এক_ফালি_চাঁদ #পর্ব_১০(অন্তিম পর্ব)

0
1805

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_১০(অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

ঘন কালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। আনন্দ নেই, হাসি নেই কোথাও। চারদিকে শুধু থমথমে পরিবেশ। বাঁধনহারা হয়ে কাঁদছেন আমেনা বেগম এবং তিনু। খালেদ রহমান একটু পরপর শার্টের হাতায় চোখ মুছছেন। তাদের মেয়ের সাথেই কেন এমনটা হতে হলো! ডাক্তার জানিয়েছে অনুর গাল থেকে গলা পর্যন্ত একদম ঝলসে গেছে। ভেতরে কাউকে এলাউ করেনি। বাইরে থেকেই সকলে এক পলক দেখেছে শান্ত নির্জীব অনুকে! বুকের ভেতরটা একদম হু হু করে ওঠে। যেই কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না। আর না সবাই বোঝে!

যারা এসিড ছুড়েছিল ওদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওদের স্বীকারোক্তি দ্বারা জানা গিয়েছে অনুকে এসিড মারার উদ্দেশ্য ওদের ছিল না। বরং অন্য মেয়েটিকে এসিড ছুড়তে গিয়েই অনুর শরীরে পড়ে যায়। পুলিশ হাসপাতালে এসেছিল। কিন্তু অনু অথবা এসিড আক্রান্ত অন্য মেয়েটি অর্থাৎ আঁখি এখন কথা বলার মতো সিচুয়েশনে নেই। ডাক্তার জানিয়েছে এখনই তাদের কারো সাথে কথা বলতে দেওয়া যাবে না। পুলিশও ওদের দুজনের জবানবন্দি ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি নেই।

করিডোরের একপাশে দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনল। বারবার চোখের সামনে অনুর ছটফট করা তখনকার দৃশ্য ভেসে উঠছে। কত কষ্ট ওকে পোহাতে হয়েছে! কী হবে সামনে? অনু এসব সহ্য করতে পারবে তো? ডাক্তার এসে জানায় ওরা এখন স্বাভাবিক সুস্থ। সবার আগে কথা বলার জন্য পুলিশই যায়। যদিও তারা উপস্থিত অনল এবং আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে উক্ত ঘটনাটি শুনেছিল তবুও একই প্রশ্ন তারা অনু এবং আঁখিকে করে। পুরো ঘটনা অনুর বলার প্রয়োজন হয়নি। শুধু এটাই জানিয়েছে সে তাদের কাউকে চিনে না। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল তা বুঝতেও পারেনি। আঁখির জবানবন্দি এমন ছিল,
‘এসিড নিক্ষেপকারী একজন যার নাম পলাশ। পলাশ আমায় প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিল কলেজে যাওয়ার সময়। সে ভালো ছেলে নয়। আমি না করে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে সে প্রায়ই আমায় বিরক্ত করত। রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করত। তারপরও যখন আমি রাজি হয়নি তখন ও হুমকি দিয়ে বলে,’তোর এই সুন্দর চেহারা নিয়ে এত বড়াই না? তোর এই চেহারাই আমি নষ্ট করে দেবো।’ সরাসরি ভয় না পেলেও মনে মনে আমি ঠিকই ভয় পেয়েছিলাম। কিছুদিন কলেজেও যাইনি। এরপর যখন আবার কলেজে যাওয়া শুরু করলাম তখন আর পলাশ আমায় বিরক্ত করত না। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, হয়তো আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই বলেছিল। কিন্তু ভুল ছিলাম আমি। সেদিন কোচিং করে ফেরার পথে…’

এইটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে আঁখি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,’সেদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে পলাশ ও ওর সঙ্গীরা আমার দিকে এগিয়ে আসে। অদ্ভুতভাবে হাসে। আমি ভয় পেয়ে দৌঁড়ানো শুরু করি। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা খাই! আমার জন্য ঐ মেয়েটাকেও এসিডের শিকার হতে হয়!’

