বেমানান,পর্ব ৭ গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি!
অষ্টমীর রাত…..
সন্ধি পুজোর আরতির শেষে ঈশানি ঘরে ঢুকতেই মিসেস দত্ত ঈশানি কে জানালো কৌশানি অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছে ঈশানিকে……
ইদানিং বছর দুয়েক হলো সন্ধ্যে বেলায় সন্ধি পুজোর লগ্ন পরে! একদিকে ভালোই হয় তাতে ঈশানির, মাঝরাত অবধি উপোষ করে থাকতে হয়না আর ঈশানিকে….
ঈশানীরা উত্তর কোলকাতার একটা কমপ্লেক্সের বাসিন্দা,,,,,,
মধ্যবিত্ত্ব গোছের কমপ্লেক্স হলেও শেষ পনেরো বছর থেকে দূর্গা পুজো হয় ওদের কমপ্লেক্সে,,,তাই ঈশানীরা কমপ্লেক্সের মধ্যেই থাকে পুরো পুজোটা,
কৌশানি যদিও জোর করে সবাই কে নিয়ে একদিন বেড়োয় নবমীর বিকেলে!
মিসেস দত্তর কথা শুনে ঈশানি আবার সদর দরজাটার দিকে এগোলো, দরজাটা খুলতেই দেখলো লিফ্ট থেকে বেড়োচ্ছে কৌশানি!
“দিভাই!! কোথায় ছিলিস? আয় আমার সাথে” বলেই ঈশানির হাতটা ধরে হনহন করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো ওদের ঘরে,,,,
ঈশানি ও কৌশানির ঘরটা ঈশানি চলে যাবার পর এখন শুধু কৌশানির ঘর……
শুধু এই পুজো পার্বনেই একসাথে থাকার সুযোগ পায় ওরা দুজন!
“কি হলো এভাবে টানতে টানতে নিয়ে এলি কেন?”
“কিছু খেয়েছিস? নাকি এখনো চলছে তোর সন্ধির উপোষ?”
“না সবাইকে ভোগটা বেড়ে একটু ওপরে এলাম, তারপর মা বললো,,,,,”
“সিরিয়াসলি দিভাই,,,,তুই পারিসও ,,,,,প্লিজ এবারে চোখ মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে,,,আমি জলদি সে, তোর ভোগটা ওপরে নিয়ে আসছি,,,,,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে কিন্তু! তুই জানিস তো আমি রেগে গেলে ……………” বলতে বলতে কৌশানি বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে!
ঈশানী জানে,,,,,কৌশানি আসতে আসতে রেডি হওয়া শুরু না করলে তার আর রক্ষে নেই!
চোখ মুখ ধুয়ে এসে ঈশানি দেখলো, কৌশানির হ্যান্ডলুমের শাড়িটা খাটের ওপর রাখা এক সাইডে, সঙ্গে ব্লাউজ, পেডিকোট ও একটা ছোট চিরকুট! চিরকুটে লেখা –
“এটা পরে নিশ!”
ঈশানি আর দেরিনা করে শাড়িটা পড়তে শুরু করলো…
মনেই মনেই ভাবতে শুরু করলো কৌশানি নিজের শাড়িটা ঈশানিকে কেন পড়তে বলে গিয়েছে!
“ওহ্হো! দিভাই প্লিজ,,,,অভাবে প্লিট করিসনা,,,,,,বোট নেকটা তো বোঝাই যাচ্ছেনা!”
বলেই কৌশানি ঈশানির সামনে পুরো প্লিটটা খুলে শাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কাঁধের কাছে একটা সেফটি পিন লাগিয়ে দিলো নিমেষেই……
“দিভাই তাড়াতাড়ি এবারে এখানে বোস তো দেখি…….” বলেই কৌশানি মেকআপ লাগাতে শুরু করলো ঈশানির মুখে,,,,
“একটু চোখটা বন্ধ কর এবারে, লাইনার লাগাবো! ……হমম ঠিক আছে,,,,,নানা খুলিসনা চোখের পাতা,,,,,এবারে ঠোঁটটা খোল! লিপস্টিকটা লাগাবো….”
