হৃদয়ের একূল ওকূল,পর্ব-০১

0
2544

#হৃদয়ের একূল ওকূল,পর্ব-০১
#সুরভি হাসনিন

–রাতের বেলা অসভ্য লোকটা খালি গায়ে হাত দিতে চাইছে আম্মা। ধাক্কা মাইরা ফালায় দিসি বেডারে।

আম্মা মাটির চুলা লেপে পুছে সকালের নাস্তা বানানোর জন্য তৈরী হয়েছে। চালের গুড়োর রুটি বানাতে শুরু করেছে রহিমা বুজি। ও পাড়ার হরি কাকু বড় মাছ ধরে সকাল সকাল দিয়ে গেছে। তাজা কৈ, মাগুর আর শোল মাছ শব্দ করে হাড়ির ভেতর ঘাই দিয়ে বেড়াচ্ছে। কেরোসিন স্টোভে তেলে ভাজা পিঠা বানানো শুরু করেছে মর্জিনা ফুফু। আম্মা পরোটার খামির করে রেখেছে রাতে। আমার পালা মোরগ ‘রাজবাহাদুর’ আর ‘শাহেনশাহ’ জবাই হয়ে ছিলে কেটে চুলোয় ওঠার জন্য রেডি। এমন সময় আতিক্কা আমার এই কথায় আম্মা মনের ভুলে চুলো লেপার কাদামাটি সহ হাতটা দিয়ে কপাল মুছে ফেললো। আম্মাকে লাগছে বাংলা সিনেমার কমেডিয়ানের মতো। দিলদার ছিলো কমেডি হিরো। ওর একটা সুপার হিট সিনেমা আছে ‘আবদুল্লাহ’। নূতনের সাথে ‘আবদুল্লাহ’ সিনেমার জমকালো গান, ‘আবদুল্লাহ, আমি আবদুল্লাহ’র সাথে এই সেদিন স্কুল ফেয়ারওয়েল এ আমরা হাত পা বাঁকিয়ে ভেঙ্গুরা ডান্স দিয়েছি। ভেঙ্গুরা ডান্স হলো হাত ঠ্যাং ভাঙ্গা নাচ। যেই নাচে না থাকে মুদ্রা না থাকে তাল। আমার সাথে গতকাল হুট করে যেই লোকটার বিয়ে হয়ে গেলো তার নামও আবদুল্লাহ।

আম্মার কপাল ধীরে ধীরে কুঁচকে যেতে শুরু করেছে। বাকি সবাই হাসাহাসি করে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। শুধু মর্জিনা ফুফু,’ ডাঙ্গর মাইয়ার নাঙ্গ ধরনের বয়স হয়া বিয়া হইছে, ঢং কমে নাই’ বলে আবার পিঠা ভাজা শুরু করলো।

–কিয়ারসস! জামাইরে বিছানার থন ফালায় দিসস তুই।কিয়ের লাইগা ফালাইসস। তরে কনি মারে নাই পোলায়?
–কিয়ের কনি মারব, হের দিকে চায় কেডা। মিষ্টিডি দিছিলা না, জাম মিষ্টিডা টক হয়া গেসিলো। আমার স্বাদ লাগে নাই খায়া।
–জামাইর লাইগা মিষ্টি দিসি, তুই ঝোলা ভরসস? ওরে আল্লাহ, এই নাগিন মাইয়া বিয়া দিয়াও শান্তি পাইলাম না। দুনিয়া শুদ্দা খায়া ফালাইতি হারামজাদী।

