস দেই৷ বিয়ের আগে কাওকে ভালোবেসো না৷ তোমার বাবা মা তোমাকে যার হাতে তুলে দেবে একমাত্র তাকেই ভালোবেসো।”
“জানভিদি, তুমি নিশ্চয়ই কাওকে ভালোবাসো। নাহলে সবসময় তোমার মুখে ভালোবাসা নিয়ে এত ভয়ংকর বানী কেন শুনি?”
জানভি জবাবে এক গাল হাসি দিলো। জবাব না পেয়ে পূজারীনি আর প্রশ্ন করলো না। তারাতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে তারা ঘর থেকে বের হলো। স্নিগ্ধ আর বিজয় সোফায় বসে গেমস খেলছে। তাদের বের হতে দেখে স্নিগ্ধ হেসে বিজয়ের উদ্দেশ্যে বলল- “বিজয় জানিস পেতনিরা আজও হুরপরী সাজতে যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ দাদা, হুরপরী সেজে যে কী হবে।”
অর্পিতা তাদের কথা শুনে হনহন করে এগিয়ে এসে কোমড়ে দুহাত রেখে বলল-
“তোদের সমস্যা কী হ্যাঁ? আমরা সাজুগুজু করতে পারি আর তোরা করতে পারিস না বলে কী জেলাস ফিল হয়?”
স্নিগ্ধ পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল- “আমাদের মেকআপের প্রয়োজন নেই। আমরা তো জন্মের মিস্টার পারফেক্ট।”
অর্পিতার জবাব দেয়ার আগে হাতে টান অনুভব করলো। পাশ ফিরে দেখে জানভি। অর্পিতা তাকে কিছু বলার আগে জানভি বলল- “ও কেমন তুমি জানো। দুষ্টুমি করছে, চলো এখন লেইট হচ্ছি আমরা।”
অর্পিতা স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে চলে গেল। স্নিগ্ধ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসছে। জানভি তার দিকে তাকিয়ে বলল- “দাঁড়ি দেখে কাবির সিং এর শাহিদ কাপুরের মতো দেখাচ্ছে। এসে যাতে দেখি দিলওয়ালের শাহরুখ খান হয়ে গিয়েছো।”
বলেই জানভি হাঁটা ধরলো। স্নিগ্ধ বিরক্ত ভাব নিয়ে বলল- “আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই মিস দেবজানি সরকার।”
“তুমি বাধ্য, আর আমি জানি আমি যা বলবো তুমি করবে।” বলেই জানভি অর্পিতা আর পূজারীনিকে নিয়ে বাহিরে চলে গেল। স্নিগ্ধ ঠাঁই বসে আছে। মেয়েটা তাকে অতিরিক্ত হুকুম দেয়। কিন্তু সে মিথ্যে কিছু বলেনি। এত বড় দাঁড়ি তারও পছন্দ না। স্নিগ্ধ উঠে ঘরে চলে গেল। তাদের থেকে কিছুটা দূরে রঞ্জন হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো দৃশ্য দেখে সে লম্বা নিশ্বাস ফেলে হাসলো।

চারপাশে গান বাজনার শব্দে বাড়ি মেতে উঠেছে। আজ বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে। সবার মুখে হাসি বেদনা দুটোই। অর্পিতার বাবা ঘর থেকে বের হচ্ছে না। একমাত্র মেয়ে আজ উনাকে ছেড়ে অন্যের বাড়ি চলে যাবে। মেয়ে সেখানে সুখী থাকবে কিনা ভেবেই উনার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে সুখী থাকলে উনার থেকে খুশী আর কেও হবে না। কিন্তু মেয়ে একটু কষ্ট পেলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারেন না উনি। অর্পিতা তার ঘরে বসে আছে। ভারী শাড়ি গহনা পড়ে সে পাথরের মতো জমে আছে। জানভি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার লেহেঙ্গার ওড়না ঠিক করে নিলো। পূজারীনি গিয়ে মেহমানদের সামলাচ্ছে। জানভি অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বলল- “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ করো”
“তুমি জানো আজ তুমি তোমার পরিবার ছেড়ে চলে যাবে। ভয় করছে না তোমার? আমি যখনই এমন কিছু ভাবি প্রচুর ভয় করে।”
“ভয় না, কষ্ট হচ্ছে খুব। মা বাবাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো বুঝতে পারছি না। কিন্তু খুব ভালোও লাগছে। তার হাতে হাত রেখে সারাজীবন পাড় করার ইচ্ছা।”
“দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায়?”