এবার আঁখির কান্নার দমক আরও বেড়ে যায়। ডাক্তাররা জানায় এই সময়ে ওদের উত্তেজিত করা ঠিক হবে না। পুলিশের যা জানার দরকার তা জেনে নিয়েছে। আর কোনো প্রশ্ন তারা করেনি। তবে এটা বলেছে যে এর প্রাপ্য শাস্তি পলাশ ও ওর বন্ধুরা পাবে। হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের দলবল। একদিনে একই সময়ে দুই মেয়ে এসিডের শিকার। এই খবর যেন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। ডাক্তাররা তাদের হাসপাতালের ভেতর এলাউ করেনি। তারা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে অনু এবং আঁখির সঙ্গে কথা বলার জন্য। এরমধ্যে যতটুকু জানা হয়েছে ততটুকুই টিভি, পত্রিকায় প্রচার করা হয়েছে। তাদের আগের ছবি এবং এসিডে ঝলসে যাওয়া ছবি দেখে সকলের মনেই আক্ষেপ। এত সুন্দর চেহারা! আজকাল সত্যিই এটাও মনে হয় যে, সুন্দর হওয়া’ও পাপ, অন্যায়!
.
অনু সুস্থ হওয়ার পর-ও কারো সঙ্গেই কথা বলতে চায়নি। এমনকি দেখা-ও করেনি। অনল ভেতরে যায়নি একবারও। আমেনা বেগম যাওয়ার পর হাত ধরে কান্না করে অনু। আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠবে সেই কান্নার সুরে। আজ অনু এবং আঁখিকে আদালতে যেতে হবে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। দুজনকেই রেডি করা হয়। কিন্তু আয়না দেখতে দেওয়া হয় না কাউকেই। এমনকি ফোনও তাদের থেকে দূরে রাখে। এই ঝলসে যাওয়া মুখ দেখলে বেঁচে থাকার ইচ্ছে এখানেই মরে যাবে। গালে, গলায় হাত বুলিয়ে আৎকে ওঠে অনু। বুঝতে পারে নিজের করুণ পরিস্থিতি।
________________

ঘরের এক কোণায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে অনু। কিছু্ক্ষণ আগেই আদালত থেকে এসেছে। আসামীদের ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত অনু নিজেকে দেখেনি। আঁখির মুখ দেখতে পায়নি। ওড়না দিয়ে বড়ো ঘোমটা দেওয়া ছিল। তবে হাতটা দেখতে পেরেছিল। ডান হাতের ওপর ভাগ একদম ঝলসে পুড়ে গেছে। কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য! হাতের যদি এই অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে মুখের অবস্থা কী রকম হয়েছে? বাড়ির সামনে আসার পর এলাকার মানুষদের করা বিকৃত মুখভঙ্গি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তাদের চোখে ভয় স্পষ্ট ছিল। তারা কি অনুকে ভয় পাচ্ছে?

ঘর থেকে সকল প্রকার আয়না জাতীয় সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সে নিজেই তার মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। কেমন দেখাচ্ছে তাকে? খুব ভয়ংকর? খুব? ঠোঁট ভেঙে কান্না চলে আসে। ফ্লোরে গুটি গুটি পায়ে গলু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিতুস ওর কোলের কাছে এসে বসে আছে। খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হবে তিতুসও বোধ হয় কাঁদছে। তবে সে অন্যান্যদের মতো ভয় পাচ্ছে না।

আমেনা বেগম প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসেন। তিনুর হাতে পানির গ্লাস। কাঁদতে কাঁদতে ওদের চোখমুখ ফুলে গেছে। নিজেকে কোনো রকম ভাবেই সামলে রাখতে পারছে না আমেনা বেগম। অনুর মুখের দিকে তাকালেই বুক ভেঙে কান্না চলে আসে। চোখ নামিয়ে ভাত মেখে মুখের সামনে ধরেন। অনু বিষাদিত সুরে বলে,’তুমিও কি আমার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছ মা?’
তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ত্যাগ করেন। অনুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলেন,’না মা, না। আমি কেন ভয় পাব? তুই আমার মেয়ে। আমার কলিজা। তুই আগে যেমন ছিলি, এখন তেমনই আছিস। আমার অনু সবসময় সুন্দর।’