আম্মার শাপশাপান্ত রেখে কয়লা নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে উঠানে আসলাম। আব্বা খেজুর গাস কাটিয়ে রস নামিয়েছেন। পাশের বাড়ির ভদ্র কাকী জালি ভর্তি গরম গরম চিতই পিঠা নিয়ে ঢুকলো, কাঁসার থালা দিয়ে ঢাকা বাঁশের জালির একপাশে নরম ঝোলা গুড় আর দুধ মিঠা নারকেল কোড়া। কুলকুচি করে দৌড় লাগিয়েছি কাকীর পিছু পিছু। ঘাড় ঘুরিয়ে আব্বাকে দেখে নিলাম। আব্বা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখছে। মনে হয়, বিবাহিত কন্যার সাত সকালে দৌড়টা আব্বা নিতে পারে নাই।
–কাকী গরম পিঠার লগে বেশী কইরা গুড় নাইরকেল দেও দেহি। খুদা লাগছে।
–ও দিদি, তোমার মাইয়া এত সকালে বাইরে কি করে। ঘরে যাও মা, বাবা জীবন একা।
— বাবা জীবন কেডা। আবার কোন নতুন বেডা আইছে আম্মা।

আম্মা আমার দিকে পিছা ফিক্কা মেরেছে। সরে গিয়ে হাসতে হাসতে পিছনে ফিরে দেখি দিলদার থুক্কু আবদুল্লাহ সাহেব দরজা দিয়ে মাত্র বের হয়ে ছিলো। উড়ন্ত পিছাটা ওনার গায়ে গিয়ে লাগতেই লোকটা আবার ভেতরে ঢুকে গেলো। আম্মা ঘটনার ঘনঘটায় প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নাই। তারপর যখন বোধগম্য হলো, ‘আয় হায় মায়মুনার বাপ’ বলে চিল্লাফাল্লা শুরু করে দিলো। ততক্ষণে পিঠা নিয়ে আমি পগার পার। আজকে সই শাহিনাকে দেখতে আসবে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে উঠানে নেমে দৌড় দেব, আব্বা ডাকলেন,

— মায়মুনা ঘরে যাও আম্মা। জামাই বাবাজীরে বুঝায়া কও তোমার আম্মা বিলাইরে পিছা মারডে গিয়া জামাইয়ের গায়ে লাগছে। তোমার আম্মায় কানতাছে।
–আমি যাইতাম না আব্বা। শাহিনার বাড়িত যাই। ওরে আইজ দেখতে আইবো। আমরা সাজপাট করায় দিমু।
আব্বা চোখ গরম করে এমন ভাবে তাকিয়েছে, যেনো আমি ফাটা ডিম, তেলে দিয়ে পোচ করে কৎ করে গিলে ফেলবেন।
— গতকাইল তোমার বিয়া হইছে। তুমি আইজ কোন জাগাত যাইবা না। ঘরে যাও, আবদুল্লাহরে পাঠায় দেও। হে আমার লাগে বাহির ঘরে নাস্তা করব। মুরুব্বীরা আইতাছে। তোমার শশুড়বাড়ির লোকজন দুপুর কালে আইবো। খাসী জবাই দিসি। তোমার জন্য মুগের ডাইল, গরুর তেল, লাউ রান্না হইব। বাপের বাড়ির থিকা যাইবা ভালা মন্দ যা মন চায় খায়া যাও।
–আব্বা আমি যাইতাম না। থাকি, হে যাক গিয়া। পরে আপনে গিয়া আমারে দিয়া আইলেন।
–মায়মুনা, তোমার বয়স হইছে। মা মরা মাইয়া দেইখা তোমারে কুনুদিন ধমক দেই নাই। তোমার নয়া আম্মা তোমারে মাডিত থোয় নাই, মাথাত রাহে নাই, বুকের মদ্যে রাইখা পালছে। হে কুনু আপন মা’র থন কম না। যাও ঘরে গিয়া জিনিষ পাটি গুছাও। বাদ আসর পোলাপক্ষ রওয়ানা দিব।