“কৌশানি তুই কি করছিস বলতো? এরম হঠাৎ আমাকে সাজাতে বসে গেলি কেন? আর কোথায় বেড়োবো আমরা?”
“উউউফ! দিভাই একটু চুপচাপ বসনা……দেখলি তো তোর এখনো খাওয়া হয়নি এদিকে লিপস্টিকটা লাগিয়ে ফেললাম! ধুর! আমার আর ভালো লাগেনা……”
বলেই ছুটে গেলো বাইরের ঘরের দিকে,,,তারপর একটা ছোট্ট বাটিতে একটু ভোগ নিয়ে এলো!
“নে-নে,,,,জলদি কর!
তাড়াতাড়ি শেষ কর দেখি!একদম অল্প এনেছি…..বাকিটা এসে খেয়ে নিশ! এখন প্লিজ তাড়াতাড়ি কর!”
সত্যি কৌশানি আর একদম পাল্টালোনা…….মনে মনেই ভাবলো ঈশানি! এরম দুমদাম মাথায় ভুত চাপে ওর! আবার সব জায়গাতে তে তার দিভাই কে নিয়ে যেতেই হবে! এসব ছোট থেকে চলে আসছে……
“দিভাই হাসছিস কেন? তাড়াতাড়ি শেষ কর না!”
ঈশানি মৃদু হেসে বললো – “সত্যি তুই আর পাল্টালিনা! আর তোর নাকি দুমাস পর বিয়ে! পুরো পাগল তুই!”
“ওহ! কৌশানি এবার তো বল আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“তোকে বললাম না চুলটা কানের পাশে ঢোকাবিনা! তুই আবার হাত কেন দিলি চুলে?”
ভ্রু কুঁচকে দাঁতটা কিড়মিড় করে বললো কৌশানি!
“সরি! সরি! আর কিছু করবোনা! আর একবার ঠিক করে দে!”
“হমমম গাড়িতে উঠে ঠিক করছি!”
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ক্যাব এসে দাঁড়ালো ওদের কমপ্লেক্সের বাইরে,,,,,ঈশানি ক্যাবে উঠেই বুঝলো বাগবাজার অব্দি গাড়ি বুক করা!
“এখান থেকে এইটুকুর জন্যে, গাড়ি কেন বুক করলি?”
“একটু চুপচাপ বস না দিভাই” বলেই কৌশানি ঈশানির সামনের দিকের চুলটা ঠিক করতে শুরু করলো!”
ব্যাগ থেকে একটা অক্সিডাইস্ড কানের দুল বের করে বললো – “নে পরে নে!”
“আচ্ছা এবারে তো বল! প্লিজ”
এতক্ষণে কৌশানির মুখে হাসি দেখলো ঈশানি……কিন্তু তবুও কিছু বললোনা,,,,,শুধু বললো –
“আর মিনিট পাঁচেক চুপচাপ বস….একটা সারপ্রাইজ আছে!”
“কৌশানি! তুই কি রাজ্ কে ডেকেছিস? কৌশানি আমি তোদের মধ্যে গিয়ে কি করবো?…..”
“উউউফ! দিভাই,,,,একটু চুপচাপ বস না! আর প্লিজ তোর প্রেডিকশন স্কিলটা আমার সামনে Use করিসনা….”
ক্যাব রওনা হলো বাগবাজারের পথে,,,,
ক্যাব ছুটে চললো রাস্তার দু ধারের বড়ো বড়ো হার্ডিং পেরিয়ে! গোটা শহর তখন সেজে রয়েছে আলো রোশনাইতে! বিভিন্ন প্যান্ডেলের বিভিন্ন গান মিলেমিশে তৈরী করেছে অদ্ভুত এক ছন্দ! পুজো পুজো ছন্দ ……..