‘না মা। আমি আগের মতো নেই। আমি নেই আগের মতো! মানুষ এখন ভয় পায় আমায় দেখলে।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে খাবারের প্লেট দূরে ছুড়ে মারে। ফ্লোরজুড়ে ছিটিয়ে পড়ে ভাতের দানা। শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গলু খাটের কোণায় লুকিয়ে পড়ে। আর তিতুস উড়ে চলে যায় অন্যত্র। অনুকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে। ঘরের সবকিছু এলোমেলো করতে করতে কাঁদছে। আহাজারি করে বলছে,’এই বিশ্রী মুখ নিয়ে আমি কী করে বাইরে যাব? কেন হলো আমার সাথে এমন?’

‘আপু প্লিজ তুমি একটু শান্ত হও। এভাবে ভেঙে পড়ো না।’ ফুঁপিয়ে বলে তিনু।
দু’হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে নিজেকে মানানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় অনু। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে,’তোমরা চলে যাও। আমি একটু একা থাকতে চাই।’
ঐ মুহূর্তে ঘরে এসে উপস্থিত হয় অনল। ইশারায় আমেনা বেগম এবং তিনুকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে। তারা যাওয়ার পর অনলকে দেখে আরও রেগে যায় অনু। উল্টোপাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,’আপনি এখানে কেন এসেছেন? মজা নিতে? আনন্দ হচ্ছে না আপনার?’

অনল নিশ্চুপ। অনু বলল,’আপনি চলে যান। কারো দয়া, মায়া আমার লাগবে না। দূর থেকেই পরিহাস করেন।’
অনল এগিয়ে এসে অনুর হাত ধরে সামনে ঘুরিয়ে দাঁড় করায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে অনু। কাঁদতে কাঁদতে বলে,’চলে যান। প্লিজ! চলে যান আপনি।’
ঐভাবেই অনুকে জড়িয়ে ধরে অনল। সে কথা বলতে পারছে না। অনুকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না তার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর। সে জানে না কীভাবে অনুকে স্বাভাবিক করবে, কীভাবে সামলাবে। শুধু জানে অনুকে তারই সামলাতে হবে। কিছু্ক্ষণ নিরবে কেঁদে অনলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজেও পিছিয়ে যায় অনু। চিৎকার করে বলে,’আপনি চলে যাচ্ছেন না কেন? চলে যান আপনি।’

‘অনু পাগলামি করিস না। এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। তোর তো এখানে কোনো দোষ নেই। কেন এমন করছিস?’
‘কারণ দোষ না করেও আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। মানুষ ভয় পায় আমায় দেখলে।’
অনল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আহাজারি করে কাঁদতে কাঁদতে পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে অনু। নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অনল ঘর থেকে বেরিয়ে আবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ফিরে আসে। অনুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা খোরগোশের বাচ্চা অনুর কোলের ওপর রাখে। অশ্রুশিক্ত নয়নে সে অনলের দিকে তাকায়। অনলের চোখের পানি চিকচিক করছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে সে এখন কাঁদতে চাচ্ছে না। অনুর গালে আলতো করে হাত রেখে অনল বলে,’তোর পিলু! ওকে আমি ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কুকুর নেয়নি। ইচ্ছে ছিল, যেদিন তোকে বিয়ে করব সেদিন ফিরিয়ে দেবো। বিয়ে হওয়ার আগেই ফিরিয়ে দিলাম। তবে বিয়ে হবে আজ।’

‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? কীসব আবোল-তাবোল বকছেন!’
‘আবোল-তাবোল নয়। যা বলেছি ভেবেই বলেছি। আমি তোকে ভালোবাসি। তোকেই বিয়ে করব।’
‘অসম্ভব।’
‘কেন অসম্ভব অনু? তোর মুখ ঝলসে গেছে বলে কি আমার ভালোবাসায় ভাঁটা পড়েছে? কমে গেছে আমার ভালোবাসা?’
‘আপনার এখন আবেগের বয়স নেই। কোন আবেগের টানে আপনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমি জানি না। বাড়ি চলে যান।’