গতকাল রাতে তুমুল বৃষ্টিতে নতুন বউকে নিয়ে যেতে পারেনি ওরা। তাই আজ আবার আসবে। দুপুরে ভুরিভোজ শেষে বর-কনে রওয়ানা দিবে। এমনি কথা শুনেছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আম্মা আব্বা আমাকে যেতে দেবে না। এস এস সি তে এক সাবজেক্ট ফেল করে আব্বা যে সত্যি সত্যি বিয়ে দিয়ে দেবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তাও আবার পাশের ইউনিয়নের পল্লী বিদ্যুত অফিসে চাকরী করা আবদুল্লাহ সাথে। আমি হলাম মাইমুনা, গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। কয়েক ক্লাস ফেল করে অনেক দেরীতে স্কুল পাস দিলেও বয়স আমার আঠারো পেরিয়ে উনিশ বছর। আমার প্রেমে চেয়ারম্যান চাচার বাইক চালানো ছেলে নজমুল পাগল। নজমুল ও আমার মতো ফেল্টু। গত কালকে বিয়ে পরানোর আগ পর্যন্ত বাইক নিয়ে সে পুকুর ঘাটে অপেক্ষায় ছিলো। সেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো ভুইত্তামারা আবদুল্লাহ মিয়ার সাথে। ঘরের ভেতর এসে দেখি বেটা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আহা অভিমান -তোর গুষ্টি কিলাই।

–মুনা, তোমার দরকারী সব গুছায় নাও। আব্বা আগে আসবে। আম্মার শরীর ভালো না।
–আমি যামু না। আপনে যান গিয়া। কাইল সকালে আব্বায় আমারে দিয়াইবনে। আপনের আম্মার লাইগা আমার আম্মায় খাজুর গুড়ের সিরা করতাসে। খাইলে দেখবেন বিছনার মইধ্যে ফাল পাইড়া বইব।
ভুইত্তামারা হা হয়ে আমাকে দেখছে দেখে ভালো লাগলো না। ফুফু পিতলের থালায় সরায় ঢাকা পিঠা নিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে পাকের ঘরে যেতে বললো।

–জিনিষ পত্র বেশী নাই, আপনার দেওয়া সুটকেস নিয়া হাঁটা দিমুনে। হাঁটায় আমি ফার্স্ট ক্লাস চ্যাম্পিয়ান। স্কুলের রেসে সব সময় জিতি। আমার কত্ত গুলা মেডেল আছে। আগে আব্বায় বৈঠক ঘরে ঝুলায় থুইতো। বিয়ার কথা চালাচালির পর থিকা ভিতরের ঘরে হান্দায় রাখছে। বিয়ার কইন্যা দৌড় পাড়ে, এডা একটা শরমের কথা। কন!
–কয় ক্লাস থেকা দৌড়াও। তুমি আর কি কি পারো মুনা?
–এই কাল রাইতের থিকা ‘মুনা মুনা’ ডাকা শুরু করছেন। আমার নাম মায়মুনা। ডাকলে পুরা নাম ডাকেন। বাইট্টা কইরা ডাকা লাগব না।
দিলদার চেহারা বানিয়ে আবদুল্লা আবার চুপ। লোকটা দেখতে খারাপ না। পুরুষরা যেমন হয়, মাজা মাজা রং, লম্বা গড়ন। নাক চোখ মুখে মায়া আছে। চোখ গুলা সুন্দর, খুব সুন্দর। তাকায় থাকলে ভিতর পড়তে পারে এমন। কিন্তু, এসব ভেবে আমার লাভ নাই। এই স্বামীর ঘর আমি করব না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলা আবদুল্লা মিয়ার বাড়ি ঘরের লোকজন আসলো। শশুর আব্বা দুটা পিঠা খেয়ে বাকি খাবার সাথে বেঁধে দিতে বলেছে। আমি তখন শাহিনার বিছানায় ভরপেট শুটকী ভর্তায় ভাত খেয়ে শুয়েছি। পেটের মধ্যে গুড়গুড় ডাক দিচ্ছে। আম্মা তখন আমাকে টানতে টানতে কলামুড়ার পেছন দিয়ে বাড়িতে ঢোকালো। শাহিনাকে মাত্র মেহেদী লাগানো শুরু করেছিলো। দেখতে পারলাম না বলে মনে বিরাট দুঃখ লাগছে। থ্যাবড়া মেড়ে কাজল, লিপস্টিক দিয়ে, পাউড়ার ঝেড়ে বিয়ের শাড়ি গহনা পরিয়ে আম্মা যখন আমাকে সাজানো শেষ করেছে, আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসছে। মর্জিনা ফুফু ফিকফিক হেসে আম্মার সাথে রসিকতা জুড়েছে। আম্মাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে দিলাম,