“নিশ্চয়ই যায়, আমি ভেবেছি নিয়েছি সে আমার দ্বিতীয় না শেষ ভালোবাসা হবে।”
জানভি অর্পিতার পাশে বসে অর্পিতার হাত ধরে বলল- “আমার ঠিক মতো কিছু মনে নেই। কিন্তু তুমি তোমার পিছুটান ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছো ভীষণ ভালো লাগছে।”
অর্পিতা জানভির হাতের উপর হাত রেখে বলল- “তোমারও একটা পিছুটান আছে। এখন তাকে ভুলে যাবে না-কি আবার আগলে নিবে সম্পূর্ণ তোমার উপর। কিন্তু আমি চাইবো তুমি তাকে আর একবার সুযোগ দাও।”
জানভি তাকিয়ে রইলো অর্পিতার দিকে। সে এমন দোটানায় পরেছে সেখান থেকে কিভাবে বের হবে নিজেও জানে না। বর এসেছে বর এসেছে বলে চারপাশে চেচামেচি শুরু হলো। পূজারীনি এসে বলতেই অর্পিতা জানভির হাত চেপে ধরলো। জানভি অর্পিতার দিকে তাকিয়ে হাসলো। নিজের হাত ছাড়িয়ে পূজারীনিকে নিয়ে বাহিরে চলে গেল। তারা দৌড়ে দরজার সামনে গেল। সেখানে স্নিগ্ধও আছে। জানভি স্নিগ্ধকে এক নজর দেখে আবার সামনের দিকে তাকাল। অর্পিতার বরও লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। বিজয় উঁচু স্বরে বলল- “আরে জিজু লজ্জা পেলে চলবে না। তারাতাড়ি আসুন আর পেতনিটাকে বিয়ে করে নিয়ে যান।”
সবাই হাসলো বিজয়ের কথা শুনে। বরকে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসানো হলো। মাত্র এসেছে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়া যাক। অর্পিতার বাবা উনার বিয়াইকে খুঁজছেন। গহনা নিয়ে যা হলো আর একবার ক্ষমা চেয়ে নিলে ভালো হয়। উনি মেয়ের দিচ্ছেন। মেয়ের জন্য হলেও সবার সামনে নিচু হতে হবে। বিয়ের পর যদি মেয়ের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়? উনি রিস্ক নিতে পারবেন না। স্নিগ্ধ গ্লাসে জুস নিয়ে অর্পিতার বরের সামনে আসলো। এসে দেখে জানভি অলরেডি তাকে জুস দিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধ বিরক্ত চেহারা বানালো৷ জানভি শব্দহীন আসলো। কিছুক্ষণ পর বরকে মণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হলো। অর্পিতার মা বলায় জানভি আর পূজারীনি অর্পিতাকে নিতে ঘরে গেল। অর্পিতা পায়চারি করছে। পূজারীনি বলল- “বলুন ম্যাম আপনার রাজপুত্র আপনার অপেক্ষা করছে।”
“এখনই বিয়ে?”