অনল এবার অনুর দু’গালে হাত রাখে। চোখে চোখ রেখে বলে,’আল্লাহ্’র কসম! তোকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আমি আবেগের বশে নেইনি। আমি তোকে ভালোবাসি। আমার পরিবারের সবাই রাজি। আজই তোর বাবার সাথে কথা হবে।’
অনলের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে অনু বলে,’কেন এমন করছেন আপনি! কেন ভালোবাসেন!’
অনল কিছু বলল না। শুধু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বাহুবন্ধনে শক্ত করে আবদ্ধ করে রাখল অনুকে।
.
.
খালেদ রহমান বাড়িতে ছিলেন না। একটু আগেই এসেছেন। চোখে-মুখে চিন্তার আভাস। চোখে-মুখ ফোলা।
‘চা দেবো?’ জিজ্ঞেস করেন আমেনা বেগম।
‘দাও।’
চা বানানোই ছিল। গরম করে কাপে ঢেলে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখে। পাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করে,’কোথায় গিয়েছিলে?’
‘বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে কথা বলতে।’
‘মানে?’
‘বাড়িটা বিক্রি করে দেবো আমেনা। মেয়ের চিকিৎসা করাবো। দেশের বাইরে পাঠাবো সার্জারি করার জন্য। কেউ আমার মেয়েকে কুৎসিত বলুক, বিশ্রী বলুক এটা আমি চাই না। সহ্য করতে পারব না আমি।’

কথার উত্তর দিতে পারলেন না আমেনা বেগম। কান্না ছাড়া তিনি আর কী-ই বা করতে পারবেন? তবে রাগী মানুষটার আড়ালে’ও যে অফুরান্ত ভালোবাসা রয়েছে সেটা তিনি আজ বুঝতে পারলেন। খালেদ রহমানের ব্যাপারে তার একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। যা আজ তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে। মানুষটার ভেতর অনেক ভালোবাসা রয়েছে যা রাগের আড়ালে খুঁজে বের করা মুশকিল। অনলের বাবা-মা এসে বিয়ের কথা বলেছেন। কিছু্ক্ষণ নিরব থেকে ভাবুক হয়ে খালেদ রহমান বলেছিলেন,’অনলকে আমার অপছন্দ নয়। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায় এতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আগে অনু পুরোপুরি ঠিক হবে তারপর বিয়ে। কেউ যেন আমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলে এটা না বলতে পারে যে, অনল দয়া দেখিয়ে ওকে বিয়ে করেছে।’

সকলে অভিভূত হয়েছিল উনার কথা শুনে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বারবার ওড়নায় চোখ মুছেছিল অনু। সে তার বাবার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছিল! অথচ বাবা কত ভালোবাসে। খালেদ রহমানের সিদ্ধান্তে সবাই রাজি হয়েছে। উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য টাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জেসি এবং শুভা বেশিরভাগ সময়টা এখন অনুদের বাসাতেই থাকে। লুডু খেলে, গান শোনে, চোর-পুলিশ খেলে। প্রকৃত বন্ধুরা কখনোই ভুলে যায় না। তারা পাশে থাকে যেকোনো মুহূর্তে। সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছে অনুও।

দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে ঠিক করা হলো ওরা ছাদে যাবে। ছাদে বসে বসে লুডু খেলবে চারজন মিলে। জেসি আর শুভা সোফায় বসে আরাম করছে। কলিংবেল বাজে তখন। দরজা খুলে দেয় তিনু। এলাকার অনেকেই এসেছে এবং সেই ভিক্ষুক বৃদ্ধা মহিলাটিও। তাদের সকলকে ভেতরে নিয়ে আসে তিনু। ওড়না দিয়ে মুখের এক সাইড অনু ঢেকে রেখেছে। বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করেন,’ভালো আছো বইন? তোমার খবর আমি শুনছিলাম। আইছিলামও দেখতে। কিন্তু তুমি তহন কারো লগেই দেহা করো নাই।’