–আইজ না যাই আম্মা। কাইল আব্বার লগে যামু।
–বিয়ার পরে স্বামীর বাড়ি যাইতে হয় তাড়াতাড়ি। শাশুড়ীর কথা শুনবা, সেবা যত্ন করবা। আগামীকাইল ফিরানীত নিয়ামু।

আম্মা আমাকে দুগাল ভাত খাইয়ে বাহির ঘরে নিয়ে এলো। বাড়ির মুরুব্বীদের সালাম শেষে আবদুল্লা মিয়ার মটর সাইকেলে চেপে যখন তাদের বাড়ি পৌছালাম, তখন সন্ধ্যা। গ্রামের মধ্যে দুই তলা পাকা দালান। উঠানের ভেতর দিয়ে ইটের দেয়াল। বাড়ির দরজায় ফুফু শাশুড়ী শরবত খাইয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাড়িটা ভেতর থেকে আরো সুন্দর। কাঁচের মতো পিছল আস্তরনে মেঝে ঢাকা। আমার পা পিছলে যাচ্ছিলো, আবদুল্লা মিয়া পাশ থেকে শক্ত করে ধরে ফেলায় ইজ্জত রক্ষা। নীচ থেকে উপরে যাবার সিড়িতে দাঁড়িয়ে এতগুলো ননদ- দেবর একে একে ছবি তুললো। ভারি শাড়ি কাপড়ে ধুপী বাড়ির বস্তা হয়ে যখন শাশুড়ীর কাছে পৌছালাম, পেশাবের গন্ধে গা উল্টে এলো। কি আশ্চর্য! বুড়ি কি বিছানায় মুতে!

–আম্মা, বউ নিয়া আসছি। উঠবেন না?
— বউরে আমার মাথার কাছে বসা। কই মুখ দেখি না কেন।
রাবারক্লথে ঢাকা বিছানার এক কোনায় কোনমতে বসলাম। বুড়ির গলার আওয়াজ শক্ত, কাজকর্ম বিছানায়, আইলসা একটা।
–আম্মা, গলাডা নামাও দেহি। আমি ভয় পেয়েছি, কামড় দেবে নাকি! ভয়ে ভয়ে গলা নামালাম। ওমা, দেখি ভারী একটা হার গলায় পরিয়ে, বুড়ি হাত দিয়ে আমার মাথা মুছে দিচ্ছে।
–এই হারডা তোমার দাদী শাউরীর। আইজ থেকা তোমার। আবদুল্লা আমার বড় ভালো পোলা। সংসারী হইও। স্বামীর পায়ের তলে বউয়ের বেস্ত, মনে রাখবা। স্বামীর মন অখুশী করবা না। স্বামী দুইটা বাড়ি দিলেও চুপ কইরা সইজ্য করবা।
–আম্মা, আপনি বিশ্রাম করেন। আমারে কাল সকালে যেতে হবে, বেশী দিন ছুটি পাই নাই। শুক্রবার ফিরব। আপনার কিছু লাগলে বলেন, নিয়া আসলাম।
–আমার কিছু লাগতো না বাজান। তুমি বউয়ের লাইগা তেল সাবান কিনা আনবা।
–আমি তেল মাখি না। সাবান আনলো ডাব সাবান আনবেন। দুই টাকার সাবান গায়ে মাখলে গা কুটকুট করে।