ক্যাব এসে দাঁড়ালো বাগবাজারে! ঈশানি তখনও বুঝে উঠতে পারছিলোনা কৌশানি এক্সাক্টলি কি করতে চাইছে?
ভাড়াটা মিটিয়ে ক্যাব থেকে বেরোতেই ঈশানি দেখলো স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে! স্নিগ্ধর মুখে মৃদু হাসির রেখা! ঠিক দেখেছে তো ঈশানি?
খানিকক্ষণের জন্যে হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু স্নিগ্ধর দিকে চেয়ে রইলো ঈশানি,,,,,,,মন জুরে অদ্ভুত সেই ভালোলাগায় মেশানো ভয়ের ঝড় বয়ে গেল,,,,,চেয়েও কিছু বলতে পারলোনা!!
হৃদস্পন্দন বেড়ে দুগুণ, হাতটা কেমন যেন কাঁপছিলো ঈশানির……
“কিরে দিভাই? কেমন লাগলো সারপ্রাইস?” ফিসফিস করে বললো কৌশানি!
এতক্ষণে ঈশানি স্নিগ্ধর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ে দেখলো কৌশানির দিকে,,,,,,,
“তুই কি ভাবে…..”
“কি ভাবে আবার?
তোর ফোনটা ওপরে রেখে নীচে চলে গেলি সন্ধি পুজোর অঞ্জলি দিতে,,,,এদিকে সমানে স্নিগ্ধ দার ফোন! একবার, দুবার নয় দিভাই,,,,,আটটা মিসড কল ছিল,,,,তাই পরের বারের রিংটাই আমি ফোনটা ধরি,,,, স্নিগ্ধ দা আমাকে বলে তোর সাথে দেখা করতে চায়,,,,আমি বললাম ঘন্টা দুই লাগবে হয়তো, বললো রাজি!
আর স্নিগ্ধ দা, আমরা কিন্তু পনেরো মিনিট আগেই পৌঁছে গিয়েছি……. সো……. আমার কিন্তু ট্রিট লাগবে!”
“আঃ! কৌশানি! আমি তোকে পরে খাওয়াবো!”
“কেন? আমি কি বেকার ছেলে নাকি?” স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো…..
“নাঃ স্যার! মানে!”
“আআবার ……….. ফর্মালিটি করছিস! বল কৌশানি কি খাবি?”
“আপাতত আইসক্রিমেই কাজ চালিয়ে নেবো! ”
“আচ্ছা কি আইসক্রিম ?”
“Anything! আইসক্রিম হলেই হলো! ওঃ! আচ্ছা স্নিগ্ধ দা দিদি কিন্তু বাদ!”
“কেন??”
বলে স্নিগ্ধ তাকালো ঈশানির দিকে!
“ও ঠিকই বলছে স্যার, আজ বাইরের কিছু খাবোনা!”
“কিন্তু আইসক্রিম তো নিরামিষ!”
“সরি! আসলে…..”
“ওকে ম্যাডাম! নো প্রব্লেম! আমি ফোর্স করবোনা! কৌশানি জাস্ট দু মিনিট…………………..”
“কিরে দিভাই! কতদিন চলবে তোদের এই সাইলেন্ট লাভ!”
“উউফ কৌশানি! বিরক্ত করিসনা,,,,ঘুমোতে দে এখন! অনেক রাত হয়ে গিয়েছে! ”
“ওহ্হো! তাই নাকি! তাহলে বারবার ফোন চেক করছিস কেন? ঘুম পেলে ঘুমো………..
এরম ফোনটা নিয়ে খুটখুট করছিস কেন?”
“কোথায় ফোন চেক করেছি রে!” বলেই ফোনটা লক করে বালিশের পাশে রেখে দিলো ঈশানি…..
“ওহঃ প্লিজ দিভাই,,,,, এতো লুকোনোর কিছু নেই! শোন আমি আজকে যেটা বুঝলাম শুধু তোদের ব্যাপারটা অফিসিয়াল হয়নি এই যা,,,,নয়তো টানা পোনে দু ঘন্টা কেউ অপেক্ষা করেনা!