অনু কৃত্রিম হেসে বলল,’ভালো আছি দাদু।’
কথাবার্তার শব্দ পেয়ে খালেদ রহমান এবং আমেনা বেগমও ড্রয়িংরুমে আসেন। সকলের সঙ্গে আলাপবার্তা করেন। এরপর তারা সবাই টেবিলের ওপর টাকা রেখে বলেন,’বেশি টাকা-পয়সা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নাই ভাই। অনু জানে আমাদের অবস্থা। যা পারছি দিছি। আমরাও চাই আমাদের অনু আবার প্রাণ ফিরে পাক। হাসি-খুশি অনু ফিরে আসুক আমাদের মাঝে।’

আমেনা বেগম এবং খালেদ রহমানের চোখে পানি এসে পড়ে। এতগুলো মানুষ অনুকে ভালোবাসে! এমনি এমনি নয়, অনুও তাদের ভালোবাসে। কিছু মানুষ ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে না। যেটা করে তা হচ্ছে বেঈমানি। এই সহজ-সরল মানুষগুলো বেঈমানি বোঝে না। তাদের প্রত্যেককেই অনু কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করেছিল। তাদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিল। এখন অনুর বিপদেও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। ক’জন-ই বা থাকে বিপদের সময়ে পাশে? যদিও টাকার ব্যবস্থা সব হয়ে গিয়েছিল তবুও খালেদ রহমান তাদের ফিরিয়ে দিলেন না। অনুর প্রাণোচ্ছল জীবন ফিরে পাওয়ার পিছনে না হয় তাদেরও কিছুটা অবদান, ভালোবাসার স্পর্শ থাকুক। অনু কেঁদে ফেলে এত ভালোবাসা দেখে।

তিনু বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,’তুই-ই ঠিক ছিলি আপু। সেদিন তুই মিথ্যে বলিসনি। তারাও তোর বিপদে পাশে আছে।’
দুপুর থেকে বিকেল অব্দি তারা সবাই গল্প করলেন। অনুকে সময় দিলেন। অনু ভুলেই গেছে প্রায় তার কষ্ট। সবাই পাশে আছে কিন্তু অনল নেই। ওকে ছাড়া সবকিছু বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অবশ্য সে গিয়েছে পাসপোর্ট আর ভিসার কিছু কাজ শেষ করতে। ওরা কাল’ই যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডে সার্জারি করার জন্য। এখানে ইউসূফেরও হাত রয়েছে। সে সহযোগিতা করেছে বলেই চিকিৎসার ব্যবস্থা দ্রুত হয়েছে। ঐদেশের হাসপাতালেও বন্ধুদের দিয়ে কথা বলিয়ে রেখেছে। কাল সকালের ফ্লাইটেই সুইজারল্যান্ড যাবে।
.
সব কাজ শেষ করে রাতে বাড়িতে ফেরে অনল। রাতে অনুদের বাসাতেই খায়। ইশারায় তিনুকে জিজ্ঞেস করে,’অনু কোথায়?’
প্রত্যুত্তরে তিনুও চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে,’ছাদে।’
খাওয়া শেষ করে অনল-ও ছাদে চলে যায়। উপস্থিতি জানান দিতে খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে।
‘এহেম, এহেম।’
অনু একবার পেছনে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। চাদরটা আরেকটু ভালো করে টেনে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। অনল এগিয়ে গিয়ে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’উফ! ঠান্ডা।’

অনু এবার তাকালোও না। অনল এবার অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,’একটু চাদরটা শেয়ার করবি অনু? খুব ঠান্ডা লাগছে।’
‘কেন? সাথীর কাছে গিয়ে চান।’ চেতে বলল অনু।
‘এখানে আবার সাথী আসলো কোথা থেকে?’
‘আকাশ থেকে! সেদিনের কথা মনে নেই?’
‘আছে। ঐদিন ওকে জ্যাকেট দিয়েছিলাম। তারপর যে একদিন আমাদের বাড়ির ছাদে তোকে জ্যাকেট দিলাম? এখন তুইও চাদর শেয়ার করবি। করতে বাধ্য তুই। দে।’
অনল চাদরে ধরে টান দিতে যাবে তার আগেই অনু দূরে সরে যায়।
‘দেবো না। সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি?’
‘কত কাজ আমার! রাত পোহালেই কাল চলে যাবি। আজ এমন করছিস কেন?’
‘কাল কে কে যাব?’
‘পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ যাবে তোর সাথে।’