আবদুল্লা মিয়া হাতের আঙুল তুলে আমাকে চুপ করতে বললো। বুড়ি মনে হয় শেষের কথা গুলো শুনতে পায়নি। চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। কথা শেষ হলে চাচতো ভাবী রুমে পৌছে দিলো। রাতের খাবার রুমে দিয়ে যাবে। এই বাড়িতে আবদুল্লাহ মিয়ার আব্বা আম্মা কাজের লোক সহ মোট পাঁচটা প্রাণী থাকে। আবদুল্লাহ সপ্তাহ শেষে শুক্র-শনি বাড়ি আসে। রবিবারের বাসে অফিস চলে যায়। বর্গা দেয়া ধানী জমির ফসলী লাভ, ছেলের ইনকামে স্বচ্ছল পরিবার। আবদুল্লাহ মিয়ার আব্বা সরকারী কলেজের শিক্ষক ছিলো। পেনশনের টাকায় বাড়ি তোলার পর ওনার এক টাকাও অবশিষ্ট নাই। সবই এই বাড়িতে পা দিয়ে শুনে ফেলেছি।

আবদুল্লা মিয়া আসার আগে শাড়ি চুড়ি ছাড়ার নিয়তে সুটকেস খুলে দেখি আম্মা শয়তানি করেছে। শাড়ি ছাড়া একটা সালোয়ার কামিজ নেই। মাথার চুল ছিড়তে ছিড়তে শাড়ি নিলাম। শাড়ির কুঁচি ধরা পৃথিবীর দশম আশ্চর্য। দা দিয়ে আস্ত লাফানি কৈ মাছ কাটার থেকেও কঠিন কাজ শাড়ির কুঁচি করা। শাড়ি পেচায় আধামাধা করে বসে আছি। ভুইত্তামারা রুমে ঢুকে বেয়াক্কেলের মতো হাসা শুরু করলো।

–তোমারে দেখতে আবলুস কাঠের মত লাগছে। ঘাড়ে গর্দানে ত্যানা প্যাচানো।
— আমার গায়ের রং মাশাল্লা চান্দের মতো। আপনে কি কানা নাকি।
— শাড়ি পরতে না পারো পরার দরকার নাই। এমনে উল্টা পাল্টা পইরো না। বাড়িতে সবার বড় তেমন ভাঁজ দিয়ে চলবা।

বেকুব লোকরা বলে কি! সে না হয় বুড়া, আমার তো বয়স কম। অবশ্য গ্রামের দিকে ছেলে মেয়ে সবার কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কথা বলতে বলতে আবদুল্লা মিয়া গায়ের কাছে।চলে এসেছে। কালকে নিজের বাড়িতে ছিলাম, ধাক্কা মেরে ভয় ছিলো না। আজকে এই লোকের বাড়িতে আছি, আমার সাথে লোকবল নাই। আজকে ধাক্কা মারলে যদি মেরে কেটে পুতে রেখে দেয়!

–আমার শরীর ভালো না। ঘুম পাইতেছে। আপনি খাবার খায়া নেন। আমি ঘুমায় উঠে খাবো।
–তোমারে আমি জোর করবো না মুনা। কোন সম্পর্ক জোড়াজুড়ি দিয়ে শুরু করলে টিকে না। আমি বুঝতে পারছি, বিয়েটা তুমি নিজের ইচ্ছায় করো নাই। না করে উপায় ছিলো না হয়ত।

ভ্যাচরভ্যাচর না শুনে শুয়ে পরলাম। পেটে আগুন জ্বলছে। আম্মার কথা আব্বার কথা মনে হচ্ছে। নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে কত দূরে চলে এসেছি। আব্বা জেদ করে বিয়ে দিয়ে দিলো। আমাকে একটু ও বুঝলো না। সকাল বেলায় ঘুম ভেঙে শুনলাম আবদুল্লা মিয়া অফিস চলে গেছে। লোকটা যাওয়ায় শান্তি পেলাাম। আব্বাা আসলে এই যে আব্বার সাথে যাবো আর আসবো না। দরকার লাাগলে ঘাটে কয়েকটা আছাড় পিছাড় খেয়ে হাত পায়ে দাগ কাটায় নিলাম। এই রকম মদনা লোকের সাথে সংসার করবে মাইমুনা! এটা হতেই পারে না। নীমের ডাল দাঁতের নিচে দিয়ে রুম থেকে মাথা বাহির করলাম। গলাটা জিরাফের মত লম্বা হলে ভালো হতো। চাচাতো ভাবী রুমে ঢুকে গেলো।