পূজারীনি আর জানভি হাসিমুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। অর্পিতাকে ধরে তারা বাহিরে নিয়ে গেল। সবার দৃষ্টি কনের দিকে৷ অর্পিতা চোখ তুলে তার বরের দিকে তাকাল। হা হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। অর্পিতা হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। স্নিগ্ধ জানভির দিকে তাকিয়ে আছে। আজ জানভি কনেকে নিয়ে মণ্ডপে আসলো। কিছুদিন পর হয়তো সে অন্য কারো কনে সেজে মণ্ডপে আসবে। স্নিগ্ধর বুক ভারী হয়ে আসলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে রঞ্জনের দিকে তাকাল। রঞ্জনও জানভির দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধর ইচ্ছে হলো তার চোখ তুলে ফেলতে। কিন্তু রঞ্জনের অধিকার আছে জানভির দিকে তাকানোর। সে চেয়েও তাকে থামাতে পারবে না। তারা অর্পিতাকে তার বরের পাশে বসিয়ে সরে গেল। পূজারীনি চুল ঠিক করতে করতে রঞ্জনের দিকে তাকাল। তার কেন যেন মনে হলো রঞ্জন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে আবার তার পাশে থাকা জানভির দিকে তাকাল। হয় তো জানভিকে দেখছে রঞ্জন। পূজারীনি আবার রঞ্জনের দিকে তাকাল। রঞ্জন হঠাৎ মুচকি হাসলো। পূজারীনি লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেলল।

বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে থেকেই অর্পিতা কান্না শুরু করেছে। তার বর তার হাত ধরে বার বার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। জানভি রঞ্জন ও স্নিগ্ধ দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। স্নিগ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখে বলল- “তোমাদেরও কিছুদিন পর বিয়ে। তো আমি দাওয়াত পাবো?”
জানভি চমকে উঠল। অবাক দৃষ্টিতে তাকাল স্নিগ্ধর দিকে। রঞ্জন হাসিমুখে বলল- “ঝামেলা হওয়ার আগে তুমি আমাকে বন্ধু ছিলে। তোমাকে দাওয়ার দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আশা করছি এসে কোনো গন্ডগোল করবে না।”
“একদম না, আমি ভালো হয়ে গিয়েছি। নিজের জীবন ধ্বংস হতে অনুভব করেছি তোমাদের বিয়ে কী জিনিস তাহলে?”
জানভি বলল- “কিন্তু আমি চাই না তুমি আমার বিয়েতে আসো।”
“কেন? আমি ওয়াদা করলাম কোনো গন্ডগোল করবো না। প্লিজ দেবজানি সরকার আমাকে দাওয়াত দিও।”
জানভি জবাব দিলো না। স্নিগ্ধ ইচ্ছে করে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর নিজেও কষ্টের বোঝা টানতে চাচ্ছে।

পরেরদিন……
স্নিগ্ধ জানভি ও রঞ্জন আজ ঢাকার জন্য রওয়ানা দিবে। জানভি তার জামার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে গেল নাস্তা করার জন্য। স্নিগ্ধ আগে থেকেই বসে পূজারীনি আর বিজয়ের সাথে কথা বলছে। জানভি রঞ্জনকে না দেখে রঞ্জন যে ঘরে আছে সেখানে গেল। রঞ্জন তার ব্যাগে কী যেন খুঁজছে। জানভি পারমিশন নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। রঞ্জনকে নিশ্চিত দেখে জিজ্ঞেস করলো- “কী খুঁজছো?”
“টাকা পাচ্ছি না। কোথায় যে হারালো বুঝতে পারছি না।”
“পূজারীনি বলেছিল এই বাসায় অনেক বেশী চুরি হয়। শুনেছিলে না অর্পিতার গহনাও চুরি হয়েছিল?”
“হুম, স্নিগ্ধ বিষয়টা সামলে নিয়েছে শুনে খুশী হয়েছে খুব। আচ্ছা থাক ২ হাজার ব্যাপারই। এমনিতে ঢাকা যাওয়ার মতো টাকা আছে।”
“আচ্ছা, চলো এখন নাস্তা করে নাও।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি শুধু পূজারীনির হাতের তৈরী এক কাপ চা খাবো।”
“মনে হচ্ছে পূজারীনির তৈরী চা তোমাকে কাবু করে ফেলেছে।”
“পুরোপুরি”
জানভি আর রঞ্জন দুজনই হাসলো। রঞ্জন জামার ব্যাগ বিছানায় রেখে শুধু মানিব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। ডাইনিং রুমে যেতেই স্নিগ্ধ বলল-
“আমি ভাবছিলাম লেলা কোথায় গেল। এখন বুঝলাম লেলা তার মজনুকে ডাকতে গিয়েছিল।”
“তুমি তোমার আজব জাতের কথা বার্তা বন্ধ করবে?”
রঞ্জনের কথা শুনে স্নিগ্ধ হেসে বলল-
“কী বাপু সত্য হজম হয় না?”