ভ্রুঁ কুঁচকে মুখ কালো করে ফেলে অনু। অনল ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে,’ঢং! কে কে যাবে! কেন রে তুই কি মহারাণী ভিক্টোরিয়া? রাজ্য জয় করতে যাবি যে, সবাই তোর সঙ্গে যাবে যুদ্ধ করতে! তা তো নয় তাই না? তুই যাবি চিকিৎসা করতে। যাদের যাওয়ার প্রয়োজন তারাই যাবে। আঙ্কেল যাবে, ইউসূফ ভাইয়া যাবে আর তুই।’
অনু দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে বলে,’গণ্ডার!’
অনল জিজ্ঞেস করে,’এই তুই কি বললি?’
‘কী বললাম?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্ন করে অনু।
‘মাত্রই কী যেন বললি! কীসের ডার না কী জানি। কী বলছিলি বল?’
‘সেটাই তো কী বলছিলাম?’
‘একদম ঢং করবি না অনু। ভালোই ভালো বল কী বলছিস?’
অনু আমতা আমতা করে বলে,’আ…আন্ডার হ্যাঁ আন্ডার বলছিলাম।’
‘কীসের আন্ডার?’
‘কীসের আন্ডার! ঐতো ঐযে কবিতা বলছিলাম আমি। টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার, হাওয়াই আন্ডার হোয়াট ইউ আর…’ জোর পূর্বক ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুঁটিয়ে বলল অনু। অনল ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলে,’গাধী! ঐটা আন্ডার না, ওয়ান্ডার হবে।’
এবারও বোকার মতো হেসে অনু বলল,’হ্যাঁ, ঐ একই।’
অনল আর কিছু না বলে চলে যায়। এদিকে বুকের ওপর হাত রেখে জোরে শ্বাস নেয় অনু। বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে আজ। ‘কিছু বলেও শান্তি নেই। সব শুনে ফেলে। গণ্ডার যেন কোথাকার!’ বিড়বিড় করে বলল সে। আবারও একা একা দাঁড়িয়ে থাকে। অদ্ভুত মানুষ! চলে গেল? কই একটু গল্প করবে তা নয়!

আচমকা তখন অনল ফিরে এসে চাদরটা টেনে নিয়ে নেয়। গায়ে জড়িয়ে পেছন থেকে অনুকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আমার অনুর চিকিৎসা হবে আর আমি থাকব না? কাল আমিও যাব। আমার পাগলীর পাশে আমি থাকব। একদম ঢাল হয়ে।’
অনুর ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠে। অনলের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। অনল বলে,
‘জানিস অনু তোর প্রতি আলাদা টান, ভালোবাসা সবসময়ই আমার কাজ করতো। কিন্তু ঝগড়া করতে করতে কেন জানি ভালোবাসাটা ধরতেই পারতাম না। সত্যি বলতে তোর পাশে অন্য কোনো ছেলেকে আমি সহ্যও করতে পারতাম না। তাসিনকেও না। আমার ভয় হতো তোকে হারিয়ে ফেলার। এরপর যখন তাসিনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম ওর ক্যারেক্টার ভালো না তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। বল তো কেন?’
‘কেন?’
‘কারণ আমি জানতাম প্রমাণ করতে পারলে তুই কোনোদিন ওর সাথে রিলেশন রাখবি না। আপদ বিদায় হবে।’

অনু হাসে। কিছু্ক্ষণ নিরব থেকে বলে,’আচ্ছা যদি এরকমটা হতো এসিড না লেগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যেতাম। অথবা এই অবস্থার পর সুইসাইড করতাম তখন কী করতেন?’
সঙ্গে সঙ্গে অনুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনল। পারছে না শুধু বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে। অনু মৃদুস্বরে বলে,’ভর্তা হয়ে যাব তো!’
অনল এবার আলতো করে ধরে বলে,’এমন কথা কখনো মুখেও আনিস না অনু। তোর এই অবস্থাতেই আমি বেঁচেও জিন্দা লাশ হয়ে ছিলাম। তোর মুখে একটু হাসি দেখার জন্য ছটফট করতাম। আর তুই…! তোকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। তোর মুখ এমন থাকলেও আমার কিছু যায় আসে না। যেকোনো পরিস্থিতিতেই তুই আমার। সবভাবেই, সব সাজেই আমি তোকে ভালোবাসি।’