— ও মা, সকাল সকাল আবদুল্লা চলে গেলো। তুমি ঘুমায় ছিলা। জামাইরে বিদায় দিলা না। কেমন বউ?
–চালাক বউ। বেশী পিরিতি দেখাইলে যদি বলে, সাথে চলো? আজকে আমার ফিরানী। উনি না থাকলে ফিরানীতে আমি একলাই চলে যাবো।
–জ্যাঠাইমা বলছে, তোমাদের ফিরানী হবে আবদুল্লা ফিরলে। আজকে চাচা আইসা তোমারে দেখে যাবে। চাচীরে ও আসতে কয়ে দাও।
–আপনার সাইজ তো মাশাআল্লাহ।
–এই মেয়ে, তোমার মুখে তালা চাবি নাই? কি কও এসব।
–না ভাবী, আপনের একটা সালোয়ার কামিজ আমারে দেন। আমি সব শাড়ি আনছি। দেখেন না, কেমন সাপ সাপ লাগতেছে।

ভাবী ‘লা হাওয়া ওয়ালা কু আতা’ পড়তে পড়তে ঘরে গিয়ে দুটো সালোয়ার কামিজ এনে দিলো। জামাটা ঢিলা, পায়জামা বাইট্টা। আমাকে আয়নায় দেখাচ্ছে সিনেমার বেয়াক্কল হিরোইনের মতো। কোনমতে নীচর তলায় নামলাম। খিদেয় পেটে হাতি নাচানাচি করছে। টেবিলে নাস্তা দেয়া। চেয়ার টেনে গপাগপ খাওয়া শুরু করেছি। এদের নাস্তায় বিলাতি রুটি হয়। মানে পাউরুটি, তার মধ্যে এক পিস বুটের হালুয়া, আলু – চিচিঙ্গা ঝিরি ভাজি আর ফার্স্ট ক্লাস এক কাপ দুধ চা। ডিমটা পোচ, কুসুমে রুটি চুবিয়ে খেতে খেতে বেহেস্তে চলে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে শুনি, কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে।

–এইটা তো আমার নাস্তা বউমা। হাঁইটা এসে আমি খাই। তোমার খিদা লাগছে, থাক তুমি খাও। ও জলিলের বউ আমারে দুইটা হাত রুটি আর এক কাপ চা দিয়া যা।বউ এর সাথে বইসা নাস্তা খাই।
–চাচা এইটা আপনার নাস্তা ছিলো?
–এই চাচা কে? আমি তোমার শ্বশুড়। আব্বা ডাকবা। তোমারে কিছু শিখায় নাই ব্যাপারী?
–আমার আব্বা একজন হাজী মুসাব্বর ব্যাপারী। আপনে আবদুল্লা মিয়ার আব্বা। আমি বাবা ডাকব নে।
শশুড় মশাই মজার মানুষ বুঝে গেছি। ওনার সাথে কথা বলে আনন্দ পাচ্ছি।
–দুঃখিত বাবা। আপনের নাস্তা আমি সাবাড় দিসি। টেবিলে এইটা বাদে কিছু ছিলো না।
–বারবার এইটা এইটা বলে না মা জননী। আল্লাহ পাক প্রতি দানায় তার বান্দার নাম লিখা রাখছেন। কে কোন দানা খাবে সব ঠিক করা।
–হাঁস-মুরগা যে দানা খায় তারাও কি আমাদের গোত্রিও? আপনি আমার আব্বার মতো আমারে মা জননী ডাকছেন। আমি আপনারে আব্বাই বলবো। আব্বা আমারে কোন বিষয় বুঝাইতে গেলে মা জননী বলেন। আচ্ছা, ঐ বুড়া বেটি আপনের বউ কেমনে। মানে, আপনের ছেলের আম্মা।
শশুড় আব্বা এবার কটমটিয়ে তাকালেন। এতটা বেয়াদবি মনে হয় নিতে পারেন নাই। যাক গিয়ে, উনার জন্য বাড়ির খাস চাকর নফর আলী নাস্তা নিয়ে আসছে। এই লোকটা ইট পাথর মুখ করে চলাফেরা করে। পরনে লুঙ্গী গেঞ্জী, মুখে পান, চোখে বাদামী ফ্রেমের চশমা। কাজের মানুষ চোখে চশমা দিয়ে হাঁটা চলা করে,অথচ আমার শশুড় আব্বার চোখে চশমা নাই। এটা একটা তাজ্জব বিষয়।
–নফরালী, কাইল থেকে বউ’র জন্য সেইম সেইম নাস্তা বানাবা। আমরা এক সাথে নাস্তা খাবো। তোমার আম্মাকে বিছানায় খাবার দিসো? ওনারে পরিষ্কার করা হইছে?