রঞ্জন লম্বা নিশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসলো। তার পাশে জানভিও বসলো৷ রঞ্জন বলার আগেই পূজারীনি তার দিকে চা ভর্তি কাপ এগিয়ে দিলো৷ রঞ্জন হাসলো। নাস্তা করে তারা উঠে দাঁড়াল। রাস্তা জ্যাম থাকলে অসুবিধা। তাই তারাতাড়ি বের হতে হবে। বড়োরা সোফায় বসে আছে। তারা যার যার ঘরে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাহিরে আসলো। বিজয় আর পূজারীনি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। জানভি পূজারীনিকে ও স্নিগ্ধ বিজয়কে জড়িয়ে ধরলো। বিজয় বলল-
“স্নিগ্ধদা, কবে আসবে আবার?”
“ভাবছি এক্সাম শেষ হলে আবার আসলো। তখন পুরো গ্রাম ঘুরে দেখাবে আমাকে, ওকে?”
“আচ্ছা”
পূজারীনি জানভিকে ছেড়ে বলল- “দিদি তো চলে গেল। আর এখন তুমিও চলে যাচ্ছো। একা হয়ে গেলাম আমি।”
“আমরা প্রতিদিন ফোনে কথা বলবো ঠিক আছে? আর খুব শীগগিরই আবার আসবো তোমাদের সাথে দেখা করতে। তোমার এইচএসসি পরীক্ষা সামনে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বে ঠিক আছে?”
“আচ্ছা”
রঞ্জন দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। অর্পিতার বাবাকে দেখে সে এগিয়ে গেল। বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বাবা রঞ্জনের মাথায় হাত রেখে বলল- “চিরসুখী হও বাবা। আবার এসো কেমন?”
“জি আংকেল, আমি খুব শীগগিরই আবার আসবো। আমার ইচ্ছে আমার বাবা মাকে নিয়ে আসার।”
“আরে এটা তো আরো ভালো কথা। আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকবো।”
রঞ্জন মুচকি হেসে চোখ ঘুরিয়ে পূজারীনির দিকে তাকাল। পূজারীনি জানভির সাথে কথা বলছে। হঠাৎ সে ধাক্কা অনুভব করলো। স্নিগ্ধ তাকে ঠেলে অর্পিতার বাবার সামনে দাঁড়াল। রঞ্জন বিরক্ত হয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ বাবাকে বলল- “আংকেল আমাকে আবার আসতে বলবেন না?”
বাবা শব্দ করে হেসে দিলো। স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“আমার তো ইচ্ছে তোমাকে এখানেই রেখে দেয়া। আমার মনে জায়গা করে নিয়েছো তুমি।”
স্নিগ্ধ রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। রঞ্জন অবাক হলো। স্নিগ্ধ যেন কমপিটিশনে নেমেছে। রঞ্জন হাসলো। স্নিগ্ধ তো এমনই৷ সবার থেকে বিদায় নিয়ে তারা বাসা থেকে বের হলো। বাসস্ট্যান্ড বাসা থেকে কিছুটা দূর তাই হেটেই তারা রওয়ানা দিলো। শীতের সকাল চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। খুবই সুন্দর লাগছে পরিবেশ। জানভি গ্রামের শীতের সকাল ক্যামেরায় বন্দি করে নিলো৷ বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে স্নিগ্ধ তিনজনের জন্য টিকিট কিনে নিলো। বাসে উঠে তারা তিনজন শেষের সিটে গিয়ে বসলো। জানভি দুজনের মাঝে বসেছে। তার জীবনটাই এমন। দুজনের মাঝে সে ফেঁসে গিয়েছে। বাস চলল ঢাকার উদ্দেশ্যে। স্নিগ্ধ মোবাইলে গেমস খেলছে। রঞ্জন আর জানভি কথা বলছে। বেশ কিছু রাস্তা এগুনোর পর বাস থেকে গেল। সবাই অবাক হলো। রাস্তার ঠিক মাঝামাঝিতে বাস থেমেছে। স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল- “এই ভাই বাস থামালেন কেন?”