‘মুখের অপারেশন না করলে আমারও কোনো আফসোস থাকতো না সত্যি। আমি তো বুঝেই নিয়েছি, চিনেই নিয়েছি কারা আমার পাশে আছে আর থাকবে। বন্ধু তো অনেক আছে কিন্তু দিনশেষে শুধু জেসি আর শুভাকেই পেয়েছি। অনেকের বাবা-মা নাকি এ-ও বলেছে যে নিজের দোষে নাকি আজ আমার এই অবস্থা! তাদের ধারণামতে আমি চঞ্চল। হয়তো কোনো ছেলের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি তাই আমার এই হাল। তাদের মেয়ে আমার সাথে মিশলে যদি ওদেরও ক্ষতি হয়? কী অদ্ভুত মানুষের চিন্তা-ভাবনা তাই না? অথচ জেসি, শুভা সব বাঁধা উপেক্ষা করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
যেসব মানুষদের আমি সাহায্য করতাম তারাও আমার বিপদে আমার পাশে আছে। আমি শুধু তাদের প্রয়োজনই ছিলাম না বরং প্রিয়জনও ছিলাম এটা তো স্পষ্ট। যেই বাবাকে মনে মনে অপছন্দ করতাম, ভাবতাম আমায় সে ভালোবাসে না। অথচ সেই সবার চেয়ে বেশি অস্থির। কারো কাছ থেকে হাত পাতেনি। জমি-জমা সব বিক্রি করেছে। এমনকি নিজের শখের বাড়িটাও বিক্রি করতে দু’বার ভাবেনি।
আর… আর যাকে আমি ভালোবাসি সে এখনও আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার বাবা-মা, ভাই এসে তিনবেলা আমায় দেখে যাচ্ছে। সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের বাড়ির বউ হওয়ার কথা। তারা অপেক্ষায় আছে। তাহলে এখন আপনিই বলেন, কেন আমি সামান্য এক্সিডেন্টের জন্য সবকিছু ছেড়ে দেবো? সত্যি বলতে অনেকবার ভেবেছিলামও সুইসাইডের কথা। কিন্তু সবার এত সাহস, ভরসা, সাপোর্ট সেটা হতে হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, বেঁচে থাকার জন্য এসব আমার জন্য যথেষ্ট।’ অনলের বুকে মাথা রেখেই কথাগুলো বলল অনু।

অনুর কপালে চুমু খেল অনল। আরেকটু শকলত করে জড়িয়ে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’আমার পাগলীটা অনেক বুঝদার হয়েছে। আকাশে আজ চাঁদ দেখতে পাচ্ছিস?’
অনু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার অনলের বুকে মাথা রাখে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,’হুম।’

‘আকাশে কিন্তু আজ সম্পূর্ণ চাঁদ নেই। তবুও চারপাশ কত আলোকিত দেখেছিস? কুয়াশা কিন্তু চাঁদের সৌন্দর্য আড়াল করতে পারেনি। তেমনি সামান্য ঝলসে যাওয়া চামড়া-ও পারেনি তোর সৌন্দর্য কেড়ে নিতে। বরং তোর মনের সৌন্দর্য তোর চেহারার সৌন্দর্যকে আরও দ্বিগুণ করেছে। আর সম্পূর্ণ চাঁদ না পেলে আফসোসও থাকত না। আমার সম্পূর্ণ চাঁদ লাগবেও না রে। শুধু তুই থাকলেই হবে। তোর মুখের পোড়া অংশ কখনো তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কমাতে পারেনি। তুই যে আমার চাঁদ। আমার ভালোবাসার এক ফালি চাঁদ।’

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here