নফরালী ঘাড় নেড়ে হা উত্তর দিলো। এই লোকটা রহস্যময়।কথা বললে ইশারা ইঙ্গিতে উত্তর দেয়। বয়স বেশী না। কিন্তু ভাব গতিকে মহা বিজ্ঞ। শশুড় আব্বা আমাকে শাশুড়ীর রুমে সালাম দিয়ে আসতে বলেছেন। বুড়ির রুমে আবার পেশাব শুঁকতে যাবো ভেবে দম উল্টে আসছে। নফরালী আমার পিছু পিছু আসছিলো।

–এই যে নফ্রালী, আপনে যান গিয়া। আমি একা যেতে পারবো।
–আব্বার আদেশ, আপনারে রুম পর্যন্ত নিয়া যাইতে। সে যা বলছে তাই করতে হবে। কথার নড়নচড়ন হইত না।
— আরিব্বাপ রে। এই বাড়ির কালকের লোকজন গুলা কই?
–সকলে তাদের বাড়ি গেছে গা। ভাইয়ের নির্দেশ, আম্মার কাছে বেশী লুকজন ঘুরা ফিরা করবে না। আম্মা উত্তেজিত হয়ি যায়।
–কেন উত্তেজিত হয়ি যায়? আপনে আমারে বলে দেন।
নফ্রালীরে আমি যুক্তবর্ণে ডাকব ভাবছি। কোন কথার উত্তর দিলো না। বুড়ির রুমের কাছে আসলাম। কমবয়সী একটা মেয়েকে গতকাল বুড়ির ঘরে দেখেছি। ঐ মেয়েটাই, নফ্রলীকে দেখে থামলো।
–এখন চান, হে ঘুমায়। ওষুদ দিসি। রাইতে খুব চান্তিতে ঘুমাইছে। ভাবীরে দেখতে চাইছিলো।
–এই মেয়ে, তুমি কথা এমনে বলো কেনো? আমার সাথে বলো, শান্তি। বলো, দশবার বলবা। এরপর নাস্তা খাবা। এই নফ্রালী, এরে খানা খাদ্য দিবা না।

সুমনাকে নফ্রালী ধমকে নীচে পাঠালো। বুড়া কমসে কম চল্লিশ বছর, সুমনা আমার সমবয়সী। এই বাড়ির মালিক থেকে বুড়া সবাই আকাশ পাতাল বয়স ব্যবধানে বিবাহ করা রিসাওয়াত চালু করেছে। রুমে ফিরে বসতে, চাচাতো ভাবী এসে হাজির। ওনার নাম রুমা। কাল রাত থেকে মহিলা আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। যদিও এখন মহিলার উদ্দেশ্য ভালো না। বাসর রাতের নানা রকম রাসালো গল্প ফেঁদে আমার পেট থেকে কথা বাহির করার চেষ্টায় আছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here