কিন্তু ওখান থেকে জবাব আসলো না। রঞ্জন এগিয়ে গেল বিষয়টা দেখার জন্য। জানভি পেছনে তাকাল। পেছন থেকে একটার পর একটা গাড়ি এসে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার ভয় করছে খুব। স্নিগ্ধ জানভির হাতের উপর হাত রেখে বলল- “ভয় পাচ্ছো?” জানভি তার দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে বলল- “আমি আছি” তখনই রঞ্জন আসলো।
“সামনে চাকার পাম্প কমে গিয়েছে। ঠিক করে ফেলবে ১০ মিনিটের মধ্যে। আচ্ছা শুনো আমার ক্ষুধা পেয়েছে। আমি গিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসি। তোমরা কিছু খাবে?”
স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল- “তুমি কেন আনবে? আমিও যেতে পারি। না-কি দেখাচ্ছো তুমি কত কেয়ারিং।”
“স্নিগ্ধ আমার রিকুয়েষ্ট ডক্টর শামসুর নাহারের সাথে যোগাযোগ করে তুমি তোমার চিকিৎসা করাও তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছো। আমি বাথরুমে যাবো তাই ভাবলাম আশে পাশে দোকান খুঁজে কিছু কিনে নিয়ে আসি।”
“এই এই যাচ্ছো ভালো কথা। হাত ধুয়ে তারপর আমাদের খাবার কিনবে। দাঁড়াও টাকা দিচ্ছি।”
রঞ্জন কী বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। ছেলেটার প্রতি তার মায়া হলো। সত্যি হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। রঞ্জন চলে গেল টাকা নিয়ে। জানভি হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। সে খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছিল। স্নিগ্ধ নাক মুখ কুঁচকালো। জানালার দিয়ে সে বাহিরে তাকালো। সে খেয়াল করলো দূর থেকে ফুল স্পিডে একটা বড়ো ট্রাক এগিয়ে আসছে। স্নিগ্ধ ভালে মতো দেখলো ট্রাকটার স্পিড বেড়েই চলেছে। সময়ের মতো না থামালে বাসের সাথে টক্কর লাগবে। স্নিগ্ধ দ্রুত দাঁড়িয়ে বলল- “সবাই বাস থেকে নামুন।” তার কথা শুনে একজন বলল- “কিন্তু কেন?”
“সেই রাস্তা থেকে একটা ট্রাক আসছে।”
“আসুক, বাস দেখে থেমে যাবে।”
স্নিগ্ধ আবার সেখানে তাকাল। ট্রাক তো স্পিড কমাচ্ছে না। তখনই রাস্তা থেকে বাসচালক চিৎকার করে বলল- “সবাই বাস থেকে নামুন। ট্রাকের ব্রেকফেইল হয়েছে।”
সবাই চমকে উঠল। দ্রুত উঠে এলোপাথাড়ি ভাবে দৌড়াতে শুরু হলো। স্নিগ্ধ আবার সেখানে তাকাল। ট্রাক অনেকটা কাছে। সে তারাতাড়ি জানভির হাত ধরে দৌড়ে গেল। জানভির হাত ধরে টেনে এগিয়ে দিয়ে বলল- “তুমি তারাতাড়ি নামো আমি আসছি।”
“স্নিগ্ধ তারাতাড়ি আসো।”
“বাস থেকে নেমে দূরে দৌড়ে যাও। অনেক মানুষ আমরা একসাথে দৌড়াতে পারবো না।”
স্নিগ্ধর ধমক শুনে জানভি দৌড়ে বাস থেকে নেমে গেল। স্নিগ্ধ একটা বাচ্চা ও মাকে দেখলো। তাদের দ্রুত বাস থেকে নামালো। পেছনে আরো মানুষ আছে। ট্রাকটা খুব সামনে এসে পরলো৷

ঠিক ৩০ মিনিটের মধ্যে টিভির প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলে খবর ছড়িয়ে পরলো। ঢাকা আসার পথে একটি বাসের সাথে ট্রাকের সংঘর্ষে ভয়ংকর এক্সিডেন্ট হয়েছে। বাসে মোট ৮ জন মানুষ ছিল ও ট্রাকে তিনজন। সেই দুর্ঘটনায় মোট ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here