আর তারপর
তুই খেলিনা বলে আইসক্রিম টাও খেলনা! এতো ভিড়ের মধ্যেও অন্য কোনো মেয়েকে দেখছিলোনা! শুধু তোর দিকে বারবার তাকাচ্ছিলো…..উউফ! কি কেমিস্ট্রি……”
“বাজে বকিসনা একদম! ও তো বললো ওর বন্ধুরা ছিল,,, তাইতো ও ছিল!”
“বাহ! ও বললো আর তুই বিশ্বাস করলি!! যেন তুই কিছুই বুঝিসনা! ……
এই দিদি! শোন না তোদের কেমিস্ট্রি টা কিন্তু সেই….. জানিস,,,, Damn হ্যান্ডসম কিন্তু স্নিগ্ধ দা! জাস্ট হিরো লুক!”
“এতো ফালতু বকিস না….. তুই…..!” এবারে বেশ খানিকটা হাসি হাসি গলায় বললো ঈশানি!
“ওই দিভাই সত্যি বল!”
“কি?”
“তোর পছন্দ নয়!”
ঈশানি কোনো জবাব দিলোনা! হাতে ফোনটা নিয়ে আবার হোয়াটস্যাপ চেক করতে শুরু করলো,,,,ফোনের আলোয় কৌশানি দেখলো ঈশানির হাসি মুখটা!
“ওই দিদি! বললিনা কিন্তু তুই……”
“উউফ! বললাম তো তোকে সেরম ………” ঈশানি কথা শেষ করার আগেই ফোনটা বেজে উঠলো,,,স্ক্রিনে স্নিগ্ধর নাম!
ঈশানির ফোনটা বাজতে দেখেই কৌশানি মুচকি হেসে বললো – “আমি এবারে ঘুমোই! আর কি সময় হবে কারুর! ”
ঈশানি ফোনটা রিসিভ করে মৃদু স্বরে বললো – “হমম হ্যালো…..”
“শোন না! জেগে আছিস তো? আর পাঁচ মিনিট অনলাইন থাক………জাস্ট পাঁচ মিনিট…….আমি অনলাইন আসছি!”
“আচ্ছা ওকে!”
ঘন্টা দুয়েকেরও বেশি কথা হলো ওদের সেদিন রাতে!
স্নিগ্ধ সেদিন ঈশানিকে শোনালো – স্নিগ্ধর ছেলেবেলার প্রথম দূর্গা পুজোর গল্প,,,,ভাই বোনদের সাথে মামার বাড়ি থাকতে যাওয়ার গল্প,,,,স্নিগ্ধর দুষ্টুমির গল্প,,,,,তারপর কথায় – কথায় শুরু হলো বন্ধুদের সাথে পুজো দেখতে যাওয়ার গল্প,,,,ইত্যাদি,,,,ইত্যাদি,,,কি ভাবে যে ঘন্টা দুয়েক কেটে গেলো ঈশানি টেরও পেলোনা!
গল্পের শেষে, ফোনটা লক করে চোখ দুটো বুঝলো ঈশানি,,, কালো পাঞ্জাবিতে স্নিগ্ধর মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে!
বারবার মনে পড়ছিলো স্নিগ্ধর সেই মায়াভরা গলায় ঈশানকি বলা কথাটা – “হ্যাঁ রে ঈশানি! তোর খুব কষ্ট হলো না! সারাদিন উপোষ করে আবার আমার সাথে দেখা করতে এলি বলে! সরি রে! আমি বুঝিনি জানিস তোর এতোটা কষ্ট হবে!”
স্নিগ্ধর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো ঠিক যেন কোনো বাচ্চা কে কথাগুলো বলছে স্নিগ্ধ! ….
চোখ দুটো অজান্তেই জলে ভোরে এলো ঈশানির!
এতো সুখ কপালে সইবে তো!…….
ভাবতে ভাবতে ঈশানির চোখ দুটো বুজে এলো ঘুমে………
(চলবে……)